করোনা সংক্রমণ রোধে ঢিমেতালভাব

সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন নিজেকে

করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তালিকায় গতকাল নতুন করে যোগ হলো ৪৭ জনের নাম। করোনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও ঢিলেঢালাভাব এসেছে স্বাস্থ্যবিভাগ, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে জনগণের মাঝে। করোনাকে যেন পাত্তাই দিচ্ছেন না তারা। প্রতিদিন কমবেশি অর্ধশত মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। এখন করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে, করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু যেন নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে হরহামেশাই বাইরে বের হচ্ছেন নাগরিকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ ও আক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরেই মৃত্যু একটানা চলছে। অনেক বেশি ওপরেও উঠছে না, আবার নিচেও নামছে না। সংক্রমণ একেবারে নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে সেগুলো শতভাগ সফল হচ্ছে না। এজন্যই একটানা চলছে। দেশে করোনার সার্বিক চিত্র পাওয়া গেলে সংক্রমণ কোথায় রয়েছে সেটা কিছুটা হলেও বলা যেতো। আর এ কারণেই দেশে করোনা পরিস্থিতি কোন অবস্থায় রয়েছে, সেটা বলা যাচ্ছে না। দেশে করোনা নিয়ে একটা গোলকধাঁধা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

জানা গেছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে মোট মারা যাওয়া ৪ হাজার ১৭৪ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা বিভাগে। এখানে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ১৯ জন। মৃত্যের সংখ্যা বিচারে ঢাকার পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে মারা গেছেন ৯১১ জন, খুলনা বিভাগে ৩৪৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৭৯ জন, সিলেট বিভাগে ১৮৮ জন, রংপুর বিভাগে ১৮১ জন, বরিশাল বিভাগে ১৬০ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৯ জন।

করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ালেও গতকাল সরেজমিন রাজধানীতে দেখা গেছে, মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এ কারণে অনেকেই নিজের অজান্তে করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন। করোনায় দৈনিক মৃত্যুতে এখন কারও কিছু আসছে না। প্রথম ৮ মার্চ দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর খবরে মানুষ ভয়ে ছিলেন। আবার একজন যখন করোনায় মৃত্যু হলো তখন দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হত ভয় পেতেন। পরিবারের একজনের জ্বর, সর্দি ও কাশি হলে অন্যরা দূরত্ব বজায় রাখতেন। এমনও ঘটনা ঘটেছে করোনার কারণে স্ত্রী তার স্বামীকে ঘরে তুলেনি, বাইরে রেখেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। আর প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১৮ মার্চ। দেশে প্রথম মৃত্যু পর ২০ এপ্রিল ১০০ মৃত্যু হয়, ৯ মে ২০০ মৃত্যু হয়, ২৫ মে ৫০০ মৃত্যু হয়, ১০ জুন ১ হাজার মৃত্যু হয়, ২১ জুন ১৫০০ মৃত্যু হয়, ৩ জুলাই ২০০০ মৃত্যু হয়, ১৭ জুলাই ২ হাজার ৫০০ মৃত্যু হয়, ২৮ জুলাই ৩ হাজার মৃত্যু হয়, ১২ আগস্ট সাড়ে ৩ হাজার মৃত্যু হয়। তারপর ১৩ দিনের মাথায় ২৫ আগস্ট মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার হয় এবং সর্বশেষ গতকাল ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৪ হাজার ১৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী সংক্রমিত হওয়ার প্রায় তিন মাস পর জুন এসে এক লাখ মানুষ করোনা সংক্রমিত হন। জুলাই মাসে ২ লাখ করোনা সংক্রমণ ছাড়িয়ে যায়, সর্বশেষ ২৬ আগস্ট ৩ লাখ করোনা মানুষ সংক্রমিত হন।

জুনে রোগী বেশি ছিল। জুলাইতে নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ, মানুষের আস্থাহীনতা, কিট সংকট, পরীক্ষা করাতে নানান ভোগান্তির কারণে করোনা নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমে যায়। আগস্ট মাসের শুরুর দিকে হাসপাতালে রোগী সংখ্যা কমে গেলেও এখন আবার বাড়ছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. রওশন আনোয়ার সংবাদকে বলেন, করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু তরুণরা স্বাস্থ্যবিধি পাত্তা দিচ্ছে না। প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে হরহামেশাই বাইরে বের হচ্ছেন। বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হয়ে অন্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মুনীর বলেন, করোনা সম্পর্কে মানুষের নলেজ রয়েছে, কিন্তু তার প্র্যাক্টিস নেই। আমরা করোনাকালে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি, ভলান্টিয়ার গ্রুপ তৈরি করতে পারিনি। সেটা করতে পারলে জনগণের মধ্যে আরও সচেতনতা তৈরি হতো।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের কিছুটা মিল রয়েছে। তবে কোনও কোনও দেশে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক ওপরে উঠছে, আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না। কিন্তু আবার অনেক দেশ যে সংক্রমণ কমে আনছে সেটাও হচ্ছে না। আবার ইউরোপের দেশগুলোতে প্রথম দিকে নাস্তানাবুদ হয়েছে, তাদের মৃত্যুহারও বেশি। কিন্তু তারা একসময় সেটা নিয়ন্ত্রণে করেছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সংবাদকে বলেন, করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দ্বিগুণ করা উচিত। স্বাস্থ্যবিভাগ করোনা নমুনা পরীক্ষা দ্বিগুণ করতে না পারলেও আগের মতো দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা যেন করে। কিন্তু বর্তমানে নমুনা পরীক্ষা ২০ হাজার থেকে কমে ১৫ হাজারে এসেছে।

হাসপাতালের বিষয়ে বিএমএ’র মহাসচিব বলেন, হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা মারাত্মক অবস্থা। চীনের স্ট্যাডি হচ্ছে- উহানের হাসপাতাল থেকে ৪১ শতাংশ করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে। আমাদের দেশের সরকার নির্দেশনা দিয়েছে, ৫০ শয্যার অধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-নন কোভিড উভয় রোগীর চিকিৎসা দেবে। সরকারের সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে। কারণ ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালগুলো বাসা-বাড়ির জন্য বানানো হয়েছে।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের অযোগ্যতার কারণে গত ৫ মাসেও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা রাখে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অযোগ্য রয়ে গেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশ যা করেছে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। করোনা সংক্রমণ কেন কমছে না সেটি অনুসদ্ধান গুরুত্বপূর্ণ, সেটি করা হচ্ছে না। আইসোলেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নানা কিছুর ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগ অযোগ্য। সারাদেশে করোনা সংক্রমিত ও উপসর্গ নিয়ে ৭৮ জন চিকিৎসক মারা গেছেন কোন দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেননি, ক্ষতিপূরণ দেননি এবং চিকিৎসকদের পরিবারের কাছে যায়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সঠিক সময়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এখন আমরা সবাই মিলে এর মাশুল দিচ্ছি। চীনে সংক্রমণের পর যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্য বিভাগ তা গ্রহণ করেনি।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ সময় মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন করোনা রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ হাসপাতাল বিমুখ হয়েছে। সরকারের যে পরিকল্পনাগুলো নিয়েছিল এত ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার অভাবে করোনার গতির সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগ এগিয়ে যেতে পারছে না। করোনা প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর যখন যেটা মনে করেছে সেটিই করেছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বাস্তবায়ন করেনি।

তিনি আরও বলেন, আগস্টে ঢাকায় করোনা আক্রান্ত বেড়েছে। উল্টোদিকে করোনা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যবিভাগে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। করোনা চিকিৎসা গুটিয়ে নেয়ার প্রবণতা চলছে। মানুষ করোনা টেস্ট কম করেন সেজন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণ নিম্নগামীর লক্ষণ নেই। যদিও সরকারি হিসেবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখানোর প্রবণতা চলছে। বাস্তবে, করোনা আক্রান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বেশি সেটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে দিচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলী সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে একটানা মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। দিন দিন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। চলতি আগস্ট মাসে ঢাকায় করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে, অনেকক্ষেত্রে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে বা গুটিয়ে নেয়ার কার্যক্রম চলছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

শনিবার, ২৯ আগস্ট ২০২০ , ৯ মহররম ১৪৪২, ২৯ আগস্ট ২০২০

করোনা সংক্রমণ রোধে ঢিমেতালভাব

সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন নিজেকে

ফারুক আলম

করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তালিকায় গতকাল নতুন করে যোগ হলো ৪৭ জনের নাম। করোনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও ঢিলেঢালাভাব এসেছে স্বাস্থ্যবিভাগ, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে জনগণের মাঝে। করোনাকে যেন পাত্তাই দিচ্ছেন না তারা। প্রতিদিন কমবেশি অর্ধশত মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। এখন করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে, করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু যেন নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে হরহামেশাই বাইরে বের হচ্ছেন নাগরিকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ ও আক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরেই মৃত্যু একটানা চলছে। অনেক বেশি ওপরেও উঠছে না, আবার নিচেও নামছে না। সংক্রমণ একেবারে নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে সেগুলো শতভাগ সফল হচ্ছে না। এজন্যই একটানা চলছে। দেশে করোনার সার্বিক চিত্র পাওয়া গেলে সংক্রমণ কোথায় রয়েছে সেটা কিছুটা হলেও বলা যেতো। আর এ কারণেই দেশে করোনা পরিস্থিতি কোন অবস্থায় রয়েছে, সেটা বলা যাচ্ছে না। দেশে করোনা নিয়ে একটা গোলকধাঁধা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

জানা গেছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে মোট মারা যাওয়া ৪ হাজার ১৭৪ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা বিভাগে। এখানে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ১৯ জন। মৃত্যের সংখ্যা বিচারে ঢাকার পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে মারা গেছেন ৯১১ জন, খুলনা বিভাগে ৩৪৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৭৯ জন, সিলেট বিভাগে ১৮৮ জন, রংপুর বিভাগে ১৮১ জন, বরিশাল বিভাগে ১৬০ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৯ জন।

করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ালেও গতকাল সরেজমিন রাজধানীতে দেখা গেছে, মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এ কারণে অনেকেই নিজের অজান্তে করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন। করোনায় দৈনিক মৃত্যুতে এখন কারও কিছু আসছে না। প্রথম ৮ মার্চ দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর খবরে মানুষ ভয়ে ছিলেন। আবার একজন যখন করোনায় মৃত্যু হলো তখন দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হত ভয় পেতেন। পরিবারের একজনের জ্বর, সর্দি ও কাশি হলে অন্যরা দূরত্ব বজায় রাখতেন। এমনও ঘটনা ঘটেছে করোনার কারণে স্ত্রী তার স্বামীকে ঘরে তুলেনি, বাইরে রেখেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। আর প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১৮ মার্চ। দেশে প্রথম মৃত্যু পর ২০ এপ্রিল ১০০ মৃত্যু হয়, ৯ মে ২০০ মৃত্যু হয়, ২৫ মে ৫০০ মৃত্যু হয়, ১০ জুন ১ হাজার মৃত্যু হয়, ২১ জুন ১৫০০ মৃত্যু হয়, ৩ জুলাই ২০০০ মৃত্যু হয়, ১৭ জুলাই ২ হাজার ৫০০ মৃত্যু হয়, ২৮ জুলাই ৩ হাজার মৃত্যু হয়, ১২ আগস্ট সাড়ে ৩ হাজার মৃত্যু হয়। তারপর ১৩ দিনের মাথায় ২৫ আগস্ট মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার হয় এবং সর্বশেষ গতকাল ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৪ হাজার ১৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী সংক্রমিত হওয়ার প্রায় তিন মাস পর জুন এসে এক লাখ মানুষ করোনা সংক্রমিত হন। জুলাই মাসে ২ লাখ করোনা সংক্রমণ ছাড়িয়ে যায়, সর্বশেষ ২৬ আগস্ট ৩ লাখ করোনা মানুষ সংক্রমিত হন।

জুনে রোগী বেশি ছিল। জুলাইতে নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ, মানুষের আস্থাহীনতা, কিট সংকট, পরীক্ষা করাতে নানান ভোগান্তির কারণে করোনা নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমে যায়। আগস্ট মাসের শুরুর দিকে হাসপাতালে রোগী সংখ্যা কমে গেলেও এখন আবার বাড়ছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. রওশন আনোয়ার সংবাদকে বলেন, করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু তরুণরা স্বাস্থ্যবিধি পাত্তা দিচ্ছে না। প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে হরহামেশাই বাইরে বের হচ্ছেন। বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হয়ে অন্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মুনীর বলেন, করোনা সম্পর্কে মানুষের নলেজ রয়েছে, কিন্তু তার প্র্যাক্টিস নেই। আমরা করোনাকালে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি, ভলান্টিয়ার গ্রুপ তৈরি করতে পারিনি। সেটা করতে পারলে জনগণের মধ্যে আরও সচেতনতা তৈরি হতো।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের কিছুটা মিল রয়েছে। তবে কোনও কোনও দেশে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক ওপরে উঠছে, আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না। কিন্তু আবার অনেক দেশ যে সংক্রমণ কমে আনছে সেটাও হচ্ছে না। আবার ইউরোপের দেশগুলোতে প্রথম দিকে নাস্তানাবুদ হয়েছে, তাদের মৃত্যুহারও বেশি। কিন্তু তারা একসময় সেটা নিয়ন্ত্রণে করেছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সংবাদকে বলেন, করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দ্বিগুণ করা উচিত। স্বাস্থ্যবিভাগ করোনা নমুনা পরীক্ষা দ্বিগুণ করতে না পারলেও আগের মতো দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা যেন করে। কিন্তু বর্তমানে নমুনা পরীক্ষা ২০ হাজার থেকে কমে ১৫ হাজারে এসেছে।

হাসপাতালের বিষয়ে বিএমএ’র মহাসচিব বলেন, হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা মারাত্মক অবস্থা। চীনের স্ট্যাডি হচ্ছে- উহানের হাসপাতাল থেকে ৪১ শতাংশ করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে। আমাদের দেশের সরকার নির্দেশনা দিয়েছে, ৫০ শয্যার অধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-নন কোভিড উভয় রোগীর চিকিৎসা দেবে। সরকারের সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে। কারণ ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালগুলো বাসা-বাড়ির জন্য বানানো হয়েছে।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের অযোগ্যতার কারণে গত ৫ মাসেও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা রাখে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অযোগ্য রয়ে গেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশ যা করেছে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। করোনা সংক্রমণ কেন কমছে না সেটি অনুসদ্ধান গুরুত্বপূর্ণ, সেটি করা হচ্ছে না। আইসোলেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নানা কিছুর ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগ অযোগ্য। সারাদেশে করোনা সংক্রমিত ও উপসর্গ নিয়ে ৭৮ জন চিকিৎসক মারা গেছেন কোন দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেননি, ক্ষতিপূরণ দেননি এবং চিকিৎসকদের পরিবারের কাছে যায়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সঠিক সময়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এখন আমরা সবাই মিলে এর মাশুল দিচ্ছি। চীনে সংক্রমণের পর যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্য বিভাগ তা গ্রহণ করেনি।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ সময় মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন করোনা রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ হাসপাতাল বিমুখ হয়েছে। সরকারের যে পরিকল্পনাগুলো নিয়েছিল এত ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার অভাবে করোনার গতির সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগ এগিয়ে যেতে পারছে না। করোনা প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর যখন যেটা মনে করেছে সেটিই করেছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বাস্তবায়ন করেনি।

তিনি আরও বলেন, আগস্টে ঢাকায় করোনা আক্রান্ত বেড়েছে। উল্টোদিকে করোনা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যবিভাগে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। করোনা চিকিৎসা গুটিয়ে নেয়ার প্রবণতা চলছে। মানুষ করোনা টেস্ট কম করেন সেজন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণ নিম্নগামীর লক্ষণ নেই। যদিও সরকারি হিসেবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখানোর প্রবণতা চলছে। বাস্তবে, করোনা আক্রান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বেশি সেটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে দিচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলী সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে একটানা মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। দিন দিন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। চলতি আগস্ট মাসে ঢাকায় করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে, অনেকক্ষেত্রে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে বা গুটিয়ে নেয়ার কার্যক্রম চলছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।