সংকটের তিন বছর পার

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনও অনিশ্চিত

মায়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে বাংলাদেশের পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনও অনিশ্চিত। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের তিন বছরেও ফেরত পাঠানো যায়নি। কবে পাঠানো যাবে তাও ঠিক করে বলতে পারছে না সরকার। এদিকে মায়ানমারের এ দুটি বড় আঞ্চলিক প্রতিবেশী মায়ানমারকে চাপ দিচ্ছে না। তারা শুধু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমারকে উৎসাহিত করছে। এটা যথেষ্ট নয়। কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এটা না হলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে মনে করে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বাংলাদেশে শুরু রোহিঙ্গাদের বোঝাটা বহন করছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

এছাড়া বড় দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যে ভূমিকা পালন করার কথাছিলো তা দেখা যায়নি। এ দুটি রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যা যা করা দরকার যথাসাধ্য করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টির কাজ অব্যাহত রাখতে হবে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়টির ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্বিচারে হত্যা, বাড়িঘরে আগুন ও নারীদের ধর্ষণ করে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়। বর্বরোচিত নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গরা। ওই সময়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত ছিল। ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। রোহিঙ্গা সংকট তিন বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করলেও প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি নেই। করোনা মহামারীর কারণে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সব বন্ধ করে দিয়েছে মায়ানমার। তবে বাংলাদেশ হাল ছাড়ছে না। করোনা মহামারীর মধ্যেই ছয় লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মায়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ তালিকা থেকে মায়ানমারের যাচাই খুবই ধীরগতির। মায়ানমার দুই পর্যায়ে মাত্র ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে যাচাই করে প্রত্যাবাসনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তারমধ্যে প্রথম পর্যায়ের মাত্র আট হাজারের তালিকা বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের ২২ হাজারের তালিকা এখনও দেয়নি। মহামারীর পাশাপাশি আগামী নভেম্বরে মায়ানমারে জাতীয় নির্বাচনের কারণেও প্রত্যাবাসনে দেশটি ধীরগতি দেখাতে পারে। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তা স্থগিত হয়। বাংলাদেশের একার প্রচেষ্টায় তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে- এটা মনে করা ঠিক হবে না। চীন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করেন কূটনীতিকরা।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজও শুরু হতে যাচ্ছে। প্রায় ছয়শ’ রোহিঙ্গা যাদের বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের ভাসানচরে রাখা হয়েছে। অবশিষ্টদেরও পর্যায়ক্রমে সেখানে স্থানান্তর করা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত নিজ আবাসস্থলে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আশাবাদী। যুদ্ধ ছাড়া যা যা করণীয় তার সবই করেছি। যুদ্ধ আমরা করব না। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মায়ানমার আমাদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য তাদের সঙ্গে আমরা তিনটা দ্বিপক্ষীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমার রাজি আছে। মায়ানমার রাজি থাকলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কাজ কিছুই করেনি। এখন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। মায়ানমার এই বিলম্ব করছে। আমরা মায়ানমারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। ছয় লাখ রোহিঙ্গার নাম-ঠিকানাসহ তালিকা মায়ানমারের কাছে দিয়েছি।

ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ, চীন, মায়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাপনা করেছি। আবার বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাপনাও রয়েছে। যারা মায়ানমারের পক্ষের দেশ তারাও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলছে। এটা এখন সার্বজনীন দাবি। ভারত এখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে কাজ করবে বলে আমাদের বলেছে। জাতিসংঘকে যুক্ত করেছি। আইনি প্রক্রিয়াও কাজ হচ্ছে। গাম্বিয়া আইসিজেতে গেছে। আইসিসি কাজ করছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮ সালে এসেছিল। ১৯৯২ সালেও এসেছিল। দুই বারেই ফিরে গেছে। এবারও ফিরে যাবে বলে আশা করি। কারণ মায়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি আছে। তবে কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে তা বলতে পারব না।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। গত সোমবার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ তাগিদ দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, মায়ানমারের ভেতরে ও বাইরে বাস্তুচ্যূত ও রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি ইউএনএইচসিআর তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে।

সিএনএন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করে বর্মি সামরিক বাহিনী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এর মধ্যে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশে ফিরতে দেয়নি বর্মি কর্তৃপক্ষ। নিজ দেশ থেকে জঘন্য উপায়ে বিতাড়িত রাষ্ট্রহীন এ জাতিগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। শরণার্থী জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি।

ইউএনএইচসিআর বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য কেবল শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের প্রতি সমর্থন জানানোই যথেষ্ট নয়। তাদের বরং এই সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই এখন মায়ানমারের বাইরে বসবাস করছে। ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এরই মধ্যে আট লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে নিবন্ধনভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি গভীর মানবিক প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে। শরণার্থীদের সুরক্ষা এবং তাদের জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিবন্ধিত প্রতি ১০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে ৯ জনই বাংলাদেশে বাস করছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মায়ানমার কর্তৃক জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন ও সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গণহত্যা প্রতিরোধে মায়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ ঘোষণা করে। তবে কিছুই মানেনি মায়ানমার। দেশের ভেতরে সংঘটিত গুরুতর অপরাধ তদন্তের জন্য জাতিসংঘকেও অনুমতি দেয়নি তারা। নিজেরাও সামরিক নৃশংসতার বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য কোন তদন্ত চালায়নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, মায়ানমার সরকারের বোঝা উচিত রোহিঙ্গাদের জন্য তারা যে ধরনের ভয়াবহ ভোগান্তি তৈরি করেছে তার কথা বৈশ্বিক করোনা মহামারী পরিস্থিতির মধ্যেও মুছে ফেলা যাবে না। মায়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমাধানসূত্র গ্রহণ করা।

বুধবার, ২৬ আগস্ট ২০২০ , ৬ মহররম ১৪৪২, ২৬ আগস্ট ২০২০

সংকটের তিন বছর পার

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনও অনিশ্চিত

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

মায়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে বাংলাদেশের পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনও অনিশ্চিত। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের তিন বছরেও ফেরত পাঠানো যায়নি। কবে পাঠানো যাবে তাও ঠিক করে বলতে পারছে না সরকার। এদিকে মায়ানমারের এ দুটি বড় আঞ্চলিক প্রতিবেশী মায়ানমারকে চাপ দিচ্ছে না। তারা শুধু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমারকে উৎসাহিত করছে। এটা যথেষ্ট নয়। কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এটা না হলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে মনে করে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বাংলাদেশে শুরু রোহিঙ্গাদের বোঝাটা বহন করছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

এছাড়া বড় দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যে ভূমিকা পালন করার কথাছিলো তা দেখা যায়নি। এ দুটি রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যা যা করা দরকার যথাসাধ্য করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টির কাজ অব্যাহত রাখতে হবে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়টির ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্বিচারে হত্যা, বাড়িঘরে আগুন ও নারীদের ধর্ষণ করে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়। বর্বরোচিত নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গরা। ওই সময়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত ছিল। ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। রোহিঙ্গা সংকট তিন বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করলেও প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি নেই। করোনা মহামারীর কারণে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সব বন্ধ করে দিয়েছে মায়ানমার। তবে বাংলাদেশ হাল ছাড়ছে না। করোনা মহামারীর মধ্যেই ছয় লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মায়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ তালিকা থেকে মায়ানমারের যাচাই খুবই ধীরগতির। মায়ানমার দুই পর্যায়ে মাত্র ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে যাচাই করে প্রত্যাবাসনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তারমধ্যে প্রথম পর্যায়ের মাত্র আট হাজারের তালিকা বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের ২২ হাজারের তালিকা এখনও দেয়নি। মহামারীর পাশাপাশি আগামী নভেম্বরে মায়ানমারে জাতীয় নির্বাচনের কারণেও প্রত্যাবাসনে দেশটি ধীরগতি দেখাতে পারে। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তা স্থগিত হয়। বাংলাদেশের একার প্রচেষ্টায় তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে- এটা মনে করা ঠিক হবে না। চীন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করেন কূটনীতিকরা।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজও শুরু হতে যাচ্ছে। প্রায় ছয়শ’ রোহিঙ্গা যাদের বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের ভাসানচরে রাখা হয়েছে। অবশিষ্টদেরও পর্যায়ক্রমে সেখানে স্থানান্তর করা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত নিজ আবাসস্থলে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আশাবাদী। যুদ্ধ ছাড়া যা যা করণীয় তার সবই করেছি। যুদ্ধ আমরা করব না। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মায়ানমার আমাদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য তাদের সঙ্গে আমরা তিনটা দ্বিপক্ষীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমার রাজি আছে। মায়ানমার রাজি থাকলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কাজ কিছুই করেনি। এখন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। মায়ানমার এই বিলম্ব করছে। আমরা মায়ানমারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। ছয় লাখ রোহিঙ্গার নাম-ঠিকানাসহ তালিকা মায়ানমারের কাছে দিয়েছি।

ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ, চীন, মায়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাপনা করেছি। আবার বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাপনাও রয়েছে। যারা মায়ানমারের পক্ষের দেশ তারাও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলছে। এটা এখন সার্বজনীন দাবি। ভারত এখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে কাজ করবে বলে আমাদের বলেছে। জাতিসংঘকে যুক্ত করেছি। আইনি প্রক্রিয়াও কাজ হচ্ছে। গাম্বিয়া আইসিজেতে গেছে। আইসিসি কাজ করছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮ সালে এসেছিল। ১৯৯২ সালেও এসেছিল। দুই বারেই ফিরে গেছে। এবারও ফিরে যাবে বলে আশা করি। কারণ মায়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি আছে। তবে কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে তা বলতে পারব না।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। গত সোমবার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ তাগিদ দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, মায়ানমারের ভেতরে ও বাইরে বাস্তুচ্যূত ও রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি ইউএনএইচসিআর তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে।

সিএনএন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করে বর্মি সামরিক বাহিনী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এর মধ্যে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশে ফিরতে দেয়নি বর্মি কর্তৃপক্ষ। নিজ দেশ থেকে জঘন্য উপায়ে বিতাড়িত রাষ্ট্রহীন এ জাতিগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। শরণার্থী জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি।

ইউএনএইচসিআর বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য কেবল শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের প্রতি সমর্থন জানানোই যথেষ্ট নয়। তাদের বরং এই সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই এখন মায়ানমারের বাইরে বসবাস করছে। ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এরই মধ্যে আট লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে নিবন্ধনভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি গভীর মানবিক প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে। শরণার্থীদের সুরক্ষা এবং তাদের জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিবন্ধিত প্রতি ১০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে ৯ জনই বাংলাদেশে বাস করছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মায়ানমার কর্তৃক জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন ও সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গণহত্যা প্রতিরোধে মায়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ ঘোষণা করে। তবে কিছুই মানেনি মায়ানমার। দেশের ভেতরে সংঘটিত গুরুতর অপরাধ তদন্তের জন্য জাতিসংঘকেও অনুমতি দেয়নি তারা। নিজেরাও সামরিক নৃশংসতার বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য কোন তদন্ত চালায়নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, মায়ানমার সরকারের বোঝা উচিত রোহিঙ্গাদের জন্য তারা যে ধরনের ভয়াবহ ভোগান্তি তৈরি করেছে তার কথা বৈশ্বিক করোনা মহামারী পরিস্থিতির মধ্যেও মুছে ফেলা যাবে না। মায়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমাধানসূত্র গ্রহণ করা।