ডিপিএমে আগ্রহ বাড়ছে সরকারি কেনাকাটায়
ডিরেক্ট প্রক্রিউরমেন্ট মেথডে (ডিপিএম বা সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া) সরকারি কেনাকাটায় স্বেচ্ছাচারিতা চলছেই। বাড়ছে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ। ক্রয় প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের কোন জটিলতা সৃষ্টি হলেই কেবল শর্তসাপেক্ষে ‘ডিপিএম করা যাবে’-এই ধরনের সরকারি সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগেই উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা এখন ডিপিএমে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি ব্যায়ের পাশাপাশি পণ্যের প্রত্যাশিত গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের সঙ্গে বিরোধের কারণে ক্রয় প্রক্রিয়াও আটকে রয়েছে; মামলার জালেও আটকে পড়ছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প।
এই ধরনের বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সম্প্রতি ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (গত ১৫ জুলাই অনুষ্ঠিত) সভার আলোচনার উদ্বৃতাংশ’ অনুযায়ী সব মন্ত্রণালয় বিভাগে একটি চিঠি প্রদান করা হয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ইতঃপূর্বে একক উৎস (সিঙ্গেল সোর্স) থেকে ক্রয়ের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে একাধিকবার নির্দেশনা দেয়া হয়। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি ক্ষেত্রে একক উৎস থেকে ক্রয় না করার বিষয়ে সদয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে, এখন থেকে ক্রয়কারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থা একক উৎস হতে পণ্য, কার্য, সেবা ইত্যাদি ক্রয় না করার বিষয়ে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ অর্থ ব্যয় হয় সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে। এর আওতায় পণ্য ও সেবা ক্রয় করা হয়। সরকারের ৪৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে প্রায় দেড় হাজার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি ক্রয় কার্যক্রম উন্মক্ত দরপত্রে বিশেষ করে ‘ই-জিপি’তে হলেও ‘নানা জটিলতা সৃষ্টি’ করে কিছু মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং এর অধীনস্ত সংস্থার ক্রয় কার্যক্রম ডিপিএম’র মাধ্যমে করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনৈতিক তৎপরতা, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা প্রকল্প দলিল) উপেক্ষা করে ক্রয়-কার্যক্রম পরিচালনা, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার চেষ্টা, ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণাসহ নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদকে বলেছেন, ‘যারা ই-জিপি প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে ডিপিএম করছে, তারা প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করছেন, দ্বিতীয়ত তারা নিজেদের সুবিধা অর্জনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। কারণ এটার মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার ই-জিপি হলেই যে দুর্নীতি হবে না, সেটাও না। ই-জিপিতেও দুর্নীতি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের একটি গবেষণা আসছে।’
যেভাবে ডিপিএম হয়
ডিপিএম প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিপিএম করার লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে দরপত্রে অনাবশ্যকভাবে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, যাতে দরদাতা কোন প্রতিষ্ঠান কাজ না পায়। অনেক ক্ষেত্রে ডিপিএম’র মধ্যস্থতাকারীর পরামর্শ অনুযায়ী শর্ত ঠিক করা হয়। এতে দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য সরবরাহে অযোগ্য ও অসামর্থ্য বিবেচিত হয়। এই সুযোগেই ডিপিএম’র মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিরা প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তারা আলোচনা সাপেক্ষে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা হবে সেই প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ন্যূনতম ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সরকারের একটি বিভাগের জন্য প্রায় ২০ কোটি টাকায় চার হাজার পিস ল্যাপটপ কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয় একটি প্রকল্পের অধীনে। দরপত্রে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেশে উৎপাদন, সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা থাকতে হবে। পাশাপাশি ওই প্রতিষ্ঠানের ৬৪ জেলায় আইএসও সার্টিফাইড শাখা থাকতে হবে। এই ধরনের পণ্য সরবরাহে দেশে প্রায় অর্ধশত বিশ^খ্যাত ল্যাপটপ ব্র্যান্ডের এজেন্ট থাকলেও তারা ওই দুটি শর্তের কারণে দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দরপত্র উন্মুক্ত করে দেখা যায়, মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান শিডিউল জমা দিয়েছে, যার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ওই দুটি শর্ত পূরণে সক্ষম। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান ওই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কিছু পণ্য সরবরাহের কাজ পেতে পারে।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গত বছর পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২৫টি সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল। এগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন অধিদফতর ও সংস্থাকে। ওইসব সমস্যার মধ্যেও দরপত্র সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয় ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০১১ সালের ২ জুন এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিওরমেন্ট (ই-জিপি) ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ওয়েব পোর্টাল সময়োপযোগী সংযোজন।’
প্রধানমন্ত্রী ওই বক্তবের পর পর্যায়ক্রমে প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগেই ই-জিপি কার্যক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ক্রয় প্রক্রিয়ায় ইচ্ছেকৃতভাবে জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ডিপিএম কার্যক্রমে অতিউৎসাহী হচ্ছেন।
ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয়ের ক্ষেত্রে পিপিআরএ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যা ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয়ের অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। কিন্তু এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেস্বী কর্মকর্তা বা ব্যক্তি নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ডিপিএম’র ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘যে সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ও সযোজিত দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে, কেবল মাত্র সে সব প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয় করা যেতে পারে।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা রয়েছে, কোন প্রকল্পে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটার সুযোগ রয়েছে।’
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল কমিটির (সিপিটিইউ) মতামত উপেক্ষা করেই ডিপিএম প্রক্রিয়ায় ক্রয়-কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হচ্ছে।
ডিপিএম প্রক্রিয়ায় পণ্য ক্রয়ের চেষ্টা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ঝুলে গেছে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডয়া ক্লাসরুম স্থাপন কার্যক্রম। এ বিষয়ে প্রায় ছয়মাস আগে সিপিটিইউ’র মতামত নেয়ার পরও দরপত্র কার্যক্রম চূড়ান্ত হচ্ছে না।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ সংবাদকে বলেন, ‘আসলে টেন্ডারে পণ্যের মূল্য কিছুটা বেশি দেখা গেছে। এজন্য কার্যক্রমটি পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আমার একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি পক্ষ ‘দরপত্র’ বাদ দিয়ে এখন ‘ডিপিএম’ প্রক্রিয়ায় দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া ক্রয় করতে চায়।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আইসিটি’র মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (২য় পর্যায়)’র অধীনে তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল গত জুনের মধ্যে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেম- ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। গড়ে একটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও পরবর্তীতে প্রকল্পের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা নানা জটিলতা সৃষ্টি করে ‘ডিপিএম’ প্রক্রিয়ায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেন কেনার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরপরই লালফিতায় আটকে পড়ে প্রকল্পটি। প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন নাগাদ। একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে এই প্রকল্পে বিপুল অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ হলেও কারোর শাস্তি হয়নি।
বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০
ডিপিএমে আগ্রহ বাড়ছে সরকারি কেনাকাটায়
রাকিব উদ্দিন
ডিরেক্ট প্রক্রিউরমেন্ট মেথডে (ডিপিএম বা সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া) সরকারি কেনাকাটায় স্বেচ্ছাচারিতা চলছেই। বাড়ছে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ। ক্রয় প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের কোন জটিলতা সৃষ্টি হলেই কেবল শর্তসাপেক্ষে ‘ডিপিএম করা যাবে’-এই ধরনের সরকারি সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগেই উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা এখন ডিপিএমে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি ব্যায়ের পাশাপাশি পণ্যের প্রত্যাশিত গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের সঙ্গে বিরোধের কারণে ক্রয় প্রক্রিয়াও আটকে রয়েছে; মামলার জালেও আটকে পড়ছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প।
এই ধরনের বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সম্প্রতি ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (গত ১৫ জুলাই অনুষ্ঠিত) সভার আলোচনার উদ্বৃতাংশ’ অনুযায়ী সব মন্ত্রণালয় বিভাগে একটি চিঠি প্রদান করা হয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ইতঃপূর্বে একক উৎস (সিঙ্গেল সোর্স) থেকে ক্রয়ের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে একাধিকবার নির্দেশনা দেয়া হয়। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি ক্ষেত্রে একক উৎস থেকে ক্রয় না করার বিষয়ে সদয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে, এখন থেকে ক্রয়কারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থা একক উৎস হতে পণ্য, কার্য, সেবা ইত্যাদি ক্রয় না করার বিষয়ে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ অর্থ ব্যয় হয় সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে। এর আওতায় পণ্য ও সেবা ক্রয় করা হয়। সরকারের ৪৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে প্রায় দেড় হাজার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি ক্রয় কার্যক্রম উন্মক্ত দরপত্রে বিশেষ করে ‘ই-জিপি’তে হলেও ‘নানা জটিলতা সৃষ্টি’ করে কিছু মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং এর অধীনস্ত সংস্থার ক্রয় কার্যক্রম ডিপিএম’র মাধ্যমে করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনৈতিক তৎপরতা, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা প্রকল্প দলিল) উপেক্ষা করে ক্রয়-কার্যক্রম পরিচালনা, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার চেষ্টা, ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণাসহ নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদকে বলেছেন, ‘যারা ই-জিপি প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে ডিপিএম করছে, তারা প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করছেন, দ্বিতীয়ত তারা নিজেদের সুবিধা অর্জনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। কারণ এটার মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার ই-জিপি হলেই যে দুর্নীতি হবে না, সেটাও না। ই-জিপিতেও দুর্নীতি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের একটি গবেষণা আসছে।’
যেভাবে ডিপিএম হয়
ডিপিএম প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিপিএম করার লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে দরপত্রে অনাবশ্যকভাবে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, যাতে দরদাতা কোন প্রতিষ্ঠান কাজ না পায়। অনেক ক্ষেত্রে ডিপিএম’র মধ্যস্থতাকারীর পরামর্শ অনুযায়ী শর্ত ঠিক করা হয়। এতে দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য সরবরাহে অযোগ্য ও অসামর্থ্য বিবেচিত হয়। এই সুযোগেই ডিপিএম’র মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিরা প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তারা আলোচনা সাপেক্ষে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা হবে সেই প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ন্যূনতম ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সরকারের একটি বিভাগের জন্য প্রায় ২০ কোটি টাকায় চার হাজার পিস ল্যাপটপ কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয় একটি প্রকল্পের অধীনে। দরপত্রে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেশে উৎপাদন, সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা থাকতে হবে। পাশাপাশি ওই প্রতিষ্ঠানের ৬৪ জেলায় আইএসও সার্টিফাইড শাখা থাকতে হবে। এই ধরনের পণ্য সরবরাহে দেশে প্রায় অর্ধশত বিশ^খ্যাত ল্যাপটপ ব্র্যান্ডের এজেন্ট থাকলেও তারা ওই দুটি শর্তের কারণে দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দরপত্র উন্মুক্ত করে দেখা যায়, মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান শিডিউল জমা দিয়েছে, যার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ওই দুটি শর্ত পূরণে সক্ষম। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান ওই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কিছু পণ্য সরবরাহের কাজ পেতে পারে।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গত বছর পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২৫টি সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল। এগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন অধিদফতর ও সংস্থাকে। ওইসব সমস্যার মধ্যেও দরপত্র সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয় ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০১১ সালের ২ জুন এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিওরমেন্ট (ই-জিপি) ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ওয়েব পোর্টাল সময়োপযোগী সংযোজন।’
প্রধানমন্ত্রী ওই বক্তবের পর পর্যায়ক্রমে প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগেই ই-জিপি কার্যক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ক্রয় প্রক্রিয়ায় ইচ্ছেকৃতভাবে জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ডিপিএম কার্যক্রমে অতিউৎসাহী হচ্ছেন।
ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয়ের ক্ষেত্রে পিপিআরএ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যা ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয়ের অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। কিন্তু এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেস্বী কর্মকর্তা বা ব্যক্তি নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ডিপিএম’র ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘যে সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ও সযোজিত দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে, কেবল মাত্র সে সব প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয় করা যেতে পারে।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা রয়েছে, কোন প্রকল্পে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটার সুযোগ রয়েছে।’
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল কমিটির (সিপিটিইউ) মতামত উপেক্ষা করেই ডিপিএম প্রক্রিয়ায় ক্রয়-কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হচ্ছে।
ডিপিএম প্রক্রিয়ায় পণ্য ক্রয়ের চেষ্টা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ঝুলে গেছে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডয়া ক্লাসরুম স্থাপন কার্যক্রম। এ বিষয়ে প্রায় ছয়মাস আগে সিপিটিইউ’র মতামত নেয়ার পরও দরপত্র কার্যক্রম চূড়ান্ত হচ্ছে না।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ সংবাদকে বলেন, ‘আসলে টেন্ডারে পণ্যের মূল্য কিছুটা বেশি দেখা গেছে। এজন্য কার্যক্রমটি পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আমার একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি পক্ষ ‘দরপত্র’ বাদ দিয়ে এখন ‘ডিপিএম’ প্রক্রিয়ায় দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া ক্রয় করতে চায়।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আইসিটি’র মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (২য় পর্যায়)’র অধীনে তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল গত জুনের মধ্যে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেম- ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। গড়ে একটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও পরবর্তীতে প্রকল্পের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা নানা জটিলতা সৃষ্টি করে ‘ডিপিএম’ প্রক্রিয়ায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেন কেনার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরপরই লালফিতায় আটকে পড়ে প্রকল্পটি। প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন নাগাদ। একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে এই প্রকল্পে বিপুল অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ হলেও কারোর শাস্তি হয়নি।