মানুষ বাঁচে মানুষের জন্য

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনা মানুষকে নিষ্ঠুর করে তুলেছে-মানুষ মানুষকে বলছে মানুষ থেকে দূরে থাকতে। কার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলছে? বলছে, করোনায় আক্রান্ত মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র, স্বামী-কন্যা, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকতে। এই রীতি পালন করতে করতে আমরা এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছি যে, করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহ নিয়ে কবরস্থানে গেলে জীবিত মনুষ্যগুলো অগ্নিমূর্তি ধারণ করে লাশ দাফনে বাধা দিচ্ছি, শ্মশানে মৃতদেহ এলে মরণপণে শবদাহে প্রতিরোধ গড়ে তুলছি। করোনা রোগীর মরদেহ এই নশ্বরবাসীরা কবরস্থ হতে দেবে না, শ্মশানে দাহ করতে দেবে না, এমন কি দাফন করতে নেয়ার জন্য মসজিদের খাটিয়াটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেবে না। করোনা রোগে আক্রান্ত মা’কে সন্তান যখন জঙ্গলে রেখে আসে, করোনা রোগে মৃত পিতা-মাতা যখন সন্তানের মাটি বা অগ্নি পাচ্ছে না তখন যে স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মরা মানুষগুলোর কবর দেয়া বা সৎকারের ব্যবস্থা করেছে সেই প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে, ‘আল মারকাজুল ইসলাম’। পাথওয়ে নামে আরও একটি বেসরকারি সংগঠনও মৃতদেহ দাফন করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও মৃতদেহ দাফনে একটি দল কাজ করেছে। করোনা ভাইরাসের ভয়ে যে সব মরদেহ তাদের আত্মীয় স্বজনেরা নেয় না তাদের কবর দিচ্ছে বা সৎকারের ব্যবস্থা করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ। ঢাকার বাইরে পুলিশ, স্থানীয় কাউন্সিলর বা এক বা একাধিক মহৎ ব্যক্তি দাফন ও সৎকারের কাজ সম্পন্ন করছে।

করোনার এই মহাসংকটে কিছু মানুষ আমাদের মতো ঘরে আবদ্ধ না থেকে অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। আমরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য করোনার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ঘরবন্দি জীবন কাটিয়েছি, কাটাচ্ছি; আর আমাদের রক্ষা করতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন চিকিৎসক, পুলিশ, সেনা, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাংকার, বিদ্যুৎকর্মী, সাংবাদিক, বন্দর-শ্রমিক, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, পরিবহনকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ। ফ্রন্ট ফাইটারের কাতারে ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে আছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরাও যারা যাবতীয় ভয় দূরে ঠেলে রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করে চলেছেন নিরলসভাবে। বুভুক্ষু মানুষগুলোকে আমার পরিচিত অনেককে তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্য করতে দেখেছি। গুলশানের শর্মিলা নামে এক ভদ্রমহিলা বহুদিন বাস্তুহারা মানুষ ও কুকুরদের খাবার দিয়েছেন। বগুড়ার এক স্কুল শিক্ষিকা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাপড় কিনে বাড়িতে নিজে মাস্ক তৈরি করে দিনের বেলায় তা এলাকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছেন। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি ছোট্ট শিশু তার জমানো ৯৭১ টাকা তুলে দিয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে গৃহকর্মীদের গৃহকর্ম থেকে বিরত রাখা হলেও তাদের মজুরি আগাম দেয়ার বহু নজির রয়েছে। আমেরিকায় এক কাস্টমার ৯০ ডলারের খাবার খেয়ে হোটেলের সব কর্মীদের জন্য বকশিস দিয়ে যান ৯ হাজার ৪০০ ডলার।

করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতায় একটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসাপাতাল শুধু চৌদ্দ দিনের পরিশ্রমে চালু হয়েছে। চট্টগ্রামের জনসাধারণ স্বেচ্ছাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে বিনা মূল্যে করোনা টেস্ট করার সুবিধাসহ বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছেন। ২০১৩ সনে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী কিশোর কুমার দাশ। অভাবের তাড়নায় এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন এই মানুষটি। তিনি এখন পেরুতে শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করছেন। প্রথম থেকে প্রতিষ্ঠাতা কিশোরের নিজ অর্থায়নে চললেও বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের অর্থায়নে চলছে এর কার্যক্রম। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের তরুণেরা করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকেই মসজিদ, হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ অনেক জায়গায় জীবাণুনাশক কর্মসূচি ছাড়াও কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষের বাসায় বাসায় বিনা মূল্যে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি তৈরি করে বিতরণ করেছে খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে?

শহরের কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রম এবং অনাথাশ্রমেও খাবার পৌঁছে দিচ্ছে সংগঠনটি। করোনার নির্জন রাস্তা-ঘাটে অভুক্ত কুকুর, বিড়ালদেরও এই প্রতিষ্ঠান থেকে খাবার দেয়া হয়েছে, সবজি বিপন্ন কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি সবজি কেনার ব্যবস্থা করেছে। বিদ্যানন্দের ঢাকা বিভাগের পরিচালক এবং ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সালমান খান ইয়াসীন। ২০১৬ সনে তারা আরেকটি চমকপ্রদ কার্যক্রম শুরু করে; সুবিধাবঞ্চিত শিশু, প্রতিবন্ধী ও ষাটোর্ধ্ব কর্মহীন প্রায় তিন হাজার মানুষকে বিভিন্ন নির্ধারিত স্পটে এক টাকার বিনিময়ে খাবার বিতরণ করছে। বিদ্যানন্দের নিজস্ব গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে তৈরি স্যানিটারি প্যাড ফুটপাত, রেলস্টেশন, নৌবন্দর ও বস্তিতে নিঃস্ব মহিলাদের কাছে মাত্র ৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। তাদের এ ফ্যাক্টরি থেকেই এতিমখানার শিশুদের জন্য টি-শার্ট তৈরি করে বিলানো হয়। তাদের অভিনব কিছু উদ্যোগ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; নির্বাচনের পর পোস্টারগুলো অপসারণ করে তারা খাতা বানিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও এতিমখানার শিক্ষার্থীদের লিখতে দিয়েছে।

কিছু মানুষের ভেতর ধর্মের আবেগ এমনভাবে কাজ করে যা তাদের কট্টরপন্থিতে পরিণত করে, তখন এদের মধ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এরা উগ্রনীতি নিয়ে মানবতার কবর রচনা করে। এ শ্রেণীর লোকগুলো অবস্থাসম্পন্ন হলেও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত লোকদের জন্য কিছুই করে না, বরং কেউ কিছু করতে চাইলেও তাদের কাজে নানা কৌশলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। মানবিকতা আর ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার চেয়ে এদের কাছে অন্ধত্ব, কুসংস্কার, গোঁড়ামি আর সংকীর্ণতা বড় হয়ে উঠে। একজন হিন্দু লোকের বদান্যতায় এমন একটি মহতী উদ্যোগকে কিছু সাম্প্রদায়িক লোক সহ্য করতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হচ্ছে, এটি সনাতন হিন্দুধর্ম প্রচারের একটি সংগঠন; দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে, এরা ‘গো-চেনা’ মিশিয়ে খাবার তৈরি করে। তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে, ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার একজন হিন্দু। চতুর্থ অভিযোগ হচ্ছে, ‘বিদ্যানন্দ’ হিন্দু নাম। ‘আনন্দ’ (বিদ্যার আনন্দ) শব্দটির মধ্যে কেন হিন্দু হিন্দু গন্ধ তা বোঝা মুশকিল, তবে কুকুরের নাসারন্ধ্র থাকলে এমন গন্ধ পাওয়া যেতে পারে, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি নাকি মানুষের চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। এ প্রতিষ্ঠানে ৯০ ভাগ মুসলিম স্বেচ্ছাসেবক কাজ করা সত্ত্বেও হিন্দু সনাতন ধর্মের প্রচার বা খাবারে ‘গো-চেনা’ মেশানো কীভাবে সম্ভব তা বোঝার চেষ্টা না করাই ভালো। কিছু লোক আছে যারা নিজেরা কিছুই করে না, কিন্তু অন্যদের মহতি উদ্যোগ ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগে যায়, এদের কাজ হচ্ছে শুধু নষ্ট করা।

বিশ্বের অনেক ক্রীড়াবিদ, চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান ব্যক্তি, ব্যবসায়ী করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই মানবিকতা ও মহানুভবতা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনাভাইরাসের কারণে আফ্রিকার বাসিন্দারা গোত্রীয় বিভেদ ভুলে গিয়ে করোনা মোকাবিলায় পরস্পরের সহায়তায় এগিয়ে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সশস্ত্র গ্রুপগুলোর যুবকেরা খাবার আর সাবান নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও অনেক মানবিক লোক রয়েছেÑ এ সময়ে হিন্দুর শবদেহ উঠছে মুসলমানের কাঁধে, মুসলমানের মৃতদেহ বহন করছে হিন্দু অ্যামবুল্যান্স ড্রাইভার। যারা জানাজা পড়ছেন, কবর খুঁড়ছেন, শবদেহ বহন করছেন, মুখাগ্নি করছেন তারা তো মৃত ব্যক্তির কোন আত্মীয় নন, মাস্ক-পিপিই দ্বারা আবৃত থাকায় এদের ধর্মীয় পরিচয়ও কেউ জানে না। মুসলমান বা হিন্দুর ছোঁয়ায় মৃতদেহ অসূচি হলো কী না তা কেউ জিজ্ঞেসও করছে না। আসলে মানুষ বাঁচে মানুষের জন্য। পৃথিবীতে জীবনের মূল্য বেড়ে গেছে, ধর্মের অনুকম্পায় করোনামুক্ত হওয়ার প্রত্যাশায় মানুষ নিশ্চুপ থাকছে না, ভ্যাকসিন আবিষ্কারে রাষ্ট্র ও সম্পদশালীগণ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছেন। স্বল্প আয়ের লোকগুলোও নিজেদের অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের কথা না ভেবে যাদের বেশি প্রয়োজন তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ। পরিজন বর্জিত শবযাত্রায় শোকের চেয়ে স্পর্শ ভয়ে এখন সবাই থাকে আতঙ্কিত। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়লেও মনের নৈকট্য বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। করোনা থেকে বাঁচার জন্য যে লোকগুলোকে আমরা এড়িয়ে চলছি সেই লোকগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য আমরা সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠছি। মানুষ এখন মিলনের প্রত্যাশায় গভীর আগ্রহ সহকারে দিন গুনছে। মহামারীর এ দুর্যোগে ভালো কিছু হলে আবেগে আপ্লুত হই, মানুষের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয়। এমন লোকদের জন্য আমাদের অভিবাদন।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ৩০ আগস্ট ২০২০ , ১০ মহররম ১৪৪২, ১৪ ভাদ্র ১৪২৭

মানুষ বাঁচে মানুষের জন্য

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনা মানুষকে নিষ্ঠুর করে তুলেছে-মানুষ মানুষকে বলছে মানুষ থেকে দূরে থাকতে। কার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলছে? বলছে, করোনায় আক্রান্ত মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র, স্বামী-কন্যা, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকতে। এই রীতি পালন করতে করতে আমরা এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছি যে, করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহ নিয়ে কবরস্থানে গেলে জীবিত মনুষ্যগুলো অগ্নিমূর্তি ধারণ করে লাশ দাফনে বাধা দিচ্ছি, শ্মশানে মৃতদেহ এলে মরণপণে শবদাহে প্রতিরোধ গড়ে তুলছি। করোনা রোগীর মরদেহ এই নশ্বরবাসীরা কবরস্থ হতে দেবে না, শ্মশানে দাহ করতে দেবে না, এমন কি দাফন করতে নেয়ার জন্য মসজিদের খাটিয়াটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেবে না। করোনা রোগে আক্রান্ত মা’কে সন্তান যখন জঙ্গলে রেখে আসে, করোনা রোগে মৃত পিতা-মাতা যখন সন্তানের মাটি বা অগ্নি পাচ্ছে না তখন যে স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মরা মানুষগুলোর কবর দেয়া বা সৎকারের ব্যবস্থা করেছে সেই প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে, ‘আল মারকাজুল ইসলাম’। পাথওয়ে নামে আরও একটি বেসরকারি সংগঠনও মৃতদেহ দাফন করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও মৃতদেহ দাফনে একটি দল কাজ করেছে। করোনা ভাইরাসের ভয়ে যে সব মরদেহ তাদের আত্মীয় স্বজনেরা নেয় না তাদের কবর দিচ্ছে বা সৎকারের ব্যবস্থা করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ। ঢাকার বাইরে পুলিশ, স্থানীয় কাউন্সিলর বা এক বা একাধিক মহৎ ব্যক্তি দাফন ও সৎকারের কাজ সম্পন্ন করছে।

করোনার এই মহাসংকটে কিছু মানুষ আমাদের মতো ঘরে আবদ্ধ না থেকে অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। আমরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য করোনার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ঘরবন্দি জীবন কাটিয়েছি, কাটাচ্ছি; আর আমাদের রক্ষা করতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন চিকিৎসক, পুলিশ, সেনা, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাংকার, বিদ্যুৎকর্মী, সাংবাদিক, বন্দর-শ্রমিক, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, পরিবহনকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ। ফ্রন্ট ফাইটারের কাতারে ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে আছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরাও যারা যাবতীয় ভয় দূরে ঠেলে রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করে চলেছেন নিরলসভাবে। বুভুক্ষু মানুষগুলোকে আমার পরিচিত অনেককে তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্য করতে দেখেছি। গুলশানের শর্মিলা নামে এক ভদ্রমহিলা বহুদিন বাস্তুহারা মানুষ ও কুকুরদের খাবার দিয়েছেন। বগুড়ার এক স্কুল শিক্ষিকা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাপড় কিনে বাড়িতে নিজে মাস্ক তৈরি করে দিনের বেলায় তা এলাকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছেন। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি ছোট্ট শিশু তার জমানো ৯৭১ টাকা তুলে দিয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে গৃহকর্মীদের গৃহকর্ম থেকে বিরত রাখা হলেও তাদের মজুরি আগাম দেয়ার বহু নজির রয়েছে। আমেরিকায় এক কাস্টমার ৯০ ডলারের খাবার খেয়ে হোটেলের সব কর্মীদের জন্য বকশিস দিয়ে যান ৯ হাজার ৪০০ ডলার।

করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতায় একটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসাপাতাল শুধু চৌদ্দ দিনের পরিশ্রমে চালু হয়েছে। চট্টগ্রামের জনসাধারণ স্বেচ্ছাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে বিনা মূল্যে করোনা টেস্ট করার সুবিধাসহ বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছেন। ২০১৩ সনে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী কিশোর কুমার দাশ। অভাবের তাড়নায় এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন এই মানুষটি। তিনি এখন পেরুতে শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করছেন। প্রথম থেকে প্রতিষ্ঠাতা কিশোরের নিজ অর্থায়নে চললেও বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের অর্থায়নে চলছে এর কার্যক্রম। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের তরুণেরা করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকেই মসজিদ, হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ অনেক জায়গায় জীবাণুনাশক কর্মসূচি ছাড়াও কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষের বাসায় বাসায় বিনা মূল্যে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি তৈরি করে বিতরণ করেছে খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে?

শহরের কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রম এবং অনাথাশ্রমেও খাবার পৌঁছে দিচ্ছে সংগঠনটি। করোনার নির্জন রাস্তা-ঘাটে অভুক্ত কুকুর, বিড়ালদেরও এই প্রতিষ্ঠান থেকে খাবার দেয়া হয়েছে, সবজি বিপন্ন কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি সবজি কেনার ব্যবস্থা করেছে। বিদ্যানন্দের ঢাকা বিভাগের পরিচালক এবং ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সালমান খান ইয়াসীন। ২০১৬ সনে তারা আরেকটি চমকপ্রদ কার্যক্রম শুরু করে; সুবিধাবঞ্চিত শিশু, প্রতিবন্ধী ও ষাটোর্ধ্ব কর্মহীন প্রায় তিন হাজার মানুষকে বিভিন্ন নির্ধারিত স্পটে এক টাকার বিনিময়ে খাবার বিতরণ করছে। বিদ্যানন্দের নিজস্ব গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে তৈরি স্যানিটারি প্যাড ফুটপাত, রেলস্টেশন, নৌবন্দর ও বস্তিতে নিঃস্ব মহিলাদের কাছে মাত্র ৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। তাদের এ ফ্যাক্টরি থেকেই এতিমখানার শিশুদের জন্য টি-শার্ট তৈরি করে বিলানো হয়। তাদের অভিনব কিছু উদ্যোগ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; নির্বাচনের পর পোস্টারগুলো অপসারণ করে তারা খাতা বানিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও এতিমখানার শিক্ষার্থীদের লিখতে দিয়েছে।

কিছু মানুষের ভেতর ধর্মের আবেগ এমনভাবে কাজ করে যা তাদের কট্টরপন্থিতে পরিণত করে, তখন এদের মধ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এরা উগ্রনীতি নিয়ে মানবতার কবর রচনা করে। এ শ্রেণীর লোকগুলো অবস্থাসম্পন্ন হলেও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত লোকদের জন্য কিছুই করে না, বরং কেউ কিছু করতে চাইলেও তাদের কাজে নানা কৌশলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। মানবিকতা আর ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার চেয়ে এদের কাছে অন্ধত্ব, কুসংস্কার, গোঁড়ামি আর সংকীর্ণতা বড় হয়ে উঠে। একজন হিন্দু লোকের বদান্যতায় এমন একটি মহতী উদ্যোগকে কিছু সাম্প্রদায়িক লোক সহ্য করতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হচ্ছে, এটি সনাতন হিন্দুধর্ম প্রচারের একটি সংগঠন; দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে, এরা ‘গো-চেনা’ মিশিয়ে খাবার তৈরি করে। তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে, ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার একজন হিন্দু। চতুর্থ অভিযোগ হচ্ছে, ‘বিদ্যানন্দ’ হিন্দু নাম। ‘আনন্দ’ (বিদ্যার আনন্দ) শব্দটির মধ্যে কেন হিন্দু হিন্দু গন্ধ তা বোঝা মুশকিল, তবে কুকুরের নাসারন্ধ্র থাকলে এমন গন্ধ পাওয়া যেতে পারে, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি নাকি মানুষের চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। এ প্রতিষ্ঠানে ৯০ ভাগ মুসলিম স্বেচ্ছাসেবক কাজ করা সত্ত্বেও হিন্দু সনাতন ধর্মের প্রচার বা খাবারে ‘গো-চেনা’ মেশানো কীভাবে সম্ভব তা বোঝার চেষ্টা না করাই ভালো। কিছু লোক আছে যারা নিজেরা কিছুই করে না, কিন্তু অন্যদের মহতি উদ্যোগ ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগে যায়, এদের কাজ হচ্ছে শুধু নষ্ট করা।

বিশ্বের অনেক ক্রীড়াবিদ, চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান ব্যক্তি, ব্যবসায়ী করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই মানবিকতা ও মহানুভবতা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনাভাইরাসের কারণে আফ্রিকার বাসিন্দারা গোত্রীয় বিভেদ ভুলে গিয়ে করোনা মোকাবিলায় পরস্পরের সহায়তায় এগিয়ে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সশস্ত্র গ্রুপগুলোর যুবকেরা খাবার আর সাবান নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও অনেক মানবিক লোক রয়েছেÑ এ সময়ে হিন্দুর শবদেহ উঠছে মুসলমানের কাঁধে, মুসলমানের মৃতদেহ বহন করছে হিন্দু অ্যামবুল্যান্স ড্রাইভার। যারা জানাজা পড়ছেন, কবর খুঁড়ছেন, শবদেহ বহন করছেন, মুখাগ্নি করছেন তারা তো মৃত ব্যক্তির কোন আত্মীয় নন, মাস্ক-পিপিই দ্বারা আবৃত থাকায় এদের ধর্মীয় পরিচয়ও কেউ জানে না। মুসলমান বা হিন্দুর ছোঁয়ায় মৃতদেহ অসূচি হলো কী না তা কেউ জিজ্ঞেসও করছে না। আসলে মানুষ বাঁচে মানুষের জন্য। পৃথিবীতে জীবনের মূল্য বেড়ে গেছে, ধর্মের অনুকম্পায় করোনামুক্ত হওয়ার প্রত্যাশায় মানুষ নিশ্চুপ থাকছে না, ভ্যাকসিন আবিষ্কারে রাষ্ট্র ও সম্পদশালীগণ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছেন। স্বল্প আয়ের লোকগুলোও নিজেদের অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের কথা না ভেবে যাদের বেশি প্রয়োজন তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ। পরিজন বর্জিত শবযাত্রায় শোকের চেয়ে স্পর্শ ভয়ে এখন সবাই থাকে আতঙ্কিত। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়লেও মনের নৈকট্য বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। করোনা থেকে বাঁচার জন্য যে লোকগুলোকে আমরা এড়িয়ে চলছি সেই লোকগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য আমরা সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠছি। মানুষ এখন মিলনের প্রত্যাশায় গভীর আগ্রহ সহকারে দিন গুনছে। মহামারীর এ দুর্যোগে ভালো কিছু হলে আবেগে আপ্লুত হই, মানুষের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয়। এমন লোকদের জন্য আমাদের অভিবাদন।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com