করোনায় গভীর সংকটে শিক্ষা ব্যবস্থা

করোনা মহামারীর কারণে এবার জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাও নেয়া হবে না। ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আরেক দফা বাড়লো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। এ দফায় আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। এ নিয়ে টানা সাত মাসেরও বেশি ছুটির কবলে পড়লো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।

দীর্ঘ ছুটির কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে না পেরে দেশের অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশা খুঁজছেন। সবমিলিয়ে দীর্ঘ সংকটের মুখে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটির ঘোষণা দেয়। দুই মন্ত্রণালয় পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ছুটি বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে জানানো হয়।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাস্তরে অনলাইনেও শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর পর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে সীমিত পরিসরে অফিস ও ১ জুন থেকে গণপরিবহন খুলে দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই রয়েছে।

এলোমেলো পরীক্ষা ব্যবস্থা

দেশে করোনা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি না হওয়ার কারণে এ বছর পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে স্কুলভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া হবে। এজন্য এবার পঞ্চমের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাবে না। উপবৃত্তি যথারীতি চালু থাকবে। প্রতিবছর নভেম্বরে পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হয়।

হবে না জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা

কেন্দ্রীয়ভাবে এবার অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না বলে গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এমএ খায়ের জানান।

তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। তবে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে কি ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে সে বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।’

করোনা পরিস্থিতিতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে মহামারী পরিস্থিতিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব হলেও একাদশ শ্রেণীতে গত ৯ আগস্ট হতে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাস্তরে অনলাইনে সীমিত পরিসরে ক্লাস চালু করেছে সরকারি ও বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়।

পরীক্ষার বিকল্পের খোঁজে দুই মন্ত্রণালয়

দেশে করোনা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী সংকটে রূপ নেয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য বিকল্প পদ্ধতি কী হতে পারে তা খুঁজছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এইচএসসি পরীক্ষা ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণের বিষয়ে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হতে পারে তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গতকাল নিজ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর, সংস্থার প্রধানদের অংশগ্রহণে করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক অনলাইন সভায় এ নির্দেশনা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সভায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম খান এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর, সংস্থার কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন।

সভা শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয় সেক্ষেত্রে এইচএসসি পরীক্ষা ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণের বিষয়ে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হতে পারে সে বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।

সভায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন কার্যক্রম আরও ফলপ্রসূ করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় শিক্ষামন্ত্রী করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত রাখতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্দেশ দেন। সভায় কওমি মাদ্রাসা ছাড়া দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাসস্থানে থাকবে প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীরা

করোনা সংক্রমণ থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য আগামী ৩ অক্টোবর সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডার গার্টেন বন্ধ থাকবে জানিয়ে গতকাল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এ সময়ে নিজেদের ও অন্যদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীগণ নিজ নিজ বাসস্থানে অবস্থান করবে। শিক্ষার্থীদের বাসস্থানে অবস্থানের বিষয়টি অভিভাবকরা নিশ্চিত করবেন এবং স্থানীয় প্রশাসন তা নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করবেন। প্রধান শিক্ষকগণ তাদের শিক্ষার্থীরা যাতে বাসস্থানে অবস্থান করে নিজ নিজ পাঠ্যবই অধ্যয়ন করে সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের মাধ্যমে নিশ্চিত করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা ও অনুশাসনসমূহ মেনে চলতে হবে।’

অর্থসংকটে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

করোনা সংকটে দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিশুদের কিন্ডার গার্টেন, বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, কারিগরি ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান বিক্রিও করে দিচ্ছেন। কোন কোন উদ্যোক্তা ‘ফার্নিচারসহ স্কুল, ‘কলেজ বিক্রি হইবে’-‘স্কুল ভবন ভাড়া হবে’ অথবা ‘টু-লেট’ ঝুলিয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলি, সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে। সারাদেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিক্রি ও বন্ধের তথ্য দিচ্ছেন শিক্ষক সংগঠনগুলো। অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়ে ফল বিক্রি, মুদির দোকান দেয়াসহ দিনমজুরের কাজ করছেন। এই শ্রেণীর বেশিরভাগই শিক্ষক চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে।

শিক্ষক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের সৃষ্টি বিদ্যাপিঠ, রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ঢাকা ক্যাডেট স্কুল, পূর্ব ধোলাইপাড় এলাকার হলিহার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রামপুরার ইকরা আইডিয়াল স্কুল, দনিয়া কদমতলীর ঢাকা কিন্ডার গার্টেন, যাত্রাবাড়ীর আধুনিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ব্রিটেন স্ট্যান্ডার্ড স্কুল, পশ্চিম ধানমন্ডির দীক্ষাপীঠ, মিরপুরের শিশুকানন স্কুল, নতুন জুরাইনের নলেজ হেভেন আইডিয়াল স্কুল, উত্তর মুগদাপাড়ার প্লাজা কিন্ডার গার্টেন।

এছাড়াও মুগদা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুরের শতদল কিন্ডার গার্টেন, আলমবাগের স্কলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, জুরাইন পাইলট স্কুল, নুরে মদিনা কিন্ডার গার্টেন, ব্রাইট কেজি স্কুল, এনপি মিনি ইংলিশ স্কুল এবং আলমবাগ কিন্ডারগার্টেনও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে বিক্রির জন্য বেশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ঝুলানো হয়েছে; এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার ফুলকুঁড়ি কিন্ডার গার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুল, সাভার বাইপাইলে অবস্থিত সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকার কচুক্ষেতে অবস্থিত আইডিয়াল পাবলিক স্কুল, রামপুরার হলিভিশন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যতম। দনিয়া রসুলপুরে ব্লু-বার্ড আইডিয়াল স্কুলও বন্ধ রয়েছে।

এ ব্যাপারে রাজধানীর শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এমএম সাত্তার সংবাদকে বলেন, ‘করোনা মহামারীতে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি সহযোগিতা পেলে বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠান একটু হলেও দাঁড়াতে পারবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের কারিগরি শিক্ষায় আজ যে অর্জন তা কিন্তু বেসরকারি স্তরেই। এজন্য কারিগরি শিক্ষা খাত যে সংকটে পড়েছে তাতে যদি প্রণোদনা না দেয়া হয় তাহলে জননেত্রী শেখ হাসিনার এ অর্জন যেমন গভীর সংকটে পড়বে, তেমনি কতদিনে এ খাত দাঁড়াতে পারবে তা ধারণা করা কঠিন।’

কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি আরও দীর্ঘায়িত হলে কিন্ডার গার্টেন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। বেকার হয়ে পড়বে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সরকারের আর্থিক সহায়তা না পেলে এই ১০ লাখ পরিবার চরম দুর্ভোগে পড়বে।

বর্তমানে সারাদেশে ৬০ হাজারের মতো কিন্ডার গার্টেন এবং সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে জানিয়ে মিজানুর রহমান জানান, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক কোটির বেশি শিশু শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়াও ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০ , ৮ মহররম ১৪৪২, ২৮ আগস্ট ২০২০

করোনায় গভীর সংকটে শিক্ষা ব্যবস্থা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

করোনা মহামারীর কারণে এবার জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাও নেয়া হবে না। ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আরেক দফা বাড়লো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। এ দফায় আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। এ নিয়ে টানা সাত মাসেরও বেশি ছুটির কবলে পড়লো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।

দীর্ঘ ছুটির কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে না পেরে দেশের অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশা খুঁজছেন। সবমিলিয়ে দীর্ঘ সংকটের মুখে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটির ঘোষণা দেয়। দুই মন্ত্রণালয় পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ছুটি বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে জানানো হয়।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাস্তরে অনলাইনেও শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর পর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে সীমিত পরিসরে অফিস ও ১ জুন থেকে গণপরিবহন খুলে দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই রয়েছে।

এলোমেলো পরীক্ষা ব্যবস্থা

দেশে করোনা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি না হওয়ার কারণে এ বছর পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে স্কুলভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া হবে। এজন্য এবার পঞ্চমের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাবে না। উপবৃত্তি যথারীতি চালু থাকবে। প্রতিবছর নভেম্বরে পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হয়।

হবে না জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা

কেন্দ্রীয়ভাবে এবার অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না বলে গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এমএ খায়ের জানান।

তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। তবে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে কি ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে সে বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।’

করোনা পরিস্থিতিতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে মহামারী পরিস্থিতিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব হলেও একাদশ শ্রেণীতে গত ৯ আগস্ট হতে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাস্তরে অনলাইনে সীমিত পরিসরে ক্লাস চালু করেছে সরকারি ও বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়।

পরীক্ষার বিকল্পের খোঁজে দুই মন্ত্রণালয়

দেশে করোনা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী সংকটে রূপ নেয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য বিকল্প পদ্ধতি কী হতে পারে তা খুঁজছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এইচএসসি পরীক্ষা ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণের বিষয়ে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হতে পারে তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গতকাল নিজ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর, সংস্থার প্রধানদের অংশগ্রহণে করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক অনলাইন সভায় এ নির্দেশনা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সভায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম খান এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর, সংস্থার কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন।

সভা শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয় সেক্ষেত্রে এইচএসসি পরীক্ষা ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণের বিষয়ে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হতে পারে সে বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।

সভায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন কার্যক্রম আরও ফলপ্রসূ করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় শিক্ষামন্ত্রী করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত রাখতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্দেশ দেন। সভায় কওমি মাদ্রাসা ছাড়া দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাসস্থানে থাকবে প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীরা

করোনা সংক্রমণ থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য আগামী ৩ অক্টোবর সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডার গার্টেন বন্ধ থাকবে জানিয়ে গতকাল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এ সময়ে নিজেদের ও অন্যদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীগণ নিজ নিজ বাসস্থানে অবস্থান করবে। শিক্ষার্থীদের বাসস্থানে অবস্থানের বিষয়টি অভিভাবকরা নিশ্চিত করবেন এবং স্থানীয় প্রশাসন তা নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করবেন। প্রধান শিক্ষকগণ তাদের শিক্ষার্থীরা যাতে বাসস্থানে অবস্থান করে নিজ নিজ পাঠ্যবই অধ্যয়ন করে সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের মাধ্যমে নিশ্চিত করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা ও অনুশাসনসমূহ মেনে চলতে হবে।’

অর্থসংকটে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

করোনা সংকটে দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিশুদের কিন্ডার গার্টেন, বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, কারিগরি ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান বিক্রিও করে দিচ্ছেন। কোন কোন উদ্যোক্তা ‘ফার্নিচারসহ স্কুল, ‘কলেজ বিক্রি হইবে’-‘স্কুল ভবন ভাড়া হবে’ অথবা ‘টু-লেট’ ঝুলিয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলি, সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে। সারাদেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিক্রি ও বন্ধের তথ্য দিচ্ছেন শিক্ষক সংগঠনগুলো। অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়ে ফল বিক্রি, মুদির দোকান দেয়াসহ দিনমজুরের কাজ করছেন। এই শ্রেণীর বেশিরভাগই শিক্ষক চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে।

শিক্ষক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের সৃষ্টি বিদ্যাপিঠ, রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ঢাকা ক্যাডেট স্কুল, পূর্ব ধোলাইপাড় এলাকার হলিহার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রামপুরার ইকরা আইডিয়াল স্কুল, দনিয়া কদমতলীর ঢাকা কিন্ডার গার্টেন, যাত্রাবাড়ীর আধুনিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ব্রিটেন স্ট্যান্ডার্ড স্কুল, পশ্চিম ধানমন্ডির দীক্ষাপীঠ, মিরপুরের শিশুকানন স্কুল, নতুন জুরাইনের নলেজ হেভেন আইডিয়াল স্কুল, উত্তর মুগদাপাড়ার প্লাজা কিন্ডার গার্টেন।

এছাড়াও মুগদা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুরের শতদল কিন্ডার গার্টেন, আলমবাগের স্কলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, জুরাইন পাইলট স্কুল, নুরে মদিনা কিন্ডার গার্টেন, ব্রাইট কেজি স্কুল, এনপি মিনি ইংলিশ স্কুল এবং আলমবাগ কিন্ডারগার্টেনও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে বিক্রির জন্য বেশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ঝুলানো হয়েছে; এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার ফুলকুঁড়ি কিন্ডার গার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুল, সাভার বাইপাইলে অবস্থিত সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকার কচুক্ষেতে অবস্থিত আইডিয়াল পাবলিক স্কুল, রামপুরার হলিভিশন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যতম। দনিয়া রসুলপুরে ব্লু-বার্ড আইডিয়াল স্কুলও বন্ধ রয়েছে।

এ ব্যাপারে রাজধানীর শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এমএম সাত্তার সংবাদকে বলেন, ‘করোনা মহামারীতে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি সহযোগিতা পেলে বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠান একটু হলেও দাঁড়াতে পারবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের কারিগরি শিক্ষায় আজ যে অর্জন তা কিন্তু বেসরকারি স্তরেই। এজন্য কারিগরি শিক্ষা খাত যে সংকটে পড়েছে তাতে যদি প্রণোদনা না দেয়া হয় তাহলে জননেত্রী শেখ হাসিনার এ অর্জন যেমন গভীর সংকটে পড়বে, তেমনি কতদিনে এ খাত দাঁড়াতে পারবে তা ধারণা করা কঠিন।’

কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি আরও দীর্ঘায়িত হলে কিন্ডার গার্টেন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। বেকার হয়ে পড়বে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সরকারের আর্থিক সহায়তা না পেলে এই ১০ লাখ পরিবার চরম দুর্ভোগে পড়বে।

বর্তমানে সারাদেশে ৬০ হাজারের মতো কিন্ডার গার্টেন এবং সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে জানিয়ে মিজানুর রহমান জানান, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক কোটির বেশি শিশু শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়াও ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।