গ্রামীণ উন্নয়নে অগ্রাধিকার প্রয়োজন

ড. জাহাঙ্গীর আলম

মানুষের আদি নিবাস গ্রাম। শহর গড়ে উঠেছে পরে। শুরুতে কৃষির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে শিল্প। বিকশিত হয়েছে সেবা খাত। ক্রমেই এগিয়ে গেছে নগরায়ন। মানুষের অভিগমন হয়েছে গ্রাম থেকে শহরে। কৃষকের সন্তানেরা নিয়োজিত হয়েছে শিল্পে সেবা কাজে। তারা শিক্ষিত হয়ে চাকরি নিয়েছে সরকারি দপ্তরে। এভাবে পৃথিবীর সব দেশেই পরিলক্ষিত হয়েছে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে অভিযাত্রা। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। আমাদের স্বাধীনতার সময়ও দেশের শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ লোকের আবাসস্থল ছিল গ্রাম। বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশ। শহরগুলোতে এখন বাস করে বাকি ২৫ শতাংশ লোক। দিনের পর দিন গ্রাম থেকে মানুষের শহরমুখী অভিগমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ-আয়েশ, ভোগ-বিলাস শহরে বেশি। সেখানে মানুষের আয় বেশি। ঘর-দোয়ার, রাস্তাঘাট শহরে ভালো। খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মান শহরে ভালো। সেখানে কাজের সুযোগ বেশি। সরকারি অফিস আদালত সবই শহরে। শিল্প, কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে শহরেই বেশি। গ্রামের অনেক মানুষ তাই শহরমুখী। কেউ আবার বিদেশমুখীও। তবু তারা আবার ফিরে আসে গ্রামে। ফিরে আসে নাড়ির টানে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও আপনজন গ্রামেই বেশি। ঈদে, পুজোয় কিংবা নববর্ষে তাই তাদের গ্রামে ফেরা। এক সঙ্গে যাতে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারে সবাই। তাছাড়াও মানুষ তার গ্রামে ফিরে আসে ভিন্ন কারণে। বাধ্য হয়েই তারা গ্রামমুখী হয়। যেমন হয়েছিল একাত্তরে। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়।

২৫ মার্চ কালরাত্রির পর অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়েছিল জীবন বাঁচানোর জন্য। চলে এসেছিল পাকিস্তান সেনাদের চোখের আড়ালে, নিভৃত গ্রামে। একদিন, দুইদিন ধরে কতকটা যানবাহনে আর কিছুটা পায়ে হেঁটে পথ চলার পর ক্লান্ত দেহে এসে পৌঁছেছিল গ্রামে। তারপরও তারা খান সেনাদের ভয়ে ঘুরে বেরিয়েছিল এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, ছায়া দিয়েছিল, খাদ্য দিয়েছিল আদিকাল থেকে গড়ে উঠা গ্রাম। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী করে নিয়েছিল ওই গ্রামের মানুষ। এবারও মানুষ আবার গ্রামমুখী হয়েছে এই করোনাকালে। লকডাউন উপেক্ষা করে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে লাখ লাখ মানুষ। আশ্রয় নিয়েছে পৈতৃক ভিটায়। যেখানে বাড়ি ভাড়া দেয়ার টেনশন নেই। বিজলি বাতি, পাখা না থাকলেও কোন সমস্যা হয় না। গ্রামের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে অনেক স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলা হয়। জোছনার আলোয় রাতে পথ চলা যায়। খোলা বাতাস উপভোগ করা যায় ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দিনে মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলা যায় অনেকক্ষণ। ইচ্ছে হলে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়া যায়। কারও করোনার সর্দি-কাশি আছে কিনা কেউ তার খবর রাখে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যও কোন কড়াকড়ি থাকে না। সেখানে কেবলই সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষ। কোন একাকীত্ব নেই। সবার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন। একের জন্য দরদ আছে অপরের বুকে জমা। অথচ যুগ যুগ ধরে এ গ্রামগুলো অবহেলিত। শিক্ষায়, চিকিৎসায় ও আয়-রোজগারে অনেক পশ্চাদপদ গ্রামের মানুষ। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভঙ্গুর, সেকেলে। এই বৈষম্যের কারণে নিজেদের নিতান্তই অসহায় ভাবে গ্রামের মানুষ। এ পেক্ষাপটে এখন গ্রাম উন্নয়নের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। বিদেশ ফেরত শ্রমিক আর শহর ফেরত মানুষের বাসোপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার আমাদের গ্রামগুলোকে। বাংলাদেশের শহরগুলো এখন পরিবেশের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয় জায়গা। সেখানে আরও বেশি মানুষের অভিগমন ঠেকানোর জন্য উপযুক্ত কর্মসৃজনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার গ্রামেই। এর জন্য গ্রামগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতে হবে। নীতিগত সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে গ্রামীণ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। বাজেটে সরকারি বরাদ্দের হিস্যা বাড়াতে হবে গ্রামের জন্য। গ্রামীণ উন্নয়নকে চিহ্নিত করতে হবে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ হিস্যা নিশ্চিত করেছিলেন। এরপর থেকে তা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। গত বাজেটে (২০১৯-২০) উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে এ খাতে বরাদ্দ করা হয় মোট বাজেটের ১২ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬.৫৮ শতাংশ, যার মধ্যে সমবায় ও পল্লী উন্নয়নের জনা রাখা হয় মোট বাজেটের মাত্র ০.৪৭ শতাংশ অর্থ। কোন যুগোপযোগী গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এ বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। গ্রাম ও শহরের বৈষম্য হ্রাস এবং গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়নের জানা বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ অর্থ পল্লী উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা উচিত।

আমাদের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহেনতী মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সব ধরনের শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’। অতঃপর সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য গ্রহণ করা দরকার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি। এর জন্য সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

গ্রাম উন্নয়ন বলতে গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি ও কুটির শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ সব কিছুরই উন্নয়ন বোঝায়। এর আধুনিকায়ন মানে সব ক্ষেত্রে নয়া প্রযুক্তির প্রসার ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়টি ও জড়িত। এ ক্ষেত্রে গ্রাম বাংলার প্রকৃত রূপ অটুট রাখতে হবে। গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা, গাছপালা, বনবীথি, ক্ষেতখামার আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ যথাযথভাবে অক্ষুণ্ন রেখেই প্রণয়ন করতে হবে সব উন্নয়ন পরিকল্পনা। তাতে নাগরিক সুবিধা সংবলিত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় এক উন্নত বাসস্থানে পরিণত হবে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত গ্রামীণ খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে। মানুষের আয় বৃদ্ধি পাবে। বৈষম্য হ্রাস পাবে গ্রামীণ ও শহর জীবনের গ্রামের বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে নারী-পুরুষ সবাই।

গ্রামের উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম কৃষি খাতের উন্নয়ন দরকার। আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি ব্যবসাকে লাভজনক করা দরকার। তবে সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে। কৃষি খাতের ওপর মানুষের নির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামীণ শিল্প, ছোট ব্যবসা ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৭-৮ লাখ। এগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব করা দরকার। গ্রামের সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স আসছে তার সিংহভাগই অর্জন করছে গ্রামের মানুষ। কিন্তু এর উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ কম। গ্রামীণ কৃষি উৎপাদনে, ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতে এ অর্থ বিনিয়োগ করা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আবহমানকাল ধরে হস্তচালিত তাঁত, তেলের ঘানি, বাঁশ-বেত ও মাটির কাজ গ্রামের মানুষের সম্পূরক আয়ের ব্যবস্থা করছে। এগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। আরও পুঁজিনির্ভর ও শ্রম সৃজনকারী ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে গ্রামে। তাছাড়া, গ্রামে গ্রাস সংযোগ, পরিবহন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, বাজার ও রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকা-কে বেগবান করতে পারে। সর্বোপরি গ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে গ্রামের মানুষ। স্থায়ী বসবাসে আগ্রহী হবে তারা। গ্রামের মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ গ্রামীণ উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত। বর্তমানে গ্রামে যে বিনিয়োগ হয় তার বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে আসে। প্রতিষ্ঠানিক উৎসের অবদান এক্ষেত্রে খুবই কম। অধিক সুদের মহাজনী ব্যবসা গ্রামে এখনও বড় ভূমিকা পালন করছে আর্থিক খাতে। এ অবস্থার উন্নতি কল্পে গ্রামপর্যায়ে ব্যাংক শাখার দ্রুত সম্প্রসারণ দরকার। বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে পুরোপুরি নিয়োজিত রাখা দরকার কৃষি ও গ্রামীণ খাতে অর্থায়নের জন্য। তাছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও কমিউনিটি ব্যাংকিং উৎসাহিত করা দরকার। তদুপরি সমবায় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে গ্রামীণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। গ্রামের মানুষ মহাজনের কাছে যায় ঋণের সহজলভ্যতার জন্য। এটি প্রতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কৃষিতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অকৃষিখাত সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের কোন বিকল্প নেই।

গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থাকে মানসম্মত পর্যায়ে উন্নীত করা দরকার। গ্রামের বিদ্যালয়গুলোকে কাঠামোগতভাবে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে যোগ্য শিক্ষক। স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা। গ্রামের মক্তবগুলোকে শিক্ষার মূল ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। স্কুল, মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক ও মানবিক মূলবোধ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাক্রম চালু করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও দিতে হবে। তাছাড়া সংস্কৃতির বিকাশ, খেলাধুলা ও স্কাউটিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালু করতে হবে প্রতিটি স্কুলে। তাতে পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দেহ ও মনের সুষম বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে।

শিক্ষা ছাড়া মানবিক উন্নয়নের আর একটি প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে আমাদের গ্রামগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমান সরকারের আমলে গড়ে উঠা কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়া গ্রামগুলোতে আর কোন বিকল্প নেই। এগুলোর আধুনিকায়ন গ্রামীণ চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তাছাড়া দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে এগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুদিন এগুলোতে এমবিবিএস ডাক্তারের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকন্তু গ্রামীণ রোগীদের জন্য প্রয়োজনে শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ও চিকিৎসাসেবা নেয়ার অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তবে এখনও গ্রামের নারীদের অনেকেই পারিবারিকভাবে অবহেলিত। সামাজিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। খাদ্যগ্রহণ, আর্থিক উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন। এর প্রতিকার দরকার। নারীদের জন্য গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। তাদের পারিবারিক ও গৃহাস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যায়ন দরকার। নারী কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক অর্থায়ন, প্রণোদনা ও সমর্থন ইত্যাদির ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবই দরকার। কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করলেও গ্রামীণ মজুরি কাঠামো তাদের প্রতিকূলে। মাঠের একই কাজে পুরুষ যে মজুরি পায়, নারী শ্রমিক তার দুই তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি পায় না। এ বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন বিঘিœত হচ্ছে। খাল, ডোবা, নালা ভরাট হচ্ছে। চিরায়ত পানি নিষ্কাশনের পথ ভরাট করে তাতে বাড়ি বানানো হচ্ছে। বৃক্ষ জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে। নদী ও বায়ু দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর অবসান দরকার। গ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুন বনায়ন সৃষ্টি, বৃক্ষ রোপণ ও ফলের বাগান তৈরির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাহাড়, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা, পার্ক, যাত্রাগান, পালা গান ইত্যাদির আয়োজন থাকতে হবে নিয়মিত। সংরক্ষণ করতে হবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। অতীতে গ্রামের সব মানুষের মধ্যে এক ধরনের সুদৃঢ় আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করার মানসিকতা ছিল। কালক্রমে তাতে চির ধরছে। সেই পুরোনো বন্ধন ও মূল্যবোধ আবার ফিরিয়ে আসতে হবে।

গ্রামে ভূমিহীনতা বাড়ছে। জনসংখ্যার চাপে জমিগুলো হচ্ছে খণ্ডবিখণ্ড। নতুন বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের ফলে অনেক জমি চলে যাচ্ছে চাষের বাইরে। তাতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.৭৪ শতাংশ কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চিরায়ত কৃষি জমি সংরক্ষণ করা দরকার ফসল উৎপাদনের জন্য। অপরদিকে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আবাসস্থল গড়ে তোলা দরকার প্রতিটি গ্রামে। এমতাবস্তায় পরিকল্পিত আবাসন কর্মসূচি হাতে নেয়া দরকার গ্রামের ক্রমবর্ধমান বাসিন্দাদের জন্য। এ ক্ষেত্রে গ্রামে গ্রামে নির্মাণ করা যেতে পারে বহুতল পাকা ভবন। যেখানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ শহুরে জীবনেরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকবে। এর জন্য প্রতিটি গ্রামে জনমত সাপেক্ষে আলাদা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। আরও সফল করে তুলতে হবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

বর্তমান আওয়ামী লীগহ সরকার গ্রাম উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে বলা হয়েছে, গ্রাম হবে শহর। আমার গ্রাম আমার শহর : প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গ্রাম উন্নয়নের পথ-নকশাও উপস্থাপন করা হয়। তা এখন বাস্তবায়ন করা দরকার। সে প্রেক্ষপট সামনে রেখে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে গ্রাম উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]

শনিবার, ০৬ জুন ২০২০ , ২৩ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ১৩ শাওয়াল ১৪৪১

গ্রামীণ উন্নয়নে অগ্রাধিকার প্রয়োজন

ড. জাহাঙ্গীর আলম

মানুষের আদি নিবাস গ্রাম। শহর গড়ে উঠেছে পরে। শুরুতে কৃষির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে শিল্প। বিকশিত হয়েছে সেবা খাত। ক্রমেই এগিয়ে গেছে নগরায়ন। মানুষের অভিগমন হয়েছে গ্রাম থেকে শহরে। কৃষকের সন্তানেরা নিয়োজিত হয়েছে শিল্পে সেবা কাজে। তারা শিক্ষিত হয়ে চাকরি নিয়েছে সরকারি দপ্তরে। এভাবে পৃথিবীর সব দেশেই পরিলক্ষিত হয়েছে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে অভিযাত্রা। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। আমাদের স্বাধীনতার সময়ও দেশের শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ লোকের আবাসস্থল ছিল গ্রাম। বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশ। শহরগুলোতে এখন বাস করে বাকি ২৫ শতাংশ লোক। দিনের পর দিন গ্রাম থেকে মানুষের শহরমুখী অভিগমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ-আয়েশ, ভোগ-বিলাস শহরে বেশি। সেখানে মানুষের আয় বেশি। ঘর-দোয়ার, রাস্তাঘাট শহরে ভালো। খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মান শহরে ভালো। সেখানে কাজের সুযোগ বেশি। সরকারি অফিস আদালত সবই শহরে। শিল্প, কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে শহরেই বেশি। গ্রামের অনেক মানুষ তাই শহরমুখী। কেউ আবার বিদেশমুখীও। তবু তারা আবার ফিরে আসে গ্রামে। ফিরে আসে নাড়ির টানে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও আপনজন গ্রামেই বেশি। ঈদে, পুজোয় কিংবা নববর্ষে তাই তাদের গ্রামে ফেরা। এক সঙ্গে যাতে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারে সবাই। তাছাড়াও মানুষ তার গ্রামে ফিরে আসে ভিন্ন কারণে। বাধ্য হয়েই তারা গ্রামমুখী হয়। যেমন হয়েছিল একাত্তরে। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়।

২৫ মার্চ কালরাত্রির পর অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়েছিল জীবন বাঁচানোর জন্য। চলে এসেছিল পাকিস্তান সেনাদের চোখের আড়ালে, নিভৃত গ্রামে। একদিন, দুইদিন ধরে কতকটা যানবাহনে আর কিছুটা পায়ে হেঁটে পথ চলার পর ক্লান্ত দেহে এসে পৌঁছেছিল গ্রামে। তারপরও তারা খান সেনাদের ভয়ে ঘুরে বেরিয়েছিল এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, ছায়া দিয়েছিল, খাদ্য দিয়েছিল আদিকাল থেকে গড়ে উঠা গ্রাম। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী করে নিয়েছিল ওই গ্রামের মানুষ। এবারও মানুষ আবার গ্রামমুখী হয়েছে এই করোনাকালে। লকডাউন উপেক্ষা করে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে লাখ লাখ মানুষ। আশ্রয় নিয়েছে পৈতৃক ভিটায়। যেখানে বাড়ি ভাড়া দেয়ার টেনশন নেই। বিজলি বাতি, পাখা না থাকলেও কোন সমস্যা হয় না। গ্রামের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে অনেক স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলা হয়। জোছনার আলোয় রাতে পথ চলা যায়। খোলা বাতাস উপভোগ করা যায় ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দিনে মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলা যায় অনেকক্ষণ। ইচ্ছে হলে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়া যায়। কারও করোনার সর্দি-কাশি আছে কিনা কেউ তার খবর রাখে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যও কোন কড়াকড়ি থাকে না। সেখানে কেবলই সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষ। কোন একাকীত্ব নেই। সবার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন। একের জন্য দরদ আছে অপরের বুকে জমা। অথচ যুগ যুগ ধরে এ গ্রামগুলো অবহেলিত। শিক্ষায়, চিকিৎসায় ও আয়-রোজগারে অনেক পশ্চাদপদ গ্রামের মানুষ। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভঙ্গুর, সেকেলে। এই বৈষম্যের কারণে নিজেদের নিতান্তই অসহায় ভাবে গ্রামের মানুষ। এ পেক্ষাপটে এখন গ্রাম উন্নয়নের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। বিদেশ ফেরত শ্রমিক আর শহর ফেরত মানুষের বাসোপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার আমাদের গ্রামগুলোকে। বাংলাদেশের শহরগুলো এখন পরিবেশের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয় জায়গা। সেখানে আরও বেশি মানুষের অভিগমন ঠেকানোর জন্য উপযুক্ত কর্মসৃজনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার গ্রামেই। এর জন্য গ্রামগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতে হবে। নীতিগত সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে গ্রামীণ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। বাজেটে সরকারি বরাদ্দের হিস্যা বাড়াতে হবে গ্রামের জন্য। গ্রামীণ উন্নয়নকে চিহ্নিত করতে হবে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ হিস্যা নিশ্চিত করেছিলেন। এরপর থেকে তা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। গত বাজেটে (২০১৯-২০) উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে এ খাতে বরাদ্দ করা হয় মোট বাজেটের ১২ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬.৫৮ শতাংশ, যার মধ্যে সমবায় ও পল্লী উন্নয়নের জনা রাখা হয় মোট বাজেটের মাত্র ০.৪৭ শতাংশ অর্থ। কোন যুগোপযোগী গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এ বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। গ্রাম ও শহরের বৈষম্য হ্রাস এবং গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়নের জানা বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ অর্থ পল্লী উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা উচিত।

আমাদের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহেনতী মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সব ধরনের শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’। অতঃপর সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য গ্রহণ করা দরকার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি। এর জন্য সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

গ্রাম উন্নয়ন বলতে গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি ও কুটির শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ সব কিছুরই উন্নয়ন বোঝায়। এর আধুনিকায়ন মানে সব ক্ষেত্রে নয়া প্রযুক্তির প্রসার ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়টি ও জড়িত। এ ক্ষেত্রে গ্রাম বাংলার প্রকৃত রূপ অটুট রাখতে হবে। গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা, গাছপালা, বনবীথি, ক্ষেতখামার আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ যথাযথভাবে অক্ষুণ্ন রেখেই প্রণয়ন করতে হবে সব উন্নয়ন পরিকল্পনা। তাতে নাগরিক সুবিধা সংবলিত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় এক উন্নত বাসস্থানে পরিণত হবে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত গ্রামীণ খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে। মানুষের আয় বৃদ্ধি পাবে। বৈষম্য হ্রাস পাবে গ্রামীণ ও শহর জীবনের গ্রামের বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে নারী-পুরুষ সবাই।

গ্রামের উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম কৃষি খাতের উন্নয়ন দরকার। আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি ব্যবসাকে লাভজনক করা দরকার। তবে সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে। কৃষি খাতের ওপর মানুষের নির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামীণ শিল্প, ছোট ব্যবসা ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৭-৮ লাখ। এগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব করা দরকার। গ্রামের সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স আসছে তার সিংহভাগই অর্জন করছে গ্রামের মানুষ। কিন্তু এর উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ কম। গ্রামীণ কৃষি উৎপাদনে, ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতে এ অর্থ বিনিয়োগ করা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আবহমানকাল ধরে হস্তচালিত তাঁত, তেলের ঘানি, বাঁশ-বেত ও মাটির কাজ গ্রামের মানুষের সম্পূরক আয়ের ব্যবস্থা করছে। এগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। আরও পুঁজিনির্ভর ও শ্রম সৃজনকারী ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে গ্রামে। তাছাড়া, গ্রামে গ্রাস সংযোগ, পরিবহন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, বাজার ও রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকা-কে বেগবান করতে পারে। সর্বোপরি গ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে গ্রামের মানুষ। স্থায়ী বসবাসে আগ্রহী হবে তারা। গ্রামের মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ গ্রামীণ উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত। বর্তমানে গ্রামে যে বিনিয়োগ হয় তার বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে আসে। প্রতিষ্ঠানিক উৎসের অবদান এক্ষেত্রে খুবই কম। অধিক সুদের মহাজনী ব্যবসা গ্রামে এখনও বড় ভূমিকা পালন করছে আর্থিক খাতে। এ অবস্থার উন্নতি কল্পে গ্রামপর্যায়ে ব্যাংক শাখার দ্রুত সম্প্রসারণ দরকার। বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে পুরোপুরি নিয়োজিত রাখা দরকার কৃষি ও গ্রামীণ খাতে অর্থায়নের জন্য। তাছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও কমিউনিটি ব্যাংকিং উৎসাহিত করা দরকার। তদুপরি সমবায় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে গ্রামীণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। গ্রামের মানুষ মহাজনের কাছে যায় ঋণের সহজলভ্যতার জন্য। এটি প্রতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কৃষিতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অকৃষিখাত সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের কোন বিকল্প নেই।

গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থাকে মানসম্মত পর্যায়ে উন্নীত করা দরকার। গ্রামের বিদ্যালয়গুলোকে কাঠামোগতভাবে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে যোগ্য শিক্ষক। স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা। গ্রামের মক্তবগুলোকে শিক্ষার মূল ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। স্কুল, মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক ও মানবিক মূলবোধ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাক্রম চালু করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও দিতে হবে। তাছাড়া সংস্কৃতির বিকাশ, খেলাধুলা ও স্কাউটিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালু করতে হবে প্রতিটি স্কুলে। তাতে পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দেহ ও মনের সুষম বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে।

শিক্ষা ছাড়া মানবিক উন্নয়নের আর একটি প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে আমাদের গ্রামগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমান সরকারের আমলে গড়ে উঠা কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়া গ্রামগুলোতে আর কোন বিকল্প নেই। এগুলোর আধুনিকায়ন গ্রামীণ চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তাছাড়া দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে এগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুদিন এগুলোতে এমবিবিএস ডাক্তারের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকন্তু গ্রামীণ রোগীদের জন্য প্রয়োজনে শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ও চিকিৎসাসেবা নেয়ার অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তবে এখনও গ্রামের নারীদের অনেকেই পারিবারিকভাবে অবহেলিত। সামাজিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। খাদ্যগ্রহণ, আর্থিক উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন। এর প্রতিকার দরকার। নারীদের জন্য গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। তাদের পারিবারিক ও গৃহাস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যায়ন দরকার। নারী কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক অর্থায়ন, প্রণোদনা ও সমর্থন ইত্যাদির ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবই দরকার। কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করলেও গ্রামীণ মজুরি কাঠামো তাদের প্রতিকূলে। মাঠের একই কাজে পুরুষ যে মজুরি পায়, নারী শ্রমিক তার দুই তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি পায় না। এ বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন বিঘিœত হচ্ছে। খাল, ডোবা, নালা ভরাট হচ্ছে। চিরায়ত পানি নিষ্কাশনের পথ ভরাট করে তাতে বাড়ি বানানো হচ্ছে। বৃক্ষ জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে। নদী ও বায়ু দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর অবসান দরকার। গ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুন বনায়ন সৃষ্টি, বৃক্ষ রোপণ ও ফলের বাগান তৈরির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাহাড়, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা, পার্ক, যাত্রাগান, পালা গান ইত্যাদির আয়োজন থাকতে হবে নিয়মিত। সংরক্ষণ করতে হবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। অতীতে গ্রামের সব মানুষের মধ্যে এক ধরনের সুদৃঢ় আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করার মানসিকতা ছিল। কালক্রমে তাতে চির ধরছে। সেই পুরোনো বন্ধন ও মূল্যবোধ আবার ফিরিয়ে আসতে হবে।

গ্রামে ভূমিহীনতা বাড়ছে। জনসংখ্যার চাপে জমিগুলো হচ্ছে খণ্ডবিখণ্ড। নতুন বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের ফলে অনেক জমি চলে যাচ্ছে চাষের বাইরে। তাতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.৭৪ শতাংশ কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চিরায়ত কৃষি জমি সংরক্ষণ করা দরকার ফসল উৎপাদনের জন্য। অপরদিকে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য আবাসস্থল গড়ে তোলা দরকার প্রতিটি গ্রামে। এমতাবস্তায় পরিকল্পিত আবাসন কর্মসূচি হাতে নেয়া দরকার গ্রামের ক্রমবর্ধমান বাসিন্দাদের জন্য। এ ক্ষেত্রে গ্রামে গ্রামে নির্মাণ করা যেতে পারে বহুতল পাকা ভবন। যেখানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ শহুরে জীবনেরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকবে। এর জন্য প্রতিটি গ্রামে জনমত সাপেক্ষে আলাদা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। আরও সফল করে তুলতে হবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

বর্তমান আওয়ামী লীগহ সরকার গ্রাম উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে বলা হয়েছে, গ্রাম হবে শহর। আমার গ্রাম আমার শহর : প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গ্রাম উন্নয়নের পথ-নকশাও উপস্থাপন করা হয়। তা এখন বাস্তবায়ন করা দরকার। সে প্রেক্ষপট সামনে রেখে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে গ্রাম উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]