নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

মিলটন রহমান

কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রেম ‘নার্গিস’। প্রথম প্রেম তাওবা বলি কী করে। আলোচক-সমালোচকরা বলেন তাই আমিও একই দিকে ছাতা ধরলাম। আবার সমালোচকরাই বলেন নজরুলের জীবনে অনেক নারীর উপস্থিতি ঘটেছিলো। তার মধ্য থেকে তিনজনের নাম বেশি উচ্চারিত। সৈয়দা খাতুন বা নার্গিস আসার খানম, প্রমিলা সেনগুপ্তা এবং ফজিলাতুন্নেসা জোহা। তবে আরো অনেক নারীর উপস্থিতি কখন কীভাবে ঘটে তার কোনো দলিল পাওয়া যায় না। তাই বলতে চাই প্রথম যে তরুণীর প্রতি নজরুল বেশি আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি ‘নার্গিস’। নার্গিসের নাম নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ১৯২১ সালে কুমিল্লার মুরাদ নগরের দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে যে তরুণীর সাথে নজরুলের পরিচয় এবং পরে ঘনিষ্ঠতা জন্ম নেয় তার নাম সৈয়দা খাতুন। খান সাহেবের ভাগ্নি। নজরুল সেখানে অবস্থানকালে মায়ের সাথে মাঝে মাঝে মামা বাড়িতে আসতেন সৈয়দা খাতুন। সেখানে এক সময় দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। এই সম্পর্ক তৈরির বিষয়েও কিছু সস্তা কথা বেশ ভালোই বিক্রি হয়। যেমন- গান গেয়ে নজরুল সৈয়দা খাতুনের হৃদয় হরণ করেছিলেন। প্রথম দেখাতেই দুজনের প্রেম হয়ে যায়। ইত্যকার সিনেমাটিক গালগল্পের অন্ত নেই। তবে, সৈয়দা খাতুনের ভাই মুনসী আব্দুল জব্বারের বিয়েতে দুজনের প্রণয় দানা বাঁধতে শুরু করে। কারণ ওই অনুষ্ঠানে নজরুলের গান এবং বাঁশির সুরে বিমোহিত হয়েছিলেন খাতুন। নজরুল, তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। খাতুনও নজরুলের গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নজরুলের সুঠাম দেহসৌষ্ঠবও ভালো লাগার কারণ ছিলো। এই সম্পর্ক যখন পাকাপাকি করার চিন্তা করছিলেন নজরুল তখন চিঠিতে কলকাতার বন্ধু মহলে তা জানিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলকে একটি চিঠিতে ‘ভয় হয় যে, হয়তবা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়’ এমন শংকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে ‘যাঁকে পেয়েছিস তিনিই যে তোর চির জনমের হারানো গৃহলক্ষ্মী একথা সত্যি যদি এতটুকু সত্য হয়, তাহলে তোর সৌভাগ্যে আমার সত্যই ঈর্ষা হচ্ছে।’ এখানে নজরুল কোন সত্য কথাটি বলতে চেয়েছেন? যাকে ভালোবেসেছেন তাকে কি তাহলে ক্ষণিকের জন্য চেয়েছেন? চিরকালের গৃহলক্ষ্মী নয়? এ প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়া অবান্তর নয়। তারপরও সম্পর্ক পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অল্প শিক্ষিত ভাগ্নীকে নজরুলের উপযুক্ত করে তুলতে মামা আকবর আলী খান আদাজল খেয়ে লাগলেন। শরৎচন্দ্রের রচনা পাঠ করিয়ে জগৎ সংসার সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলছিলো। সেই সৈয়দা খাতুনের নাম পাল্টে রাখলেন নার্গিস আসার খানম। কিন্তু আমাদের সিংহভাগ নজরুল প্রেমী জানেন ‘ভালোবেসে নজরুল প্রেমিকার নাম রাখেন নার্গিস’- যা সত্য নয়। নার্গিস নয় তার পুরো নাম নার্গিস আসার খানম রাখা হয়। রসজ্ঞরা বলেন, খানমের ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানেই নাকি নজরুল খানমের নাম রেখেছিলেন ‘নার্গিস’। বিয়ের একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে কারো নাম পাল্টে রাখার চিন্তা কীভাবে কাজ করেছিলো বা সে সুযোগ তৈরি হয়েছিলো তা একবার ভাবার প্রয়োজন ছিলো। তাছাড়া নজরুল যে নাম রেখেছিলেন তার জোরালো কোনো প্রমাণও নেই। নার্গিস আর নজরুলের প্রেম বিষয়ক মুখরোচক গল্প কেবল সাহিত্যবোদ্ধা নয়, আমজনতার মাঝেও প্রতিষ্ঠিত। এই গল্প দুজনকে বাসরঘর পর্যন্ত নিয়ে ছেড়েছে। যেখানে দুজনের বিয়েই হয় নি, সেখানে বাসর ঘর আসে কোত্থেকে? দুজনের দেখাদেখি শেষের প্রায় ষোল বছর পর ১৯৩৭ সালে নার্গিসের একটি পত্র আসে কবির কাছে। সেখানে তখন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। শৈলজানন্দ তখন পত্রের উত্তর লিখতে বললে নজরুল গান দিয়েই জবাব দিয়েছিলেন এভাবে-

‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই

কেন মনে রাখ তারে।

ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।’

এ কিসের ইঙ্গিত? বাসরঘর পর্যন্ত গেলেন কিন্তু নার্গিস কবিকে একটি মালাও পরাতে পারলেন না! কারণ মালা পরানো পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক গড়ায়নি। বিয়ের কাবিননামার একটি শর্ত নজরুল মেনে নেন নি। তাই বিয়ে আসর থেকেই ভেঙে যায়। ওই শর্তে লেখা ছিলো বিয়ের পরে তাকে দৌলতপুর থাকতে হবে। এই শর্ত নজরুল মেনে নেন নি। শর্তটি যে ছিলো তা প্রায় সকল ঐতিহাসিকের লেখায় উচ্চারিত হয়েছে। তবে সে কাবিননামায় নজরুল ইসলাম স্বাক্ষর করেছিলেন কিনা তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাছাড়া ওই কাবিননামা কখনো কারো হস্তগত হয়েছে বা কোথাও সংরক্ষণে আছে বলেও জানা যায় না। ফলে আদৌ কোনো কাবিননামা প্রস্তুত হয়েছিলো কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দৌলতপুরে বিয়ের পরে থাকার শর্ত নিয়ে নজরুল ইসলাম বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি বিয়ের আসর থেকেই পায়ে হেঁটে কুমিল্লার দিকে যাত্রা করেন। এ প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদের তথ্য প্রণিধানযোগ্য বলে আমি মনে করি।

‘...আলী আকবর খানও বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর মুসাবিদা করা কাবিন নামায় একটি শর্ত ছিলো এই যে, কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুর গ্রামে এসে নার্গিস বেগমের সঙ্গে বাস করতে পারবে, কিন্তু নার্গিস বেগমকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না। এই শর্ত নজরুল ইসলামের গৌরবে বেধেছিল। তাই সে বিয়ে না করেই বিয়ের মজলিস হতে উঠে রাত্রেই পায়ে হেঁটে কুমিল্লা চলে যায়।’ (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা)

এই বক্তব্য আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য। কারণ মুজফফর আহমদ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন। একসাথে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতেন। তাছাড়া স্বয়ং বিয়ের আসরে উপস্থিতি অতিথি সন্তোষ কুমারের মুখ থেকে ঘটনার আদ্যেপান্ত শুনেই মুজফ্ফর আহমেদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে এ বিষয়টি উপস্থাপন করেন। আবার এও ভুললে চলবে না যে, নজরুল যখন বিয়ের আসর ছেড়ে পায়ে হেঁটে কুমিল্লা রওয়ানা করেছিলেন তখন সাথে ছিলেন বিরজা সুন্দরীর পুত্র বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মুজফ্ফর আহমদের কথা কেনো দলিল হিশেবে ধরা যায় তা আরো নিবিড়ভাবে বোঝা যাবে কবির কুমিল্লা ফিরে আসার পরের ঘটনার দিকে তাকালে। নজরুল ইসলাম কুমিল্লা ফিরে আসার পর কলকাতায় বন্ধুদের একটি চিঠি লেখেন। তাতে আকবর আলী খানের প্রতারণার বর্ণনা ছিলো। সে সময় কিছুটা অসুস্থ হয়ে যে পড়েছিলেন সে কথা উল্লেখ করে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার জন্য বন্ধুদের কাছে কিছু টাকাও চান নজরুল। সে সময় সবাই মিলে মুজফ্ফর আহমদকেই

নজরুলকে কুমিল্লা থেকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেন। মুজফ্ফর ত্রিশটা টাকা ধার নিয়ে যাত্রা শুরু করেন কুমিল্লার দিকে। পৌঁছান ১৯২১ সালের ৬ জুলাই। সেখান থেকে আট জুলাই দুজন কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। নজরুল ইসলাম সেবার প্রায় চার মাস পর বন্ধু মুজাফফরের সাথে কলকাতা ফিরেন। কলকাতায় তালতলা লেনে মুজাফফর আহমদের সাথেই থাকতে শুরু করেন। কুমিল্লা থেকে কলকাতা আসা পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে একসাথে থাকার সুবাধে নজরুল ইসলামের কাছ থেকে শোনা তথ্য দিয়েই মুজফফর আহমদ ‘নজরুল স্মৃতিকথা’ রচনা করেছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো সমালোচক কেন জানি মুজফফরের তথ্যকে আমলে নিতে চান না। তাহলে নজরুল বিষয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভুল তথ্য প্রচার হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তাছাড়া নজরুলের বিয়ে হওয়া না হওয়া বিষয়ে বিরজাসুন্দরী দেবীর রচনা থেকে আরো স্পষ্ট করা যাক। তার আগে একটু বলে রাখি কে এই বিরজাসুন্দরী। ১৯২১ সালে নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সাথে দৌলতপুর যাওয়ার পথে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় যান এবং সেখানে পাঁচ দিন অবস্থান করেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আকবর আলী খানের স্কুল বন্ধু। এই বীরেন্দ্রর মা হলেন বিরজাসুন্দরী দেবী। নজরুল ইসলাম খুব কম সময়ে মানুষকে আপন করে নেয়ার অসামান্য ক্ষমতা রাখতেন। বিরজাসুন্দরীও খুব মায়াবতি ছিলেন। ফলে নজরুল ইসলাম তাঁকে মা বলেই সম্বোধন করেন। ওই বাড়িতে আরো থাকতেন বীরেন্দ্রর দুই বোন কমলা সেনগুপ্ত (বাচ্চি), অঞ্জলি সেনগুপ্ত (জটু)। বীরেন্দ্রর বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবি ও তার একমাত্র মেয়ে প্রমীলা দেবি, যিনি আশালতা (দুলি) নামেই পরিচিত ছিলেন। প্রমিলা নামটি পরে নজরুল ইসলামের দেয়া। নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান বিরজাসুন্দরী দেবির পুরো পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। সেই বিয়েতে আসার বর্ণনা বিরজাসুন্দরী দেবি করেছিলেন এভাবে-

‘...‘আ’(আলী আকবর) আমার পুত্র ‘বী’র(বীরেন্দ্রের) সহপাঠি... সে আমাকে মা বলে এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। তার জন্যই তার ভাগ্নীর (অতএব আমার নাতনীর) বিয়েতে তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। মুসলমানের বিয়ে এই প্রথম দেখলাম। ওদের বিয়ে একদিনে হয় না। সেদিন হলো আমাদের পাকাকথার বা লগ্নপত্রের মতো। ...বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলতে থাকলো মধ্য পথেই।’

বিরজাসুন্দরীর এই সাক্ষ্য থেকে আরো পরিষ্কার হওয়া যায় যে বিয়ে পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ভেঙে যায়। নজরুল-নার্গিসের এই বিয়ে ভেঙে যাওয়া বিষয়ে কোনো কোনো সমালোচক বিরাজাসুন্দরী ও তার পরিবারের সদস্যদের দায়ি করার অপেচেষ্টাও করেছেন। এর যে কোনো ভিত্তি ছিলো না তার কারণ, বিরজাসুন্দরীর পরিবারের সাথে তখন নজরুলের এমন কোনো সম্পর্ক হয় নি যে নিজেদের স্বার্থে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন তারা। তখন প্রমিলা দেবির সাথেও নজরুলের তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় নি।

তো বিয়ের আসর ছেড়ে যাওয়ার পর নার্গিসের সাথে কবির আর দেখা হয় নি। নার্গিস এবং নজরুলের সম্পর্কে চির ধরার প্রধান কারণ মামা আকবর আলী খান। একজন বই ব্যবসায়ী। তিনি মূলত কাবিননামায় ওই শর্ত জুড়ে দিয়ে নজরুলকে আটকে নিজের প্রকাশনা বাণিজ্যের কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। নজরুলের শিশুতোষ রচনাগুলো তখন বেশ জনপ্রিয়। আকবর আলী খান শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে নজরুলের লেখাগুলো দিয়ে নিজের বাণিজ্য পোক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কলকাতায় আকবর আলী খানের সাথে মেলামেশায় বন্ধুরা নজরুলকে প্রায়ই সতর্ক করতেন। লোকটি চতুর এবং স্বার্থবাজ বলেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সাথে নজরুলের ঠিক কখন কোথায় পরিচয় হয়েছিলো তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। আকবর আলী একজন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার সৈনিক ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে করাচিতে দু’জনের পরিচয় ঘটে বলেও জানা যায়। তবে তিনি অবসরের পর কলকাতায় এসে যুক্ত হন পুস্তক বাণিজ্যে। এই বাণিজ্যের স্বার্থেই নজরুলকে কব্জা করার একটি বাসনা সব সময় লালন করতেন তিনি। যা কমরেড মুজফ্ফর আহমদসহ নজরুলের বন্ধুদের চোখ এড়ায় নি। তাঁরা সকলেই আকবর আলী খানকে মতলববাজ বলেই জানতেন। সেই মতলবের ফাঁদে পড়ে দৌলতপুরে গিয়ে নজরুল ইসলাম আড়াই মাস ছিলেন। এই সময়ে বিয়ে দেয়ার জন্য আকবর আলী খান নিজের পরিবারের মধ্যে আরো তিনটি মেয়ে নজরুলকে দেখিয়েছিলেন, আলতাফ আলী খাঁর মেয়ে টুনি, ওয়ারেছ আলী খাঁর মেয়ে নুরজাহান এবং মেজাবত আলী খাঁর মেয়ে আম্বিয়া খানম। এদের কাউকেই কবি পছন্দ করেন নি। কিন্তু আকবর আলী খান থেমে থাকেন নি। নজরুলকে তিনি এতো বেশি কব্জা করে রখেছিলেন যে, কোনো চিঠি পোস্ট করার জন্য দিলে তা না করে লুকিয়ে রাখতেন। নজরুল ইসলামের কাছে বন্ধুদের প্রেরিত চিঠিও আকবার আলী খান লুকিয়ে রাখতেন। এতে বোঝা যায় তিনি চাইতেন না কেউ নজরুলের সাথে যোগাযোগ রাখুক বা কোনো বিষয়ে পরামর্শ দিক। মুজফ্ফর আহমেদের একটি চিঠি থেকে তা আরো পরিষ্কার জানা যায়-

‘ভাই কাজী সাহেব

ইতিপূর্বে আপনার কোনো পত্র পাইনি। ওয়াজেদ আলী সাহেবের চিঠিতে জানলুম যে ৩ আষাঢ় তারিখে আপনার বিয়ে হচ্ছে। সময় খুব সংকীর্ণ। কাজেই আমার যাওয়া হচ্ছে না। তবে ভালয় ভালয় সব মিটে যাক, এ প্রার্থনা জানাচ্ছি খোদার দরবারে।’

এই যে বিয়ের ঠিক কয়েকদিন আগে মুজফ্ফর আহমদ, পবিত্র কুমার গঙ্গোপাধ্যায় এবং ওয়াজেদ আলীসহ বন্ধুরা সংবাদ পান তারও নকশাকার আকবর আলী খান। বিয়ের দাওয়াত পত্রও তিনি নজরুলের বন্ধুদের ডাকে ছাড়েন দেরিতে। যাতে দাওয়াত পেয়েও আসার সময় সংকুলান করতে না পারেন। নজরুল ইসলাম তাঁর কবিসুলভ সরলতায় কারো কূটবুদ্ধি ঠাহর করতে পারেন নি। নার্গিসকে তো তাঁর ভালো লেগেছিলোই। মনের সবটুকু দিয়ে সে ভালোবাসা তিনি নার্গিসের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে রেখেছিলেন। তবে এর সুযোগ নিয়ে কেউ যে স্বার্থসিদ্ধির চাতুরতায় মশগুল হয়ে উঠেছিলেন তা আঁচ করতে পারেননি নজরুল। তিনি মানুষকে আপন করে নেয়ার সারল্যে ভরা হৃদয়ের একজন মানুষ। এ প্রসঙ্গে আকবর আলী খানের ভাগিনা ও নার্গিসের ভাই মুনসি আব্দুর জব্বারের লেখা স্মরণ করা যেতে পারে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘প্রাণ খোলা ছিলেন কবি। পরকে আপন করার অসীম ক্ষমতা ছিলো তাঁর। ...অতি অল্প সময়ে বাড়ির ছোট বড় সকলকে তিনি একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন।’ কেবল দৌলতপুরের মানুষ নয়, প্রকৃতিকেও নজরুল আপন করে নিয়েছিলেন। সে ভালো লাগা কবিতায় প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘ছায়ানট’ কাব্যের বেশ কয়েকটি কবিতা দৌলতপুরে রচিত।

‘দিঘল শ্বাসের বাউল বাজে নাসার সে তার জোর-বাঁশিতে,

পান্না-ক্ষরা কান্না যেন ঠোঁট-চাপা তার চোর হাসি সে।

ম্লান তার লাল গালের লালিম

রোদ-পাক আধ-ডাঁশা ডালিম

গাগরি ব্যথার ডুবায় কে তার টোল খাওয়া গাল-চিবুক-কুয়ায়।’

(মানস-বধূ, ছায়ানট)

কোন বধূর কথা বলেছিলেন কবি? দৌলতপুর কবিকে বিমোহিত করেছিলো। তার মানুষগুলোকেও আপন করে নিয়েছিলেন। তারপরও কেন এই দীর্ঘশ্বাস! এরকম অন্যান্য কবিতাতেও প্রায় একই শংকা, অনুরাগ ঝংকৃত হয়েছে কবির জবানিতে। সৈয়দা খাতুনের মনোবিশ্বে কবি ভ্রমণ করতে গিয়েই এমন সব স্তবক সাজিয়েছেন? তা যদি হয়, তাহলে সম্পর্কের শুরু থেকেই কবি ইন্দ্রীয় কোথাও না কোথাও নতুন বাগানের পাশাপাশি মৌসুম শেষের বাগান ভাঙার গানও শুনেছিলেন। আকবর আলী খান মূলত নজরুল ইসলামকে বাগে আনার জন্যই নিজের পরিবারের কারো সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে কথা সর্বজানা। তাহলে নজরুল এবং নার্গিসের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তার মধ্যেও কি কৃত্রিমতা ছিলো? নার্গিস কি কেবল মামার পক্ষে কাজ করেছিলেন? মধ্যে কোনোই ভাব-ভালবাসা ছিলো না? মোজফ্ফর আহমদ অনেকটা ভালবাসাহীন এক কৌশল বলেই অভিহিত করেছেন সম্পর্কটিকে। তবে ইতিহাস বিচারে আমার তা মনে হয় নি। জানি না হয়তো মুজফফর আহমদের কথাই সঠিক। কিন্তু জীবনের দীর্ঘ বছর নজরুলের পথ চেয়েছিলেন যে রমণী তাকে ভালবাসাহীনতা বলি কী করে? দু’জনের মধ্যকার আত্মিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ছিলো বলেই আমার মনে হয়েছে। আরেকটি প্রশ্ন পাঠক হিশেবে আমার মনে জাগে, তা হলো, নজরুল ইসলাম দৌলতপুরে কেনো গিয়েছিলেন? যাওয়ার আগে তিনি তো সৈয়দা খাতুনের খবর জানতেন না। কেবল যে আকবর আলী খানের ফাঁদে পা দিয়ে গিয়েছিলেন তাও আমার মনে হয় না। কবি বন্ধু গায়ক নলিনীকান্ত সরকারের বক্তব্য একটু জানা যেতে পারে- ‘একদিন সারা বিকেল তার সাথে আড্ডা দিয়ে, পরদিন সকাল বেলা গিয়ে দেখি, নজরুল ঘরে নেই। তার এক সহকক্ষবাসী বন্ধু (মোসলেম ভারতের আফজালুল হক) হাসতে হাসতে বললেন, সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লা চলে গেছে।’

আফজালুল হক আরো বলেছিলেন আলী আকবর খান বাসায় গিয়ে নজরুলকে কীসব বুঝিয়েছিলেন আর তিনি উঠে রওয়ানা করেন কুমিল্লার দিকে। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি একজনের কথায় এভাবে গিয়েছিলেন কেন? তাঁর রচনার দিকে তাকালে এ প্রশ্নের উত্তর অনেকখানি পাওয়া যায়। দোলনচাঁপা, পুবের হাওয়া, চক্রবাক, ছায়ানট কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় দৌলতপুরের ছায়া বিরাজিত। দৌলতপুরের প্রকৃতি, ধর্মসাগর এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ কবিকে মুগ্ধ করেছিলো। পরবর্তীতে কবি সেই মায়াবিহারে যে আরো এক মায়ায় ডুবে যাবেন তা কল্পনায় ছিলো না। সৈয়দা খাতুন নজরুলের বলিষ্ঠ দৈহিক সৌন্দর্য আর গান ও বাঁশিতে মজেছিলেন তা সত্য। নজরুলও যে বিনিময়ে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তা সারা জীবনের রচনায় ছড়ানো রয়েছে। দৌলতপুর ছাড়ার পেছনে কাবিন নামায় ‘ঘরজামাই’ থাকার প্রস্তাব ছিলো তাই কেবল আমরা জানি। নজরুল ইসলামের মানসিক ঐশ্বর্য ছিলো, ছিলো না আর্থিক সঙ্গতি। এ নিয়ে আকবর আলী খান যেমন বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন, তেমনি নার্গিসও পীড়া দেয়ার ক্ষেত্রে কম যান নি। এসব বুকে নিয়ে কবি রাতের আঁধারে কুমিল্লা গিয়ে নিজের আত্মসম্মানবোধের কথা আকবর আলী খানকে পত্রে জানিয়েছিলেন এভাবে- ‘আমিও আপনাদের মতো মানুষ। আমার গণ্ডারের চামড়া নয়, কেবল সহ্যগুণটা কিছু বেশি। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কাণ্ডজ্ঞান ছিল না বা “কেয়ার” করিনি বলে আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার “ম্যানলিনেসে” বা পৌরুষে গিয়ে বাজে যাতে আমাকে কেঊ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন “ক্ষুদ্র আত্মা” হয়ে যাইনি।’

নজরুল ইসলামের জীবনে এই ব্যক্তিত্ববোধ এই চেতনা ও রৌদ্রদীপ্ত চারিত্রিক প্রখরতা তা থেকে কোন অভাব, কোন হুমকি, কিছুই তাঁকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি। কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফিরে আসার পর নার্গিস ও তাঁর মামা আকবর আলী খান নজরুলকে দৌলতপুরে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টার অন্ত রাখেন নি। নার্গিস চিঠি দিয়েও কবিকে ফেরাতে পারেন নি। আকবর আলী খান কলকাতায় গিয়ে এমনকি অর্থের প্রলোভন দেখিয়েও নজরুলকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে নজরুল ইসলাম বেশ কয়েকবার কুমিল্লায় যান কিন্তু দৌলতপুরমুখি হন নি। নার্গিস কবির কুমিল্লা যাওয়ার খবরে বিচলিত হতেন। তাঁর আবাক বিস্ময় জিজ্ঞাসাও ছিলো, কবি কুমিল্লা আসেন কিন্তু দৌলতপুরে কেনো নয়? কারণ ততদিনে নজরুলের অন্তর্লোকে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। বিরজাসুন্দরী দেবির বাড়িতে তাঁর অন্তরে নতুন প্রেম জেগে ওঠে। নতুন অর্ঘ্য হাতে কবির হৃদয়ে ঠাঁই নিতে থাকেন প্রমিলা দেবী। ততদিনে আকবর আলী খান নার্গিসকে ঢাকায় নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে রাখেন এবং তাঁর প্রেসের ম্যানেজার কবি আজীজুল হাকিমের সাথে বিয়ে দেন। যদিও এ বিষয়ে কিছুটা তথ্য বিভ্রাটে পড়েছি আমি। সাংবাদিক, কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলার সময় জানালেন, ‘নার্গিসের স্বামী আজীজুল হাকিম কবি ছিলেন না। তবে পুরানা পল্টনে সওগাত কার্যালয়ে আসতেন আর হাসতে হাসতে বলতেন, তিনি নজরুলের স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী। আমরা তার কথা শুনে হাসতাম।’ আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নার্গিসের দুই চিকিৎসক সন্তানদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। মেয়ে ডাক্তার শাহানারা বসবাস করেন অক্সফোর্ডে আর ছেলে ডাক্তার আজাদ ফিরোজ থাকেন ম্যানচেস্টারে। আজাদই তাঁর মা নার্গিসকে বিলেত নিয়ে আসেন। সেখানেই নার্গিস ১৯৮৫ সালের দুই জুন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সমাধিও ম্যানচেস্টারে। যদি এই দুই সন্তান বেঁচে থাকেন হয়তো কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

পঁচিশ এপ্রিল ১৯২৪ সালে কবি বিয়ে করলেন আশালতা দেবীকে। পরে কবি আশলতার নাম রাখেন প্রমিলা দেবী। কবির সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন প্রমীলা। এছাড়া ফজিলাতুন্নেছাকে ঘিরেও নজরুল ইসলামের জীবনের বর্ণাঢ্য অধ্যায় রয়েছে। সে বিষয়ে অন্য রচনার অবতারণা হতে পারে। আমি এই রচনায় কেবল নার্গিসের সাথে নজরুল ইসলামের শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কোথায় ছিলো তা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। ইতিহাসবিদরা এ বিষয়টি আরো খোলতায় করতে পারবেন বলে মনে করি।

তথ্যসূত্র

কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা-মুজফ্ফর আহমদ

কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন-রফিকুল ইসলাম

আব্দুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলী-২

নজরুল একাডেমি পত্রিকা-৪৭ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা

নজরুল একাডেমি পত্রিকা-৪৫ বর্ষ ৪১ সংখ্যা

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

মিলটন রহমান

image

কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রেম ‘নার্গিস’। প্রথম প্রেম তাওবা বলি কী করে। আলোচক-সমালোচকরা বলেন তাই আমিও একই দিকে ছাতা ধরলাম। আবার সমালোচকরাই বলেন নজরুলের জীবনে অনেক নারীর উপস্থিতি ঘটেছিলো। তার মধ্য থেকে তিনজনের নাম বেশি উচ্চারিত। সৈয়দা খাতুন বা নার্গিস আসার খানম, প্রমিলা সেনগুপ্তা এবং ফজিলাতুন্নেসা জোহা। তবে আরো অনেক নারীর উপস্থিতি কখন কীভাবে ঘটে তার কোনো দলিল পাওয়া যায় না। তাই বলতে চাই প্রথম যে তরুণীর প্রতি নজরুল বেশি আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি ‘নার্গিস’। নার্গিসের নাম নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ১৯২১ সালে কুমিল্লার মুরাদ নগরের দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে যে তরুণীর সাথে নজরুলের পরিচয় এবং পরে ঘনিষ্ঠতা জন্ম নেয় তার নাম সৈয়দা খাতুন। খান সাহেবের ভাগ্নি। নজরুল সেখানে অবস্থানকালে মায়ের সাথে মাঝে মাঝে মামা বাড়িতে আসতেন সৈয়দা খাতুন। সেখানে এক সময় দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। এই সম্পর্ক তৈরির বিষয়েও কিছু সস্তা কথা বেশ ভালোই বিক্রি হয়। যেমন- গান গেয়ে নজরুল সৈয়দা খাতুনের হৃদয় হরণ করেছিলেন। প্রথম দেখাতেই দুজনের প্রেম হয়ে যায়। ইত্যকার সিনেমাটিক গালগল্পের অন্ত নেই। তবে, সৈয়দা খাতুনের ভাই মুনসী আব্দুল জব্বারের বিয়েতে দুজনের প্রণয় দানা বাঁধতে শুরু করে। কারণ ওই অনুষ্ঠানে নজরুলের গান এবং বাঁশির সুরে বিমোহিত হয়েছিলেন খাতুন। নজরুল, তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। খাতুনও নজরুলের গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নজরুলের সুঠাম দেহসৌষ্ঠবও ভালো লাগার কারণ ছিলো। এই সম্পর্ক যখন পাকাপাকি করার চিন্তা করছিলেন নজরুল তখন চিঠিতে কলকাতার বন্ধু মহলে তা জানিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলকে একটি চিঠিতে ‘ভয় হয় যে, হয়তবা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়’ এমন শংকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে ‘যাঁকে পেয়েছিস তিনিই যে তোর চির জনমের হারানো গৃহলক্ষ্মী একথা সত্যি যদি এতটুকু সত্য হয়, তাহলে তোর সৌভাগ্যে আমার সত্যই ঈর্ষা হচ্ছে।’ এখানে নজরুল কোন সত্য কথাটি বলতে চেয়েছেন? যাকে ভালোবেসেছেন তাকে কি তাহলে ক্ষণিকের জন্য চেয়েছেন? চিরকালের গৃহলক্ষ্মী নয়? এ প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়া অবান্তর নয়। তারপরও সম্পর্ক পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অল্প শিক্ষিত ভাগ্নীকে নজরুলের উপযুক্ত করে তুলতে মামা আকবর আলী খান আদাজল খেয়ে লাগলেন। শরৎচন্দ্রের রচনা পাঠ করিয়ে জগৎ সংসার সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলছিলো। সেই সৈয়দা খাতুনের নাম পাল্টে রাখলেন নার্গিস আসার খানম। কিন্তু আমাদের সিংহভাগ নজরুল প্রেমী জানেন ‘ভালোবেসে নজরুল প্রেমিকার নাম রাখেন নার্গিস’- যা সত্য নয়। নার্গিস নয় তার পুরো নাম নার্গিস আসার খানম রাখা হয়। রসজ্ঞরা বলেন, খানমের ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানেই নাকি নজরুল খানমের নাম রেখেছিলেন ‘নার্গিস’। বিয়ের একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে কারো নাম পাল্টে রাখার চিন্তা কীভাবে কাজ করেছিলো বা সে সুযোগ তৈরি হয়েছিলো তা একবার ভাবার প্রয়োজন ছিলো। তাছাড়া নজরুল যে নাম রেখেছিলেন তার জোরালো কোনো প্রমাণও নেই। নার্গিস আর নজরুলের প্রেম বিষয়ক মুখরোচক গল্প কেবল সাহিত্যবোদ্ধা নয়, আমজনতার মাঝেও প্রতিষ্ঠিত। এই গল্প দুজনকে বাসরঘর পর্যন্ত নিয়ে ছেড়েছে। যেখানে দুজনের বিয়েই হয় নি, সেখানে বাসর ঘর আসে কোত্থেকে? দুজনের দেখাদেখি শেষের প্রায় ষোল বছর পর ১৯৩৭ সালে নার্গিসের একটি পত্র আসে কবির কাছে। সেখানে তখন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। শৈলজানন্দ তখন পত্রের উত্তর লিখতে বললে নজরুল গান দিয়েই জবাব দিয়েছিলেন এভাবে-

‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই

কেন মনে রাখ তারে।

ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।’

এ কিসের ইঙ্গিত? বাসরঘর পর্যন্ত গেলেন কিন্তু নার্গিস কবিকে একটি মালাও পরাতে পারলেন না! কারণ মালা পরানো পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক গড়ায়নি। বিয়ের কাবিননামার একটি শর্ত নজরুল মেনে নেন নি। তাই বিয়ে আসর থেকেই ভেঙে যায়। ওই শর্তে লেখা ছিলো বিয়ের পরে তাকে দৌলতপুর থাকতে হবে। এই শর্ত নজরুল মেনে নেন নি। শর্তটি যে ছিলো তা প্রায় সকল ঐতিহাসিকের লেখায় উচ্চারিত হয়েছে। তবে সে কাবিননামায় নজরুল ইসলাম স্বাক্ষর করেছিলেন কিনা তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাছাড়া ওই কাবিননামা কখনো কারো হস্তগত হয়েছে বা কোথাও সংরক্ষণে আছে বলেও জানা যায় না। ফলে আদৌ কোনো কাবিননামা প্রস্তুত হয়েছিলো কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দৌলতপুরে বিয়ের পরে থাকার শর্ত নিয়ে নজরুল ইসলাম বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি বিয়ের আসর থেকেই পায়ে হেঁটে কুমিল্লার দিকে যাত্রা করেন। এ প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদের তথ্য প্রণিধানযোগ্য বলে আমি মনে করি।

‘...আলী আকবর খানও বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর মুসাবিদা করা কাবিন নামায় একটি শর্ত ছিলো এই যে, কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুর গ্রামে এসে নার্গিস বেগমের সঙ্গে বাস করতে পারবে, কিন্তু নার্গিস বেগমকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না। এই শর্ত নজরুল ইসলামের গৌরবে বেধেছিল। তাই সে বিয়ে না করেই বিয়ের মজলিস হতে উঠে রাত্রেই পায়ে হেঁটে কুমিল্লা চলে যায়।’ (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা)

এই বক্তব্য আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য। কারণ মুজফফর আহমদ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন। একসাথে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতেন। তাছাড়া স্বয়ং বিয়ের আসরে উপস্থিতি অতিথি সন্তোষ কুমারের মুখ থেকে ঘটনার আদ্যেপান্ত শুনেই মুজফ্ফর আহমেদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে এ বিষয়টি উপস্থাপন করেন। আবার এও ভুললে চলবে না যে, নজরুল যখন বিয়ের আসর ছেড়ে পায়ে হেঁটে কুমিল্লা রওয়ানা করেছিলেন তখন সাথে ছিলেন বিরজা সুন্দরীর পুত্র বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মুজফ্ফর আহমদের কথা কেনো দলিল হিশেবে ধরা যায় তা আরো নিবিড়ভাবে বোঝা যাবে কবির কুমিল্লা ফিরে আসার পরের ঘটনার দিকে তাকালে। নজরুল ইসলাম কুমিল্লা ফিরে আসার পর কলকাতায় বন্ধুদের একটি চিঠি লেখেন। তাতে আকবর আলী খানের প্রতারণার বর্ণনা ছিলো। সে সময় কিছুটা অসুস্থ হয়ে যে পড়েছিলেন সে কথা উল্লেখ করে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার জন্য বন্ধুদের কাছে কিছু টাকাও চান নজরুল। সে সময় সবাই মিলে মুজফ্ফর আহমদকেই

নজরুলকে কুমিল্লা থেকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেন। মুজফ্ফর ত্রিশটা টাকা ধার নিয়ে যাত্রা শুরু করেন কুমিল্লার দিকে। পৌঁছান ১৯২১ সালের ৬ জুলাই। সেখান থেকে আট জুলাই দুজন কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। নজরুল ইসলাম সেবার প্রায় চার মাস পর বন্ধু মুজাফফরের সাথে কলকাতা ফিরেন। কলকাতায় তালতলা লেনে মুজাফফর আহমদের সাথেই থাকতে শুরু করেন। কুমিল্লা থেকে কলকাতা আসা পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে একসাথে থাকার সুবাধে নজরুল ইসলামের কাছ থেকে শোনা তথ্য দিয়েই মুজফফর আহমদ ‘নজরুল স্মৃতিকথা’ রচনা করেছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো সমালোচক কেন জানি মুজফফরের তথ্যকে আমলে নিতে চান না। তাহলে নজরুল বিষয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভুল তথ্য প্রচার হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তাছাড়া নজরুলের বিয়ে হওয়া না হওয়া বিষয়ে বিরজাসুন্দরী দেবীর রচনা থেকে আরো স্পষ্ট করা যাক। তার আগে একটু বলে রাখি কে এই বিরজাসুন্দরী। ১৯২১ সালে নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সাথে দৌলতপুর যাওয়ার পথে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় যান এবং সেখানে পাঁচ দিন অবস্থান করেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আকবর আলী খানের স্কুল বন্ধু। এই বীরেন্দ্রর মা হলেন বিরজাসুন্দরী দেবী। নজরুল ইসলাম খুব কম সময়ে মানুষকে আপন করে নেয়ার অসামান্য ক্ষমতা রাখতেন। বিরজাসুন্দরীও খুব মায়াবতি ছিলেন। ফলে নজরুল ইসলাম তাঁকে মা বলেই সম্বোধন করেন। ওই বাড়িতে আরো থাকতেন বীরেন্দ্রর দুই বোন কমলা সেনগুপ্ত (বাচ্চি), অঞ্জলি সেনগুপ্ত (জটু)। বীরেন্দ্রর বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবি ও তার একমাত্র মেয়ে প্রমীলা দেবি, যিনি আশালতা (দুলি) নামেই পরিচিত ছিলেন। প্রমিলা নামটি পরে নজরুল ইসলামের দেয়া। নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান বিরজাসুন্দরী দেবির পুরো পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। সেই বিয়েতে আসার বর্ণনা বিরজাসুন্দরী দেবি করেছিলেন এভাবে-

‘...‘আ’(আলী আকবর) আমার পুত্র ‘বী’র(বীরেন্দ্রের) সহপাঠি... সে আমাকে মা বলে এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। তার জন্যই তার ভাগ্নীর (অতএব আমার নাতনীর) বিয়েতে তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। মুসলমানের বিয়ে এই প্রথম দেখলাম। ওদের বিয়ে একদিনে হয় না। সেদিন হলো আমাদের পাকাকথার বা লগ্নপত্রের মতো। ...বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলতে থাকলো মধ্য পথেই।’

বিরজাসুন্দরীর এই সাক্ষ্য থেকে আরো পরিষ্কার হওয়া যায় যে বিয়ে পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ভেঙে যায়। নজরুল-নার্গিসের এই বিয়ে ভেঙে যাওয়া বিষয়ে কোনো কোনো সমালোচক বিরাজাসুন্দরী ও তার পরিবারের সদস্যদের দায়ি করার অপেচেষ্টাও করেছেন। এর যে কোনো ভিত্তি ছিলো না তার কারণ, বিরজাসুন্দরীর পরিবারের সাথে তখন নজরুলের এমন কোনো সম্পর্ক হয় নি যে নিজেদের স্বার্থে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন তারা। তখন প্রমিলা দেবির সাথেও নজরুলের তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় নি।

তো বিয়ের আসর ছেড়ে যাওয়ার পর নার্গিসের সাথে কবির আর দেখা হয় নি। নার্গিস এবং নজরুলের সম্পর্কে চির ধরার প্রধান কারণ মামা আকবর আলী খান। একজন বই ব্যবসায়ী। তিনি মূলত কাবিননামায় ওই শর্ত জুড়ে দিয়ে নজরুলকে আটকে নিজের প্রকাশনা বাণিজ্যের কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। নজরুলের শিশুতোষ রচনাগুলো তখন বেশ জনপ্রিয়। আকবর আলী খান শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে নজরুলের লেখাগুলো দিয়ে নিজের বাণিজ্য পোক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কলকাতায় আকবর আলী খানের সাথে মেলামেশায় বন্ধুরা নজরুলকে প্রায়ই সতর্ক করতেন। লোকটি চতুর এবং স্বার্থবাজ বলেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সাথে নজরুলের ঠিক কখন কোথায় পরিচয় হয়েছিলো তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। আকবর আলী একজন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার সৈনিক ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে করাচিতে দু’জনের পরিচয় ঘটে বলেও জানা যায়। তবে তিনি অবসরের পর কলকাতায় এসে যুক্ত হন পুস্তক বাণিজ্যে। এই বাণিজ্যের স্বার্থেই নজরুলকে কব্জা করার একটি বাসনা সব সময় লালন করতেন তিনি। যা কমরেড মুজফ্ফর আহমদসহ নজরুলের বন্ধুদের চোখ এড়ায় নি। তাঁরা সকলেই আকবর আলী খানকে মতলববাজ বলেই জানতেন। সেই মতলবের ফাঁদে পড়ে দৌলতপুরে গিয়ে নজরুল ইসলাম আড়াই মাস ছিলেন। এই সময়ে বিয়ে দেয়ার জন্য আকবর আলী খান নিজের পরিবারের মধ্যে আরো তিনটি মেয়ে নজরুলকে দেখিয়েছিলেন, আলতাফ আলী খাঁর মেয়ে টুনি, ওয়ারেছ আলী খাঁর মেয়ে নুরজাহান এবং মেজাবত আলী খাঁর মেয়ে আম্বিয়া খানম। এদের কাউকেই কবি পছন্দ করেন নি। কিন্তু আকবর আলী খান থেমে থাকেন নি। নজরুলকে তিনি এতো বেশি কব্জা করে রখেছিলেন যে, কোনো চিঠি পোস্ট করার জন্য দিলে তা না করে লুকিয়ে রাখতেন। নজরুল ইসলামের কাছে বন্ধুদের প্রেরিত চিঠিও আকবার আলী খান লুকিয়ে রাখতেন। এতে বোঝা যায় তিনি চাইতেন না কেউ নজরুলের সাথে যোগাযোগ রাখুক বা কোনো বিষয়ে পরামর্শ দিক। মুজফ্ফর আহমেদের একটি চিঠি থেকে তা আরো পরিষ্কার জানা যায়-

‘ভাই কাজী সাহেব

ইতিপূর্বে আপনার কোনো পত্র পাইনি। ওয়াজেদ আলী সাহেবের চিঠিতে জানলুম যে ৩ আষাঢ় তারিখে আপনার বিয়ে হচ্ছে। সময় খুব সংকীর্ণ। কাজেই আমার যাওয়া হচ্ছে না। তবে ভালয় ভালয় সব মিটে যাক, এ প্রার্থনা জানাচ্ছি খোদার দরবারে।’

এই যে বিয়ের ঠিক কয়েকদিন আগে মুজফ্ফর আহমদ, পবিত্র কুমার গঙ্গোপাধ্যায় এবং ওয়াজেদ আলীসহ বন্ধুরা সংবাদ পান তারও নকশাকার আকবর আলী খান। বিয়ের দাওয়াত পত্রও তিনি নজরুলের বন্ধুদের ডাকে ছাড়েন দেরিতে। যাতে দাওয়াত পেয়েও আসার সময় সংকুলান করতে না পারেন। নজরুল ইসলাম তাঁর কবিসুলভ সরলতায় কারো কূটবুদ্ধি ঠাহর করতে পারেন নি। নার্গিসকে তো তাঁর ভালো লেগেছিলোই। মনের সবটুকু দিয়ে সে ভালোবাসা তিনি নার্গিসের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে রেখেছিলেন। তবে এর সুযোগ নিয়ে কেউ যে স্বার্থসিদ্ধির চাতুরতায় মশগুল হয়ে উঠেছিলেন তা আঁচ করতে পারেননি নজরুল। তিনি মানুষকে আপন করে নেয়ার সারল্যে ভরা হৃদয়ের একজন মানুষ। এ প্রসঙ্গে আকবর আলী খানের ভাগিনা ও নার্গিসের ভাই মুনসি আব্দুর জব্বারের লেখা স্মরণ করা যেতে পারে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘প্রাণ খোলা ছিলেন কবি। পরকে আপন করার অসীম ক্ষমতা ছিলো তাঁর। ...অতি অল্প সময়ে বাড়ির ছোট বড় সকলকে তিনি একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন।’ কেবল দৌলতপুরের মানুষ নয়, প্রকৃতিকেও নজরুল আপন করে নিয়েছিলেন। সে ভালো লাগা কবিতায় প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘ছায়ানট’ কাব্যের বেশ কয়েকটি কবিতা দৌলতপুরে রচিত।

‘দিঘল শ্বাসের বাউল বাজে নাসার সে তার জোর-বাঁশিতে,

পান্না-ক্ষরা কান্না যেন ঠোঁট-চাপা তার চোর হাসি সে।

ম্লান তার লাল গালের লালিম

রোদ-পাক আধ-ডাঁশা ডালিম

গাগরি ব্যথার ডুবায় কে তার টোল খাওয়া গাল-চিবুক-কুয়ায়।’

(মানস-বধূ, ছায়ানট)

কোন বধূর কথা বলেছিলেন কবি? দৌলতপুর কবিকে বিমোহিত করেছিলো। তার মানুষগুলোকেও আপন করে নিয়েছিলেন। তারপরও কেন এই দীর্ঘশ্বাস! এরকম অন্যান্য কবিতাতেও প্রায় একই শংকা, অনুরাগ ঝংকৃত হয়েছে কবির জবানিতে। সৈয়দা খাতুনের মনোবিশ্বে কবি ভ্রমণ করতে গিয়েই এমন সব স্তবক সাজিয়েছেন? তা যদি হয়, তাহলে সম্পর্কের শুরু থেকেই কবি ইন্দ্রীয় কোথাও না কোথাও নতুন বাগানের পাশাপাশি মৌসুম শেষের বাগান ভাঙার গানও শুনেছিলেন। আকবর আলী খান মূলত নজরুল ইসলামকে বাগে আনার জন্যই নিজের পরিবারের কারো সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে কথা সর্বজানা। তাহলে নজরুল এবং নার্গিসের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তার মধ্যেও কি কৃত্রিমতা ছিলো? নার্গিস কি কেবল মামার পক্ষে কাজ করেছিলেন? মধ্যে কোনোই ভাব-ভালবাসা ছিলো না? মোজফ্ফর আহমদ অনেকটা ভালবাসাহীন এক কৌশল বলেই অভিহিত করেছেন সম্পর্কটিকে। তবে ইতিহাস বিচারে আমার তা মনে হয় নি। জানি না হয়তো মুজফফর আহমদের কথাই সঠিক। কিন্তু জীবনের দীর্ঘ বছর নজরুলের পথ চেয়েছিলেন যে রমণী তাকে ভালবাসাহীনতা বলি কী করে? দু’জনের মধ্যকার আত্মিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ছিলো বলেই আমার মনে হয়েছে। আরেকটি প্রশ্ন পাঠক হিশেবে আমার মনে জাগে, তা হলো, নজরুল ইসলাম দৌলতপুরে কেনো গিয়েছিলেন? যাওয়ার আগে তিনি তো সৈয়দা খাতুনের খবর জানতেন না। কেবল যে আকবর আলী খানের ফাঁদে পা দিয়ে গিয়েছিলেন তাও আমার মনে হয় না। কবি বন্ধু গায়ক নলিনীকান্ত সরকারের বক্তব্য একটু জানা যেতে পারে- ‘একদিন সারা বিকেল তার সাথে আড্ডা দিয়ে, পরদিন সকাল বেলা গিয়ে দেখি, নজরুল ঘরে নেই। তার এক সহকক্ষবাসী বন্ধু (মোসলেম ভারতের আফজালুল হক) হাসতে হাসতে বললেন, সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লা চলে গেছে।’

আফজালুল হক আরো বলেছিলেন আলী আকবর খান বাসায় গিয়ে নজরুলকে কীসব বুঝিয়েছিলেন আর তিনি উঠে রওয়ানা করেন কুমিল্লার দিকে। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি একজনের কথায় এভাবে গিয়েছিলেন কেন? তাঁর রচনার দিকে তাকালে এ প্রশ্নের উত্তর অনেকখানি পাওয়া যায়। দোলনচাঁপা, পুবের হাওয়া, চক্রবাক, ছায়ানট কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় দৌলতপুরের ছায়া বিরাজিত। দৌলতপুরের প্রকৃতি, ধর্মসাগর এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ কবিকে মুগ্ধ করেছিলো। পরবর্তীতে কবি সেই মায়াবিহারে যে আরো এক মায়ায় ডুবে যাবেন তা কল্পনায় ছিলো না। সৈয়দা খাতুন নজরুলের বলিষ্ঠ দৈহিক সৌন্দর্য আর গান ও বাঁশিতে মজেছিলেন তা সত্য। নজরুলও যে বিনিময়ে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তা সারা জীবনের রচনায় ছড়ানো রয়েছে। দৌলতপুর ছাড়ার পেছনে কাবিন নামায় ‘ঘরজামাই’ থাকার প্রস্তাব ছিলো তাই কেবল আমরা জানি। নজরুল ইসলামের মানসিক ঐশ্বর্য ছিলো, ছিলো না আর্থিক সঙ্গতি। এ নিয়ে আকবর আলী খান যেমন বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন, তেমনি নার্গিসও পীড়া দেয়ার ক্ষেত্রে কম যান নি। এসব বুকে নিয়ে কবি রাতের আঁধারে কুমিল্লা গিয়ে নিজের আত্মসম্মানবোধের কথা আকবর আলী খানকে পত্রে জানিয়েছিলেন এভাবে- ‘আমিও আপনাদের মতো মানুষ। আমার গণ্ডারের চামড়া নয়, কেবল সহ্যগুণটা কিছু বেশি। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কাণ্ডজ্ঞান ছিল না বা “কেয়ার” করিনি বলে আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার “ম্যানলিনেসে” বা পৌরুষে গিয়ে বাজে যাতে আমাকে কেঊ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন “ক্ষুদ্র আত্মা” হয়ে যাইনি।’

নজরুল ইসলামের জীবনে এই ব্যক্তিত্ববোধ এই চেতনা ও রৌদ্রদীপ্ত চারিত্রিক প্রখরতা তা থেকে কোন অভাব, কোন হুমকি, কিছুই তাঁকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি। কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফিরে আসার পর নার্গিস ও তাঁর মামা আকবর আলী খান নজরুলকে দৌলতপুরে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টার অন্ত রাখেন নি। নার্গিস চিঠি দিয়েও কবিকে ফেরাতে পারেন নি। আকবর আলী খান কলকাতায় গিয়ে এমনকি অর্থের প্রলোভন দেখিয়েও নজরুলকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে নজরুল ইসলাম বেশ কয়েকবার কুমিল্লায় যান কিন্তু দৌলতপুরমুখি হন নি। নার্গিস কবির কুমিল্লা যাওয়ার খবরে বিচলিত হতেন। তাঁর আবাক বিস্ময় জিজ্ঞাসাও ছিলো, কবি কুমিল্লা আসেন কিন্তু দৌলতপুরে কেনো নয়? কারণ ততদিনে নজরুলের অন্তর্লোকে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। বিরজাসুন্দরী দেবির বাড়িতে তাঁর অন্তরে নতুন প্রেম জেগে ওঠে। নতুন অর্ঘ্য হাতে কবির হৃদয়ে ঠাঁই নিতে থাকেন প্রমিলা দেবী। ততদিনে আকবর আলী খান নার্গিসকে ঢাকায় নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে রাখেন এবং তাঁর প্রেসের ম্যানেজার কবি আজীজুল হাকিমের সাথে বিয়ে দেন। যদিও এ বিষয়ে কিছুটা তথ্য বিভ্রাটে পড়েছি আমি। সাংবাদিক, কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলার সময় জানালেন, ‘নার্গিসের স্বামী আজীজুল হাকিম কবি ছিলেন না। তবে পুরানা পল্টনে সওগাত কার্যালয়ে আসতেন আর হাসতে হাসতে বলতেন, তিনি নজরুলের স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী। আমরা তার কথা শুনে হাসতাম।’ আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নার্গিসের দুই চিকিৎসক সন্তানদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। মেয়ে ডাক্তার শাহানারা বসবাস করেন অক্সফোর্ডে আর ছেলে ডাক্তার আজাদ ফিরোজ থাকেন ম্যানচেস্টারে। আজাদই তাঁর মা নার্গিসকে বিলেত নিয়ে আসেন। সেখানেই নার্গিস ১৯৮৫ সালের দুই জুন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সমাধিও ম্যানচেস্টারে। যদি এই দুই সন্তান বেঁচে থাকেন হয়তো কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

পঁচিশ এপ্রিল ১৯২৪ সালে কবি বিয়ে করলেন আশালতা দেবীকে। পরে কবি আশলতার নাম রাখেন প্রমিলা দেবী। কবির সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন প্রমীলা। এছাড়া ফজিলাতুন্নেছাকে ঘিরেও নজরুল ইসলামের জীবনের বর্ণাঢ্য অধ্যায় রয়েছে। সে বিষয়ে অন্য রচনার অবতারণা হতে পারে। আমি এই রচনায় কেবল নার্গিসের সাথে নজরুল ইসলামের শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কোথায় ছিলো তা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। ইতিহাসবিদরা এ বিষয়টি আরো খোলতায় করতে পারবেন বলে মনে করি।

তথ্যসূত্র

কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা-মুজফ্ফর আহমদ

কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন-রফিকুল ইসলাম

আব্দুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলী-২

নজরুল একাডেমি পত্রিকা-৪৭ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা

নজরুল একাডেমি পত্রিকা-৪৫ বর্ষ ৪১ সংখ্যা