বিয়াল্লিশ বছরে বিএনপির সাফল্য-ব্যর্থতা

মোহাম্মদ শাহজাহান

আজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ৪২ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৭৮ সালের এ দিনে দেশের প্রথম স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান সময়ে দলটি প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। দুর্নীতির দায়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। দুই বছর কারাবাসের পর কারাদণ্ড স্থগিত করে বিএনপি নেত্রীকে ছয় মাসের জামিন দেয়া হয়েছে। এ মাসের শেষ দিকে তার জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। দণ্ডিত হওয়ার পর বেগম জিয়া তার প্রবাসী (পলাতক) পুত্র তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। ২১ আগস্ট (২০০৪) গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আরও দুটি মামলায় দুর্নীতির দায়ে তার (১০+৭) ১৭ বছর সাজা হয়েছে। ২০০৮ সালে ‘রাজনীতি করবেন না’- এই মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বের হয়ে তারেক ব্রিটেনে চলে যান। সেই থেকে ১২ বছর ধরে তিনি লন্ডনে বসে বসে রাজনীতি করছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরিবারের সদস্যসহ আরও অনেক হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

এক সময় দেশের সম্ভাবনাময় অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি যে আজকে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে, তা এমনিতেই আসেনি। জিয়া, বেগম জিয়া, তাদের পুত্র তারেক রহমান এবং বিএনপির দুষ্কর্মের জন্যই দলটি চরম দুরবস্থায় পতিত হয়েছে। আর দুষ্কর্মের খেসারত দিতে হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। অপকর্মের কারিগর জিয়াপুত্র তো তার পলাতক জীবনে আরাম আয়াশেই রয়েছেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে ঘোষিত ফলাফলে বিএনপি জোটের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর মতোই হামলা-নির্যাতন চলতে থাকে। পূর্ণিমাসহ বহু কিশোরী যুবতী ও নারীকে ওই সময়ে ধর্ষণের করা হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের আমলে গ্রেনেড হামলা ছাড়াও ওই সময় আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী, এসএএমএস কিবরিয়া, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় অসংখ্য মামলা।

এক সময়ের জনপ্রিয় নেত্রী, দেশের দুবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলার রায়ে ১০ বছরের সাজা পেয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে রয়েছেন। বারবার ভুল রাজনীতি এবং তার পুত্রকে অত্যধিক প্রশ্রয় দেয়ার কারণে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শেষ হতে চলেছে। দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে বিএনপি নেত্রী যদি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন না করতেন, ওই নির্বাচন প্রতিহত করার নামে সন্ত্রাস না করতেন এবং ২০১৫ সালের অবরোধ আন্দোলনের নামে তার সন্ত্রাসী আন্দোলনে শত শত মানুষ প্রাণ না হারাতো তাহলে বেগম জিয়া এবং বিএনপি আজকের দুর্দশায় পতিত হতো না। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়, বাংলাদেশের রাজনীতি হয়তো আজ অন্য খাতে প্রবাহিত হতো। ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দেশের বড় বড় সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটের মেয়র পদে বিপুল ভোটে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিল। এমনকি দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ হিসেবে পরিচিত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের হ্যাটট্রিক বিজয়ী মেয়র আজমতউল্লা খানও পরাজিত হয়েছিলেন। বিএনপি বর্জন না করলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও বিএনপির আসন সংখ্যা অবিশ্বাস্য সংখ্যায় বেড়ে যেত। সেই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বেগম জিয়া যে চরম ভুল করেছেন, এর মাশুলই বিএনপি এবং বেগম জিয়াকে দিতে হচ্ছে। অথচ ওই নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপি সিনিয়র নেতারাসহ প্রায় সব নেতাকর্মী প্রস্তুত ছিলেন। নির্বাচন বর্জন করেও ম্যাডাম ক্ষ্যান্ত থাকেননি, ওই নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য শুরু হয় দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা। যানবাহনে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত মানুষ পর্যন্ত তখন হত্যা করা হয়। উপর্যুপরি ব্যর্থতার পরও বেগম জিয়া চুপ থাকতে পারলেন না। পরের বছর ২০১৫ সালের বেগম জিয়ার একক সিদ্ধান্তে নির্বাচনের ১ম বর্ষপূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি থেকে তিনি সরকার পতনের জন্য অবরোধ আন্দোলনের নামে আবার রাজপথে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেন।

ওই সময় চলন্ত বাসে বোমা হামলা ও আগুন লাগিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। আগুন জ্বালিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করা হয়। ৭/৮ মাস সময় ধরে মানুষ হত্যা ও রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট করে বেগম জিয়া আত্মসমর্পণ করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, বেগম জিয়ার লক্ষ্য ছিল যে কোনভাবে নির্বাচন হতে না দেয়া। আর নির্বাচন না হলে দেশে অসাংবিধানিক শাসন আসতো- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারত না। আর এটাই বিএনপির লক্ষ্য।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাজা পেয়ে বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন। বিদেশে পলাতক রাজনীতিতে অর্বাচীন তার গুণধর পুত্রকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলেন। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বহীন দু-একজন ছাড়া কেউ মনেপ্রাণে তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না। রিজভী-জাতীয় কিছু নেতাকর্মী ছাড়া দলের বৃহত্তর অংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের তেমন কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

তাছাড়া তারেক রহমান গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। আরও দুটি মামলায় তার দুর্নীতির দায়ে ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। ১২ বছর ধরে তিনি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি দেড় বছরের বেশি ছিলেন জেলে। তারেক রহমান বিএনপিতে সুযোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাদের সহ্য করতে পারেন না। ২০০১ সালে বেগম জিয়া দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তারেক রহমানরা ষড়যন্ত্র করে বি. চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। গত সংসদ নির্বাচনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ৬/৭টি আসন পায়। এর মধ্যে একটিতে জয়ী হন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারেক রহমান এক নোংরা রাজনীতির মাধ্যমে মির্জা ফখরুলের আসন শূন্য করেন। মির্জা ফখরুল সংসদে থাকলে বিএনপিরই লাভ হতো। পলাতক তারেকের অবর্তমানে ফখরুল তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। সংসদে বিএনপির গ্রুপ নেতা হিসেবে ফখরুল ইসলামকে এগিয়ে যেতে দেবেন না-এটাই তারেকের প্রতিহিংসা।

বিভিন্ন মহলে এতদিন গুঞ্জন ছিল, তারেক রহমান সময় সুযোগ মতো যে কোন সময় মির্জা ফখরুলকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। ২৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকের চার কলাম লিড নিউজের শিরোনাম ছিল- ‘তারেক কেন খুঁজছেন ফখরুলের উত্তরসূরি?’ ওই খবরে বলা হয়, : ‘তারেক রহমান তার পছন্দের একজনকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়ার জন্য লোক খুঁজছেন। সারা দেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনে নিজের পছন্দের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন পদে জায়গা করে দিচ্ছেন তিনি। এদিকে মির্জা ফখরুলে সমর্থকদের দাবি, তার বিকল্প কেউ তৈরি হয়নি। দেশে এবং দেশের বাইরে তার যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, তা এ মুহূর্তে দলে অন্য কারও নেই। কূটনীতিকদের কাছেও তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। তাছাড়া মির্জা ফখরুলকে বাদ দিলে দলের গোপন দ্বিধাবিভক্তি আরও তীব্র হবে।’ আবার কেউ কেউ মনে করেন, মির্জা ফখরুলকে সরিয়ে দিলে দুর্বল বিএনপি শুধু আরও দুর্বল হবে না, আরেকটি ভাঙনও অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

খালেদা, এরশাদ ও তারেক সেই রাষ্ট্রদ্রোহী জিয়ারই উত্তরসূরি। বেগম জিয়া দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ৭৫ বছরের এই নেত্রী বেশ অসুস্থ এবং দুই বছর কারাগারে থেকে তার মনোবলও অনেকটা ভেঙে গেছে। তারেক রহমান গ্রেনেড হামলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনা, দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন।

দেশে বর্তমানে কোন বিরোধী দল নেই বললেই চলে। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে ক্ষমতাসীনদের দৈত্য-দানবে পরিণত হতে দেখা যায়। দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল খুবই প্রয়োজন। দেশের মানুষ এবং ক্ষমতাসীনরা এখনও বিএনপিকেই প্রধান বিরোধী দল মনে করে। এখনও এই দলের এক বিশাল কর্মীবাহিনী রয়েছে। জনসমর্থন নেই এ কথাও বলা যাবে না। জিয়ার স্বৈরশাসনকাল বাদ দিলেও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি ১০ বছর দেশ শাসন করেছে। বেগম জিয়া এবং তদীয় পুত্রের ভুল রাজনীতি দলটিকে বর্তমানের করুণ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া বা মির্জা ফখরুল ও অন্য শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিকভাবে স্বাধীনতার মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতা এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের (অবিকৃত) প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বিএনপি যদি রাজনীতি করে তাহলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে আসা অসম্ভব কিছু নয়। বস্তুত জামিনে মুক্ত বেগম খালেদা জিয়া কি সিদ্ধান্ত নেন তার ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যৎ।

২৯ আগস্ট, ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১১ মহররম ১৪৪২, ১৫ ভাদ্র ১৪২৭

বিয়াল্লিশ বছরে বিএনপির সাফল্য-ব্যর্থতা

মোহাম্মদ শাহজাহান

আজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ৪২ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৭৮ সালের এ দিনে দেশের প্রথম স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান সময়ে দলটি প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। দুর্নীতির দায়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। দুই বছর কারাবাসের পর কারাদণ্ড স্থগিত করে বিএনপি নেত্রীকে ছয় মাসের জামিন দেয়া হয়েছে। এ মাসের শেষ দিকে তার জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। দণ্ডিত হওয়ার পর বেগম জিয়া তার প্রবাসী (পলাতক) পুত্র তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। ২১ আগস্ট (২০০৪) গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আরও দুটি মামলায় দুর্নীতির দায়ে তার (১০+৭) ১৭ বছর সাজা হয়েছে। ২০০৮ সালে ‘রাজনীতি করবেন না’- এই মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বের হয়ে তারেক ব্রিটেনে চলে যান। সেই থেকে ১২ বছর ধরে তিনি লন্ডনে বসে বসে রাজনীতি করছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরিবারের সদস্যসহ আরও অনেক হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

এক সময় দেশের সম্ভাবনাময় অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি যে আজকে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে, তা এমনিতেই আসেনি। জিয়া, বেগম জিয়া, তাদের পুত্র তারেক রহমান এবং বিএনপির দুষ্কর্মের জন্যই দলটি চরম দুরবস্থায় পতিত হয়েছে। আর দুষ্কর্মের খেসারত দিতে হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। অপকর্মের কারিগর জিয়াপুত্র তো তার পলাতক জীবনে আরাম আয়াশেই রয়েছেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে ঘোষিত ফলাফলে বিএনপি জোটের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর মতোই হামলা-নির্যাতন চলতে থাকে। পূর্ণিমাসহ বহু কিশোরী যুবতী ও নারীকে ওই সময়ে ধর্ষণের করা হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের আমলে গ্রেনেড হামলা ছাড়াও ওই সময় আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী, এসএএমএস কিবরিয়া, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় অসংখ্য মামলা।

এক সময়ের জনপ্রিয় নেত্রী, দেশের দুবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলার রায়ে ১০ বছরের সাজা পেয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে রয়েছেন। বারবার ভুল রাজনীতি এবং তার পুত্রকে অত্যধিক প্রশ্রয় দেয়ার কারণে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শেষ হতে চলেছে। দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে বিএনপি নেত্রী যদি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন না করতেন, ওই নির্বাচন প্রতিহত করার নামে সন্ত্রাস না করতেন এবং ২০১৫ সালের অবরোধ আন্দোলনের নামে তার সন্ত্রাসী আন্দোলনে শত শত মানুষ প্রাণ না হারাতো তাহলে বেগম জিয়া এবং বিএনপি আজকের দুর্দশায় পতিত হতো না। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়, বাংলাদেশের রাজনীতি হয়তো আজ অন্য খাতে প্রবাহিত হতো। ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দেশের বড় বড় সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটের মেয়র পদে বিপুল ভোটে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিল। এমনকি দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ হিসেবে পরিচিত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের হ্যাটট্রিক বিজয়ী মেয়র আজমতউল্লা খানও পরাজিত হয়েছিলেন। বিএনপি বর্জন না করলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও বিএনপির আসন সংখ্যা অবিশ্বাস্য সংখ্যায় বেড়ে যেত। সেই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বেগম জিয়া যে চরম ভুল করেছেন, এর মাশুলই বিএনপি এবং বেগম জিয়াকে দিতে হচ্ছে। অথচ ওই নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপি সিনিয়র নেতারাসহ প্রায় সব নেতাকর্মী প্রস্তুত ছিলেন। নির্বাচন বর্জন করেও ম্যাডাম ক্ষ্যান্ত থাকেননি, ওই নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য শুরু হয় দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা। যানবাহনে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত মানুষ পর্যন্ত তখন হত্যা করা হয়। উপর্যুপরি ব্যর্থতার পরও বেগম জিয়া চুপ থাকতে পারলেন না। পরের বছর ২০১৫ সালের বেগম জিয়ার একক সিদ্ধান্তে নির্বাচনের ১ম বর্ষপূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি থেকে তিনি সরকার পতনের জন্য অবরোধ আন্দোলনের নামে আবার রাজপথে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেন।

ওই সময় চলন্ত বাসে বোমা হামলা ও আগুন লাগিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। আগুন জ্বালিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করা হয়। ৭/৮ মাস সময় ধরে মানুষ হত্যা ও রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট করে বেগম জিয়া আত্মসমর্পণ করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, বেগম জিয়ার লক্ষ্য ছিল যে কোনভাবে নির্বাচন হতে না দেয়া। আর নির্বাচন না হলে দেশে অসাংবিধানিক শাসন আসতো- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারত না। আর এটাই বিএনপির লক্ষ্য।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাজা পেয়ে বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন। বিদেশে পলাতক রাজনীতিতে অর্বাচীন তার গুণধর পুত্রকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলেন। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বহীন দু-একজন ছাড়া কেউ মনেপ্রাণে তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না। রিজভী-জাতীয় কিছু নেতাকর্মী ছাড়া দলের বৃহত্তর অংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের তেমন কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

তাছাড়া তারেক রহমান গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। আরও দুটি মামলায় তার দুর্নীতির দায়ে ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। ১২ বছর ধরে তিনি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি দেড় বছরের বেশি ছিলেন জেলে। তারেক রহমান বিএনপিতে সুযোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাদের সহ্য করতে পারেন না। ২০০১ সালে বেগম জিয়া দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তারেক রহমানরা ষড়যন্ত্র করে বি. চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। গত সংসদ নির্বাচনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ৬/৭টি আসন পায়। এর মধ্যে একটিতে জয়ী হন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারেক রহমান এক নোংরা রাজনীতির মাধ্যমে মির্জা ফখরুলের আসন শূন্য করেন। মির্জা ফখরুল সংসদে থাকলে বিএনপিরই লাভ হতো। পলাতক তারেকের অবর্তমানে ফখরুল তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। সংসদে বিএনপির গ্রুপ নেতা হিসেবে ফখরুল ইসলামকে এগিয়ে যেতে দেবেন না-এটাই তারেকের প্রতিহিংসা।

বিভিন্ন মহলে এতদিন গুঞ্জন ছিল, তারেক রহমান সময় সুযোগ মতো যে কোন সময় মির্জা ফখরুলকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। ২৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকের চার কলাম লিড নিউজের শিরোনাম ছিল- ‘তারেক কেন খুঁজছেন ফখরুলের উত্তরসূরি?’ ওই খবরে বলা হয়, : ‘তারেক রহমান তার পছন্দের একজনকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়ার জন্য লোক খুঁজছেন। সারা দেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনে নিজের পছন্দের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন পদে জায়গা করে দিচ্ছেন তিনি। এদিকে মির্জা ফখরুলে সমর্থকদের দাবি, তার বিকল্প কেউ তৈরি হয়নি। দেশে এবং দেশের বাইরে তার যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, তা এ মুহূর্তে দলে অন্য কারও নেই। কূটনীতিকদের কাছেও তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। তাছাড়া মির্জা ফখরুলকে বাদ দিলে দলের গোপন দ্বিধাবিভক্তি আরও তীব্র হবে।’ আবার কেউ কেউ মনে করেন, মির্জা ফখরুলকে সরিয়ে দিলে দুর্বল বিএনপি শুধু আরও দুর্বল হবে না, আরেকটি ভাঙনও অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

খালেদা, এরশাদ ও তারেক সেই রাষ্ট্রদ্রোহী জিয়ারই উত্তরসূরি। বেগম জিয়া দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ৭৫ বছরের এই নেত্রী বেশ অসুস্থ এবং দুই বছর কারাগারে থেকে তার মনোবলও অনেকটা ভেঙে গেছে। তারেক রহমান গ্রেনেড হামলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনা, দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন।

দেশে বর্তমানে কোন বিরোধী দল নেই বললেই চলে। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে ক্ষমতাসীনদের দৈত্য-দানবে পরিণত হতে দেখা যায়। দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল খুবই প্রয়োজন। দেশের মানুষ এবং ক্ষমতাসীনরা এখনও বিএনপিকেই প্রধান বিরোধী দল মনে করে। এখনও এই দলের এক বিশাল কর্মীবাহিনী রয়েছে। জনসমর্থন নেই এ কথাও বলা যাবে না। জিয়ার স্বৈরশাসনকাল বাদ দিলেও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি ১০ বছর দেশ শাসন করেছে। বেগম জিয়া এবং তদীয় পুত্রের ভুল রাজনীতি দলটিকে বর্তমানের করুণ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া বা মির্জা ফখরুল ও অন্য শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিকভাবে স্বাধীনতার মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতা এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের (অবিকৃত) প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বিএনপি যদি রাজনীতি করে তাহলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে আসা অসম্ভব কিছু নয়। বস্তুত জামিনে মুক্ত বেগম খালেদা জিয়া কি সিদ্ধান্ত নেন তার ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যৎ।

২৯ আগস্ট, ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com