বাজার সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিনে

বছরে উৎপাদন ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বছরে ৩ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে ঢাকায় একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ৪টি পলিথিন ব্যবহার করে করোনা সুরক্ষাসামগ্রী প্লাস্টিক বর্জ্য একমাসে সাড়ে ১৪ হাজার টন উৎপাদিত পলিথিন বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নেই : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়ছে : দাবি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের

সারাদেশে পলিথিন উৎপাদন, ব্যবহারে সরকারের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব নেই। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) পরিসংখ্যানে শুধু ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হওয়ার তথ্য রয়েছে। আর ওয়েস্ট কনসার্ন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। যার বেশিরভাগ পুনরায় ব্যবহার হয় না।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস, সবজিসহ সব পণ্যের জন্য নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বাজার করতে আসা বেশিরভাগ ক্রেতা একটা পণ্যের জন্য একটা পলিথিন ব্যবহার করলেও আবদুল গণি নামে এক ক্রেতা ১০টি পণ্যের জন্য ২০টি নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করেন। তিনি একদিনে পুরো সপ্তাহের বাজার করেছেন। প্রতিটি পণ্যের জন্য মানুষ একটা পলিথিন ব্যবহার করেন, আপনি কেন দুটি পলিথিন ব্যবহার করছেন এমন প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পলিথিনের দিকে ইঙ্গিত করতেই বললেন, বাজারে তো পলিথিন ছাড়া অন্য কিছু নাই। কিসে নিব তাহলে? ফ্রিজে মাছ, মাংস রাখতে পলিথিন দরকার। সেজন্য প্রতিটি পণ্যের জন্য দুটি করে পলিথিন নিয়েছেন। আবদুল গণির মতো পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করছেন। এসব কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার কমেনি।

ওয়েস্ট কনসার্নের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর কমবেশি ১০ লাখ টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে। এরমধ্যে বছরে তিন লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা, খাল-বিল ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে। আবার এক কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এতে প্রতিবছর ১০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। আর শুধু ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। দেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার কমবেশি ১ বিলিয়ন ডলার। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার হয় প্যাকেজিংয়ে। এ খাতে প্রায় ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ, বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনে ব্যবহার হয় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ, অটোমোবাইলে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ইলেক্ট্রনিক্সে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কৃষিতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে বছরে ৫০ হাজা কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে প্রতিবছর এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়।

পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর কমবেশি ২ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করে। এ থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। এরমধ্যে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ প্লাস্টিক, যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৭০০ টন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৫০ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। আর বাকি ৫০ শতাংশ বিভিন্নভাবে নদী, খাল, বিল ও রাস্তার দু’পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)’র গবেষণা তথ্যমতে, বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পলিথিন বাদেও করোনাভাইরাস উপসর্গ ধরা পড়ার পরে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত একমাসে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভসসহ সংশ্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন। শুধু ঢাকায় উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৭৬ টন। যার বড় একটি অংশ যত্রতত্র ফেলার কারণে মাটি ও পানিতে মিশছে।

ঢাকাসহ সারা দেশে ডিপার্টমেন্টাল চেইনশপ থেকে শুরু করে কাঁচাবাজারে মাছ-মাংস, শাক-সবজি সবকিছুই দেয়া হচ্ছে পলিব্যাগে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় অবাধে চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি ও ব্যবহার। অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার। এদিকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকার পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আইন করলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। কঠোর আইন থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে বন্ধ হচ্ছে না নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার।

পলিথিন তৈরির ইথিলিন, পলিকার্বনেট, পলি প্রোপাইলিন ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ বা পলিমারের অণুগুলো পরস্পর এত সুষ্ঠু ও শক্তভাবে থাকে যে, সেখানে কোন অণুজীব যেমন-ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রবেশ করতে পারে না। ব্যাকটেরিয়া ময়লা, আবর্জনা পচিয়ে ও খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। অথচ ব্যাকটেরিয়া পলিথিন নষ্ট করতে পারে না। মাটির নিচে বা ওপরে অথবা পানিতে সর্বত্রই পলিথিন পচনহীন অবস্থায় শত শত বছর টিকে থাকে। এরমধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। আর পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ টেকসই ও মজবুত। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা এ পলিব্যাগ কয়েক মাসের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে এটি পরিবেশ দূষণ করে না। এটিকে তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে।

মালিবাগ কাঁচাবাজারে পলিথিনে বাজার করেন লুৎফর রহমান। পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, পলিথিন মাটিতে পচে না, পরিবেশের ক্ষতি করে, পলিথিন বৃষ্টিতে ড্রেনে গিয়ে পড়লে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাজারে পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নেই। চারদিকেই তো পলিথিন আর পলিথিন। বন্ধ করারতো কোন ব্যবস্থা দেখি না। করোনার মধ্যে এখন মানুষ হ্যান্ডগ্লাভস হিসেবে পলিথিন ব্যবহার করছে।

ঢাকার নাখালপাড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ তা জানি। কিন্তু পলিথিন ব্যবহারে ঝক্কিঝামেলা কম। মানুষ এ কারণে এটি ব্যবহার করে। আমরাও করি। পরিবেশের জন্য পলিথিন ক্ষতিকর এটা সবাই জানে। তারপরও জেনেশুনে ব্যবহার করে। তিনি আরও বলেন, হাত বাড়ালেই পলিথিন পাই। পলিথিন সহজলভ্য না হলে তো আমরা এটা ব্যবহার করতে পারতাম না।

সরজমিনে দেখা গেছে, পলিথিন ব্যবহার আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও বাজারে পলিথিনের ব্যবহার চলছে দেদার। বিভিন্ন দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সাইজের পলিথিন। বাজারের বিভিন্ন দোকান ঘুরে কাস্টমাররা নির্বিঘেœ কিনছে পলিথিন। পলিথিন ব্যাগের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে তৈরি হচ্ছে হাতল ছাড়া পলিথিনের ব্যাগ। আর হাতলওয়ালা ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার তিন থেকে চার হাজার টাকা। চকবাজারের দোকানি ফিরোজ মান্নান বলেন, বেশিরভাগ দোকানে পলিথিন পাওয়া যায়। যারা কিনতে আসে তারা সহজেই পেয়ে যায়। আগে থেকে অর্ডার দিলে সাইজ অনুযায়ী পলিথিন ব্যাগ বানিয়ে দেয়া যায়। অন্যদিকে, রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ রেলগেট, খিলগাঁও রেলগেট, বাদামতলী ঘাট ও কারওয়ান বাজারে পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, সার, চাল, আদা, রসুন ও পিয়াজ বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে কিছু দোকানে চালের ক্ষেত্রে পাটের বস্তার ব্যবহার দেখা গেছে। বাকি পণ্যগুলোর জন্য আগের মতোই প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু রাজধানীতে প্রতিদিন কমবেশি দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যবহার হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির কারখানা কমবেশি দুই হাজার। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক।

বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পলিথিন বন্ধের কথা বলা হচ্ছে না, আমরা পলিথিন বন্ধের কথা বলছি। বিশ্বের অনেক দেশে পলিথিন ব্যবহার নেই। রুয়ান্ডায় পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। ওই দেশে পলিথিন নিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। আমাদের দেশে পলিথিন নিষিদ্ধে সরকার আইন পাশ করেছে। কিন্তু সেই আইন প্রথম দুই বছর প্রয়োগ করে, এরপর আইনের আর প্রয়োগ নেই। পলিথিনের বিকল্প সরকার বাজারে নিয়ে আসেনি এবং আইন বাস্তবায়ন করেনি। আর পলিথিনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযান চালানো হয় সেগুলো লোক দেখানো। কারণ এসব অভিযানে ন্যূনতম কার্যকারিতা নেই। কারণ প্রকাশে বাজারে পলিথিন উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। শপিং সেন্টারে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধ করতে হবে। ফ্রিজে মাছ ও মাংস রাখার জন্য বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন আনা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান সংবাদকে বলেন, বিশ্বব্যাপী পলিথিন বিরোধী আন্দোলন চলছে। সমুদ্রে পাহাড়সমান পলিথিন জমেছে। মাটিতে পলিথিন নষ্ট হতে কয়েকশ’ বছর সময় লাগে। কৃষি ভূমির গুণগত মান নষ্ট করে ফসল উৎপাদনে ব্যঘাত সৃষ্টি করে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে পলিথিনের কারণে নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। আবার যেসব পলিথিন সমুদ্রে যায় কিছুদিন পর পলিথিন গুঁড়ি গুঁড়ি কণা হয়, সেই কণা মাছ খাচ্ছে। সেই মাছ আবার মানুষ খাওয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। পলিথিনের ক্ষতি সরকারি আমলা ও সাধারণ মানুষ সবাই জানেন। সরষের মধ্যে ভূত থাকার কারণে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। পলিথিন বিরোধী আইন তৈরি করার পর কঠোরভাবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই আইনের প্রয়োগ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে জেলা পর্যায়ে পরিবেশ অধিদফতর অভিযান চালায়, যা হাস্যকর। কারণ পলিথিন তো জেলা শহরে উৎপাদন হয় না, রাজধানীতে উৎপাদন হয়। পলিথিন উৎপাদন কেন্দ্র ঢাকায় কারখানা বন্ধ করা হচ্ছে না। পলিথিন দমনে বছরের পর বছর শুধু অভিযান চলে। এসব অভিযানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা ও কারাদ- দেয়া হয়। তবে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না একটুও। আইনের প্রয়োগ এবং পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় দিনদিন বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন বিরোধী আইন যখন করা হয় তখন পরিবেশ অধিদফতরের লোকবল ছিল কয়েকজন এখন কয়েকশ’ জনবল রয়েছে। সদিচ্ছার অভাবে বাজারে পলিথিন বন্ধ সম্ভব হচ্ছে না।

২০০২ সালের ৮ এপ্রিল পরিবেশ অধিদফতর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছু শর্ত সাপেক্ষে পলিথিনের সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে। সেই সময় আইনটি বেশ সফলভাবে প্রয়োগও হয়। কাগজের ঠোঙা আর কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন ক্রেতারা। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণেই নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ ফিরে এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন আবদুস সোবহান।

জানা গেছে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দুই দফায় আদেশ মোট ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এসব আইন-নির্দেশ উপেক্ষা করে চাল ও মিলমালিকেরা আগের মতো প্লাস্টিকের বস্তায় বিপণন করে চলেছেন।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, ১৯টি পণ্যের মোড়ক পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে জেলা শহরে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চললেও রাজধানীতে অভিযান হচ্ছে না। ওই আদেশের পর প্রথম দিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছিল। তবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাবে আগের মতো ঢিলেমি অবস্থায় চলে এসেছে।

বিভিন্ন পণ্যে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবুল কালাম সংবাদকে বলেন, গত ৬ মাস যাবৎ করোনার সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। ১৯টি পণ্যে পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। প্রথম দিকে নির্দেশনা বাস্তবায়নে জনগণকে জানাতে বড় পরিসরে অভিযান চালানো হয়েছিল। তবে এখন পাটের তৈরি ঝুঁড়ি ও ব্যাগের ব্যবহার তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে পাটপণ্যের ব্যবহার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।

দীর্ঘদিন পাটের তৈরি পলিথিনের কথা জনগণ শুনছেন, এটি কি রূপকথার গল্পের মতো রয়ে গেল এমন প্রশ্নে মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ অল্প আকারে উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ ১০ টাকায় বিক্রি করছে। এই দাম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পাটের পলিথিন ব্যাগ পরিবশেবান্ধব কিনা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চলছে। করোনার কারণে পরীক্ষার ফলাফল দেরি হয়েছে। পরিবেশবান্ধব হলে বড় পরিসরে পাটের তৈরি পলিথিন বাজারে নিয়ে এসে জনগণের নাগালের কাছাকাছি দাম রাখা হবে। নিষিদ্ধ পলিথিনের দাম কম ও ক্রেতাদের হাতের নাগালে পাওয়ায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি দফতর ও অফিসগুলোতে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়ছে।

চকবাজারে পলিথিন পাইকার আশরাফুজ্জামান বলেন, সারাদেশে পলিথিনের চাহিদা এতোটাই বেড়েছে যে সাপ্লাই দিতে পারছি না। একটা মেশিনে দিনে ৫০ মন পলিথিন উৎপাদন করছি। আরেকটা মেশিন হলে ভালো হতো। করোনা শেষ হলে আরেকটি পলিথিন উৎপাদন মেশিন কিনবেন আশরাফুজ্জামান।

চকবাজারে লায়লা পাইকারি পলিথিন দোকানের মালিক হাফিজুর রহমান শেখ বলেন, সাদা পলিথিনের ব্যাগ কেজি আকারে বিক্রি হয় আর রঙিন পলিথিন ইঞ্চি আকারে। সাদা পলিথিনের কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা আর রঙিন পলিথিনের কেজি কমবেশি ২০০ টাকায় বিক্রি করেন। চকবাজারের এই দোকানের মতো সারি সারি পলিথিনের দোকান রয়েছে।

বাজারি পণ্য, চকলেটের খোসা থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির চেয়ারটেবিল পর্যন্ত প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে দিনকে দিন। পলিথিন ও প্লাস্টিক–দূষণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও চিন্তিত। ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে ২০০২ সালে প্রথম পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। সেসময় বিকল্প হিসেবে কাগজের ঠোঙা ব্যবহার বেড়েছিল। তবু অগ্রগতি হয়নি।

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০ , ৮ মহররম ১৪৪২, ২৮ আগস্ট ২০২০

বাজার সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিনে

বছরে উৎপাদন ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বছরে ৩ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে ঢাকায় একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ৪টি পলিথিন ব্যবহার করে করোনা সুরক্ষাসামগ্রী প্লাস্টিক বর্জ্য একমাসে সাড়ে ১৪ হাজার টন উৎপাদিত পলিথিন বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নেই : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়ছে : দাবি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের

ফারুক আলম

image

প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে যেখানে সেখানে। উন্মুক্ত স্থান, নদী-নালায় ফেলা এসব প্লাস্টিক ক্ষতি করছে পরিবেশের। রাজধানীর একটি স্থান থেকে তোলা -সহোরাব আলম

সারাদেশে পলিথিন উৎপাদন, ব্যবহারে সরকারের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব নেই। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) পরিসংখ্যানে শুধু ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হওয়ার তথ্য রয়েছে। আর ওয়েস্ট কনসার্ন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। যার বেশিরভাগ পুনরায় ব্যবহার হয় না।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস, সবজিসহ সব পণ্যের জন্য নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বাজার করতে আসা বেশিরভাগ ক্রেতা একটা পণ্যের জন্য একটা পলিথিন ব্যবহার করলেও আবদুল গণি নামে এক ক্রেতা ১০টি পণ্যের জন্য ২০টি নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করেন। তিনি একদিনে পুরো সপ্তাহের বাজার করেছেন। প্রতিটি পণ্যের জন্য মানুষ একটা পলিথিন ব্যবহার করেন, আপনি কেন দুটি পলিথিন ব্যবহার করছেন এমন প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পলিথিনের দিকে ইঙ্গিত করতেই বললেন, বাজারে তো পলিথিন ছাড়া অন্য কিছু নাই। কিসে নিব তাহলে? ফ্রিজে মাছ, মাংস রাখতে পলিথিন দরকার। সেজন্য প্রতিটি পণ্যের জন্য দুটি করে পলিথিন নিয়েছেন। আবদুল গণির মতো পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করছেন। এসব কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার কমেনি।

ওয়েস্ট কনসার্নের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর কমবেশি ১০ লাখ টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে। এরমধ্যে বছরে তিন লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা, খাল-বিল ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে। আবার এক কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এতে প্রতিবছর ১০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। আর শুধু ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। দেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার কমবেশি ১ বিলিয়ন ডলার। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার হয় প্যাকেজিংয়ে। এ খাতে প্রায় ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ, বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনে ব্যবহার হয় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ, অটোমোবাইলে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ইলেক্ট্রনিক্সে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কৃষিতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে বছরে ৫০ হাজা কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে প্রতিবছর এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়।

পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর কমবেশি ২ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করে। এ থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। এরমধ্যে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ প্লাস্টিক, যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৭০০ টন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৫০ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। আর বাকি ৫০ শতাংশ বিভিন্নভাবে নদী, খাল, বিল ও রাস্তার দু’পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)’র গবেষণা তথ্যমতে, বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পলিথিন বাদেও করোনাভাইরাস উপসর্গ ধরা পড়ার পরে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত একমাসে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভসসহ সংশ্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন। শুধু ঢাকায় উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৭৬ টন। যার বড় একটি অংশ যত্রতত্র ফেলার কারণে মাটি ও পানিতে মিশছে।

ঢাকাসহ সারা দেশে ডিপার্টমেন্টাল চেইনশপ থেকে শুরু করে কাঁচাবাজারে মাছ-মাংস, শাক-সবজি সবকিছুই দেয়া হচ্ছে পলিব্যাগে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় অবাধে চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি ও ব্যবহার। অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার। এদিকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকার পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আইন করলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। কঠোর আইন থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে বন্ধ হচ্ছে না নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার।

পলিথিন তৈরির ইথিলিন, পলিকার্বনেট, পলি প্রোপাইলিন ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ বা পলিমারের অণুগুলো পরস্পর এত সুষ্ঠু ও শক্তভাবে থাকে যে, সেখানে কোন অণুজীব যেমন-ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রবেশ করতে পারে না। ব্যাকটেরিয়া ময়লা, আবর্জনা পচিয়ে ও খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। অথচ ব্যাকটেরিয়া পলিথিন নষ্ট করতে পারে না। মাটির নিচে বা ওপরে অথবা পানিতে সর্বত্রই পলিথিন পচনহীন অবস্থায় শত শত বছর টিকে থাকে। এরমধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। আর পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ টেকসই ও মজবুত। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা এ পলিব্যাগ কয়েক মাসের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে এটি পরিবেশ দূষণ করে না। এটিকে তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে।

মালিবাগ কাঁচাবাজারে পলিথিনে বাজার করেন লুৎফর রহমান। পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, পলিথিন মাটিতে পচে না, পরিবেশের ক্ষতি করে, পলিথিন বৃষ্টিতে ড্রেনে গিয়ে পড়লে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাজারে পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নেই। চারদিকেই তো পলিথিন আর পলিথিন। বন্ধ করারতো কোন ব্যবস্থা দেখি না। করোনার মধ্যে এখন মানুষ হ্যান্ডগ্লাভস হিসেবে পলিথিন ব্যবহার করছে।

ঢাকার নাখালপাড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ তা জানি। কিন্তু পলিথিন ব্যবহারে ঝক্কিঝামেলা কম। মানুষ এ কারণে এটি ব্যবহার করে। আমরাও করি। পরিবেশের জন্য পলিথিন ক্ষতিকর এটা সবাই জানে। তারপরও জেনেশুনে ব্যবহার করে। তিনি আরও বলেন, হাত বাড়ালেই পলিথিন পাই। পলিথিন সহজলভ্য না হলে তো আমরা এটা ব্যবহার করতে পারতাম না।

সরজমিনে দেখা গেছে, পলিথিন ব্যবহার আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও বাজারে পলিথিনের ব্যবহার চলছে দেদার। বিভিন্ন দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সাইজের পলিথিন। বাজারের বিভিন্ন দোকান ঘুরে কাস্টমাররা নির্বিঘেœ কিনছে পলিথিন। পলিথিন ব্যাগের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে তৈরি হচ্ছে হাতল ছাড়া পলিথিনের ব্যাগ। আর হাতলওয়ালা ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার তিন থেকে চার হাজার টাকা। চকবাজারের দোকানি ফিরোজ মান্নান বলেন, বেশিরভাগ দোকানে পলিথিন পাওয়া যায়। যারা কিনতে আসে তারা সহজেই পেয়ে যায়। আগে থেকে অর্ডার দিলে সাইজ অনুযায়ী পলিথিন ব্যাগ বানিয়ে দেয়া যায়। অন্যদিকে, রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ রেলগেট, খিলগাঁও রেলগেট, বাদামতলী ঘাট ও কারওয়ান বাজারে পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, সার, চাল, আদা, রসুন ও পিয়াজ বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে কিছু দোকানে চালের ক্ষেত্রে পাটের বস্তার ব্যবহার দেখা গেছে। বাকি পণ্যগুলোর জন্য আগের মতোই প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু রাজধানীতে প্রতিদিন কমবেশি দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যবহার হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির কারখানা কমবেশি দুই হাজার। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক।

বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পলিথিন বন্ধের কথা বলা হচ্ছে না, আমরা পলিথিন বন্ধের কথা বলছি। বিশ্বের অনেক দেশে পলিথিন ব্যবহার নেই। রুয়ান্ডায় পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। ওই দেশে পলিথিন নিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। আমাদের দেশে পলিথিন নিষিদ্ধে সরকার আইন পাশ করেছে। কিন্তু সেই আইন প্রথম দুই বছর প্রয়োগ করে, এরপর আইনের আর প্রয়োগ নেই। পলিথিনের বিকল্প সরকার বাজারে নিয়ে আসেনি এবং আইন বাস্তবায়ন করেনি। আর পলিথিনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযান চালানো হয় সেগুলো লোক দেখানো। কারণ এসব অভিযানে ন্যূনতম কার্যকারিতা নেই। কারণ প্রকাশে বাজারে পলিথিন উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। শপিং সেন্টারে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধ করতে হবে। ফ্রিজে মাছ ও মাংস রাখার জন্য বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন আনা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান সংবাদকে বলেন, বিশ্বব্যাপী পলিথিন বিরোধী আন্দোলন চলছে। সমুদ্রে পাহাড়সমান পলিথিন জমেছে। মাটিতে পলিথিন নষ্ট হতে কয়েকশ’ বছর সময় লাগে। কৃষি ভূমির গুণগত মান নষ্ট করে ফসল উৎপাদনে ব্যঘাত সৃষ্টি করে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে পলিথিনের কারণে নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। আবার যেসব পলিথিন সমুদ্রে যায় কিছুদিন পর পলিথিন গুঁড়ি গুঁড়ি কণা হয়, সেই কণা মাছ খাচ্ছে। সেই মাছ আবার মানুষ খাওয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। পলিথিনের ক্ষতি সরকারি আমলা ও সাধারণ মানুষ সবাই জানেন। সরষের মধ্যে ভূত থাকার কারণে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। পলিথিন বিরোধী আইন তৈরি করার পর কঠোরভাবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই আইনের প্রয়োগ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে জেলা পর্যায়ে পরিবেশ অধিদফতর অভিযান চালায়, যা হাস্যকর। কারণ পলিথিন তো জেলা শহরে উৎপাদন হয় না, রাজধানীতে উৎপাদন হয়। পলিথিন উৎপাদন কেন্দ্র ঢাকায় কারখানা বন্ধ করা হচ্ছে না। পলিথিন দমনে বছরের পর বছর শুধু অভিযান চলে। এসব অভিযানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা ও কারাদ- দেয়া হয়। তবে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না একটুও। আইনের প্রয়োগ এবং পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় দিনদিন বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন বিরোধী আইন যখন করা হয় তখন পরিবেশ অধিদফতরের লোকবল ছিল কয়েকজন এখন কয়েকশ’ জনবল রয়েছে। সদিচ্ছার অভাবে বাজারে পলিথিন বন্ধ সম্ভব হচ্ছে না।

২০০২ সালের ৮ এপ্রিল পরিবেশ অধিদফতর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছু শর্ত সাপেক্ষে পলিথিনের সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে। সেই সময় আইনটি বেশ সফলভাবে প্রয়োগও হয়। কাগজের ঠোঙা আর কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন ক্রেতারা। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণেই নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ ফিরে এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন আবদুস সোবহান।

জানা গেছে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দুই দফায় আদেশ মোট ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এসব আইন-নির্দেশ উপেক্ষা করে চাল ও মিলমালিকেরা আগের মতো প্লাস্টিকের বস্তায় বিপণন করে চলেছেন।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, ১৯টি পণ্যের মোড়ক পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে জেলা শহরে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চললেও রাজধানীতে অভিযান হচ্ছে না। ওই আদেশের পর প্রথম দিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছিল। তবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাবে আগের মতো ঢিলেমি অবস্থায় চলে এসেছে।

বিভিন্ন পণ্যে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবুল কালাম সংবাদকে বলেন, গত ৬ মাস যাবৎ করোনার সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। ১৯টি পণ্যে পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। প্রথম দিকে নির্দেশনা বাস্তবায়নে জনগণকে জানাতে বড় পরিসরে অভিযান চালানো হয়েছিল। তবে এখন পাটের তৈরি ঝুঁড়ি ও ব্যাগের ব্যবহার তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে পাটপণ্যের ব্যবহার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।

দীর্ঘদিন পাটের তৈরি পলিথিনের কথা জনগণ শুনছেন, এটি কি রূপকথার গল্পের মতো রয়ে গেল এমন প্রশ্নে মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ অল্প আকারে উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ ১০ টাকায় বিক্রি করছে। এই দাম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পাটের পলিথিন ব্যাগ পরিবশেবান্ধব কিনা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চলছে। করোনার কারণে পরীক্ষার ফলাফল দেরি হয়েছে। পরিবেশবান্ধব হলে বড় পরিসরে পাটের তৈরি পলিথিন বাজারে নিয়ে এসে জনগণের নাগালের কাছাকাছি দাম রাখা হবে। নিষিদ্ধ পলিথিনের দাম কম ও ক্রেতাদের হাতের নাগালে পাওয়ায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি দফতর ও অফিসগুলোতে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়ছে।

চকবাজারে পলিথিন পাইকার আশরাফুজ্জামান বলেন, সারাদেশে পলিথিনের চাহিদা এতোটাই বেড়েছে যে সাপ্লাই দিতে পারছি না। একটা মেশিনে দিনে ৫০ মন পলিথিন উৎপাদন করছি। আরেকটা মেশিন হলে ভালো হতো। করোনা শেষ হলে আরেকটি পলিথিন উৎপাদন মেশিন কিনবেন আশরাফুজ্জামান।

চকবাজারে লায়লা পাইকারি পলিথিন দোকানের মালিক হাফিজুর রহমান শেখ বলেন, সাদা পলিথিনের ব্যাগ কেজি আকারে বিক্রি হয় আর রঙিন পলিথিন ইঞ্চি আকারে। সাদা পলিথিনের কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা আর রঙিন পলিথিনের কেজি কমবেশি ২০০ টাকায় বিক্রি করেন। চকবাজারের এই দোকানের মতো সারি সারি পলিথিনের দোকান রয়েছে।

বাজারি পণ্য, চকলেটের খোসা থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির চেয়ারটেবিল পর্যন্ত প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে দিনকে দিন। পলিথিন ও প্লাস্টিক–দূষণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও চিন্তিত। ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে ২০০২ সালে প্রথম পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। সেসময় বিকল্প হিসেবে কাগজের ঠোঙা ব্যবহার বেড়েছিল। তবু অগ্রগতি হয়নি।