সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি বাজার ব্যবস্থা

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা সরকারকে বিকল্প বাজার তৈরির পরামর্শ

সিন্ডিকেটের কাছে এক ধরনের জিম্মিই হয়ে পড়েছে দেশের বাজার ব্যবস্থা। কয়েক মাস আগেও সংকটের কারণে বহুগুণ বেড়েছিল পিয়াজের দাম। তখনও কিন্তু কিছু পিয়াজ গুদামে পচে নষ্ট হয়েছিল। অর্থাৎ সংকটের মধ্যেও একটা সিন্ডিকেট পিয়াজ মজুদ করে বাজারে অতিরিক্ত সংকট সৃষ্টি করেছিল। আর গত এক সপ্তাহ ধরে শুরু হয়েছে চালের সিন্ডিকেট। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কিন্তু বাজারে চালের দাম বাড়ছেই। কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থাৎ চালের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও রয়েছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সরকার দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকে নাগালে আনার চেষ্টা করলেও তা নাগালে আসছে না। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধরা যাক, একজন কৃষক এক কেজি বেগুন উৎপাদন করে তা বিক্রি করছে ২০ টাকায়। কয়েক হাত ঘুরে একজন ভোক্তা সেই বেগুন কিনছে ৮০ টাকায়। কৃষক পাচ্ছে ২০ টাকা। সাধারণ জনগণ কিনছে ৮০ টাকায়। সিন্ডিকেট সরিয়ে নিচ্ছে মাঝখানের ৬০ টাকা। অনেক সময় কৃষকের উৎপাদন পর্যায়ে যে খরচ হয়েছিল, তার চেয়ে কম দামেও পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আবার ভোক্তারাও বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে খুচরা বাজারে। কারণ বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করে সেই সিন্ডিকেট। এতে কৃষক ও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু অবৈধ্য সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘আসলে এই সমস্যার সমাধান সহজ না। আর চালের বাজারের ক্ষেত্রেও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এবার আম্ফানে অনেক ধান নষ্ট হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা ভাবছেন, আগামীতে চালের সরবরাহ কমতে পারে। তাই আগেই সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। অর্থনীতির এটা একটা নিয়ম। সাপ্লাই কমলে দাম বেড়ে যায়। এখন এই সমস্যা দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমটি হলো- সরকার নিজে চাল কিনতে পারে এবং ভোক্তার কাছে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে। এভাবে প্রতিটি জেলায়, থানায় সরকার নিজস্ব বাজার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এখানে সরকারের বাড়তি টাকা খরচ হবে না। কারণ সরকারও ব্যবসা করবে। সরকার যখন এটি করবে তখন সিন্ডিকেটের কাছে একটা ম্যাসেজ যাবে যে, তারা যদি পণ্য স্টক করে তাহলে একটা সময় তা নষ্ট হয়ে যাবে তবুও ভোক্তা বেশি দামে কিনবে না। কারণ ভোক্তা তখন বিকল্প হিসেবে সরকারের বাজার থেকে কিনবে। আর দ্বিতীয় সমাধান হলো- যখন জিম্মি : পৃষ্ঠা : ১১ ক : ৪

জিম্মি : বাজার

(১ম পৃষ্ঠার পর)

সংকট দেখা দেবে তখন পণ্য আমদানি করতে হবে।’

তবে জানা গেছে, আমদানিতেও সিন্ডিকেট সমস্যা রয়েছে। যেসব ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তারাও সিন্ডিকেট করে বেশি দামে চাল বাজারে ছাড়ে। সেখানেও যদি এই সমস্যা হয় তাহলে সমাধান কি হবে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এজন্য তদারকি করতে হবে। তারা যে এলসি বা যে প্রক্রিয়ায় আমদানি করে, তার দাম দেখে তদন্ত করতে হবে। যদি বেশি দাম নেয় তাহলে তার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।’

মাত্র কয়েক মাস আগে পিয়াজের দাম নিয়ে বড় ধরনের হট্টগোল হলো। কয়েকদিন ধরে চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে। জানা গেছে, চালের মজুদ পর্যাপ্ত থাকার পরও দাম বাড়ছে। অর্থাৎ চাল সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই চালকল মালিকদের বলেছেন, তাদের কাছে কত চাল মজুদ আছে তা যেন জানায়। তাতে বুঝা যাবে যে, আসলে চালের সংকট রয়েছে নাকি তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। গত বুধবারও চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। এদিন পাইকারি চালের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলীতে মিনিকেট আতপ বিক্রি হচ্ছে ২২৫০ টাকা বস্তা, দিনাজপুরী পাইজাম ২৬০০ টাকা, চিনিগুঁড়া চাল ৩০০০ থেকে ৪৭০০ টাকা, ৫০ কেজি বস্তার বেতি আতপ ২০০০ টাকা, স্বর্ণা সিদ্ধ ২২৬০ থেকে ২২৬৫ টাকা, ২৫ কেজি বস্তার নাজিরশাইল সিদ্ধ ১৪৮০ টাকা, মোটা সিদ্ধ চাল ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা। পাইকারি বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বস্তাপ্রতি দাম বেশি নেয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর যখন বাজার মনিটরিং টিম যাচ্ছে তখন তখন দাম বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম প্রতিদিন সকালে বাজার মনিটরিং করে। এই টিমের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে, প্রতিটি বাজারে যেন মূল্য তালিকা টানানো থাকে এবং সেই মূল্য তালিকা অনুযায়ী যেন পণ্যের দাম রাখে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই মূল্য তালিকা সব বাজারে টানানো থাকে না। আবার অনেক সময় মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য করা হয় ক্রেতাদের। খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, পাইকারদের থেকে তারা বেশি মূল্যে পণ্য কিনেছে। তাই দাম বেশি না রাখলে লাভ হবে না তাদের। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাজার মনিটরিং টিম যখন অভিযানে যান, তখন তাদের দাম কম বলে। আবার সাধারণ ক্রেতার কাছে বেশি নেয়।

এই প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা সংবাদকে বলেন, ‘ভোক্তার স্বার্থ নিয়ে আমরা প্রতিনয়তই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। গতকালও চাল ব্যবসায়ীদের প্রায় ৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। কিন্তু যদি ভোক্তার মধ্যে সচেতনতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না হয়, তাহলে অভিজান চালিয়েও কোন লাভ হবে না।’ বাজার সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন ভোক্তার অধিকারের বিষয়ে সচেতন তেমনি ব্যবসায়ীদের বিষয়েও সচেতন। তবে ব্যবসায়ীরা যদি অসাধু উপায় অবলম্বন করে ভোক্তাকে ঠকায়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই বিকল্প ভাবতে হবে যেভাবে ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। গত ঈদেও আদার দাম কেজিতে ২৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। আমরা মাত্র ৪ দিন অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। এতেই সেই আদা ১৫০ টাকায় নেমে আসে। সেহেতু বোঝায় যায়, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূলের দাম বৃদ্ধি করছে কোন কোন সময়।’

এই মনিটরিং টিম যে নির্ধারিত ন্যায্যমূল্য হিসেবে বাজার তদারকি করে সেই ন্যায্যমূল্য নির্ধারণেও সমস্যা রয়েছে বলে জানা গেছে। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে যখন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হয় তখন তারা বাড়তি অনেক খরচ যোগ করেন। এছাড়া নির্দিষ্ট পণ্যটি পরিবহন করতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যে চাঁদা দেয়া হয় সেটাও পণ্যের খরচের মধ্যে যোগ হয়। তাহলে এসব খরচ যোগ করে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা কতটা যৌক্তিক এমন প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করি ঠিকই, কিন্তু সেটাকে প্রকৃত ন্যায্যমূল্য বলা যায় না। কারণ পণ্যটি পরিবহনে রাস্তার চাঁদাবাজদের কয় টাকা দেয়া হয়েছে সেই দায়ভার কেন ভোক্তা বহন করবে? কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে। আমরা একটা ভুল ও অনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’

সম্প্রতি চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা একে-অপরকে দোষারোপ করছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকাররা দাম বাড়াচ্ছে। আবার পাইকাররা বলছেন, তারা বস্তায় ২৫ পায়সা দাম বাড়ালে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. নিজাম উদ্দিন সংবাদকে বলেন, ‘বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তবে যে পরিমাণে খুচরা বাজারে বেড়েছে সেই পরিমাণ বাড়েনি। আমাদের এখানে দাম ২৫ পয়সা থেকে ৫০ পয়সা বাড়লে, খুচরা বাজারে বাড়ে ৩ থেকে ৪ টাকা। আমার যতটা ধারণা, মিলেও চালের দাম বাড়েনি। তারপরও খুচরা বাজারে বেড়েছে।’

তবে খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যায় আরেক পরিস্থিতি। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চালের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের কোন হাত নেই। পাইকারি বাজারে বেশি দামে চাল কিনে তাই খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। বেশি দামে না বিক্রি করলে তাদের লোকসান হবে। এভাবে বিশৃঙ্খলভাবে চলছে বাজার ব্যবস্থাপনা। বাড়তি দামে পণ্য কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তা, কিন্তু একটা অসাধু গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে।

তবে এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থা কিছুটা রোধ করে প্রান্তিক কৃষকদের রক্ষা করার জন্য কৃষকের বাজার নামের একটি কর্মসূচি শুরু করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিপণন অধিদফতর। এই কর্মসূচির নাম কৃষকের বাজার। দেশের ৬৪টি জেলায় এই কৃষকের বাজার গড়ে তোলা হবে। সেখানে ন্যায্য দামে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য কৃষকের বাজারে বিক্রি করবে। সেখান থেকে ভোক্তা সরাসরি ন্যায্য দামে কিনতে পারবে। একই সঙ্গে পণ্যগুলো হবে একেবারে নিরাপদ ও বিষমুক্ত।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে রাজধানীর কয়েকটি স্থানে কৃষকের বাজারের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালু হয়েছে। সেইসব কর্মসূচিতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। মূল প্রকল্পটি এখনও প্রস্তুত হয়নি। সেটি প্রস্তুত হলে, দেশের ৬৪টি জেলায় কৃষকের বাজার বসবে। সেই বাজারে কোন সিন্ডিকেট বা মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। কৃষক সরাসরি তার পণ্য মাঠে থেকে তুলে কৃষকের বাজারে বিক্রি করতে পারবেন।

এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান সংবাদকে বলেন, ‘কৃষকের বাজার হবে নিরাপদ কৃষিপণ্যের মার্কেট। এটা আমরা করতে চাই। তবে এটাতে অনেক শ্রম দিতে হবে। মার্কেট করার জন্য জায়গা লাগবে। সেই জায়গা কোথা থেকে পাবো সেটাও বিষয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমরা বলেছি, সবাই আগ্রহ দেখাচ্ছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য আমরা প্রত্যেক উপজেলায় দুটি করে গ্রাম নিয়েছি। নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে কিনা, সেটা কৃষি অফিসার মনিটরিং করে থাকেন। ফসল রোপণ থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত মনিটরিং হয়। মার্কেট করার ক্ষেত্রে আমরা খুব সাবধানে এগোচ্ছি যেন টেকসই একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। এই মার্কেটে কৃষক সরাসরি এসে তার পণ্য বিক্রি করবেন।’

বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ছোট ছোট হাটে কৃষক সরাসরি পণ্য বিক্রি করছেন। সেই পণ্য যায় আড়তে। তারপর আবার আড়ত থেকে পাইকাররা নিয়ে যান বড় শহরে। সাধারণত কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা পণ্য নিয়ে যান। কিন্তু কৃষকের বাজার হলে চাষিরা জেলাপর্যায়ে নিজেই পণ্য নিয়ে সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। তাকে কোন ধরনের টোল দিতে হবে না। আমরা সেফ ফুড মার্কেট করতে চাচ্ছি এজন্য যে, সবজি সরাসরি এসে আমাদের রান্নাঘরে ঢোকে।’

যে সিন্ডিকেট ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য রোধে এই বাজার করা হচ্ছে সেখানে বাজারের কোন দুর্বলতার কারণে সেখানেও সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ঢুকে পড়তে পারে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষি বিপণন অধিদফতরের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘এই বাজারটি করা হচ্ছে কৃষকের জন্য। কৃষক এখানে সরাসরি তার উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করবে। একজন ভোক্তা সেখান থেকে ন্যায্য দামে পণ্য কিনে ভোগ করবেন। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। তারপরও বাজার যেহেতু প্রতিটি গ্রামে করা সম্ভব না, তাই পাইকাররা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনেও কৃষক বাজারে বিক্রি করতে পারেন। তবে সেখানেও আমাদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। আর কৃষক সরাসরি বিক্রি করলে তো আর কোন কথায় থাকল না। তারপরও কৃষকের মধ্যে আমরা গ্রুপ মার্কেটিং করার জন্য উৎসাহিত করছি। গ্রুপ মার্কেটিং করলে কয়েকজন কৃষক তাদের পণ্য দূর থেকেও জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবেন। সেখানে পাইকারের কাছেও বিক্রি করতে হবে না।’

একজন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক নিজে পণ্য উৎপাদন করেন। তাই সেই পণ্যটির লাভের বেশিরভাগ অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা ও অরাজগতার কারণে মধ্যেস্বত্বভোগীরা লাভের সিংহভাগ ভোগ করছে। আর বর্তমানে এই সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী। তারা যেকোন সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় হয়েছে ৭ টাকা ৬০ পয়সা। কৃষক তা গড়ে ১ টাকা ২৫ পয়সা লাভে বিক্রি করেন প্রতি কেজি ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী একই আলু কিনে বিক্রি করেন ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে। এতে তার ব্যয় হয় ১ টাকা ১০ পয়সা, লাভ হয় সোয়া ২ টাকা। পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হয় ১৭ টাকা ১৫ পয়সা কেজিতে। পাইকার ১ টাকা ৬০ পয়সা খরচ করে লাভ করেন ৩ টাকা ৩৫ পয়সা। খুচরা বিক্রেতা কেজিতে ৯০ পয়সা ব্যয় ও ৩ টাকা ৯৫ পয়সা লাভ করে আলু বিক্রি করেন প্রতি কেজি ২২ টাকায়।

দেখা যাচ্ছে, কৃষক তার উৎপাদিত আলু বিক্রি করে যে পরিমাণ লাভ করে তার থেকে বেশি লাভ করে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা। এটা হলো- কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পরিসংখ্যান। সরেজমিনে এরচেয়ে বেশি লাভ করে সিন্ডিকেট বা মধ্যস্বত্বভোগীরা।

আরও খবর
টার্গেট সাড়ে ১৯ লাখ টন সংগ্রহ ৮ লাখ ৩৬ হাজার টন
রেডিও, টিভি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণেও নিবন্ধন লাগবে
প্রণব মুখার্জির জীবনাবসান
প্রণব মুখার্জির মৃত্যু উপমহাদেশের রাজনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি : রাষ্ট্রপতি
প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয় : প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন
আরও ৩৩ জনের মৃত্যু
নন্দদুলালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
আগের ভাড়ায় আজ থেকে চলবে গণপরিবহন
লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব রেলওয়ের
জীবিত স্কুলছাত্রী হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরখাস্ত
ক্রসফায়ারে হত্যায় বরখাস্ত ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা
ঠিকাদার শাহাদাত জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারাগার থেকে মুক্ত!

মঙ্গলবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১১ মহররম ১৪৪২, ১৫ ভাদ্র ১৪২৭

করোনাকাল অথবা করোনাকাল নয় সবসময়ই

সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি বাজার ব্যবস্থা

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা সরকারকে বিকল্প বাজার তৈরির পরামর্শ

রেজাউল করিম

সিন্ডিকেটের কাছে এক ধরনের জিম্মিই হয়ে পড়েছে দেশের বাজার ব্যবস্থা। কয়েক মাস আগেও সংকটের কারণে বহুগুণ বেড়েছিল পিয়াজের দাম। তখনও কিন্তু কিছু পিয়াজ গুদামে পচে নষ্ট হয়েছিল। অর্থাৎ সংকটের মধ্যেও একটা সিন্ডিকেট পিয়াজ মজুদ করে বাজারে অতিরিক্ত সংকট সৃষ্টি করেছিল। আর গত এক সপ্তাহ ধরে শুরু হয়েছে চালের সিন্ডিকেট। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কিন্তু বাজারে চালের দাম বাড়ছেই। কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থাৎ চালের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও রয়েছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সরকার দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকে নাগালে আনার চেষ্টা করলেও তা নাগালে আসছে না। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধরা যাক, একজন কৃষক এক কেজি বেগুন উৎপাদন করে তা বিক্রি করছে ২০ টাকায়। কয়েক হাত ঘুরে একজন ভোক্তা সেই বেগুন কিনছে ৮০ টাকায়। কৃষক পাচ্ছে ২০ টাকা। সাধারণ জনগণ কিনছে ৮০ টাকায়। সিন্ডিকেট সরিয়ে নিচ্ছে মাঝখানের ৬০ টাকা। অনেক সময় কৃষকের উৎপাদন পর্যায়ে যে খরচ হয়েছিল, তার চেয়ে কম দামেও পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আবার ভোক্তারাও বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে খুচরা বাজারে। কারণ বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করে সেই সিন্ডিকেট। এতে কৃষক ও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু অবৈধ্য সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘আসলে এই সমস্যার সমাধান সহজ না। আর চালের বাজারের ক্ষেত্রেও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এবার আম্ফানে অনেক ধান নষ্ট হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা ভাবছেন, আগামীতে চালের সরবরাহ কমতে পারে। তাই আগেই সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। অর্থনীতির এটা একটা নিয়ম। সাপ্লাই কমলে দাম বেড়ে যায়। এখন এই সমস্যা দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমটি হলো- সরকার নিজে চাল কিনতে পারে এবং ভোক্তার কাছে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে। এভাবে প্রতিটি জেলায়, থানায় সরকার নিজস্ব বাজার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এখানে সরকারের বাড়তি টাকা খরচ হবে না। কারণ সরকারও ব্যবসা করবে। সরকার যখন এটি করবে তখন সিন্ডিকেটের কাছে একটা ম্যাসেজ যাবে যে, তারা যদি পণ্য স্টক করে তাহলে একটা সময় তা নষ্ট হয়ে যাবে তবুও ভোক্তা বেশি দামে কিনবে না। কারণ ভোক্তা তখন বিকল্প হিসেবে সরকারের বাজার থেকে কিনবে। আর দ্বিতীয় সমাধান হলো- যখন জিম্মি : পৃষ্ঠা : ১১ ক : ৪

জিম্মি : বাজার

(১ম পৃষ্ঠার পর)

সংকট দেখা দেবে তখন পণ্য আমদানি করতে হবে।’

তবে জানা গেছে, আমদানিতেও সিন্ডিকেট সমস্যা রয়েছে। যেসব ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তারাও সিন্ডিকেট করে বেশি দামে চাল বাজারে ছাড়ে। সেখানেও যদি এই সমস্যা হয় তাহলে সমাধান কি হবে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এজন্য তদারকি করতে হবে। তারা যে এলসি বা যে প্রক্রিয়ায় আমদানি করে, তার দাম দেখে তদন্ত করতে হবে। যদি বেশি দাম নেয় তাহলে তার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।’

মাত্র কয়েক মাস আগে পিয়াজের দাম নিয়ে বড় ধরনের হট্টগোল হলো। কয়েকদিন ধরে চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে। জানা গেছে, চালের মজুদ পর্যাপ্ত থাকার পরও দাম বাড়ছে। অর্থাৎ চাল সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই চালকল মালিকদের বলেছেন, তাদের কাছে কত চাল মজুদ আছে তা যেন জানায়। তাতে বুঝা যাবে যে, আসলে চালের সংকট রয়েছে নাকি তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। গত বুধবারও চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। এদিন পাইকারি চালের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলীতে মিনিকেট আতপ বিক্রি হচ্ছে ২২৫০ টাকা বস্তা, দিনাজপুরী পাইজাম ২৬০০ টাকা, চিনিগুঁড়া চাল ৩০০০ থেকে ৪৭০০ টাকা, ৫০ কেজি বস্তার বেতি আতপ ২০০০ টাকা, স্বর্ণা সিদ্ধ ২২৬০ থেকে ২২৬৫ টাকা, ২৫ কেজি বস্তার নাজিরশাইল সিদ্ধ ১৪৮০ টাকা, মোটা সিদ্ধ চাল ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা। পাইকারি বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বস্তাপ্রতি দাম বেশি নেয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর যখন বাজার মনিটরিং টিম যাচ্ছে তখন তখন দাম বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম প্রতিদিন সকালে বাজার মনিটরিং করে। এই টিমের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে, প্রতিটি বাজারে যেন মূল্য তালিকা টানানো থাকে এবং সেই মূল্য তালিকা অনুযায়ী যেন পণ্যের দাম রাখে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই মূল্য তালিকা সব বাজারে টানানো থাকে না। আবার অনেক সময় মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য করা হয় ক্রেতাদের। খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, পাইকারদের থেকে তারা বেশি মূল্যে পণ্য কিনেছে। তাই দাম বেশি না রাখলে লাভ হবে না তাদের। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাজার মনিটরিং টিম যখন অভিযানে যান, তখন তাদের দাম কম বলে। আবার সাধারণ ক্রেতার কাছে বেশি নেয়।

এই প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা সংবাদকে বলেন, ‘ভোক্তার স্বার্থ নিয়ে আমরা প্রতিনয়তই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। গতকালও চাল ব্যবসায়ীদের প্রায় ৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। কিন্তু যদি ভোক্তার মধ্যে সচেতনতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না হয়, তাহলে অভিজান চালিয়েও কোন লাভ হবে না।’ বাজার সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন ভোক্তার অধিকারের বিষয়ে সচেতন তেমনি ব্যবসায়ীদের বিষয়েও সচেতন। তবে ব্যবসায়ীরা যদি অসাধু উপায় অবলম্বন করে ভোক্তাকে ঠকায়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই বিকল্প ভাবতে হবে যেভাবে ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। গত ঈদেও আদার দাম কেজিতে ২৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। আমরা মাত্র ৪ দিন অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। এতেই সেই আদা ১৫০ টাকায় নেমে আসে। সেহেতু বোঝায় যায়, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূলের দাম বৃদ্ধি করছে কোন কোন সময়।’

এই মনিটরিং টিম যে নির্ধারিত ন্যায্যমূল্য হিসেবে বাজার তদারকি করে সেই ন্যায্যমূল্য নির্ধারণেও সমস্যা রয়েছে বলে জানা গেছে। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে যখন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হয় তখন তারা বাড়তি অনেক খরচ যোগ করেন। এছাড়া নির্দিষ্ট পণ্যটি পরিবহন করতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যে চাঁদা দেয়া হয় সেটাও পণ্যের খরচের মধ্যে যোগ হয়। তাহলে এসব খরচ যোগ করে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা কতটা যৌক্তিক এমন প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করি ঠিকই, কিন্তু সেটাকে প্রকৃত ন্যায্যমূল্য বলা যায় না। কারণ পণ্যটি পরিবহনে রাস্তার চাঁদাবাজদের কয় টাকা দেয়া হয়েছে সেই দায়ভার কেন ভোক্তা বহন করবে? কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে। আমরা একটা ভুল ও অনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’

সম্প্রতি চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা একে-অপরকে দোষারোপ করছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকাররা দাম বাড়াচ্ছে। আবার পাইকাররা বলছেন, তারা বস্তায় ২৫ পায়সা দাম বাড়ালে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. নিজাম উদ্দিন সংবাদকে বলেন, ‘বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তবে যে পরিমাণে খুচরা বাজারে বেড়েছে সেই পরিমাণ বাড়েনি। আমাদের এখানে দাম ২৫ পয়সা থেকে ৫০ পয়সা বাড়লে, খুচরা বাজারে বাড়ে ৩ থেকে ৪ টাকা। আমার যতটা ধারণা, মিলেও চালের দাম বাড়েনি। তারপরও খুচরা বাজারে বেড়েছে।’

তবে খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যায় আরেক পরিস্থিতি। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চালের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের কোন হাত নেই। পাইকারি বাজারে বেশি দামে চাল কিনে তাই খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। বেশি দামে না বিক্রি করলে তাদের লোকসান হবে। এভাবে বিশৃঙ্খলভাবে চলছে বাজার ব্যবস্থাপনা। বাড়তি দামে পণ্য কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তা, কিন্তু একটা অসাধু গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে।

তবে এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থা কিছুটা রোধ করে প্রান্তিক কৃষকদের রক্ষা করার জন্য কৃষকের বাজার নামের একটি কর্মসূচি শুরু করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিপণন অধিদফতর। এই কর্মসূচির নাম কৃষকের বাজার। দেশের ৬৪টি জেলায় এই কৃষকের বাজার গড়ে তোলা হবে। সেখানে ন্যায্য দামে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য কৃষকের বাজারে বিক্রি করবে। সেখান থেকে ভোক্তা সরাসরি ন্যায্য দামে কিনতে পারবে। একই সঙ্গে পণ্যগুলো হবে একেবারে নিরাপদ ও বিষমুক্ত।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে রাজধানীর কয়েকটি স্থানে কৃষকের বাজারের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালু হয়েছে। সেইসব কর্মসূচিতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। মূল প্রকল্পটি এখনও প্রস্তুত হয়নি। সেটি প্রস্তুত হলে, দেশের ৬৪টি জেলায় কৃষকের বাজার বসবে। সেই বাজারে কোন সিন্ডিকেট বা মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। কৃষক সরাসরি তার পণ্য মাঠে থেকে তুলে কৃষকের বাজারে বিক্রি করতে পারবেন।

এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান সংবাদকে বলেন, ‘কৃষকের বাজার হবে নিরাপদ কৃষিপণ্যের মার্কেট। এটা আমরা করতে চাই। তবে এটাতে অনেক শ্রম দিতে হবে। মার্কেট করার জন্য জায়গা লাগবে। সেই জায়গা কোথা থেকে পাবো সেটাও বিষয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমরা বলেছি, সবাই আগ্রহ দেখাচ্ছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য আমরা প্রত্যেক উপজেলায় দুটি করে গ্রাম নিয়েছি। নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে কিনা, সেটা কৃষি অফিসার মনিটরিং করে থাকেন। ফসল রোপণ থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত মনিটরিং হয়। মার্কেট করার ক্ষেত্রে আমরা খুব সাবধানে এগোচ্ছি যেন টেকসই একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। এই মার্কেটে কৃষক সরাসরি এসে তার পণ্য বিক্রি করবেন।’

বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ছোট ছোট হাটে কৃষক সরাসরি পণ্য বিক্রি করছেন। সেই পণ্য যায় আড়তে। তারপর আবার আড়ত থেকে পাইকাররা নিয়ে যান বড় শহরে। সাধারণত কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা পণ্য নিয়ে যান। কিন্তু কৃষকের বাজার হলে চাষিরা জেলাপর্যায়ে নিজেই পণ্য নিয়ে সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। তাকে কোন ধরনের টোল দিতে হবে না। আমরা সেফ ফুড মার্কেট করতে চাচ্ছি এজন্য যে, সবজি সরাসরি এসে আমাদের রান্নাঘরে ঢোকে।’

যে সিন্ডিকেট ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য রোধে এই বাজার করা হচ্ছে সেখানে বাজারের কোন দুর্বলতার কারণে সেখানেও সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ঢুকে পড়তে পারে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষি বিপণন অধিদফতরের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘এই বাজারটি করা হচ্ছে কৃষকের জন্য। কৃষক এখানে সরাসরি তার উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করবে। একজন ভোক্তা সেখান থেকে ন্যায্য দামে পণ্য কিনে ভোগ করবেন। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। তারপরও বাজার যেহেতু প্রতিটি গ্রামে করা সম্ভব না, তাই পাইকাররা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনেও কৃষক বাজারে বিক্রি করতে পারেন। তবে সেখানেও আমাদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। আর কৃষক সরাসরি বিক্রি করলে তো আর কোন কথায় থাকল না। তারপরও কৃষকের মধ্যে আমরা গ্রুপ মার্কেটিং করার জন্য উৎসাহিত করছি। গ্রুপ মার্কেটিং করলে কয়েকজন কৃষক তাদের পণ্য দূর থেকেও জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবেন। সেখানে পাইকারের কাছেও বিক্রি করতে হবে না।’

একজন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক নিজে পণ্য উৎপাদন করেন। তাই সেই পণ্যটির লাভের বেশিরভাগ অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা ও অরাজগতার কারণে মধ্যেস্বত্বভোগীরা লাভের সিংহভাগ ভোগ করছে। আর বর্তমানে এই সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী। তারা যেকোন সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় হয়েছে ৭ টাকা ৬০ পয়সা। কৃষক তা গড়ে ১ টাকা ২৫ পয়সা লাভে বিক্রি করেন প্রতি কেজি ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী একই আলু কিনে বিক্রি করেন ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে। এতে তার ব্যয় হয় ১ টাকা ১০ পয়সা, লাভ হয় সোয়া ২ টাকা। পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হয় ১৭ টাকা ১৫ পয়সা কেজিতে। পাইকার ১ টাকা ৬০ পয়সা খরচ করে লাভ করেন ৩ টাকা ৩৫ পয়সা। খুচরা বিক্রেতা কেজিতে ৯০ পয়সা ব্যয় ও ৩ টাকা ৯৫ পয়সা লাভ করে আলু বিক্রি করেন প্রতি কেজি ২২ টাকায়।

দেখা যাচ্ছে, কৃষক তার উৎপাদিত আলু বিক্রি করে যে পরিমাণ লাভ করে তার থেকে বেশি লাভ করে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা। এটা হলো- কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পরিসংখ্যান। সরেজমিনে এরচেয়ে বেশি লাভ করে সিন্ডিকেট বা মধ্যস্বত্বভোগীরা।