মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার

সিআর দত্তের জীবনাবসান

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআরদত্ত) বীর উত্তম আর নেই। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

অনন্য যুদ্ধ কৌশল ও বীরত্বের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে, বিআরটিসিসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দ্বায়িত পালন করেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সংবাদ মাধ্যমকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সিআর দত্ত বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত শুক্রবার তিনি বাথরুমে পড়ে গিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ওই অবস্থায় তাকে ফ্লোরিডার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। সেখানেই তিনি মারা যান। সিআর দত্তের সৎকারের বিষয়ে রানা দাশ গুপ্ত জানান ‘তাদের পরিবারের ইচ্ছা লাশটা বাংলাদেশে নিয়ে আসা। আমাদেরও ইচ্ছা, লাশটা বাংলাদেশে আসুক, বাংলাদেশেই তার সৎকারটা করা হোক। তবে বাংলাদেশের কোথায় তার সমাধি হবে, সেটা ঠিক করিনি। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা ঠিক করব।’

সিআর দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর ‘সেকেন্ড লেফটেনেন্ট’ পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।

১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেব দায়িত্বরত এমএজি ওসমানী সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠন করেন এবং এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করেন চিত্ত রঞ্জন দত্তকে। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান চিত্ত রঞ্জন দত্ত। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান। চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তিনি যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে দিতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধের আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সিআর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় সরকার। পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল। এছাড়া ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সিআর দত্তের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আরও শোক প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জ্ঞাপন করা হয়।

বুধবার, ২৬ আগস্ট ২০২০ , ৬ মহররম ১৪৪২, ২৬ আগস্ট ২০২০

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার

সিআর দত্তের জীবনাবসান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআরদত্ত) বীর উত্তম আর নেই। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

অনন্য যুদ্ধ কৌশল ও বীরত্বের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে, বিআরটিসিসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দ্বায়িত পালন করেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সংবাদ মাধ্যমকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সিআর দত্ত বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত শুক্রবার তিনি বাথরুমে পড়ে গিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ওই অবস্থায় তাকে ফ্লোরিডার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। সেখানেই তিনি মারা যান। সিআর দত্তের সৎকারের বিষয়ে রানা দাশ গুপ্ত জানান ‘তাদের পরিবারের ইচ্ছা লাশটা বাংলাদেশে নিয়ে আসা। আমাদেরও ইচ্ছা, লাশটা বাংলাদেশে আসুক, বাংলাদেশেই তার সৎকারটা করা হোক। তবে বাংলাদেশের কোথায় তার সমাধি হবে, সেটা ঠিক করিনি। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা ঠিক করব।’

সিআর দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর ‘সেকেন্ড লেফটেনেন্ট’ পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।

১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেব দায়িত্বরত এমএজি ওসমানী সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠন করেন এবং এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করেন চিত্ত রঞ্জন দত্তকে। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান চিত্ত রঞ্জন দত্ত। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান। চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তিনি যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে দিতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধের আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সিআর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় সরকার। পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল। এছাড়া ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সিআর দত্তের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আরও শোক প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জ্ঞাপন করা হয়।