নীলুফার মঞ্জুর, একজন অভিভাবকের দৃষ্টিতে এ দেশের এক মহীয়সী নারী

আবদুল লতিফ

নীলুফার মঞ্জুরের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল খুব সামান্যই। সানবীমস নামে গড়া তার বিদ্যামন্দিরটাতে আমার মেয়ে সাবাহ সারিকা ঐশী পড়তে যেত; সেই সুবাদে স্কুলের দু’একটা অনুষ্ঠানে তাকে দেখেছি। অভিজাত ব্যক্তিত্ব আর বিনয়ের অপূর্ব সমাহার তার কথাবার্তায়, চালচলনে। দূর থেকে সদাপ্রফুল্ল, সদাব্যস্ত এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করেছি সব সময়। তার নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান সানবীমস, বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় সূর্যকিরণ বা সূর্যরশ্মি। সেই প্রতিষ্ঠানের উজ্জ্বল সূর্য ছিলেন তিনি নিজে আর সেই সূর্যের অসংখ্য সূর্যরশ্মি ছিল তার ছাত্রছাত্রীরা। সেই রশ্মি সূর্যরশ্মির মতো ছড়িয়ে আছে দেশে এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। তার কথা বলতে গেলে তার বিদ্যামন্দিরের আদর্শের কথা বলতে হবে- প্রচারবিমুখ একটি স্কুল। ২৭ নম্বর রোডের একটি বাড়ির গেটের দেয়ালের পাশে খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যেত, ছোট একটা বোর্ডে এই বিদ্যামন্দিরটির নাম লেখা আছে ঝঁহনবধসং। সেটা স্কুলের সবচেয়ে জুনিয়র সেকশন।

সে সময় আমার কন্যা দেশের নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে, মোটামুটি মেধাবী ছাত্রী। ও যখন তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছে তখন শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই উপদেশ দিলেন, ‘ওকে সানবীমস-এ ভর্তি করে দাও’। স্কুলটা খুব ভালো, এ দেশের সবচেয়ে ভালো ইংরেজী মাধ্যম স্কুল। ভর্তি ফরম আসলো। মামনি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলো। পরীক্ষার ফল বেরোলো যখন তখন দেখলাম মেয়ে আমার অঙ্কে দশ নম্বর কম পেয়েছে। একটু নিরাশ হলাম। কারণ আজকের দিনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দশ নম্বর কেন, দুই-এক নম্বরও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর এই প্রতিযোগিতায় অনেকেই পূর্ণ নম্বর পেয়ে পাস করেছে। আসন সংখ্যা যৎসামান্য কয়েকটি। কিন্তু যখন মামণি ভর্তির জন্যে যোগ্য বিবেচিত হল, আমি অবাক হয়ে মিসেস মঞ্জুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর এই দুর্বল রেজাল্ট সত্ত্বেও আপনারা কি করে ওকে সিলেক্ট করলেন। তিনি মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমরা শুধু নম্বরটাই দেখিনি, নম্বর কম পাওয়ার কারণটাও বিবেচনা করেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম? উত্তর শুনে অবাক হলাম, উনি বললেন, আপনার মেয়ে যে কয়েকটা অঙ্কের উত্তর দিয়েছে সবটিই একেবারে সঠিক। কিন্তু একটা অঙ্ক একেবারে কোন চেষ্টাই করেনি। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, ওর আগের স্কুলে এ ধরনের অঙ্ক করানো হয়নি। তাছাড়া অন্য সব বিষয়ে ও তো ভালো করেছে। ভেবে অবাক হলাম তারা এত কিছু ভাবেন? সেই প্রথম স্কুলটার ওপর আমার শ্রদ্ধাবোধ জন্মালো।

মামণি ধাপে ধাপে স্কুলের সিঁড়িগুলো পার হচ্ছে। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর স্কুলের ছোটপরিসর পার করে ৬ নম্বর রোডের স্কুলে যেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ও একদিন বিমর্ষ মুখে বললো, আমার স্কুল থেকে তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছে। কেন ডেকেছে জানতে চাইলে ও মাথা নিচু করল কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছে না। অবশেষে এক সময় জানতে পারলাম যে স্কুলের অঙ্কের শ্রেণী পরীক্ষায় ও রেজাল্ট খারাপ করেছে। চিন্তিত হলাম। কারণ ভালো স্কুলে শুধু ভর্তি করালেই তো হবে না, সেখানে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। আসামিকে সঙ্গে করে ওর মা-বাবা অর্থাৎ আমরা স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা করলাম। আমাদের দেখে তিনি আমাদের সপরিবারে আগমনের কারণ জেনে নিলেন। তারপর মামণিকে তার অফিস কক্ষের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে অঙ্কের শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন। শিক্ষক জানালেন, সাবাহ আজকাল অঙ্কে অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। পরীক্ষাগুলোতে আশানুরূপ ভালো করতে পারছে না। মিসেস মঞ্জুর আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, সে দোষটা তো সাবাহর না। আমরা যখন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করি তখন তার সম্ভাব্যতা যাচাই করেই তাকে যোগ্য বলেই ভর্তি করে নিই। অতএব এখানে এসে যদি তার মেধার অবক্ষয় হয় তবে সে দায় তো আমাদের বহন করতে হবে। তার কথা শুনে আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছি। এই স্কুলে এভাবে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা হয়? এ দেশের অন্য কোন স্কুলে এই কারণে সতর্কতা সম্বলিত চিঠি ধরিয়ে দেয়া হতো, আর তাতে উন্নতি না হলে, তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়া হতো। মিসেস মঞ্জুর অঙ্ক শিক্ষককে নির্দেশ দিলেন, ছুটির পর সাবাহকে বাড়তি সময় আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে তার আশানুরূপ উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিন মনে মনে আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। এখানে উল্লেখ না করে পারছি না যে আমাদের একমাত্র কন্যার ও লেভেল বা এ লেভেল পরীক্ষার আগে কোন বাড়তি কোচিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়নি, স্কুলের পাঠদানই যথেষ্ঠ ছিল। এখানেই সানবীমস প্রশাসনের কৃতিত্ব।

প্রথমেই আমি মিসেস নীলুফার মঞ্জুরের প্রতিষ্ঠানটিকে সাধারণ স্কুল বলিনি, বলেছি বিদ্যামন্দির। কারণ সানবীমস কোন সাধারণ স্কুল নয়। গভীর আদর্শে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠান উপাসনালয়ের গাম্ভীর্যে বিকশিত। আমরা বাঙালি, এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় আদর্শকে হৃদয়ে লালন করেন। এই প্রতিষ্ঠানে এই সব কিছুর ওপর লক্ষ্য রেখে গঠিত হয়েছিল একটি সাংস্কৃতিক পরিম-ল। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিকী অনুষ্ঠানে একদিকে দেখেছি ধর্মীয় ভাবধারার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে বাঙালি ঐতিহ্যের লালন। একদিকে মিলাদ অনুষ্ঠান অন্যদিকে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যকে এই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা কী অপূর্ব মাধুর্যে ফুটিয়ে তুলতো তা দেখে বিস্ময় বোধ করেছি। বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিতে হলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এ যেমন সত্যি, তেমনি বাঙালি ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে হবে এও তেমনি সত্যি। এ দুয়ের অপূর্ব সমন্বয় দেখেছি মিসেস মঞ্জুরের প্রশাসনে, তার নিজ হাতে গড়া বিদ্যামন্দিরে।

এ দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে দেখলে মনে হয় যেন বানিজ্যিক উন্নতি তাদের একমাত্র লক্ষ্য। অনেক ছাত্রের ভিড়ে জমজমাট। ফলে শিক্ষার চেয়ে বানিজ্যিক সাফল্যই সেখানে প্রাধান্য পায়। সানবীমসের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল সীমিত। উদ্দেশ্য একটাই। প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে যাতে একক যত্ন নেয়া সম্ভব হয়। প্রতি শ্রেণীতে বিশজন। ফলে সকল শিক্ষার্থী একক যত্নে শিক্ষা লাভ করতো তাদের প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে। প্রতি বছর যখন আমার কন্যার গ্রেডকার্ড আমার হাতে আসতো, দেখতাম সেখানে মিসেস মঞ্জুরের নিজের হাতে লেখা মন্তব্য জ্বলজ্বল করছে। সেখানে থাকতো উৎসাহ প্রদান আর উপদেশ। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর প্রতি তার ছিল এমনি ব্যক্তিগত লক্ষ্য।

একটা দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পিকনিকে গেছে, স্কুলের পক্ষ থেকে অভিভাবক হিসেবে আছেন স্কুলের শিক্ষক মিসেস আহসান (প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নায়ক সিডনীর স্ত্রী)। সন্ধ্যাবেলায় ফিরে আসার পর প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে তাদের অভিভাবকের হাতে মায়ের স্নেহে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মিসেস মঞ্জুর।

শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষক চয়নের বিষয়েও মিসেস মঞ্জুরের নিজস্ব প্রচেষ্টা ছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে তার ছাত্রছাত্রীরা যেন শিক্ষালাভ করতে পারে। মিসেস সিতারা জাবীন, এ দেশের ইংরেজি স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের একজন নামকরা শিক্ষক। মিসেস মঞ্জুর তাকে অনুরোধ করে নিয়ে আসলেন। প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার, তাকেও তিনি ডেকে আনেন তার এই প্রতিষ্ঠানে। শুধু স্কুলের পড়াশুনার মান উন্নত করার জন্যে তার শিক্ষক চয়নের এমনি প্রচেষ্টা ছিল অব্যাহত। বাংলার শিক্ষক লীনা কবির, অঙ্ক শিক্ষক আর্কিটেক্ট গুলশান আরা সানবীমসের শিক্ষক তালিকায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে মামণি কিছুদিনের জন্যে দেশে এসেছে। তৈরি হচ্ছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে আবার পাড়ি জমাবে যুক্তরাষ্ট্রে। মিসেস মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা হতে তিনি বললেন, যে ক’দিন দেশে আছ, সে ক’দিন তোমার নিজের স্কুলে শ্রম দাওনা কেন। হাতে ধরিয়ে দিলেন শিক্ষকের নিয়োগপত্র।

মরণব্যাধি করোনা মহামারীর রূপ নিয়ে নির্মমভাবে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আমরা অসহায় হয়ে প্রকৃতির এই নির্মম আঘাত মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যখন দেখি এ তালিকায় নীলুফার মঞ্জুরের মতো মহীয়সী নারীও আছেন, তখন গভীর বেদনায় নিমজ্জিত হই। এ ক্ষতি যে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি! এমন মাতৃরূপিণী, স্নেহময়ী, শিক্ষাবিদ এ দেশের মাটিতে ক’জনই বা আছে? গভীর শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, বলার কিছু নেই। শুধু এই কামনা করি পরলোকে তার আত্মা শান্তি লাভ করুক। তিনি অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন দেশ-বিদেশে বিচ্ছুরিত তারই সৃষ্ট সূর্য রশ্মিদের মাঝে আর এ দেশের মানুষের হৃদয়জুড়ে।

সোমবার, ০১ জুন ২০২০ , ১৮ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৮ শাওয়াল ১৪৪১

নীলুফার মঞ্জুর, একজন অভিভাবকের দৃষ্টিতে এ দেশের এক মহীয়সী নারী

আবদুল লতিফ

নীলুফার মঞ্জুরের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল খুব সামান্যই। সানবীমস নামে গড়া তার বিদ্যামন্দিরটাতে আমার মেয়ে সাবাহ সারিকা ঐশী পড়তে যেত; সেই সুবাদে স্কুলের দু’একটা অনুষ্ঠানে তাকে দেখেছি। অভিজাত ব্যক্তিত্ব আর বিনয়ের অপূর্ব সমাহার তার কথাবার্তায়, চালচলনে। দূর থেকে সদাপ্রফুল্ল, সদাব্যস্ত এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করেছি সব সময়। তার নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান সানবীমস, বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় সূর্যকিরণ বা সূর্যরশ্মি। সেই প্রতিষ্ঠানের উজ্জ্বল সূর্য ছিলেন তিনি নিজে আর সেই সূর্যের অসংখ্য সূর্যরশ্মি ছিল তার ছাত্রছাত্রীরা। সেই রশ্মি সূর্যরশ্মির মতো ছড়িয়ে আছে দেশে এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। তার কথা বলতে গেলে তার বিদ্যামন্দিরের আদর্শের কথা বলতে হবে- প্রচারবিমুখ একটি স্কুল। ২৭ নম্বর রোডের একটি বাড়ির গেটের দেয়ালের পাশে খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যেত, ছোট একটা বোর্ডে এই বিদ্যামন্দিরটির নাম লেখা আছে ঝঁহনবধসং। সেটা স্কুলের সবচেয়ে জুনিয়র সেকশন।

সে সময় আমার কন্যা দেশের নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে, মোটামুটি মেধাবী ছাত্রী। ও যখন তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছে তখন শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই উপদেশ দিলেন, ‘ওকে সানবীমস-এ ভর্তি করে দাও’। স্কুলটা খুব ভালো, এ দেশের সবচেয়ে ভালো ইংরেজী মাধ্যম স্কুল। ভর্তি ফরম আসলো। মামনি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলো। পরীক্ষার ফল বেরোলো যখন তখন দেখলাম মেয়ে আমার অঙ্কে দশ নম্বর কম পেয়েছে। একটু নিরাশ হলাম। কারণ আজকের দিনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দশ নম্বর কেন, দুই-এক নম্বরও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর এই প্রতিযোগিতায় অনেকেই পূর্ণ নম্বর পেয়ে পাস করেছে। আসন সংখ্যা যৎসামান্য কয়েকটি। কিন্তু যখন মামণি ভর্তির জন্যে যোগ্য বিবেচিত হল, আমি অবাক হয়ে মিসেস মঞ্জুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর এই দুর্বল রেজাল্ট সত্ত্বেও আপনারা কি করে ওকে সিলেক্ট করলেন। তিনি মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমরা শুধু নম্বরটাই দেখিনি, নম্বর কম পাওয়ার কারণটাও বিবেচনা করেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম? উত্তর শুনে অবাক হলাম, উনি বললেন, আপনার মেয়ে যে কয়েকটা অঙ্কের উত্তর দিয়েছে সবটিই একেবারে সঠিক। কিন্তু একটা অঙ্ক একেবারে কোন চেষ্টাই করেনি। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, ওর আগের স্কুলে এ ধরনের অঙ্ক করানো হয়নি। তাছাড়া অন্য সব বিষয়ে ও তো ভালো করেছে। ভেবে অবাক হলাম তারা এত কিছু ভাবেন? সেই প্রথম স্কুলটার ওপর আমার শ্রদ্ধাবোধ জন্মালো।

মামণি ধাপে ধাপে স্কুলের সিঁড়িগুলো পার হচ্ছে। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর স্কুলের ছোটপরিসর পার করে ৬ নম্বর রোডের স্কুলে যেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ও একদিন বিমর্ষ মুখে বললো, আমার স্কুল থেকে তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছে। কেন ডেকেছে জানতে চাইলে ও মাথা নিচু করল কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছে না। অবশেষে এক সময় জানতে পারলাম যে স্কুলের অঙ্কের শ্রেণী পরীক্ষায় ও রেজাল্ট খারাপ করেছে। চিন্তিত হলাম। কারণ ভালো স্কুলে শুধু ভর্তি করালেই তো হবে না, সেখানে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। আসামিকে সঙ্গে করে ওর মা-বাবা অর্থাৎ আমরা স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা করলাম। আমাদের দেখে তিনি আমাদের সপরিবারে আগমনের কারণ জেনে নিলেন। তারপর মামণিকে তার অফিস কক্ষের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে অঙ্কের শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন। শিক্ষক জানালেন, সাবাহ আজকাল অঙ্কে অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। পরীক্ষাগুলোতে আশানুরূপ ভালো করতে পারছে না। মিসেস মঞ্জুর আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, সে দোষটা তো সাবাহর না। আমরা যখন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করি তখন তার সম্ভাব্যতা যাচাই করেই তাকে যোগ্য বলেই ভর্তি করে নিই। অতএব এখানে এসে যদি তার মেধার অবক্ষয় হয় তবে সে দায় তো আমাদের বহন করতে হবে। তার কথা শুনে আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছি। এই স্কুলে এভাবে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা হয়? এ দেশের অন্য কোন স্কুলে এই কারণে সতর্কতা সম্বলিত চিঠি ধরিয়ে দেয়া হতো, আর তাতে উন্নতি না হলে, তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়া হতো। মিসেস মঞ্জুর অঙ্ক শিক্ষককে নির্দেশ দিলেন, ছুটির পর সাবাহকে বাড়তি সময় আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে তার আশানুরূপ উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিন মনে মনে আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। এখানে উল্লেখ না করে পারছি না যে আমাদের একমাত্র কন্যার ও লেভেল বা এ লেভেল পরীক্ষার আগে কোন বাড়তি কোচিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়নি, স্কুলের পাঠদানই যথেষ্ঠ ছিল। এখানেই সানবীমস প্রশাসনের কৃতিত্ব।

প্রথমেই আমি মিসেস নীলুফার মঞ্জুরের প্রতিষ্ঠানটিকে সাধারণ স্কুল বলিনি, বলেছি বিদ্যামন্দির। কারণ সানবীমস কোন সাধারণ স্কুল নয়। গভীর আদর্শে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠান উপাসনালয়ের গাম্ভীর্যে বিকশিত। আমরা বাঙালি, এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় আদর্শকে হৃদয়ে লালন করেন। এই প্রতিষ্ঠানে এই সব কিছুর ওপর লক্ষ্য রেখে গঠিত হয়েছিল একটি সাংস্কৃতিক পরিম-ল। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিকী অনুষ্ঠানে একদিকে দেখেছি ধর্মীয় ভাবধারার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে বাঙালি ঐতিহ্যের লালন। একদিকে মিলাদ অনুষ্ঠান অন্যদিকে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যকে এই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা কী অপূর্ব মাধুর্যে ফুটিয়ে তুলতো তা দেখে বিস্ময় বোধ করেছি। বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিতে হলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এ যেমন সত্যি, তেমনি বাঙালি ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে হবে এও তেমনি সত্যি। এ দুয়ের অপূর্ব সমন্বয় দেখেছি মিসেস মঞ্জুরের প্রশাসনে, তার নিজ হাতে গড়া বিদ্যামন্দিরে।

এ দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে দেখলে মনে হয় যেন বানিজ্যিক উন্নতি তাদের একমাত্র লক্ষ্য। অনেক ছাত্রের ভিড়ে জমজমাট। ফলে শিক্ষার চেয়ে বানিজ্যিক সাফল্যই সেখানে প্রাধান্য পায়। সানবীমসের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল সীমিত। উদ্দেশ্য একটাই। প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে যাতে একক যত্ন নেয়া সম্ভব হয়। প্রতি শ্রেণীতে বিশজন। ফলে সকল শিক্ষার্থী একক যত্নে শিক্ষা লাভ করতো তাদের প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে। প্রতি বছর যখন আমার কন্যার গ্রেডকার্ড আমার হাতে আসতো, দেখতাম সেখানে মিসেস মঞ্জুরের নিজের হাতে লেখা মন্তব্য জ্বলজ্বল করছে। সেখানে থাকতো উৎসাহ প্রদান আর উপদেশ। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর প্রতি তার ছিল এমনি ব্যক্তিগত লক্ষ্য।

একটা দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পিকনিকে গেছে, স্কুলের পক্ষ থেকে অভিভাবক হিসেবে আছেন স্কুলের শিক্ষক মিসেস আহসান (প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নায়ক সিডনীর স্ত্রী)। সন্ধ্যাবেলায় ফিরে আসার পর প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে তাদের অভিভাবকের হাতে মায়ের স্নেহে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মিসেস মঞ্জুর।

শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষক চয়নের বিষয়েও মিসেস মঞ্জুরের নিজস্ব প্রচেষ্টা ছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে তার ছাত্রছাত্রীরা যেন শিক্ষালাভ করতে পারে। মিসেস সিতারা জাবীন, এ দেশের ইংরেজি স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের একজন নামকরা শিক্ষক। মিসেস মঞ্জুর তাকে অনুরোধ করে নিয়ে আসলেন। প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার, তাকেও তিনি ডেকে আনেন তার এই প্রতিষ্ঠানে। শুধু স্কুলের পড়াশুনার মান উন্নত করার জন্যে তার শিক্ষক চয়নের এমনি প্রচেষ্টা ছিল অব্যাহত। বাংলার শিক্ষক লীনা কবির, অঙ্ক শিক্ষক আর্কিটেক্ট গুলশান আরা সানবীমসের শিক্ষক তালিকায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে মামণি কিছুদিনের জন্যে দেশে এসেছে। তৈরি হচ্ছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে আবার পাড়ি জমাবে যুক্তরাষ্ট্রে। মিসেস মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা হতে তিনি বললেন, যে ক’দিন দেশে আছ, সে ক’দিন তোমার নিজের স্কুলে শ্রম দাওনা কেন। হাতে ধরিয়ে দিলেন শিক্ষকের নিয়োগপত্র।

মরণব্যাধি করোনা মহামারীর রূপ নিয়ে নির্মমভাবে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আমরা অসহায় হয়ে প্রকৃতির এই নির্মম আঘাত মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যখন দেখি এ তালিকায় নীলুফার মঞ্জুরের মতো মহীয়সী নারীও আছেন, তখন গভীর বেদনায় নিমজ্জিত হই। এ ক্ষতি যে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি! এমন মাতৃরূপিণী, স্নেহময়ী, শিক্ষাবিদ এ দেশের মাটিতে ক’জনই বা আছে? গভীর শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, বলার কিছু নেই। শুধু এই কামনা করি পরলোকে তার আত্মা শান্তি লাভ করুক। তিনি অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন দেশ-বিদেশে বিচ্ছুরিত তারই সৃষ্ট সূর্য রশ্মিদের মাঝে আর এ দেশের মানুষের হৃদয়জুড়ে।