নিরসন হয়নি ঢাকার জলাবদ্ধতা

১১ বছরে ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি এরপরও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নেই নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আর কতদিন থাকবেন ঢাকা ওয়াসার এমডি

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে যেমন ওয়াসা ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহেও ব্যর্থ হয়েছে। ১১ বছর যাবত এই সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করছেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। সেবাধর্মী এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় কেউ এ পদে থাকেননি। ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর। এ পর্যন্ত জনপ্রশাসনের সব রেকড ভেঙে তাকে পাঁচবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগামী ১৪ অক্টোবর তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু এই ১১ বছরে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসেন ব্যর্থ হন তিনি। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের নামে তার সময় ১১ বছরে ১৩ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। তারপরও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিষয়ে নানা অভিযোগ নগরবাসীর। বর্তমানে আরও একবার পানির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন তিনি। নগরবাসীর প্রশ্ন ব্যর্থতার দায় নিয়ে আর কতদিন একই পদে থাকবেন ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান। তবে ওয়াসা এমডির দাবি গত ১১ বছরে ঢাকা ওয়াসার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকা ওয়াসা এখন রোলমডেল। জলাবদ্ধতার নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান সংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে নগরবাসী জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যেহেতু ১১ বছর যাবত ওয়াসার এমডি নগরবাসীর দুর্ভোগ লাগব করতে পারেননি। তাই নগরবাসীর মতে নেতৃত্বের পরিবর্তন দরকার। সংস্থার উচ্চপদে পরিবর্তন হলে কাজের গতি বাড়বে। এছাড়া ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডেস ঢাকা শহরের পরিকল্পনায় জলাশয়, খাল-বিল-নদী-নালার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওয়াসার উদাসীনতার কারণে আজ ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার সূত্র জানায়, ওয়াসার এমডি হিসেবে প্রকৌশলী তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পান ২০০৯ সালে। ওই বছর ৩১ মে ওয়াসা বোর্ড এমডি নিয়োগের জন্য জাতীয় পত্রিকায় যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাতে আবশ্যিকভাবে চাওয়া হয়েছিল প্রার্থীদের পানি ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন বিষয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আবেদনপত্রে দেয়া বায়োডাটায় দেখা যায় এ ধরনের কোন অভিজ্ঞতা নাই। তারপরও তৎকালীন ওয়াসার বোর্ড তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করেন। দ্বিতীয় দফায় : প্রথম দফা দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর তাকসিম এ খানকে এমডি হিসেবে আরেক দফায় এক বছরের দায়িত্ব দেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ওয়াসা বোর্ড এমডির মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধির জন্য একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু তৎকালীন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ তিন বছরের মধ্যে দুই বছরের প্রস্তাব নাকচ করে মাত্র এক বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। তৃতীয় দফায় : ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর ১ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ওয়াসার এমডির। এর আগেই এমডি নিয়োগের জন্য ওয়াসা বোর্ড ২০১৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয় বিদেশে অবস্থানরত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ দেশে ফিরলে তাহার সম্মতি নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিধিবিধান মোতাবেক এমডি নিয়োগ করা হবে। কিন্তু তৎকালীন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও প্রতিমন্ত্রী আরও ২ বছরের জন্য তাকসিম এ খানকেই নিয়োগ দেন। চতুর্থ দফায় বৃদ্ধি : ২০১৫ সালে তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বোর্ড আবারও তাকসিমের মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তৎকালীন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ এক বছর কেটে দিয়ে দুই বছরের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠালে তা অনুমোদিত হয়। পঞ্চম দফায় : চতুর্থ দফার মেয়াদ শেষ হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে। তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাকসীম এ খানের মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধি করেন। যা আগামী ১৪ অক্টোবর শেষ হবে। ষষ্ঠবারে মতো আবার তাকে এমডি নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, তাকসিম এ খান ওয়াসা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে বার বার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন। এ কর্মকর্তার পাঁচটি ধাপের নিয়োগেই লঙ্ঘিত হয়েছে ওয়াসার এমডি নিয়োগসংক্রান্ত সব ধরনের বিধিবিধান। এবারও তিনি ষষ্ঠবারের মতো নিয়োগ পেতে সব আয়োজন সম্পন্ন করছেন।

এদিকে প্রকৌশলী তাকসিম এ খান দীর্ঘ ১১ বছর এমডির হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ তিনি। কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজধানীর জলাবদ্ধতার নিরসনের কাজ শুধু ওয়াসার নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিটি করপোরেশনসহ সাত সংস্থা। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে নগরবাসীর নানা অভিযোগ থাকলেও গত ১১ বছরে ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই এমডির সময় ২০১৩ সালে ওয়াসা বোর্ডকে প্রতি বছর ৫ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। যদিও মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করেনি। তবে ৫ শতাংশ হারে গত ১২ বছরে পানির দাম কেবল ৬০ শতাংশ নয়, বলতে গেলে প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর ওয়াসা এক ধাপে পানির দাম দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরে চলতি বছর এপ্রিল থেকে আবাসিক গ্রাহকের পানির দাম ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা ও বাণিজ্যিক গ্রাহকের পানির দাম ৩৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংবাদকে বলেন, গত ১০ বছরে ঢাকা ওয়াসার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এটা আমার কথা নয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। দক্ষিণ এশিয়ায় পানি ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা এখন রোলমডেল। বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিতে এখন ঢাকায় আসেন। ১০ বছর আগে ঢাকার পানির ব্যবস্থাপনা কেমন ছিল। অনেক এলাকায় মানুষ পানি পেতো না। পানির জন্য হাহাকার ছিল। তখন ঢাকার ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ পানি পেতো না। মানুষ এখন বাসায় বসে ওয়াসার বিল দিতে পারেন। অনলাইনে অভিযোগ জানাতে পারেন। ১০ বছরে ঢাকা ওয়াসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি সেবা পাচ্ছে। এখন আমরা সিসটেম লস কমিয়ে এনেছি। যেখানে দক্ষিণ এশিয়া সিসটেম লস ৪০ শতাংশ। সেখান আমাদের সিসটেম লস ২০ শতাংশ। কোন কোন ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী এ জন্যই বলেছেন ঢাকা ওয়াসা এখন রোলমডেল।

ঢাকার জলাবদ্ধতার নিরসনের বিষয়ে তিনি বলেন, যে কোন শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সেই শহরের সিটি করপোরেশনের। এটা আমরা ২০১২ সাল থেকে বলে আসছি। এখন কিন্তু ঢাকার মেয়ররা এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছেন। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করছে ৭টি সংস্থা। আমরা আগে থেকে বলে আসছিলাম এর দায়িত্ব একটি সংস্থাকে দিতে হবে। সমস্যার মূলে চিহ্নিত করে একটি মাস্টার পরিকল্পনা করে কাজ করলে এটা সমাধান হবে। কিন্তু এক একটি সংস্থা বিভিন্ন কাজ করলে এটা সমাধান হবে না। তখন এক জায়গায় ভালো হবে অন্য জায়গায় সমস্যা দেখা দিবে।

পানি দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম অনেকবার বেড়েছে। ১০ বছর আগে যে দামে পানি শোধনের মালপত্র পাওয়া যেতো, এখন কি সেই দর আছে? ডলারের মূল্য, আমদানি শুল্ক, কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাট এসব কি এক আছে? মুদ্রাম্ফীতির নিরিখে পানির দাম বাড়েনি।

মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট ২০২০ , ৫ মহররম ১৪৪২, ২৫ আগস্ট ২০২০

নিরসন হয়নি ঢাকার জলাবদ্ধতা

১১ বছরে ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি এরপরও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নেই নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আর কতদিন থাকবেন ঢাকা ওয়াসার এমডি

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

নিরসন হচ্ছে না রাজধানীর সড়কের জলাবদ্ধতা -সংবাদ

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে যেমন ওয়াসা ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহেও ব্যর্থ হয়েছে। ১১ বছর যাবত এই সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করছেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। সেবাধর্মী এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় কেউ এ পদে থাকেননি। ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর। এ পর্যন্ত জনপ্রশাসনের সব রেকড ভেঙে তাকে পাঁচবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগামী ১৪ অক্টোবর তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু এই ১১ বছরে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসেন ব্যর্থ হন তিনি। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের নামে তার সময় ১১ বছরে ১৩ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। তারপরও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিষয়ে নানা অভিযোগ নগরবাসীর। বর্তমানে আরও একবার পানির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন তিনি। নগরবাসীর প্রশ্ন ব্যর্থতার দায় নিয়ে আর কতদিন একই পদে থাকবেন ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান। তবে ওয়াসা এমডির দাবি গত ১১ বছরে ঢাকা ওয়াসার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকা ওয়াসা এখন রোলমডেল। জলাবদ্ধতার নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান সংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে নগরবাসী জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যেহেতু ১১ বছর যাবত ওয়াসার এমডি নগরবাসীর দুর্ভোগ লাগব করতে পারেননি। তাই নগরবাসীর মতে নেতৃত্বের পরিবর্তন দরকার। সংস্থার উচ্চপদে পরিবর্তন হলে কাজের গতি বাড়বে। এছাড়া ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডেস ঢাকা শহরের পরিকল্পনায় জলাশয়, খাল-বিল-নদী-নালার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওয়াসার উদাসীনতার কারণে আজ ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার সূত্র জানায়, ওয়াসার এমডি হিসেবে প্রকৌশলী তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পান ২০০৯ সালে। ওই বছর ৩১ মে ওয়াসা বোর্ড এমডি নিয়োগের জন্য জাতীয় পত্রিকায় যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাতে আবশ্যিকভাবে চাওয়া হয়েছিল প্রার্থীদের পানি ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন বিষয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আবেদনপত্রে দেয়া বায়োডাটায় দেখা যায় এ ধরনের কোন অভিজ্ঞতা নাই। তারপরও তৎকালীন ওয়াসার বোর্ড তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করেন। দ্বিতীয় দফায় : প্রথম দফা দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর তাকসিম এ খানকে এমডি হিসেবে আরেক দফায় এক বছরের দায়িত্ব দেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ওয়াসা বোর্ড এমডির মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধির জন্য একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু তৎকালীন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ তিন বছরের মধ্যে দুই বছরের প্রস্তাব নাকচ করে মাত্র এক বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। তৃতীয় দফায় : ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর ১ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ওয়াসার এমডির। এর আগেই এমডি নিয়োগের জন্য ওয়াসা বোর্ড ২০১৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয় বিদেশে অবস্থানরত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ দেশে ফিরলে তাহার সম্মতি নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিধিবিধান মোতাবেক এমডি নিয়োগ করা হবে। কিন্তু তৎকালীন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও প্রতিমন্ত্রী আরও ২ বছরের জন্য তাকসিম এ খানকেই নিয়োগ দেন। চতুর্থ দফায় বৃদ্ধি : ২০১৫ সালে তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বোর্ড আবারও তাকসিমের মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তৎকালীন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ এক বছর কেটে দিয়ে দুই বছরের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠালে তা অনুমোদিত হয়। পঞ্চম দফায় : চতুর্থ দফার মেয়াদ শেষ হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে। তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাকসীম এ খানের মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধি করেন। যা আগামী ১৪ অক্টোবর শেষ হবে। ষষ্ঠবারে মতো আবার তাকে এমডি নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, তাকসিম এ খান ওয়াসা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে বার বার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন। এ কর্মকর্তার পাঁচটি ধাপের নিয়োগেই লঙ্ঘিত হয়েছে ওয়াসার এমডি নিয়োগসংক্রান্ত সব ধরনের বিধিবিধান। এবারও তিনি ষষ্ঠবারের মতো নিয়োগ পেতে সব আয়োজন সম্পন্ন করছেন।

এদিকে প্রকৌশলী তাকসিম এ খান দীর্ঘ ১১ বছর এমডির হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ তিনি। কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজধানীর জলাবদ্ধতার নিরসনের কাজ শুধু ওয়াসার নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিটি করপোরেশনসহ সাত সংস্থা। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে নগরবাসীর নানা অভিযোগ থাকলেও গত ১১ বছরে ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই এমডির সময় ২০১৩ সালে ওয়াসা বোর্ডকে প্রতি বছর ৫ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। যদিও মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করেনি। তবে ৫ শতাংশ হারে গত ১২ বছরে পানির দাম কেবল ৬০ শতাংশ নয়, বলতে গেলে প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর ওয়াসা এক ধাপে পানির দাম দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরে চলতি বছর এপ্রিল থেকে আবাসিক গ্রাহকের পানির দাম ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা ও বাণিজ্যিক গ্রাহকের পানির দাম ৩৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংবাদকে বলেন, গত ১০ বছরে ঢাকা ওয়াসার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এটা আমার কথা নয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। দক্ষিণ এশিয়ায় পানি ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা এখন রোলমডেল। বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিতে এখন ঢাকায় আসেন। ১০ বছর আগে ঢাকার পানির ব্যবস্থাপনা কেমন ছিল। অনেক এলাকায় মানুষ পানি পেতো না। পানির জন্য হাহাকার ছিল। তখন ঢাকার ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ পানি পেতো না। মানুষ এখন বাসায় বসে ওয়াসার বিল দিতে পারেন। অনলাইনে অভিযোগ জানাতে পারেন। ১০ বছরে ঢাকা ওয়াসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি সেবা পাচ্ছে। এখন আমরা সিসটেম লস কমিয়ে এনেছি। যেখানে দক্ষিণ এশিয়া সিসটেম লস ৪০ শতাংশ। সেখান আমাদের সিসটেম লস ২০ শতাংশ। কোন কোন ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী এ জন্যই বলেছেন ঢাকা ওয়াসা এখন রোলমডেল।

ঢাকার জলাবদ্ধতার নিরসনের বিষয়ে তিনি বলেন, যে কোন শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সেই শহরের সিটি করপোরেশনের। এটা আমরা ২০১২ সাল থেকে বলে আসছি। এখন কিন্তু ঢাকার মেয়ররা এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছেন। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করছে ৭টি সংস্থা। আমরা আগে থেকে বলে আসছিলাম এর দায়িত্ব একটি সংস্থাকে দিতে হবে। সমস্যার মূলে চিহ্নিত করে একটি মাস্টার পরিকল্পনা করে কাজ করলে এটা সমাধান হবে। কিন্তু এক একটি সংস্থা বিভিন্ন কাজ করলে এটা সমাধান হবে না। তখন এক জায়গায় ভালো হবে অন্য জায়গায় সমস্যা দেখা দিবে।

পানি দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম অনেকবার বেড়েছে। ১০ বছর আগে যে দামে পানি শোধনের মালপত্র পাওয়া যেতো, এখন কি সেই দর আছে? ডলারের মূল্য, আমদানি শুল্ক, কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাট এসব কি এক আছে? মুদ্রাম্ফীতির নিরিখে পানির দাম বাড়েনি।