মানুষ বাঁচাতে হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই বাজেটের লক্ষ্য

টাকা যেখান থেকে হোক যোগাড় করতে হবে

গত বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। তাই এই বাজেটকে অবাস্তব বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে অর্থমন্ত্রী বলেছে, ঘাটতি পূরণের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে সে কথা ভেবে বাজেট প্রস্তাব করিনি। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এটাই আসল কথা। টাকা যেখান থেকেই হোক যোগাড় করা হবে। গতকাল বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। করোনাভাইরাস সংকটে এবারের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয়েছে অনলাইনে।

মোট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেটের ৬৬ শতাংশ অর্থ রাজস্ব আয় থেকে যোগানোর পরিকল্পনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা আমরা করিনি। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের অর্থনীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। অর্থ যাই লাগবে সেটা জোগাড় করা হবে। আর মহামারীর ধাক্কায় বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে যেখানে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে। কবে এই মহামারী শেষ হবে সেই নিশ্চয়তা যখন কেউ দিতে পারছে না। তখনও নতুন অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায় এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী উপস্থাপন করেছেন, তাতে অর্থনীতিতে মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ওপর জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে, বরাদ্দে মনোযাগ পেয়েছে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা আর কৃষি খাত। মহামারীর মধ্যে গত তিন মাস ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির, শিল্প উৎপাদনও গতিহারা। আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্সসহ অর্থনীতির সব সূচকই বাজে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর। তারপরও অর্থমন্ত্রী বাজেটের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় নির্বাহের জন্য ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন, যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাজেটকে ‘মানুষকে রক্ষা করার’ বাজেট হিসেবে বর্ণনা করে মুস্তফা কামাল বলেন, সেই চিন্তা থেকেই আমরা প্রথমে টাকা খরচ করব। পরে আয় করব। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তারপর টাকা জোগাড় করব। আগের দিন সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এবার দেশের অর্থনীতিতে ‘সেরা প্রবৃদ্ধিটি’ উপহার দেয়ার প্রত্যয় তার ছিল। সরকারের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাব সারাবিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট করে দিয়েছে।

তারপরও ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করার কথা জানিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, ইকোনমিস্ট গত ২ মে ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে নবম স্থানে রেখেছে। তাদের হিসাবে আমরা অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছি। তবে তার ওই লক্ষ্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি অর্থনীতিবিদদের অনেকেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম ওই লক্ষ্যকে বলেছেন ‘অবাস্তব’। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর প্রশ্ন করেছেন- ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ‘কোন যাদুবলে’ আসবে?

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সবার আগে মনে রাখতে হবে, এই বাজেট ‘স্বাভাবিক বাজেট নয়’। গতানুগতিক ধারার বাজেট এটা নয়। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ক্রান্তিকালের বাজেট। এই ক্রান্তিকালে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তেমন পাইনি। স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ ছিল। ভিন্ন পন্থায় কাজ করতে হয়েছে আমাদের। এছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায় আমরা বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্য ধরেছি। অতীতের অর্জনে আমরা দেখেছি, গত কয়েক বছর ধরে আমরা ৮ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। সারাবিশ্বের মতো অনেক দেশই এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। আমরা, চায়না এবং ভারতই কেবল এমন প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। কোভিড-১৯ সংকট ‘দ্রুত মোকাবিলা করতে পারলে’ ওই ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবদ্ধি ঠিকই পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হিসেবে পাওয়ার আশা করছেন, তার মধ্যে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা তিনি চান এনবিআরের কাছ থেকে। অর্থাৎ, এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এবার বাড়ছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। অথচ আদায় পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ কোটি টাকা করতে হয়েছে সংশোধিত বাজেটে।

সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, এনবিআরের মাধ্যমে ওই টাকা আদায়ের পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘বাস্তবভিত্তিক নয়’। আর এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ওই লক্ষ্য অর্জন করা ‘সম্ভব নয়’।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ কথা ঠিক যে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। ১০/১১ শতাংশ। এটাকে আমরা নতুন বাজেটের মাধ্যমে ১৫ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য এনবিআরকে পুরোপুরি অটোমেশনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই অটোমেশনের কাজটি মহামারীর কারণে বিলম্বিত হলেও এখন যন্ত্রপাতি আনার ব্যবস্থা হয়েছে এবং অটোমেশন হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও পূরণ করা সম্ভব বলে অর্থমন্ত্রী মনে করছেন। আমরা বিশ্বাস করি, কোভিড-১৯ বেশি দিন প্রলম্বিত হবে না। আর সে বিবেচনা থেকেই ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছি। আমাদের অতীতের অর্জন অসাধারণ অর্জন। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে প্রতিবছরই আমরা জিডিপির যে লক্ষ্য ধরেছিলাম তার থেকে বেশি অর্জন করেছি। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। নতুন বাজেটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তারমধ্যে ১৭টি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা প্রত্যাশা করছি, কোভিড-১৯ থেকে আমরা দ্রুত মুক্ত হব। আমাদের অর্থনীতি আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আর সেটা যদি হয়, আমরা বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরেছি, সেটা অর্জিত হবে। ৮ দশমিক ২ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি ধরেছি সেটাও অর্জন করতে সক্ষম হব। মোট কথা আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।

কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম যার যার বাসা থেকে ভার্চুয়াল এই সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত ছিলেন।

আরও খবর
কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব প্রত্যাহার চায় টিআইবি
জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়ন করেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব উন্নয়ন অন্বেষণ
বাজেট গতানুগতিক, করোনা সংকটের প্রতিফলন নেই সিপিডি
সংক্রমণ ৮০ হাজার ছাড়ালো মৃত্যু একদিনে ৪৬
করোনার কবল থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট আ’লীগ
মোবাইলে বাড়তি খরচের সক্ষমতা মানুষের আছে এনবিআর চেয়ারম্যান
অন্তঃসারশূন্য, কথার ফুলঝুড়ি ছাড়া এই বাজেটে কিছুই নেই
ডাক্তাররা আলাদা হাসপাতাল চান
জোনভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর হচ্ছে সরকার
চিকিৎসা পাচ্ছে না, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে রোগীরা
পুলিশ আক্রান্ত ৭ হাজারের বেশি মৃত্যু ২৩
বরিশালে করোনার নমুনা সংগ্রহ বন্ধ

শনিবার, ১৩ জুন ২০২০ , ৩০ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ২০ শাওয়াল ১৪৪১

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী

মানুষ বাঁচাতে হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই বাজেটের লক্ষ্য

টাকা যেখান থেকে হোক যোগাড় করতে হবে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

গত বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। তাই এই বাজেটকে অবাস্তব বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে অর্থমন্ত্রী বলেছে, ঘাটতি পূরণের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে সে কথা ভেবে বাজেট প্রস্তাব করিনি। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এটাই আসল কথা। টাকা যেখান থেকেই হোক যোগাড় করা হবে। গতকাল বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। করোনাভাইরাস সংকটে এবারের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয়েছে অনলাইনে।

মোট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেটের ৬৬ শতাংশ অর্থ রাজস্ব আয় থেকে যোগানোর পরিকল্পনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা আমরা করিনি। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের অর্থনীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। অর্থ যাই লাগবে সেটা জোগাড় করা হবে। আর মহামারীর ধাক্কায় বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে যেখানে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে। কবে এই মহামারী শেষ হবে সেই নিশ্চয়তা যখন কেউ দিতে পারছে না। তখনও নতুন অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায় এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী উপস্থাপন করেছেন, তাতে অর্থনীতিতে মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ওপর জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে, বরাদ্দে মনোযাগ পেয়েছে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা আর কৃষি খাত। মহামারীর মধ্যে গত তিন মাস ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির, শিল্প উৎপাদনও গতিহারা। আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্সসহ অর্থনীতির সব সূচকই বাজে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর। তারপরও অর্থমন্ত্রী বাজেটের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় নির্বাহের জন্য ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন, যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাজেটকে ‘মানুষকে রক্ষা করার’ বাজেট হিসেবে বর্ণনা করে মুস্তফা কামাল বলেন, সেই চিন্তা থেকেই আমরা প্রথমে টাকা খরচ করব। পরে আয় করব। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তারপর টাকা জোগাড় করব। আগের দিন সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এবার দেশের অর্থনীতিতে ‘সেরা প্রবৃদ্ধিটি’ উপহার দেয়ার প্রত্যয় তার ছিল। সরকারের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাব সারাবিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট করে দিয়েছে।

তারপরও ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করার কথা জানিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, ইকোনমিস্ট গত ২ মে ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে নবম স্থানে রেখেছে। তাদের হিসাবে আমরা অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছি। তবে তার ওই লক্ষ্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি অর্থনীতিবিদদের অনেকেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম ওই লক্ষ্যকে বলেছেন ‘অবাস্তব’। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর প্রশ্ন করেছেন- ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ‘কোন যাদুবলে’ আসবে?

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সবার আগে মনে রাখতে হবে, এই বাজেট ‘স্বাভাবিক বাজেট নয়’। গতানুগতিক ধারার বাজেট এটা নয়। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ক্রান্তিকালের বাজেট। এই ক্রান্তিকালে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তেমন পাইনি। স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ ছিল। ভিন্ন পন্থায় কাজ করতে হয়েছে আমাদের। এছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায় আমরা বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্য ধরেছি। অতীতের অর্জনে আমরা দেখেছি, গত কয়েক বছর ধরে আমরা ৮ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। সারাবিশ্বের মতো অনেক দেশই এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। আমরা, চায়না এবং ভারতই কেবল এমন প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। কোভিড-১৯ সংকট ‘দ্রুত মোকাবিলা করতে পারলে’ ওই ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবদ্ধি ঠিকই পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হিসেবে পাওয়ার আশা করছেন, তার মধ্যে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা তিনি চান এনবিআরের কাছ থেকে। অর্থাৎ, এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এবার বাড়ছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। অথচ আদায় পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ কোটি টাকা করতে হয়েছে সংশোধিত বাজেটে।

সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, এনবিআরের মাধ্যমে ওই টাকা আদায়ের পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘বাস্তবভিত্তিক নয়’। আর এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ওই লক্ষ্য অর্জন করা ‘সম্ভব নয়’।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ কথা ঠিক যে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। ১০/১১ শতাংশ। এটাকে আমরা নতুন বাজেটের মাধ্যমে ১৫ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য এনবিআরকে পুরোপুরি অটোমেশনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই অটোমেশনের কাজটি মহামারীর কারণে বিলম্বিত হলেও এখন যন্ত্রপাতি আনার ব্যবস্থা হয়েছে এবং অটোমেশন হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও পূরণ করা সম্ভব বলে অর্থমন্ত্রী মনে করছেন। আমরা বিশ্বাস করি, কোভিড-১৯ বেশি দিন প্রলম্বিত হবে না। আর সে বিবেচনা থেকেই ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছি। আমাদের অতীতের অর্জন অসাধারণ অর্জন। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে প্রতিবছরই আমরা জিডিপির যে লক্ষ্য ধরেছিলাম তার থেকে বেশি অর্জন করেছি। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। নতুন বাজেটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তারমধ্যে ১৭টি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা প্রত্যাশা করছি, কোভিড-১৯ থেকে আমরা দ্রুত মুক্ত হব। আমাদের অর্থনীতি আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আর সেটা যদি হয়, আমরা বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরেছি, সেটা অর্জিত হবে। ৮ দশমিক ২ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি ধরেছি সেটাও অর্জন করতে সক্ষম হব। মোট কথা আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।

কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম যার যার বাসা থেকে ভার্চুয়াল এই সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত ছিলেন।