প্রলোভন ও বোকা বানিয়ে

কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশি চক্র

একদিনে ১৫ নাইজেরীয় গ্রেফতার এদের অবৈধ অবস্থান নজরদারি নেই

নানা পরিচয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রতরণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভিনদেশি চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অবৈধ বিদেশিদের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। এছাড়া বাংলাদেশে এসে কোন কোন দেশের বিদেশিরা প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে এর কোন নজরদারিও নেই। গত ৩ দিনে সিআইডি ঢাকা মেট্টো দক্ষিণের অতিরিক্ত ডিআইডি শেখ মো. রেজাউল হায়দার চৌধুরীর তত্ত্বাবধায়নে ১৫ নাইজেরিয়ান নাগরিকসহ কমপক্ষে ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে। শুধু সিআইডি গত ২ মাসে ৪০ বিদেশিকে গ্রেফতার করেছে প্রতরণার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। এছাড়া র‌্যাব, ডিবিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অভিযানে মাঝে মধ্যে ভিনদেশি প্রতারক চক্র গ্রেফতার হচ্ছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ভিনদেশি প্রতারক চক্রের প্রতারণা নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর তারা বাংলাদেশে এসে প্রতারণা করে আসছে। বাংলাদেশিদের প্রতারণায় ফেলা অনেক সহজ। ডলার, উপহার দেয়ার মতো প্রলোভনে বাংলাদেশিদের সহজেই টোপে ফেলা যায়। এ কারণেই বিদেশিরা প্রতারণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই বেছে নিয়েছে। ভিনদেশি চক্রের মধ্যে নাইজেরিয়ান, ঘানা, কেনিয়া, আফ্রিকানসহ আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এগিয়ে আছে। ওইসব অঞ্চলের নাগরিকদের মূল পেশা প্রতারণা করা করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব দেশের নাগরিকদের উপর নজরদারি থাকলেও বাংলাদেশে সেটা নেই। এজন্য এরা বাংলাদেশে থেকে এদেশের মানুষকে প্রতারণায় ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অন্যদেশগুলোতেও প্রতারণা চালিয়ে যায়।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ কত বিদেশি আছে এর সঠিক সংখ্যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই। বিশেষ করে ব্যবসা, খেলোয়াড়, ছাত্র অথবা টুরিস্ট ভিসায় অহরহ বিদেশি বাংলাদেশে এলেও তারা কোথায় থাকছে, কি করছে এর খোঁজ-খবর নেয়ার নিয়ম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বিদেশিদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নজরদারিটা কম। এ কারণে বিদেশিরা সহজে প্রতারণা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব, ডিবি, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিদেশি প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করলেও কয়েক মাস জেলে থাকার পর তারা জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার সংবাদকে জানান, গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫ নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। গ্রেফতার হওয়া এসব নাইজেরিয়ান নাগরিক বিভিন্ন পরিচয়ে বাংলাদেশে এসে প্রতারণা করছিল। বিশেষ করে এসব চক্র আমেরিকান নারী সৈনিকদের নামে ফেক আইডিখুলে এসব আইডি থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতো। এরপর সম্পর্ক গড়ে দামি উপহার সামগ্রী পাঠানোর নামে অর্থ হাতিয়ে নিতো। এসব চক্রের পিছনে বাংলাদেশি একটি গ্রুপ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার জানান, গত দুই মাসে সব মিলিয়ে ৪০ বিদেশি প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এদের অধিকাংশ নাইজেরিয়া, ঘানা ও কেনিয়ার নাগরিক। পুলিশের ভাষ্য, দেশীয় প্রতারক চক্রের সহযোগিতায় আফ্রিকা অঞ্চলের দেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা। প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে নেয়া অর্থ পুরোটাই পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোনভাবেই এটি প্রতিরোধ হচ্ছে না। বিদেশিদের বাংলাদেশে এসে প্রতারণা বন্ধ করতে হলে সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা নিতে হবে। নজরদারি বাড়াতে হবে বিদেশিদের ওপর।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি জানায়, ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে গিফট দেয়ার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের ১৫ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি ঢাকা মেট্টোর দক্ষিণের ইউনিট। গ্রেফতারকৃতরা হলোÑ নাইজেরিয়ান নাগরিক এনজুবেচুকোউ এউগেন দারা (৩০), চুয়াউমা জন ওকেচুকোউ (৪০), উচেন্না দামিয়ান এমেইসিয়ানি (৩০), চিসম অ্যান্থনি একোয়েঞ্জি (৩৫), সাইমন ইফেচুকোউয়েদে ওকাফর (৩০), হেনরি ওসিতা ওকেচুকোউ (৩১), আইফিনয়ি জনপল চিনউইজে (৩২), ওকেকে পিটার (৩২), এমেকা দোনাতাস (৪৮), গোজি ওনইয়েদো (৪৭), পিটার চিকা আকপু (৪৮), ওবিন্না সানডে (৪০), এনওয়ান্না ইয়াং (৩৪), জেরেমিয়াহ চুকউদি এজেওবি (৩৪) ও স্টিফেন ওজিওমা ওবাইকোয়েজে (৩৪)। তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৯টি ল্যাপটপ, ২২টি মোবাইল ও ৫টি হিসাবের ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পল্লবী থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে তারা মিথ্যা তথ্যে ও অসদুপায়ে ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান করে ডলার বা গিফট দেয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল। গিফট দেয়ার নামে এ পর্যন্ত তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। চক্রটি আমেরিকান নারী সেনা অফিসারের ভুয়া ফেসবুক আইডি ও হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত আকর্ষণীয় ছবি পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। পরবর্তীতে মেসেজের মাধ্যমে বলে, সে ইয়েমেন, আফগানিস্তান বা সিরিয়াতে আছে। তার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার রয়েছে, কিন্তু ওই দেশে যুদ্ধ চলমান থাকায় যেকোন সময় সেগুলো নষ্ট হতে পারে। তাই নতুন বন্ধুকে ডলার বা এই মূল্যমান সম্পদ গিফট করতে চায়। যদি বেঁচে থাকে তাহলে এগুলো পরে ফেরত নেবে বলেও জানায়। এই ধরনের প্রলোভন দিয়ে প্রথমে বন্ধুদের ঠিকানাসহ মোবাইল নম্বর নেয় এবং ওই ঠিকানায় বন্ধুদের মেসেঞ্জারেÑ হোয়াট্স অ্যাপে গিফট প্যাকেটের ছবি পাঠায়। পরবর্তী মেসেজে যেকোন একটি এয়ারলাইন্সে গিফট প্যাকেটটি বুকিং দেয়া হয়েছে এরকম রশিদের ছবি পাঠায়। ঠিক দুই দিন পর বন্ধুর (ভুক্তভোগীর) মোবাইলে ফোন করে ভিডিওকলে এয়ারপোর্ট কাস্টমস অফিসে থাকা গিফট প্যাকেট দেখায় এবং কাস্টমসের ভ্যাট বাবদ বিভিন্ন ধাপে টাকা নিতে থাকে। সিআইডি জানায়, বাংলাদেশে অবস্থান করে নাইজেরিয়ান প্রতারক চক্র ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে প্রতারণায় ফেলে গিফট দেয়ার নামে সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগীদের মাধ্যমে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রাজধানীর মিরপুর পল্লবী থানায় একজন ভুক্তভোগীর দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার সূত্র ধরে এই ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা শুধু বাংলাদেশে নয় ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করে।

এর আগে গত ২৬ আগস্ট সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজীব ফরহানের নেতৃত্বে সিসম, মরো মহাম্মদ, মরিসন, এন্থনি নামে ৪ নাইজেরিয়ান ও ঘানার নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। ওই চক্রটিও একই কায়দায় বাংলাদেশে এসে প্রতারণা করে আসছিল। ওই চক্রটি ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে বসবাস করে প্রতারণা করে যাচ্ছিল। তারা খেলোয়াড় ও ছাত্র পরিচয়ে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে অবস্থান করে চক্রটি বিভিন্ন মানুষকে ফেসবুকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। খায়রুল ইসলাম নামে প্রতারিত হওয়া এক ব্যক্তির মামালার সূত্র ধরে ওই চক্রটি গ্রেফতার করে সিআইডি। এর আগে গত ১৯ জুন এমন প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগরের গুলশান বিভাগের অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার। অভিযানে নাইজেরিয়ান নাগরিক অনুবুচি হেনরি, বাংলাদেশি নাগরিক মো. শরিফুজ্জামান বাচ্চু, মো. জমি উদ্দিন এবং লিটন হোসেনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা ইতোমধ্যে ৩০টি একাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণায় ফেলে ২ শতাধিক নারী পুরুষের কাছ থেকে অর্ধ শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে নাইজেরিয়ান নাগরিক ওকেচুকু জোসেফ অ্্যাপসটু নামের এক প্রতারককে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রচারক চক্রের বাংলাদেশি গ্রুপের মূল হোতা মো. সাইফুর রহমান তালুকদার মিঠু, মো. ইমরান হোসেন, বাদশা মিয়া এবং মো. আলমগীরসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ব্যাপক চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।

সিআইডি জানায়, চক্রের সদস্যরা নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষ আর পুরুষদের ক্ষেত্রে নারী আইডি দিয়ে বন্ধুত্বের রিকুয়েস্ট পাঠায়। কেউ তা গ্রহণ করলে হোয়াট অ্যাপস নাম্বার দিয়ে কথা বলার অফার দেয়। এরপর এরা নিজেদের বিভিন্ন দেশের সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক, সমাজকর্মীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেয়। নিজেদের ব্যক্তিগত কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করে হোয়াট অ্যাপসে পাঠায়। কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারলে তারা আস্তে আস্তে নানা প্রলোভনে ফেলে। চক্রটি একই ধরনের ম্যাসেজ লিখে একাধিক ব্যক্তির কাছে পাঠায়। এতে তাদের টার্গেট ব্যক্তি তাদের ফাঁদে পড়লে পরবর্তীতে তাদের প্রতারণার ধাপগুলো কাজে লাগায়।

ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, বাংলাদেশ নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়াসহ আফ্রিকা অঞ্চলের যত দেশের লোক রয়েছে এদের অধিকাংশই অবৈধ বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে নাইজেরিয়ান, কেনিয়া ও ঘানার নাগরিকরা খেলোয়াড়, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী পরিচয়ে বাংলাদেশে আসার পর পরই তাদের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলে। এরপর সে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে নানা ধরনের প্রতারণা করে। অনেক সময় এরা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার জন্যও আসে। চিকিৎসার জন্য এসেও তারা প্রতারণা করে বলে তথ্য প্রমাণ রয়েছে। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম জানান, নাইজেরিয়ান এদেশে এসে তাদের সহযোগী ঠিক করে নেয়। প্রতিদিন ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়ার বিনিময়ে তাকে (নাইজেরিয়ানকে) সহযোগিতা করা বা তার সঙ্গে থাকা। প্রতারক চক্র প্রতারিত করে হাতিয়ে নেয়া টাকার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ব্যাংক একাউন্ট ব্যবহার করে। ১ লাখ টাকা একাউন্টে আসলে এর বিনিময়ে ২ থেকে ৩ হাজার করে টাকা দেয়ার চুক্তি থাকে একাউন্টধারীর সঙ্গে। এদের মূল বাংলাদেশি সহযোগিরা প্রতারণা করে নেয়া টাকার একটি কমিশন পায়। এভাবে তারা মিলেমিশে প্রতারণা করে।

শনিবার, ২৯ আগস্ট ২০২০ , ৯ মহররম ১৪৪২, ২৯ আগস্ট ২০২০

প্রলোভন ও বোকা বানিয়ে

কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশি চক্র

একদিনে ১৫ নাইজেরীয় গ্রেফতার এদের অবৈধ অবস্থান নজরদারি নেই

সাইফ বাবলু

image

গ্রেফতারকৃত নাইজেরিয়ান নাগরিকরা -সংবাদ

নানা পরিচয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রতরণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভিনদেশি চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অবৈধ বিদেশিদের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। এছাড়া বাংলাদেশে এসে কোন কোন দেশের বিদেশিরা প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে এর কোন নজরদারিও নেই। গত ৩ দিনে সিআইডি ঢাকা মেট্টো দক্ষিণের অতিরিক্ত ডিআইডি শেখ মো. রেজাউল হায়দার চৌধুরীর তত্ত্বাবধায়নে ১৫ নাইজেরিয়ান নাগরিকসহ কমপক্ষে ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে। শুধু সিআইডি গত ২ মাসে ৪০ বিদেশিকে গ্রেফতার করেছে প্রতরণার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। এছাড়া র‌্যাব, ডিবিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অভিযানে মাঝে মধ্যে ভিনদেশি প্রতারক চক্র গ্রেফতার হচ্ছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ভিনদেশি প্রতারক চক্রের প্রতারণা নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর তারা বাংলাদেশে এসে প্রতারণা করে আসছে। বাংলাদেশিদের প্রতারণায় ফেলা অনেক সহজ। ডলার, উপহার দেয়ার মতো প্রলোভনে বাংলাদেশিদের সহজেই টোপে ফেলা যায়। এ কারণেই বিদেশিরা প্রতারণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই বেছে নিয়েছে। ভিনদেশি চক্রের মধ্যে নাইজেরিয়ান, ঘানা, কেনিয়া, আফ্রিকানসহ আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এগিয়ে আছে। ওইসব অঞ্চলের নাগরিকদের মূল পেশা প্রতারণা করা করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব দেশের নাগরিকদের উপর নজরদারি থাকলেও বাংলাদেশে সেটা নেই। এজন্য এরা বাংলাদেশে থেকে এদেশের মানুষকে প্রতারণায় ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অন্যদেশগুলোতেও প্রতারণা চালিয়ে যায়।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ কত বিদেশি আছে এর সঠিক সংখ্যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই। বিশেষ করে ব্যবসা, খেলোয়াড়, ছাত্র অথবা টুরিস্ট ভিসায় অহরহ বিদেশি বাংলাদেশে এলেও তারা কোথায় থাকছে, কি করছে এর খোঁজ-খবর নেয়ার নিয়ম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বিদেশিদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নজরদারিটা কম। এ কারণে বিদেশিরা সহজে প্রতারণা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব, ডিবি, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিদেশি প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করলেও কয়েক মাস জেলে থাকার পর তারা জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার সংবাদকে জানান, গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫ নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। গ্রেফতার হওয়া এসব নাইজেরিয়ান নাগরিক বিভিন্ন পরিচয়ে বাংলাদেশে এসে প্রতারণা করছিল। বিশেষ করে এসব চক্র আমেরিকান নারী সৈনিকদের নামে ফেক আইডিখুলে এসব আইডি থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতো। এরপর সম্পর্ক গড়ে দামি উপহার সামগ্রী পাঠানোর নামে অর্থ হাতিয়ে নিতো। এসব চক্রের পিছনে বাংলাদেশি একটি গ্রুপ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার জানান, গত দুই মাসে সব মিলিয়ে ৪০ বিদেশি প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এদের অধিকাংশ নাইজেরিয়া, ঘানা ও কেনিয়ার নাগরিক। পুলিশের ভাষ্য, দেশীয় প্রতারক চক্রের সহযোগিতায় আফ্রিকা অঞ্চলের দেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা। প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে নেয়া অর্থ পুরোটাই পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোনভাবেই এটি প্রতিরোধ হচ্ছে না। বিদেশিদের বাংলাদেশে এসে প্রতারণা বন্ধ করতে হলে সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা নিতে হবে। নজরদারি বাড়াতে হবে বিদেশিদের ওপর।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি জানায়, ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে গিফট দেয়ার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের ১৫ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি ঢাকা মেট্টোর দক্ষিণের ইউনিট। গ্রেফতারকৃতরা হলোÑ নাইজেরিয়ান নাগরিক এনজুবেচুকোউ এউগেন দারা (৩০), চুয়াউমা জন ওকেচুকোউ (৪০), উচেন্না দামিয়ান এমেইসিয়ানি (৩০), চিসম অ্যান্থনি একোয়েঞ্জি (৩৫), সাইমন ইফেচুকোউয়েদে ওকাফর (৩০), হেনরি ওসিতা ওকেচুকোউ (৩১), আইফিনয়ি জনপল চিনউইজে (৩২), ওকেকে পিটার (৩২), এমেকা দোনাতাস (৪৮), গোজি ওনইয়েদো (৪৭), পিটার চিকা আকপু (৪৮), ওবিন্না সানডে (৪০), এনওয়ান্না ইয়াং (৩৪), জেরেমিয়াহ চুকউদি এজেওবি (৩৪) ও স্টিফেন ওজিওমা ওবাইকোয়েজে (৩৪)। তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৯টি ল্যাপটপ, ২২টি মোবাইল ও ৫টি হিসাবের ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পল্লবী থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে তারা মিথ্যা তথ্যে ও অসদুপায়ে ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান করে ডলার বা গিফট দেয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল। গিফট দেয়ার নামে এ পর্যন্ত তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। চক্রটি আমেরিকান নারী সেনা অফিসারের ভুয়া ফেসবুক আইডি ও হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত আকর্ষণীয় ছবি পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। পরবর্তীতে মেসেজের মাধ্যমে বলে, সে ইয়েমেন, আফগানিস্তান বা সিরিয়াতে আছে। তার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার রয়েছে, কিন্তু ওই দেশে যুদ্ধ চলমান থাকায় যেকোন সময় সেগুলো নষ্ট হতে পারে। তাই নতুন বন্ধুকে ডলার বা এই মূল্যমান সম্পদ গিফট করতে চায়। যদি বেঁচে থাকে তাহলে এগুলো পরে ফেরত নেবে বলেও জানায়। এই ধরনের প্রলোভন দিয়ে প্রথমে বন্ধুদের ঠিকানাসহ মোবাইল নম্বর নেয় এবং ওই ঠিকানায় বন্ধুদের মেসেঞ্জারেÑ হোয়াট্স অ্যাপে গিফট প্যাকেটের ছবি পাঠায়। পরবর্তী মেসেজে যেকোন একটি এয়ারলাইন্সে গিফট প্যাকেটটি বুকিং দেয়া হয়েছে এরকম রশিদের ছবি পাঠায়। ঠিক দুই দিন পর বন্ধুর (ভুক্তভোগীর) মোবাইলে ফোন করে ভিডিওকলে এয়ারপোর্ট কাস্টমস অফিসে থাকা গিফট প্যাকেট দেখায় এবং কাস্টমসের ভ্যাট বাবদ বিভিন্ন ধাপে টাকা নিতে থাকে। সিআইডি জানায়, বাংলাদেশে অবস্থান করে নাইজেরিয়ান প্রতারক চক্র ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে প্রতারণায় ফেলে গিফট দেয়ার নামে সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগীদের মাধ্যমে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রাজধানীর মিরপুর পল্লবী থানায় একজন ভুক্তভোগীর দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার সূত্র ধরে এই ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা শুধু বাংলাদেশে নয় ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করে।

এর আগে গত ২৬ আগস্ট সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজীব ফরহানের নেতৃত্বে সিসম, মরো মহাম্মদ, মরিসন, এন্থনি নামে ৪ নাইজেরিয়ান ও ঘানার নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। ওই চক্রটিও একই কায়দায় বাংলাদেশে এসে প্রতারণা করে আসছিল। ওই চক্রটি ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে বসবাস করে প্রতারণা করে যাচ্ছিল। তারা খেলোয়াড় ও ছাত্র পরিচয়ে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে অবস্থান করে চক্রটি বিভিন্ন মানুষকে ফেসবুকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। খায়রুল ইসলাম নামে প্রতারিত হওয়া এক ব্যক্তির মামালার সূত্র ধরে ওই চক্রটি গ্রেফতার করে সিআইডি। এর আগে গত ১৯ জুন এমন প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগরের গুলশান বিভাগের অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার। অভিযানে নাইজেরিয়ান নাগরিক অনুবুচি হেনরি, বাংলাদেশি নাগরিক মো. শরিফুজ্জামান বাচ্চু, মো. জমি উদ্দিন এবং লিটন হোসেনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা ইতোমধ্যে ৩০টি একাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণায় ফেলে ২ শতাধিক নারী পুরুষের কাছ থেকে অর্ধ শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে নাইজেরিয়ান নাগরিক ওকেচুকু জোসেফ অ্্যাপসটু নামের এক প্রতারককে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রচারক চক্রের বাংলাদেশি গ্রুপের মূল হোতা মো. সাইফুর রহমান তালুকদার মিঠু, মো. ইমরান হোসেন, বাদশা মিয়া এবং মো. আলমগীরসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ব্যাপক চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।

সিআইডি জানায়, চক্রের সদস্যরা নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষ আর পুরুষদের ক্ষেত্রে নারী আইডি দিয়ে বন্ধুত্বের রিকুয়েস্ট পাঠায়। কেউ তা গ্রহণ করলে হোয়াট অ্যাপস নাম্বার দিয়ে কথা বলার অফার দেয়। এরপর এরা নিজেদের বিভিন্ন দেশের সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক, সমাজকর্মীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেয়। নিজেদের ব্যক্তিগত কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করে হোয়াট অ্যাপসে পাঠায়। কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারলে তারা আস্তে আস্তে নানা প্রলোভনে ফেলে। চক্রটি একই ধরনের ম্যাসেজ লিখে একাধিক ব্যক্তির কাছে পাঠায়। এতে তাদের টার্গেট ব্যক্তি তাদের ফাঁদে পড়লে পরবর্তীতে তাদের প্রতারণার ধাপগুলো কাজে লাগায়।

ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, বাংলাদেশ নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়াসহ আফ্রিকা অঞ্চলের যত দেশের লোক রয়েছে এদের অধিকাংশই অবৈধ বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে নাইজেরিয়ান, কেনিয়া ও ঘানার নাগরিকরা খেলোয়াড়, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী পরিচয়ে বাংলাদেশে আসার পর পরই তাদের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলে। এরপর সে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে নানা ধরনের প্রতারণা করে। অনেক সময় এরা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার জন্যও আসে। চিকিৎসার জন্য এসেও তারা প্রতারণা করে বলে তথ্য প্রমাণ রয়েছে। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম জানান, নাইজেরিয়ান এদেশে এসে তাদের সহযোগী ঠিক করে নেয়। প্রতিদিন ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়ার বিনিময়ে তাকে (নাইজেরিয়ানকে) সহযোগিতা করা বা তার সঙ্গে থাকা। প্রতারক চক্র প্রতারিত করে হাতিয়ে নেয়া টাকার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ব্যাংক একাউন্ট ব্যবহার করে। ১ লাখ টাকা একাউন্টে আসলে এর বিনিময়ে ২ থেকে ৩ হাজার করে টাকা দেয়ার চুক্তি থাকে একাউন্টধারীর সঙ্গে। এদের মূল বাংলাদেশি সহযোগিরা প্রতারণা করে নেয়া টাকার একটি কমিশন পায়। এভাবে তারা মিলেমিশে প্রতারণা করে।