‘কাল বাঁচতে হলে আজ সরব হও’

দেবাহুতি চক্রবর্তী

শিরোনামটা সাম্প্রতিককালের ভারতের সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর এক যুব সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে উধৃতি। আইনজীবীর নাম প্রশান্ত ভূষণ। স্বাধীন ব্যক্তিসত্তায় বাঁচার জন্য, বাঁচানোর জন্য তিনি সরব হয়েছেন। সরব হয়েছেন তার সঙ্গে ভারতজুড়ে হাজার হাজার আইনজীবী। ভারতের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত অনেক প্রাজ্ঞ বিচারপতি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভারতে চলমান এই ঘটনা নিয়ে আমাদের জেনে বা বুঝে লাভ কী? কখনও কখনও কিছু ঘটনা দেশ -কাল-পাত্রের গণ্ডি ছাড়িয়েই উপলব্ধির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন অন্যত্র।

দেশভাগ পরবর্তী এই উপমহাদেশীয় দেশগুলি ব্রিটিশ প্রণীত দেওয়ানি, ফৌজদারি ও বিবিধ আইনের উত্তরাধিকার কিছু কিছু সংশোধনী বাদে আজও কম-বেশি বহন করে। আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইন Act No X11 Of 1926 অবিভক্ত ভারত থেকে আমরা পাই। ভারত-বাংলাদেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু পৃথক সংশোধনী অন্যান্য আইনের মতো এইক্ষেত্রেও আসে। এই দুই দেশই নিজেকে প্রজাতন্ত্র পরিচয়ে আখ্যায়িত করে। এবং দুই দেশেই সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিচারবিভাগকে সম্মান দেওয়া হয়। অনেকেই মনে করেন, সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার প্রধান অভিভাবক বিচারবিভাগ ও আদালত। এ বিচারবিভাগ বা আদালত জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ যাতে না হয়, তার জন্য রাষ্ট্রের সব অঙ্গর সক্রিয় ও সচেষ্ট থাকার কথা। বিচারবিভাগ ও আদালতের নিজের তো বটেই। আমাদের দুই দেশের সংবিধান নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। বাক স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে মানুষ একে অন্যর বিরুদ্ধে অহেতুক মানহানিমূলক বক্তব্য রাখতে অধিকারী। আইনে তার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তজনের প্রতিকার পাওয়ার অবকাশ আছে। কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তাই। আদালতের রায় নিয়ে বিচারপ্রার্থী মানুষ বা প্রতিষ্ঠান ক্ষুব্ধ হলে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সরকারও যে কারও বিরুদ্ধে একইভাবে বিচারপ্রার্থী হতে পারে। কিন্তু আদালতের সমালোচনা আর আদালত অবমাননা এক বিষয় নয়। দুই দেশেই আদালত অবমাননার তারতম্য বিচারে দেওয়ানী ও ফৌজদারী দুই ধরনের বিচার পদ্ধতি রয়েছে। যে কেউ এই প্রশ্নে অভিযুক্ত হতে পারেন। আদালত অবমাননার জন্য অন্যদের মতো আইনজীবীদের অভিযুক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত দুই দেশেই যথেষ্ট রয়েছে।

গত ২০ আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার অপরাধে অভিযুক্ত অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ফেসবুকে গত ১১ আগস্ট কোভিড মহামারীকালীন সময়ে ১৮টি বেঞ্চে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত খোলা-সংক্রান্ত প্রধান বিচারপতির আদেশ ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। উক্ত আইনজীবী ভবিষ্যতে এমন কাজ করবেন না মুচলেকায় নিজ পোস্ট তুলে নেন। যথারীতি তিনি ক্ষমা পান। এই ক্ষমা চাওয়া ও পাওয়ার উদাহরণ অনেকই রয়েছে দুই দেশে। কিন্তু, সেই একই তারিখে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত প্রশান্ত ভূষণের বক্তব্য সমস্ত আদালত অঙ্গন এবং ভারত রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গকে কাঁপিয়ে তুলেছে। প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগের মূলেও রয়েছে সামাজিক মাধ্যমে টুইট করা গত জুন মাসের দুটি পোস্ট। একটি কোভিড লকডাউন চলাকালীন অবস্থায় মাস্ক ও হেলমেট ছাড়া এক বিজেপি নেতার অতি দামি মোটর বাইকের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির ছবি নিয়ে। দ্বিতীয় টুইট পরদিন ২৯ জুন ... যেখানে তিনি ভারতের গত ছয় বছরে চার বিদায়ী প্রধান বিচারপতির ভারতীয় গণতন্ত্র রক্ষায় ভূমিকার ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ ইতিহাসের মূল্যায়নের বিষয় বলে উল্লেখ করেন।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি অরুন মিশ্রকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ এই দুটি টুইট দ্বারা আদালত অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে সিনিয়র আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সময় দেন। ২০ অগাস্ট প্রশান্ত ভূষণ এই বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন না মর্মে আদালতকে জানান। তার বক্তব্য আদালত সঠিক উপলব্ধি করতে পারেননি সেটা দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে মনে করে বিধি অনুযায়ী শাস্তি মেনে নিতে তিনি প্রস্তুত বক্তব্যের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর উক্তি নজির হিসেবে আনেন, ... I do not ask for mercy. I do not appeal to magnanimity.’ ... গত ২৫ আগস্ট রায়ের জন্য দিন ধার্য ছিল। এই আইনিজীবীর বিরুদ্ধে ২০০৯ সনে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতির জন্য আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছিল। চাপা পড়া এতদিনের সেই মামলাও সহসা তাজা হয়ে বিচারে ওঠে। এই দুই মামলার রায়ের দিন পেছানো হয়েছে। কিন্তু, ইতোমধ্যে যে ঝড় যে আলোচনা-সমালোচনা উঠছে তা খুব গভীরভাবে পর্যালোচনা ও উপলব্ধির দাবি রাখে।

প্রশান্ত ভূষণ মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জনস্বার্থে অনেক মামলা পরিচালনা করেছেন বলে জানা যায়। রাজনৈতিক মঞ্চেও তার পরিচিতি আছে। পিতা শান্তিভূষণ মোরারজি দেশাইএর আমলে মন্ত্রী ছিলেন। ৯৫ বছরের বৃদ্ধ এই প্রাক্তন মন্ত্রী কোভিড মহামারীজনিত কারণে এই বিচারে আরও সময় চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন বলে জানা যায়। এই অবমাননার মামলা শুনানিতে আদালত একটু বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন। বাবরী মসজিদ ভাঙার সময় আদভানি ও অন্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আদালত অবমাননার মামলা এখনও হিমঘরে রয়েছে। এবং এইসব অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জীবিতকালীন মামলা বিচার আর হবে না বলেই সবার প্রকাশ্য শঙ্কা। প্রশান্ত ভূষণ তার এফিডেভিটে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার কথা বারবার বলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদার স্বার্থে, জনস্বার্থে,ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি এই টুইট করেন বলে দাবি করেন। সচেতনভাবে সুস্থ চেতনায় তিনি মন্তব্য করেছেন। সেই মন্তব্য ফিরিয়ে নেয়া বা ক্ষমা চাওয়া তার নিজের বিবেকের অবমাননা হবে বলেই বিশ্বাস করেন। সবার শিরদাঁড়া যে সমান নয়, আর,এই শিরদাঁড়া সমুন্নত রাখার প্রেরণা ও শক্তি হিসেবে ভারতজুড়ে এত সমর্থন সরব হয়ে উঠবে তা সুপ্রিম আদালত আগে ভাবতে পারেননি মনে হয়।

২৫ আগস্টের এই শুনানি ঘিরে ভারতীয় সংবিধানের বর্ণিত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাক স্বাধীনতা, মানুষের সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিচারবিভাগের সাম্প্রতিককালের কিছু কিছু ভূমিকা, বিভিন্ন কোর্টের কতিপয় বিচারপতির ওপর সরকারের প্রভাব, বিচারপতিদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আইন ও বিচার কাজে অনভিজ্ঞতা, মৌলবাদী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ, এই নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দলীয় আনুগত্য, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারকের ও বিচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফের অভাব সব মিলিয়ে something is amiss with the judiciary ... এ প্রশ্নই যেন প্রকট হয়ে উঠছে। দেশের সাধারণ নাগরিকের আস্থা ও ভরসার সর্বশেষ ক্ষেত্র যেন বানভাসীতে পরিণত হচ্ছে। যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করতে চলেছে।

ব্রিটিশদের দ্বারা অবিভক্ত ভারতে এ আইনের প্রবর্তন হলেও, সেখানে এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশগুলোতে আদালতের মান এত ঠুনকো নয়, যা কথায় কথায় মানুষের কণ্ঠ চেপে ধরে। ক্ষেত্রবিশেষে ভারতে ইদানীং সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর বিচার বিভাগকে আলাদা করা কঠিন হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, আমেরিকায় প্রকাশিত এক বই ব্রিটেনের এক প্রকাশনা সংস্থা বিনা অনুমতিতে ছাপেন। সে সংক্রান্ত চলবে

বুধবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১২ মহররম ১৪৪২, ১৬ ভাদ্র ১৪২৭

‘কাল বাঁচতে হলে আজ সরব হও’

দেবাহুতি চক্রবর্তী

শিরোনামটা সাম্প্রতিককালের ভারতের সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর এক যুব সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে উধৃতি। আইনজীবীর নাম প্রশান্ত ভূষণ। স্বাধীন ব্যক্তিসত্তায় বাঁচার জন্য, বাঁচানোর জন্য তিনি সরব হয়েছেন। সরব হয়েছেন তার সঙ্গে ভারতজুড়ে হাজার হাজার আইনজীবী। ভারতের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত অনেক প্রাজ্ঞ বিচারপতি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভারতে চলমান এই ঘটনা নিয়ে আমাদের জেনে বা বুঝে লাভ কী? কখনও কখনও কিছু ঘটনা দেশ -কাল-পাত্রের গণ্ডি ছাড়িয়েই উপলব্ধির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন অন্যত্র।

দেশভাগ পরবর্তী এই উপমহাদেশীয় দেশগুলি ব্রিটিশ প্রণীত দেওয়ানি, ফৌজদারি ও বিবিধ আইনের উত্তরাধিকার কিছু কিছু সংশোধনী বাদে আজও কম-বেশি বহন করে। আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইন Act No X11 Of 1926 অবিভক্ত ভারত থেকে আমরা পাই। ভারত-বাংলাদেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু পৃথক সংশোধনী অন্যান্য আইনের মতো এইক্ষেত্রেও আসে। এই দুই দেশই নিজেকে প্রজাতন্ত্র পরিচয়ে আখ্যায়িত করে। এবং দুই দেশেই সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিচারবিভাগকে সম্মান দেওয়া হয়। অনেকেই মনে করেন, সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার প্রধান অভিভাবক বিচারবিভাগ ও আদালত। এ বিচারবিভাগ বা আদালত জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ যাতে না হয়, তার জন্য রাষ্ট্রের সব অঙ্গর সক্রিয় ও সচেষ্ট থাকার কথা। বিচারবিভাগ ও আদালতের নিজের তো বটেই। আমাদের দুই দেশের সংবিধান নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। বাক স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে মানুষ একে অন্যর বিরুদ্ধে অহেতুক মানহানিমূলক বক্তব্য রাখতে অধিকারী। আইনে তার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তজনের প্রতিকার পাওয়ার অবকাশ আছে। কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তাই। আদালতের রায় নিয়ে বিচারপ্রার্থী মানুষ বা প্রতিষ্ঠান ক্ষুব্ধ হলে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সরকারও যে কারও বিরুদ্ধে একইভাবে বিচারপ্রার্থী হতে পারে। কিন্তু আদালতের সমালোচনা আর আদালত অবমাননা এক বিষয় নয়। দুই দেশেই আদালত অবমাননার তারতম্য বিচারে দেওয়ানী ও ফৌজদারী দুই ধরনের বিচার পদ্ধতি রয়েছে। যে কেউ এই প্রশ্নে অভিযুক্ত হতে পারেন। আদালত অবমাননার জন্য অন্যদের মতো আইনজীবীদের অভিযুক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত দুই দেশেই যথেষ্ট রয়েছে।

গত ২০ আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার অপরাধে অভিযুক্ত অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ফেসবুকে গত ১১ আগস্ট কোভিড মহামারীকালীন সময়ে ১৮টি বেঞ্চে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত খোলা-সংক্রান্ত প্রধান বিচারপতির আদেশ ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। উক্ত আইনজীবী ভবিষ্যতে এমন কাজ করবেন না মুচলেকায় নিজ পোস্ট তুলে নেন। যথারীতি তিনি ক্ষমা পান। এই ক্ষমা চাওয়া ও পাওয়ার উদাহরণ অনেকই রয়েছে দুই দেশে। কিন্তু, সেই একই তারিখে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত প্রশান্ত ভূষণের বক্তব্য সমস্ত আদালত অঙ্গন এবং ভারত রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গকে কাঁপিয়ে তুলেছে। প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগের মূলেও রয়েছে সামাজিক মাধ্যমে টুইট করা গত জুন মাসের দুটি পোস্ট। একটি কোভিড লকডাউন চলাকালীন অবস্থায় মাস্ক ও হেলমেট ছাড়া এক বিজেপি নেতার অতি দামি মোটর বাইকের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির ছবি নিয়ে। দ্বিতীয় টুইট পরদিন ২৯ জুন ... যেখানে তিনি ভারতের গত ছয় বছরে চার বিদায়ী প্রধান বিচারপতির ভারতীয় গণতন্ত্র রক্ষায় ভূমিকার ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ ইতিহাসের মূল্যায়নের বিষয় বলে উল্লেখ করেন।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি অরুন মিশ্রকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ এই দুটি টুইট দ্বারা আদালত অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে সিনিয়র আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সময় দেন। ২০ অগাস্ট প্রশান্ত ভূষণ এই বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন না মর্মে আদালতকে জানান। তার বক্তব্য আদালত সঠিক উপলব্ধি করতে পারেননি সেটা দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে মনে করে বিধি অনুযায়ী শাস্তি মেনে নিতে তিনি প্রস্তুত বক্তব্যের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর উক্তি নজির হিসেবে আনেন, ... I do not ask for mercy. I do not appeal to magnanimity.’ ... গত ২৫ আগস্ট রায়ের জন্য দিন ধার্য ছিল। এই আইনিজীবীর বিরুদ্ধে ২০০৯ সনে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতির জন্য আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছিল। চাপা পড়া এতদিনের সেই মামলাও সহসা তাজা হয়ে বিচারে ওঠে। এই দুই মামলার রায়ের দিন পেছানো হয়েছে। কিন্তু, ইতোমধ্যে যে ঝড় যে আলোচনা-সমালোচনা উঠছে তা খুব গভীরভাবে পর্যালোচনা ও উপলব্ধির দাবি রাখে।

প্রশান্ত ভূষণ মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জনস্বার্থে অনেক মামলা পরিচালনা করেছেন বলে জানা যায়। রাজনৈতিক মঞ্চেও তার পরিচিতি আছে। পিতা শান্তিভূষণ মোরারজি দেশাইএর আমলে মন্ত্রী ছিলেন। ৯৫ বছরের বৃদ্ধ এই প্রাক্তন মন্ত্রী কোভিড মহামারীজনিত কারণে এই বিচারে আরও সময় চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন বলে জানা যায়। এই অবমাননার মামলা শুনানিতে আদালত একটু বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন। বাবরী মসজিদ ভাঙার সময় আদভানি ও অন্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আদালত অবমাননার মামলা এখনও হিমঘরে রয়েছে। এবং এইসব অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জীবিতকালীন মামলা বিচার আর হবে না বলেই সবার প্রকাশ্য শঙ্কা। প্রশান্ত ভূষণ তার এফিডেভিটে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার কথা বারবার বলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদার স্বার্থে, জনস্বার্থে,ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি এই টুইট করেন বলে দাবি করেন। সচেতনভাবে সুস্থ চেতনায় তিনি মন্তব্য করেছেন। সেই মন্তব্য ফিরিয়ে নেয়া বা ক্ষমা চাওয়া তার নিজের বিবেকের অবমাননা হবে বলেই বিশ্বাস করেন। সবার শিরদাঁড়া যে সমান নয়, আর,এই শিরদাঁড়া সমুন্নত রাখার প্রেরণা ও শক্তি হিসেবে ভারতজুড়ে এত সমর্থন সরব হয়ে উঠবে তা সুপ্রিম আদালত আগে ভাবতে পারেননি মনে হয়।

২৫ আগস্টের এই শুনানি ঘিরে ভারতীয় সংবিধানের বর্ণিত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাক স্বাধীনতা, মানুষের সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিচারবিভাগের সাম্প্রতিককালের কিছু কিছু ভূমিকা, বিভিন্ন কোর্টের কতিপয় বিচারপতির ওপর সরকারের প্রভাব, বিচারপতিদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আইন ও বিচার কাজে অনভিজ্ঞতা, মৌলবাদী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ, এই নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দলীয় আনুগত্য, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারকের ও বিচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফের অভাব সব মিলিয়ে something is amiss with the judiciary ... এ প্রশ্নই যেন প্রকট হয়ে উঠছে। দেশের সাধারণ নাগরিকের আস্থা ও ভরসার সর্বশেষ ক্ষেত্র যেন বানভাসীতে পরিণত হচ্ছে। যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করতে চলেছে।

ব্রিটিশদের দ্বারা অবিভক্ত ভারতে এ আইনের প্রবর্তন হলেও, সেখানে এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশগুলোতে আদালতের মান এত ঠুনকো নয়, যা কথায় কথায় মানুষের কণ্ঠ চেপে ধরে। ক্ষেত্রবিশেষে ভারতে ইদানীং সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর বিচার বিভাগকে আলাদা করা কঠিন হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, আমেরিকায় প্রকাশিত এক বই ব্রিটেনের এক প্রকাশনা সংস্থা বিনা অনুমতিতে ছাপেন। সে সংক্রান্ত চলবে