দিল মনোয়ারা মনু : অন্তর যার ভালোবাসাপূর্ণ

সীমা মোসলেম

দিল মনোয়ারা মনু, ২ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই ভালোবাসা। তার সঙ্গে আমার প্রথম কবে পরিচয় আজ মনে করতে পারব না তবে সে ছিল সুদীর্ঘকালের। তার জীবন ছিল বহুমুখী কর্মে বিস্তৃত। সাংবাদিকতা ছিল তার মূল পেশা। ছাত্রজীবনে ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু। সেই সময়ে ‘বেগম’ পরিচালনা করতেন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, নূরজাহান বেগম, রোকনুজ্জামান দাদাভাই, কবি সুফিয়া কামাল। এসব আলোকিত ব্যক্তির সংস্পর্শে তার লেখালেখির সূচনা। এর প্রভাব ছিল তার জীবনব্যাপী কর্মে। তিনি নিজেকে শুধু সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, তার কর্মের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক। কারণ তিনি ছিলেন সামাজিক অঙ্গীকারাবদ্ধ ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি। সমাজের সব ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল সোচ্চার, যদিও তিনি ছিলেন ধীর-স্থির ও মৃদুভাষী। তার অন্তরের শক্তি তাকে অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহস জোগাতো।

দিল মনোয়ারা মনুর চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। আমরা জানি নব্বই দশকের গোড়ায় যখন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ ঘটে, সে সময়ে সাংবাদিকতা পেশায় একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের অনেক সদস্যের আগমণ শুরু হয়। অনেক তরুণ এ সময়ে পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। নারীরাও সাংবাদিকতায় আসতে শুরু করেন। এ যে তরুণ প্রজন্মের এক ঝাঁক নারী সাংবাদিকতা পেশায় আসলেন তাদের একটা বড় অংশের হাতেখড়ি দিল মনোয়ারা মনুর সহায়তায়। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি ‘অনন্যা’ সম্পাদনা করেছেন। তার সম্পাদিত ‘অনন্যা’য় আজকের সুযোগ্য বহু নারী সাংবাদিকের কর্মজীবন শুরু হয়। তাকে সাংবাদিক তৈরির কারিগর বলা যায়। দিল মনোয়ারা মনু যখন সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেন, তখন এই পেশায় ছিল হাতেগোনা কয়েকজন নারী সাংবাদিক, যাদের অধিকাংশই কাজ করতেন ডেস্কে। মেয়েরা রিপোর্টিংয়ে যাবে এটা তখন ভাবাই যেত না। তরুণ প্রজন্মের নারী সাংবাদিকদের শুধু পেশায় যুক্ত করার মধ্যেই দিল মনোয়ারা মনুর ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন অনেকটা এদের অভিভাবকের মতো। Friend Philosopher Guide বলে একটা কথা আছে, তিনি ছিলেন তাই। আমরা জানি সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন গণমাধ্যম হাউসগুলোতেও বিদ্যমান। সমাজ মানস নারীকে সাংবাদিকতা পেশায় দেখতে তখনও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এই কারণে নারী সাংবাদিকদের কাজকে পত্রিকার অভ্যন্তরে এবং বাইরের সমাজে অনেকে খুব সহজভাবে নিত না। নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নতুন প্রজন্মের নারী সাংবাদিকদের নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কাজ করতে হতো। তাদের যে কোন পেশাগত সমস্যায় দিল মনোয়ারা তাদের পাশে থাকতেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন, সাহস জোগাতেন। এমনকি সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা নিয়ে মফস্বল শহর থেকে আসা তরুণী, বাসস্থানের অভাবে যার স্বপ্নভঙ্গ হতে চলেছে, তিনি তাকে নিজগৃহে থাকার সুযোগ দিয়ে তার স্বপ্নপূরণ করেছেন। এবং এই কাজগুলো তিনি খুব সহজভাবে করতেন। বিশেষ কিছু একটা করছেন, এই অভিব্যক্তি তার মধ্যে কোন সময় ছিল না। সাংবাদিকতা পেশাকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। এই পেশায় নারীরা আসুক, তাদের দক্ষতা দেখাক, সফল হোক এই আকাক্সক্ষা থেকেই তিনি তরুণদের পাশে সব সময় থাকতেন।

বাংলাদেশে একজন সফল নারী সম্পাদক হিসেবে দিল মনোয়ারা মনুর নাম উল্লেখ করলে তা বাড়িয়ে বলা হবে না। ‘অনন্যা’ নারী বিষয়ক সাময়িকী হওয়ার পরও তিনি সেখানে এমন সব লেখকদের সমবেত করেছেন যা ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমাদের সমাজে এখনও নারীদের পত্রিকা, নারী সম্পাদক ইত্যাদি ঘিরে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকদের একটা উন্নাসিকতা রয়েছে, তাদের ভূমিকার অবমূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু দিল মনোয়ারা মনু তা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি যখন ‘অনন্যা’র সম্পাদক তখন এমন অনেক লেখকদের লেখা প্রকাশ করেছেন যা ‘অনন্যা’-র মান বৃদ্ধি করেছিল। মূলধারার সাময়িকী হিসেবে অনন্যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর পাশাপাশি তিনি নবীন লেখকদের গল্প, কবিতা, কথিকা প্রকাশ করতেন। তরুণ প্রজন্মের এমন অনেক গল্পকার বা কবি রয়েছেন, যাদের প্রথম লেখা ‘অনন্যা’য় প্রকাশিত হয়েছে। একজন সফল সম্পাদকের কাজই নবীনকে তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, যা তিনি করেছেন। ‘অনন্যা শীর্ষ ১০’ প্রবর্তনে ভূমিকার মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত নারীদের পাশাপাশি পাদপ্রদীপের আলোতে নেই এমন নারীদের খুঁজে বের করে তাদের স্বীকৃতি দেয়ার পথ তৈরি করেন।

দিল মনোয়ারা মনু বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত হন, প্রথমে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে, পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সবশেষে গণমাধ্যম সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে এই আনুষ্ঠানিক যুক্ততার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে মহিলা পরিষদের সম্পর্ক ছিল। নারী আন্দোলন, নারী অধিকার, সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে মহিলা পরিষদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত করেছিল।

মহিলা পরিষদের বহুমাত্রিক কাজের বিশেষত: সংগঠনের মুখপত্র মহিলা সমাচার প্রকাশ ও বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনায় তার পরামর্শ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে গণমাধ্যম সম্পাদক হওয়ার পর মহিলা পরিষদে তার কাজের ক্ষেত্র আরও সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে, যেখানে তিনি তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করেন। গণমাধ্যম ও নারী এই ক্ষেত্রে মহিলা পরিষদের প্রয়াস হচ্ছে নারীর প্রতি প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা পালন, গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক প্রতিফলন, গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি। এসব কাজে গণমাধ্যম সম্পাদক হিসেবে দিল মনোয়ারা মনুর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

তার নেতৃত্বে ও উৎসাহে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ‘সুফিয়া কামাল ভবন’ হয়ে উঠেছিল নারী সাংবাদিকদের একটা প্ল্যাটফর্ম। সেখানে তারা মাসের একটা নির্দিষ্ট দিন সমবেত হতেন, তাদের সমস্যা, সম্ভাবনা, জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতেন। যার মধ্যে ছিল কর্মক্ষেত্রের সমস্যা, সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতা ও নারী সাংবাদিকদের নিজস্ব পেশাগত সমস্যা, এমনকি, ব্যক্তিগত সমস্যাও বাদ যেত না। তাদের এই আলোচনায় নারী আন্দোলন, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়ও থাকতো। এই পারস্পরিক ভাব বিনিময় তাদের সংকট উত্তরণে সাহস জোগাতো, কাজ করতে আরও উদ্যোগী ও উজ্জীবিত করে তুলতো। গণমাধ্যম সম্পাদক হিসেবে এই কাজটি তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে করতেন। এখানেও কিন্তু তার ভাবনা ছিল তরুণ প্রজন্মের নারী সাংবাদিকদের কীভাবে আরো অগ্রসর করা যায়, সাহস জোগানো যায়, উজ্জীবিত করা যায়, সমস্যা-সংকট যেন তাদের হতোদ্যম করে না তোলে। তিনি নিজে যখন কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মহিলা পরিষদের সব কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারছেন না, বিশেষ করে অফিসের বাইরে আন্দোলনমূলক কাজ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বিভিন্নমুখী কর্মসূচি, তখন দুঃখ পেতেন উপস্থিত হতে পারছেন না বলে। তবে সব সময় খবর নিতেন কর্মসূচি কেমন হলো। পাশাপাশি গণমাধ্যমে তা যথাযথভাবে জানানো হলো কিনা সে খবর নিতেন, সাংগঠনিকভাবে যেটা তার দায়িত্ব।

তিনি বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার অন্যতম ছিল কচি-কাঁচার মেলা। এ সংগঠনের মূল পরিচালনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। কীভাবে শিশুদের মনে দেশপ্রেম জাগানো যায়, তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করা যায় অর্থাৎ কীভাবে শিশুদের একটি সুস্থ মানসিক গঠনে গড়ে তোলা যায় সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি নেয়ার দিকে দিল মনোয়ারা মনুর নজর ছিল।

প্রবীণ যারা আছেন, তাদের খোঁজখবর নেয়া দিল মনোয়ারা মনুর একটি নিয়মিত কাজ ছিল। সবার খবর তার কাছে পাওয়া যেত। মাঝেমাঝে বিস্মিত হতে হয় তিনি কীভাবে সবার খবর এইভাবে রাখতে পারতেন। পূর্বসূরিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। পূর্বসূরি গুণীদের নিয়ে তিনি যে কত লিখেছেন তা আমরা দেখেছি। একদিন তিনি গল্প করতে করতে বলছিলেন, অনেকেই আমাকে বলে রেখেছে মনু আমি চলে গেলে তুমি কিন্তু আমাকে নিয়ে লিখবে। নবীন-প্রবীণ সবার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ। আজকের দিনে যাকে নেটওয়ার্কিং বলা হয়, যা অনেকটা কেজো যোগাযোগ, দিল মনোয়ারা মনুর ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ ছিল প্রাণের যোগ। তিনি তার অনুভব থেকে এ যোগাযোগ রাখতেন।

দিল মনোয়ারা মনুর চরিত্রের এমন এক মানবিক, মাধুর্যময়, আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট ছিল যা সহজে সবাইকে আপন করে নিতে পারত। তার এ সহজাত ভালোবাসার কারণে একবার যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠত সে সম্পর্ক হতো চিরদিনের। অপরদিক থেকে অনেক সময় এ সম্পর্ককে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করতে পারলেও, তার কোন অভিযোগ ছিল না। তার অন্তরের সৌন্দর্যে তিনি সবাইকে ভালোবাসতে পারতেন।

[লেখক : যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]

বুধবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১২ মহররম ১৪৪২, ১৬ ভাদ্র ১৪২৭

দিল মনোয়ারা মনু : অন্তর যার ভালোবাসাপূর্ণ

সীমা মোসলেম

দিল মনোয়ারা মনু, ২ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই ভালোবাসা। তার সঙ্গে আমার প্রথম কবে পরিচয় আজ মনে করতে পারব না তবে সে ছিল সুদীর্ঘকালের। তার জীবন ছিল বহুমুখী কর্মে বিস্তৃত। সাংবাদিকতা ছিল তার মূল পেশা। ছাত্রজীবনে ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু। সেই সময়ে ‘বেগম’ পরিচালনা করতেন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, নূরজাহান বেগম, রোকনুজ্জামান দাদাভাই, কবি সুফিয়া কামাল। এসব আলোকিত ব্যক্তির সংস্পর্শে তার লেখালেখির সূচনা। এর প্রভাব ছিল তার জীবনব্যাপী কর্মে। তিনি নিজেকে শুধু সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, তার কর্মের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক। কারণ তিনি ছিলেন সামাজিক অঙ্গীকারাবদ্ধ ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি। সমাজের সব ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল সোচ্চার, যদিও তিনি ছিলেন ধীর-স্থির ও মৃদুভাষী। তার অন্তরের শক্তি তাকে অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহস জোগাতো।

দিল মনোয়ারা মনুর চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। আমরা জানি নব্বই দশকের গোড়ায় যখন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ ঘটে, সে সময়ে সাংবাদিকতা পেশায় একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের অনেক সদস্যের আগমণ শুরু হয়। অনেক তরুণ এ সময়ে পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। নারীরাও সাংবাদিকতায় আসতে শুরু করেন। এ যে তরুণ প্রজন্মের এক ঝাঁক নারী সাংবাদিকতা পেশায় আসলেন তাদের একটা বড় অংশের হাতেখড়ি দিল মনোয়ারা মনুর সহায়তায়। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি ‘অনন্যা’ সম্পাদনা করেছেন। তার সম্পাদিত ‘অনন্যা’য় আজকের সুযোগ্য বহু নারী সাংবাদিকের কর্মজীবন শুরু হয়। তাকে সাংবাদিক তৈরির কারিগর বলা যায়। দিল মনোয়ারা মনু যখন সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেন, তখন এই পেশায় ছিল হাতেগোনা কয়েকজন নারী সাংবাদিক, যাদের অধিকাংশই কাজ করতেন ডেস্কে। মেয়েরা রিপোর্টিংয়ে যাবে এটা তখন ভাবাই যেত না। তরুণ প্রজন্মের নারী সাংবাদিকদের শুধু পেশায় যুক্ত করার মধ্যেই দিল মনোয়ারা মনুর ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন অনেকটা এদের অভিভাবকের মতো। Friend Philosopher Guide বলে একটা কথা আছে, তিনি ছিলেন তাই। আমরা জানি সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন গণমাধ্যম হাউসগুলোতেও বিদ্যমান। সমাজ মানস নারীকে সাংবাদিকতা পেশায় দেখতে তখনও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এই কারণে নারী সাংবাদিকদের কাজকে পত্রিকার অভ্যন্তরে এবং বাইরের সমাজে অনেকে খুব সহজভাবে নিত না। নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নতুন প্রজন্মের নারী সাংবাদিকদের নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কাজ করতে হতো। তাদের যে কোন পেশাগত সমস্যায় দিল মনোয়ারা তাদের পাশে থাকতেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন, সাহস জোগাতেন। এমনকি সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা নিয়ে মফস্বল শহর থেকে আসা তরুণী, বাসস্থানের অভাবে যার স্বপ্নভঙ্গ হতে চলেছে, তিনি তাকে নিজগৃহে থাকার সুযোগ দিয়ে তার স্বপ্নপূরণ করেছেন। এবং এই কাজগুলো তিনি খুব সহজভাবে করতেন। বিশেষ কিছু একটা করছেন, এই অভিব্যক্তি তার মধ্যে কোন সময় ছিল না। সাংবাদিকতা পেশাকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। এই পেশায় নারীরা আসুক, তাদের দক্ষতা দেখাক, সফল হোক এই আকাক্সক্ষা থেকেই তিনি তরুণদের পাশে সব সময় থাকতেন।

বাংলাদেশে একজন সফল নারী সম্পাদক হিসেবে দিল মনোয়ারা মনুর নাম উল্লেখ করলে তা বাড়িয়ে বলা হবে না। ‘অনন্যা’ নারী বিষয়ক সাময়িকী হওয়ার পরও তিনি সেখানে এমন সব লেখকদের সমবেত করেছেন যা ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমাদের সমাজে এখনও নারীদের পত্রিকা, নারী সম্পাদক ইত্যাদি ঘিরে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকদের একটা উন্নাসিকতা রয়েছে, তাদের ভূমিকার অবমূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু দিল মনোয়ারা মনু তা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি যখন ‘অনন্যা’র সম্পাদক তখন এমন অনেক লেখকদের লেখা প্রকাশ করেছেন যা ‘অনন্যা’-র মান বৃদ্ধি করেছিল। মূলধারার সাময়িকী হিসেবে অনন্যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর পাশাপাশি তিনি নবীন লেখকদের গল্প, কবিতা, কথিকা প্রকাশ করতেন। তরুণ প্রজন্মের এমন অনেক গল্পকার বা কবি রয়েছেন, যাদের প্রথম লেখা ‘অনন্যা’য় প্রকাশিত হয়েছে। একজন সফল সম্পাদকের কাজই নবীনকে তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, যা তিনি করেছেন। ‘অনন্যা শীর্ষ ১০’ প্রবর্তনে ভূমিকার মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত নারীদের পাশাপাশি পাদপ্রদীপের আলোতে নেই এমন নারীদের খুঁজে বের করে তাদের স্বীকৃতি দেয়ার পথ তৈরি করেন।

দিল মনোয়ারা মনু বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত হন, প্রথমে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে, পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সবশেষে গণমাধ্যম সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে এই আনুষ্ঠানিক যুক্ততার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে মহিলা পরিষদের সম্পর্ক ছিল। নারী আন্দোলন, নারী অধিকার, সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে মহিলা পরিষদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত করেছিল।

মহিলা পরিষদের বহুমাত্রিক কাজের বিশেষত: সংগঠনের মুখপত্র মহিলা সমাচার প্রকাশ ও বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনায় তার পরামর্শ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে গণমাধ্যম সম্পাদক হওয়ার পর মহিলা পরিষদে তার কাজের ক্ষেত্র আরও সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে, যেখানে তিনি তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করেন। গণমাধ্যম ও নারী এই ক্ষেত্রে মহিলা পরিষদের প্রয়াস হচ্ছে নারীর প্রতি প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা পালন, গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক প্রতিফলন, গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি। এসব কাজে গণমাধ্যম সম্পাদক হিসেবে দিল মনোয়ারা মনুর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

তার নেতৃত্বে ও উৎসাহে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ‘সুফিয়া কামাল ভবন’ হয়ে উঠেছিল নারী সাংবাদিকদের একটা প্ল্যাটফর্ম। সেখানে তারা মাসের একটা নির্দিষ্ট দিন সমবেত হতেন, তাদের সমস্যা, সম্ভাবনা, জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতেন। যার মধ্যে ছিল কর্মক্ষেত্রের সমস্যা, সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতা ও নারী সাংবাদিকদের নিজস্ব পেশাগত সমস্যা, এমনকি, ব্যক্তিগত সমস্যাও বাদ যেত না। তাদের এই আলোচনায় নারী আন্দোলন, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়ও থাকতো। এই পারস্পরিক ভাব বিনিময় তাদের সংকট উত্তরণে সাহস জোগাতো, কাজ করতে আরও উদ্যোগী ও উজ্জীবিত করে তুলতো। গণমাধ্যম সম্পাদক হিসেবে এই কাজটি তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে করতেন। এখানেও কিন্তু তার ভাবনা ছিল তরুণ প্রজন্মের নারী সাংবাদিকদের কীভাবে আরো অগ্রসর করা যায়, সাহস জোগানো যায়, উজ্জীবিত করা যায়, সমস্যা-সংকট যেন তাদের হতোদ্যম করে না তোলে। তিনি নিজে যখন কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মহিলা পরিষদের সব কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারছেন না, বিশেষ করে অফিসের বাইরে আন্দোলনমূলক কাজ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বিভিন্নমুখী কর্মসূচি, তখন দুঃখ পেতেন উপস্থিত হতে পারছেন না বলে। তবে সব সময় খবর নিতেন কর্মসূচি কেমন হলো। পাশাপাশি গণমাধ্যমে তা যথাযথভাবে জানানো হলো কিনা সে খবর নিতেন, সাংগঠনিকভাবে যেটা তার দায়িত্ব।

তিনি বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার অন্যতম ছিল কচি-কাঁচার মেলা। এ সংগঠনের মূল পরিচালনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। কীভাবে শিশুদের মনে দেশপ্রেম জাগানো যায়, তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করা যায় অর্থাৎ কীভাবে শিশুদের একটি সুস্থ মানসিক গঠনে গড়ে তোলা যায় সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি নেয়ার দিকে দিল মনোয়ারা মনুর নজর ছিল।

প্রবীণ যারা আছেন, তাদের খোঁজখবর নেয়া দিল মনোয়ারা মনুর একটি নিয়মিত কাজ ছিল। সবার খবর তার কাছে পাওয়া যেত। মাঝেমাঝে বিস্মিত হতে হয় তিনি কীভাবে সবার খবর এইভাবে রাখতে পারতেন। পূর্বসূরিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। পূর্বসূরি গুণীদের নিয়ে তিনি যে কত লিখেছেন তা আমরা দেখেছি। একদিন তিনি গল্প করতে করতে বলছিলেন, অনেকেই আমাকে বলে রেখেছে মনু আমি চলে গেলে তুমি কিন্তু আমাকে নিয়ে লিখবে। নবীন-প্রবীণ সবার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ। আজকের দিনে যাকে নেটওয়ার্কিং বলা হয়, যা অনেকটা কেজো যোগাযোগ, দিল মনোয়ারা মনুর ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ ছিল প্রাণের যোগ। তিনি তার অনুভব থেকে এ যোগাযোগ রাখতেন।

দিল মনোয়ারা মনুর চরিত্রের এমন এক মানবিক, মাধুর্যময়, আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট ছিল যা সহজে সবাইকে আপন করে নিতে পারত। তার এ সহজাত ভালোবাসার কারণে একবার যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠত সে সম্পর্ক হতো চিরদিনের। অপরদিক থেকে অনেক সময় এ সম্পর্ককে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করতে পারলেও, তার কোন অভিযোগ ছিল না। তার অন্তরের সৌন্দর্যে তিনি সবাইকে ভালোবাসতে পারতেন।

[লেখক : যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]