বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিমের জীবনাবসান

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের শোক

চলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসিম। গতকাল সকালে রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া....রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের সিইও আল ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি (নাসিম) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ১ জুন থেকে ঢাকার শ্যামলীর এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন নাসিম। করোনাভাইরাস মুক্ত হলেও এরমধ্যে ব্রেইন স্ট্রোক হলে তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ নাসিম গত ১ জুন হাসপাতালে ভর্তির আগে একবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করালে ফল ‘নেগেটিভ’ আসে। ওই সময় তার স্ত্রী এবং একজন গৃহকর্মীর করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেও জ্বর-কাশিসহ অন্যান্য অসুস্থতা বাড়তে থাকায় ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রাতে ওই পরীক্ষার ফল ‘পজিটিভ’ আসে। এরপর তিন দিন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ৫ জুন সকালে তার ‘স্ট্রোক’ হয় বলে নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয় জানান। এরপর সেখানেই নাসিমের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা নাসিমের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে গেলে ১৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বোর্ডের সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ক্রিটিক্যাল’ অবস্থায় যাওয়ার পর থেকেই ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছেন নাসিম। এরপর গত ৮ জুনের পর দুই দফা তার করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় ফল ‘নেগেটিভ’ এলেও লাইফ সাপোর্ট সরানো সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।

নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায়। বাবা এম মনসুর আলী ও মা মোসাম্মৎ আমেনা মনসুর। নাসিম জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় সংসদে ষষ্ঠবারের মতো সিরাজগঞ্জের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এবার মন্ত্রিত্ব না পেলেও দলের সভাপতিমণ্ডলীতে থাকার পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন নাসিম। খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সন্তান মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন পিতার মতোই সাহসী ও আপোসহীন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আপোসহীন, তেমনি মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপোসহীন। বার বার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। মাঠের রাজনীতিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন নাসিম। বাবার মতো তিনিও দেশের রাজনীতিতে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছাত্রজীবন থেকে গণমানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন মোহাম্মদ নাসিম। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হবার পরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন নাসিম। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পর যুবলীগের রাজনীতি করে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এই নেতা। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। ‘যুব সম্পাদক’ নির্বাচিত হওয়ার পর মোহাম্মদ নাসিম ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। এরপর ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে ২০০২ ও ২০০৮ সালে দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন নাসিম। ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।

রাজনৈতিক মাঠে সুবক্তা হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ নাসিম ভোটের রাজনীতিতেও সফল হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর) থেকে পাঁচবার বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তাকে স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেয়া মামলার কারণে মোহাম্মদ নাসিম অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ওই নির্বাচনে তার বড় সন্তান তানভীর শাকিল জয়কে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ নাসিমকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। বিজয়ী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মোহাম্মদ নাসিম সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়াও জাতীয় সংসদে হুইপ, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ নাসিম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার কারণে তার বাবা মনসুর আলীকে কারাগারে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তেমনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে রাজনীতি করার কারণে ১/১১ সরকারের সময়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। সে সময়ে বড় ধরনের স্ট্রোক করেন মোহাম্মদ নাসিম। নির্যাতনের শিকার হয়ে দলের অনেক নেতা সে সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার বিরুদ্ধে নানা কথা বললেও নাসিমের মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারেনি সে সময়ের সরকার।

শোক বার্তা

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ডা. এসএ মালেক ও আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

বনানীতে দাফন

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহ আজ সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের জনান, আজ সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কবরস্থান মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয় জানাজায় দলীয়-নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে উপস্থিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা সবাই যে যার অবস্থান থেকে তার জন্য দোয়া করবেন। তিনি যেহেতু দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেছে, তাই দেশের এই পরিস্থিতিতে তার মরদেহ কোথাও নেয়া হবে না। আজ সাড়ে ১০টায় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

রবিবার, ১৪ জুন ২০২০ , ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ২১ শাওয়াল ১৪৪

বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিমের জীবনাবসান

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের শোক

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

চলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসিম। গতকাল সকালে রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া....রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের সিইও আল ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি (নাসিম) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ১ জুন থেকে ঢাকার শ্যামলীর এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন নাসিম। করোনাভাইরাস মুক্ত হলেও এরমধ্যে ব্রেইন স্ট্রোক হলে তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ নাসিম গত ১ জুন হাসপাতালে ভর্তির আগে একবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করালে ফল ‘নেগেটিভ’ আসে। ওই সময় তার স্ত্রী এবং একজন গৃহকর্মীর করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেও জ্বর-কাশিসহ অন্যান্য অসুস্থতা বাড়তে থাকায় ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রাতে ওই পরীক্ষার ফল ‘পজিটিভ’ আসে। এরপর তিন দিন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ৫ জুন সকালে তার ‘স্ট্রোক’ হয় বলে নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয় জানান। এরপর সেখানেই নাসিমের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা নাসিমের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে গেলে ১৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বোর্ডের সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ক্রিটিক্যাল’ অবস্থায় যাওয়ার পর থেকেই ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছেন নাসিম। এরপর গত ৮ জুনের পর দুই দফা তার করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় ফল ‘নেগেটিভ’ এলেও লাইফ সাপোর্ট সরানো সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।

নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায়। বাবা এম মনসুর আলী ও মা মোসাম্মৎ আমেনা মনসুর। নাসিম জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় সংসদে ষষ্ঠবারের মতো সিরাজগঞ্জের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এবার মন্ত্রিত্ব না পেলেও দলের সভাপতিমণ্ডলীতে থাকার পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন নাসিম। খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সন্তান মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন পিতার মতোই সাহসী ও আপোসহীন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আপোসহীন, তেমনি মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপোসহীন। বার বার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। মাঠের রাজনীতিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন নাসিম। বাবার মতো তিনিও দেশের রাজনীতিতে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছাত্রজীবন থেকে গণমানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন মোহাম্মদ নাসিম। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হবার পরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন নাসিম। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পর যুবলীগের রাজনীতি করে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এই নেতা। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। ‘যুব সম্পাদক’ নির্বাচিত হওয়ার পর মোহাম্মদ নাসিম ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। এরপর ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে ২০০২ ও ২০০৮ সালে দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন নাসিম। ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।

রাজনৈতিক মাঠে সুবক্তা হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ নাসিম ভোটের রাজনীতিতেও সফল হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর) থেকে পাঁচবার বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তাকে স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেয়া মামলার কারণে মোহাম্মদ নাসিম অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ওই নির্বাচনে তার বড় সন্তান তানভীর শাকিল জয়কে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ নাসিমকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। বিজয়ী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মোহাম্মদ নাসিম সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়াও জাতীয় সংসদে হুইপ, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ নাসিম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার কারণে তার বাবা মনসুর আলীকে কারাগারে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তেমনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে রাজনীতি করার কারণে ১/১১ সরকারের সময়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। সে সময়ে বড় ধরনের স্ট্রোক করেন মোহাম্মদ নাসিম। নির্যাতনের শিকার হয়ে দলের অনেক নেতা সে সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার বিরুদ্ধে নানা কথা বললেও নাসিমের মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারেনি সে সময়ের সরকার।

শোক বার্তা

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ডা. এসএ মালেক ও আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

বনানীতে দাফন

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহ আজ সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের জনান, আজ সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কবরস্থান মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয় জানাজায় দলীয়-নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে উপস্থিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা সবাই যে যার অবস্থান থেকে তার জন্য দোয়া করবেন। তিনি যেহেতু দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেছে, তাই দেশের এই পরিস্থিতিতে তার মরদেহ কোথাও নেয়া হবে না। আজ সাড়ে ১০টায় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।