মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানার অগ্নিকাণ্ডের ইতিহাস বড়ই ভয়াবহ। সেখানে আগুন লাগছে কেমিক্যাল কারখানা আর গুদামে। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে মানুষ। বিনষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। পথে বসছে হাজারো পরিবার। কত স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে। চরম অনিশ্চয়তার মাঝে কাটছে পুরান ঢাকার লাখো মানুষের জীবন। ২০১০ সালের ৩ জুনে ভয়াবহ সেই দিনের সূত্রপাত। সেদিন প্রায় ৩০ লাখের অধিক মানুষের বসতি পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নেয় ১২৪টি তরতাজা প্রাণ। আহত হন ২ শত জনের বেশি। অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় এলাকার ১১টি ভবন। একটি ভবনের রান্নার চুলা থেকে নিচতলার গোডাউনে রক্ষিত ড্রামভর্তি বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মিথাইল ক্লোরাইডে আগুন লেগে যায়। পরে তা পার্শ¦বর্তী রাস্তার ওপরে রাখা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারের বিস্ফোরণ ঘটায় এবং কাছাকাছি ভবনগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দাহ্য কেমিক্যালের তীব্র আগুন, পর্যাপ্ত আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম এবং পানির অপ্রতুলতা, গাদাগাদি গড়ে-ওঠা ভবনের মাঝে সরুগলিতে যানবাহন চলাচলে নানা প্রতিকূলতায় বাড়তে থাকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা।
পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। কতিপয় লোভী ও অপরিণামদর্শী মানুষের অসচেনতার কারণে সেদিন এতগুলো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। চকবাজারের চুড়িহাট্টার বৃহৎ ভবন ওয়াহেদ ম্যানসনের দোতলায় মজুতকৃত রাসায়সিক পদার্থের বিস্ফোরণে আগুন দেশের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার আরেকটি প্রমাণ। সেখানে পুড়ে অঙ্গার হলো ৭৯টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হয় ৪১ জন। সম্পূর্ণ পুড়ে গেল ৫টি ভবন। ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ছিল ড্রাম ও বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালের মজুত। পুরান ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানা, রাসায়নিক গুদামে দাহ্য পদার্থ মজুতের পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে নিমতলী, ওয়াহেদ ম্যানশন ট্র্যাজেডির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এর জ্বলন্ত প্রমাণ। ঈদের ছুটিতে কারখানা বন্ধ না থাকলে লালবাগের পোস্তায় সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ তৈরি কারখানায়ও সেদিন প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি চুড়িহাট্টা বা নিমতলীকেও ছাড়িয়ে যেতে পারত।
দমকল বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনে অন্তত দুই শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু দুর্ভগ্যজনকভাবে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের দোকান ও গুদাম সরানো হয়নি আজও। উপরন্তু কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম বন্ধ করে দেয়ার সরকারি উদ্যোগও থেমে যাওয়ার ফলে দীর্ঘ সময় পরেও সেখানকার মানুষের জীবনঝুঁকির অবসান ঘটেনি। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪৫টি ওষুধ মার্কেটে প্রায় আড়াই হাজার ওষুধের দোকানের গোডাউন আছে প্রায় ৮ হাজার। এসব গোডাউনের অনেকগুলোতেই ড্রামভর্তি রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ এবং ফসফরাস জাতীয় দ্রব্য রয়েছে। এমনকি অনেক বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুতের জন্য ভাড়া দেন। অনেক বসতবাড়ির নিচতলা বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের নিজস্ব কারখানা ও গুদাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ গুদামে মজুত থাকে বিপুল পরিমান প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির কেমিক্যাল, এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশন। এসব কারখানা ও গুদামের বেশিরভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস বা ডিডিসি’র ছাড়পত্র নেই।
বিশেষজ্ঞের মতে, এরমধ্যে বেশকিছু কেমিক্যালের একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের তালিকায় থিনার-বি, থিনার-সি, এসিটেট, ইথানল, ইথাইল এসিটেট, টলুইন, প্রোপাইলিন এলকোহল, প্রোপাইলিন গ্লাইকলসহ ২০টি দাহ্য পদার্থকে চিহ্নিত করে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরনো ঢাকার সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা স্থাপন, রাসায়নিক পদার্থের মজুত ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সে সময় নিমতলী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয়। আদালত অভিযান চালিয়ে ১০৪টি মামলা করে ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। গঠিত দুটি কমিটি পুরান ঢাকায় ৮০০টি উচ্চমাত্রার বিপজ্জনক রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানার তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সুপারিশের পাশাপাশি টাস্কফোর্স গঠন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়িত না হলেও আবাসিক ভবনের নিচে মজুতকৃত কিছু কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ উদ্ধার ও মিডফোর্ডের ৪টি গুদাম সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল।
২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সময় বেধে সরকার ব্যবসায়ীদের সব রাসায়নিক দোকান ও গুদাম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীর চর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে কেরানীগঞ্জে ২০ একর জমির ওপর রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তব রূপ নেয়নি। এ পল্লীতে ১৭টি ভবনে ১০৭৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিমুক্তভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কথা ছিল। রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী লাল-হলুদ বিপদ সংকেতযুক্ত সাইনবোর্ড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করাসহ হোল্ডিংয়ে লোকজন বসবাস নিষিদ্ধ ঘোষণারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসবের কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১৯ সালে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাদিখানে বিসিকের কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। অর্থের জোগান না থাকায় গত নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও ৮০০ কোটি টাকা চায় বিসিক। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবধি জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয়নি। অন্যদিকে শ্যামপুরে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৪টি কেমিক্যাল গুদাম নির্মাণের প্রকল্প চলতি বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেশের পেনডেমিক পরিস্থিতিতে কাজের তেমন অগ্রগতি নেই। অথচ পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেখানকার সব দাহ্য কেমিক্যালের দোকান, গোডাউন দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক দ্রব্য মজুতকারীদের জন্য ফায়ার লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা অত্যাবশ্যক। যতদিন পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালের হাত থেকে মুক্ত করা না যায় ততদিন পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অগ্নিকাণ্ডকে দ্রুত মোকাবিলার জন্য বুড়িগঙ্গার পানি তুলে পুরনো ঢাকার সরু অলিগলিতে ফায়ার-হাইড্রেন্ট বসানো প্রয়োজন। পুরান ঢাকার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ডিডিসি, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সম্মিলিত কার্যকর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অগ্নিনির্বাপণের কার্যক্রমকে সক্রিয় করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি দিয়ে দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে দমকল বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করার কোনো বিকল্প নেই। পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ প্রতিটি পাড়া, মহল্লায় স্থানীয়ভাবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]
বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট ২০২০ , ৭ মহররম ১৪৪২, ২৭ আগস্ট ২০২০
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানার অগ্নিকাণ্ডের ইতিহাস বড়ই ভয়াবহ। সেখানে আগুন লাগছে কেমিক্যাল কারখানা আর গুদামে। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে মানুষ। বিনষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। পথে বসছে হাজারো পরিবার। কত স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে। চরম অনিশ্চয়তার মাঝে কাটছে পুরান ঢাকার লাখো মানুষের জীবন। ২০১০ সালের ৩ জুনে ভয়াবহ সেই দিনের সূত্রপাত। সেদিন প্রায় ৩০ লাখের অধিক মানুষের বসতি পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নেয় ১২৪টি তরতাজা প্রাণ। আহত হন ২ শত জনের বেশি। অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় এলাকার ১১টি ভবন। একটি ভবনের রান্নার চুলা থেকে নিচতলার গোডাউনে রক্ষিত ড্রামভর্তি বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মিথাইল ক্লোরাইডে আগুন লেগে যায়। পরে তা পার্শ¦বর্তী রাস্তার ওপরে রাখা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারের বিস্ফোরণ ঘটায় এবং কাছাকাছি ভবনগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দাহ্য কেমিক্যালের তীব্র আগুন, পর্যাপ্ত আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম এবং পানির অপ্রতুলতা, গাদাগাদি গড়ে-ওঠা ভবনের মাঝে সরুগলিতে যানবাহন চলাচলে নানা প্রতিকূলতায় বাড়তে থাকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা।
পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। কতিপয় লোভী ও অপরিণামদর্শী মানুষের অসচেনতার কারণে সেদিন এতগুলো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। চকবাজারের চুড়িহাট্টার বৃহৎ ভবন ওয়াহেদ ম্যানসনের দোতলায় মজুতকৃত রাসায়সিক পদার্থের বিস্ফোরণে আগুন দেশের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার আরেকটি প্রমাণ। সেখানে পুড়ে অঙ্গার হলো ৭৯টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হয় ৪১ জন। সম্পূর্ণ পুড়ে গেল ৫টি ভবন। ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ছিল ড্রাম ও বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালের মজুত। পুরান ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানা, রাসায়নিক গুদামে দাহ্য পদার্থ মজুতের পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে নিমতলী, ওয়াহেদ ম্যানশন ট্র্যাজেডির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এর জ্বলন্ত প্রমাণ। ঈদের ছুটিতে কারখানা বন্ধ না থাকলে লালবাগের পোস্তায় সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ তৈরি কারখানায়ও সেদিন প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি চুড়িহাট্টা বা নিমতলীকেও ছাড়িয়ে যেতে পারত।
দমকল বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনে অন্তত দুই শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু দুর্ভগ্যজনকভাবে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের দোকান ও গুদাম সরানো হয়নি আজও। উপরন্তু কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম বন্ধ করে দেয়ার সরকারি উদ্যোগও থেমে যাওয়ার ফলে দীর্ঘ সময় পরেও সেখানকার মানুষের জীবনঝুঁকির অবসান ঘটেনি। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪৫টি ওষুধ মার্কেটে প্রায় আড়াই হাজার ওষুধের দোকানের গোডাউন আছে প্রায় ৮ হাজার। এসব গোডাউনের অনেকগুলোতেই ড্রামভর্তি রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ এবং ফসফরাস জাতীয় দ্রব্য রয়েছে। এমনকি অনেক বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুতের জন্য ভাড়া দেন। অনেক বসতবাড়ির নিচতলা বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের নিজস্ব কারখানা ও গুদাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ গুদামে মজুত থাকে বিপুল পরিমান প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির কেমিক্যাল, এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশন। এসব কারখানা ও গুদামের বেশিরভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস বা ডিডিসি’র ছাড়পত্র নেই।
বিশেষজ্ঞের মতে, এরমধ্যে বেশকিছু কেমিক্যালের একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের তালিকায় থিনার-বি, থিনার-সি, এসিটেট, ইথানল, ইথাইল এসিটেট, টলুইন, প্রোপাইলিন এলকোহল, প্রোপাইলিন গ্লাইকলসহ ২০টি দাহ্য পদার্থকে চিহ্নিত করে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরনো ঢাকার সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা স্থাপন, রাসায়নিক পদার্থের মজুত ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সে সময় নিমতলী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয়। আদালত অভিযান চালিয়ে ১০৪টি মামলা করে ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। গঠিত দুটি কমিটি পুরান ঢাকায় ৮০০টি উচ্চমাত্রার বিপজ্জনক রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানার তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সুপারিশের পাশাপাশি টাস্কফোর্স গঠন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়িত না হলেও আবাসিক ভবনের নিচে মজুতকৃত কিছু কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ উদ্ধার ও মিডফোর্ডের ৪টি গুদাম সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল।
২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সময় বেধে সরকার ব্যবসায়ীদের সব রাসায়নিক দোকান ও গুদাম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীর চর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে কেরানীগঞ্জে ২০ একর জমির ওপর রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তব রূপ নেয়নি। এ পল্লীতে ১৭টি ভবনে ১০৭৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিমুক্তভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কথা ছিল। রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী লাল-হলুদ বিপদ সংকেতযুক্ত সাইনবোর্ড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করাসহ হোল্ডিংয়ে লোকজন বসবাস নিষিদ্ধ ঘোষণারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসবের কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১৯ সালে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাদিখানে বিসিকের কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। অর্থের জোগান না থাকায় গত নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও ৮০০ কোটি টাকা চায় বিসিক। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবধি জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয়নি। অন্যদিকে শ্যামপুরে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৪টি কেমিক্যাল গুদাম নির্মাণের প্রকল্প চলতি বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেশের পেনডেমিক পরিস্থিতিতে কাজের তেমন অগ্রগতি নেই। অথচ পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেখানকার সব দাহ্য কেমিক্যালের দোকান, গোডাউন দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক দ্রব্য মজুতকারীদের জন্য ফায়ার লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা অত্যাবশ্যক। যতদিন পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালের হাত থেকে মুক্ত করা না যায় ততদিন পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অগ্নিকাণ্ডকে দ্রুত মোকাবিলার জন্য বুড়িগঙ্গার পানি তুলে পুরনো ঢাকার সরু অলিগলিতে ফায়ার-হাইড্রেন্ট বসানো প্রয়োজন। পুরান ঢাকার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ডিডিসি, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সম্মিলিত কার্যকর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অগ্নিনির্বাপণের কার্যক্রমকে সক্রিয় করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি দিয়ে দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে দমকল বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করার কোনো বিকল্প নেই। পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ প্রতিটি পাড়া, মহল্লায় স্থানীয়ভাবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]