প্রায় অর্ধশত কমিটির বেশিরভাগ সুপারিশই গ্রহণ করা হয়নি

কমিটির সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে প্রায় অর্ধশত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটিগুলোর বেশিরভাগ সুপারিশ গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটিগুলোকে চিকিৎসকদের প্রাধান্য ছিল না। বেশির ভাগ কমিটিই ছিল আমলানির্ভর। এক কমিটির সঙ্গে অপর কমিটির কার্যক্রমের নেই তেমন কোন সমন্বয়। কমিটির কোন কোন সদস্য জানেও না যে, তাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটির কার্যক্রম খবরদারি করতে পাল্টা কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটি গঠনের তুঘলকি কা-ের মধ্যেই সব কমিটির কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকির জন্য সম্প্রতি একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়। এভাবে পুরো করোনাকালেই চলে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন। তবে সবকটি কমিটি এখন সক্রিয়, না নিস্ক্রিয় তা নিয়েও নানা প্রশ্ন ওঠেছে। করোনা মহামারীতে বিশে^র কোন দেশই এত সংখ্যক কমিটি গঠন করেনি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

জাতীয় পর্যায়ে গঠিত কমিটি ছাড়াও করোনা প্রতিরোধে সব জেলায় ডিসি (জেলা প্রশাসক) এবং উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ওইসব কমিটিতে সিভিল সার্জন ও স্থানীয় চিকিৎসকদের ভূমিকা ছিল নামমাত্র। জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে সির্ভিল সার্জনদের সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার সির্ভিল সার্জন সংবাদকে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরা কমিটির কেরানির দায়িত্ব পালন করি। রোগীর কাছে যাওয়া-আসা ছাড়া সবকিছুই হয় জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তে।’ নানা মহলের অর্ধশত সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নেতৃত্বে গত ১৭ এপ্রিল ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’ গঠন করলেও ওই কমিটির অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়ন বা কার্যকর হয়নি। এসব কারণেই দেশে করোনা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী সংকটে রূপ নিচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব সংবাদকে বলেন, ‘যখন প্রয়োজন ছিল তারা (স্বাস্থ্য প্রশাসন) তখন কমিটি গঠন করেছে; কিন্তু ওইসব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে কীনা, কার্যকর করা হবে কীনা সেটা তাদেরই ব্যাপার। তারা প্রয়োজন মনে করলে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে।’

কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠনের আগে গত ১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে ২৬ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়, যার সদস্যদের মধ্যে আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। এটিই সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি; যার প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তাদের ভূমিকা হলো কর্মকৌশল বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা এবং নতুন নির্দেশনা জারি করা। এ কমিটির কয়েকটি বৈঠক হলেও তাদের নেয়া অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই কিছু জানতেন না কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ৬ এপ্রিল সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ায় আমাকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। তবে আমাকে না জানিয়েই কমিটির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে। কারখানা বন্ধ করার, মসজিদে জামাতে নামাজ না পড়ার এবং গণপরিবহন বন্ধ করার সিদ্ধান্তগুলোও আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই নেয়া হয়েছে। আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাব দিতে পারি না; কমিটির প্রধান হওয়া সত্ত্বেও আমি কিছু জানি না বলে আমাকে দোষারোপ করা হয়।’

মন্ত্রীদের নিয়ে ৩১ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের আরেক কমিটি গঠন করা হলেও ওই কমিটির দৃশ্যমান কার্যক্রম প্রকাশ পায়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহকে প্রধান উপদেষ্টা করে অপর একটি কমিটি গঠন করা হয়।

অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ ১ সেপ্টেম্বর সংবাদকে বলেছেন, ‘আমি ওই কমিটিতে যাই না। আমি কোন কমিটিতেই নেই।’ ওই কমিটির কোন বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, না; আমি ওইসব কমিটিতে নেই।’

বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর ১৮ মার্চ করোনায় প্রথম একজনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপরই বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। প্রথমদিকে করোনা সংক্রান্ত সরকারি সবধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে; আমলাতান্ত্রিক পন্থায়।

এক পর্যায়ে করোনার বিস্তার ও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধে এবং হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বাড়াতে সুপারিশ দেয়ার জন্য গত ১৮ এপ্রিল সরকার ১৭ সদস্যের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটি ১০/১১ বার বৈঠক করে নানা পরামর্শ ও কর্মকৌশলের কথা জানায়। কিন্তু কমিটির বেশিরভাগ পরামর্শই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর আমলে নেয়নি। পরবর্তীতে কারিগরি পরামর্শ কমিটির পাঁচটি উপকমিটি গঠন করা হলেও ওইসব উপকমিটির কোন সুপারিশ বা মতামতও আমলে নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

করোনা প্রতিরোধে গঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিগুলোর মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে গঠিত দুটি কমিটি কাজ করছে। অন্য কমিটির মধ্যে জাতীয় পরিকল্পনার ১৩টি কমিটি। গত ২৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও ১০টি কোর কমিটি করে, যেগুলো হলো কোভিড-১৯ কোর কমিটিগুলোর সমন্বয় কমিটি; জোনিং সিস্টেম বিষয়ক গ্রুপ; সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ক কমিটি; সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ, মান ও মূল্য নির্ধারণ ও তদারকি কমিটি; অত্যাবশ্যকীয় ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কমিটি; তথ্য ব্যবস্থাপনা, গণসংযোগ ও কমিউনিটি মোবিলাইজেশন কমিটি; মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কমিটি; কোভিড-১৯ ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি; হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও পরিবেশ সংক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ কমিটি এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটি।

এই দশ কমিটিকে একীভূত করতে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েকদিন পর করোনা নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৫ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি করোনার বিস্তার রোধ, যেকোন নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের সেবা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে বলে কমিটির প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কিন্তু দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে যে ধরনের কমিটি হয়েছে; এখনো হচ্ছে, তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি, হবেও না। করোনা মোকাবিলায় কী কাজ করতে হবে, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে জাতীয় পরিকল্পনা দলিলে। সেই দলিল অনুসরণ না করে অন্ধের মতো কমিটি তৈরি করছে। অধিক কমিটি পরিস্থিতি পাল্টাতে পারবে বলে মনে হয় না।’

করোনা মোকাবিলায় গত মার্চের শুরুতেই ‘ন্যাশনাল প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্ল্যান ফর কোভিড-১৯’ (জাতীয় পরিকল্পনা দলিল) তৈরি করে সরকার। প্রথমে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা ছাড়াই দলিলটি তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে দলিলটির ৭/৮টি সংস্করণ করা হয়।

বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গত ২৬ জুলাই ৯ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স (শক্তিশালী কমিটি) গঠন করা হয়। করোনা প্রতিরোধে ও আক্রান্ত রোগীদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ পর্যন্ত জারিকৃত পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশনা এবং যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন অগ্রগতি তদারকি করতেই এই টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (জনস্বাস্থ্য) আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সে আছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন করে যুগ্মসচিব; এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিবকে (জনস্বাস্থ্য-১) সদস্য রাখা হয়েছে।

এই টাস্কফোর্স স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি হওয়া বিভিন্ন পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশনা ও যেসব কমটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকি করবে; এছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত অভিযোগ ও তথ্য পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ, বিভিন্ন কমিটির সিদ্ধান্তের সমন্বয়, যেসব হাসপাতাল ও ল্যাবে কোভিড পরীক্ষা হয়, তাদের লাইসেন্স পরীক্ষা করা এবং সরকার নির্ধারিত ফি যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কিনা সেটা তদারকি, যেসব হাসপাতাল ও ল্যাবে কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয় সেখানে পর্যাপ্ত জনবল ও পরীক্ষার যথাযথ সুবিধা রয়েছে কিনা সেটা যাচাই করবে এবং এসব বিষয় কমিটি দু’মাসে কমপক্ষে একবার সভা করবে।

এর আগে গত ২৮ জুন করোনাকালে গঠিত ১০ কমিটির পুনর্গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের করোনা বিষয়ক কমিটির সংখ্যা ন্যূনতম ৪২/৪৩টি। এত কমিটির কাজ কী, আদৌ এত কমিটির প্রয়োজন রয়েছে কী না, তা নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন ছিল। বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে যত কমিটি হয়েছে, বিশ্বের কোন দেশেই এত কমিটি হয়নি বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য :

বিশে^র করোনা সংক্রমিত দেশগুলোর তুলনায় দেশে নমুনা পরীক্ষা কম হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে- টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বারবার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে; বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিল; কিন্তু একদিনও ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার কোটায় পৌঁছাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

করোনা পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে গত ১৭ এপ্রিল ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়।

সংক্রমণ পরিস্থিতি সামনে খারাপ হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে বড় পরিসরে লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটি। সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদের আগে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে পশুর হাট স্থাপন না করার পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি। তা আমলে নেয়া হয়নি। ফলে ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

গত ১০ জুলাই ৮টি সুপারিশ করে পরামর্শক কমিটি। এর আগে গত ১০ জুন ৫টি সুপারিশ এবং গত এপ্রিলে ৮টি সুপারিশ করেছিল। গত ১০ জুন কারিগরি পরামর্শক কমিটি পাঁচ সুপারিশের মধ্যে ছিল,করোনাভাইরাসের বিস্তার বন্ধে পূর্ণ লকডাউন আরোপ করা; অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে সব হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেন থেরাপীর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে চিকিৎসা চালু করা; চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা ব্যাপকহারে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের জীবনাবসান ঘটেছে। তাঁদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। হাই-ফ্লো অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় উপকরনসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল চালু করা এবং নমুনা পরীক্ষার মান্নোয়ন ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা। এসব সুপারিশের খুব একটা বাস্তবায়ন হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট কারিগরি পরামর্শক কমিটি বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের টিকার ট্রায়াল আয়োজনের সুপারিশ করেছে। তবে এ সুপারিশটি আমলে নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ওই কমিটিও পুনর্গঠন করেছে বলে জানা গেছে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে করোনাভাইরাসের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে হওয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠান বা দেশ টিকার ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে, টিকা বাজারে আসার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়া নিশ্চিত করতে তাদের সাথে এখনই যোগাযোগ করার সুপারিশ করেছে কমিটি। টিকা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সিরিঞ্জ উৎপাদন বা কেনার প্রস্তুতি রাখা, টিকা পাওয়ার পর তা সংরক্ষণ, বিতরণের পরিকল্পনা ঠিক করে রাখা এবং টিকা পাওয়ার পর জনসংখ্যার কারা অগ্রাধিকার পাবে তা এখনই ঠিক করে রাখার পরামর্শ দেয় কারিগরি কমিটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, কয়েকটি সংস্থার টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি বাংলাদেশে হলে দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তা প্রমাণের সুযোগ তৈরি হবে। আর টিকা সফল হিসেবে প্রমাণিত হলে তা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়ার সুযোগও থাকবে।

গত ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনে হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব।

বর্তমানে বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। করোনার উৎপত্তিস্থল হলেও এখন এর সংক্রমণ থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত চীন।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

করোনা মোকাবিলায় 

প্রায় অর্ধশত কমিটির বেশিরভাগ সুপারিশই গ্রহণ করা হয়নি

কমিটির সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন

রাকিব উদ্দিন

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে প্রায় অর্ধশত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটিগুলোর বেশিরভাগ সুপারিশ গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটিগুলোকে চিকিৎসকদের প্রাধান্য ছিল না। বেশির ভাগ কমিটিই ছিল আমলানির্ভর। এক কমিটির সঙ্গে অপর কমিটির কার্যক্রমের নেই তেমন কোন সমন্বয়। কমিটির কোন কোন সদস্য জানেও না যে, তাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটির কার্যক্রম খবরদারি করতে পাল্টা কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটি গঠনের তুঘলকি কা-ের মধ্যেই সব কমিটির কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকির জন্য সম্প্রতি একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়। এভাবে পুরো করোনাকালেই চলে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন। তবে সবকটি কমিটি এখন সক্রিয়, না নিস্ক্রিয় তা নিয়েও নানা প্রশ্ন ওঠেছে। করোনা মহামারীতে বিশে^র কোন দেশই এত সংখ্যক কমিটি গঠন করেনি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

জাতীয় পর্যায়ে গঠিত কমিটি ছাড়াও করোনা প্রতিরোধে সব জেলায় ডিসি (জেলা প্রশাসক) এবং উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ওইসব কমিটিতে সিভিল সার্জন ও স্থানীয় চিকিৎসকদের ভূমিকা ছিল নামমাত্র। জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে সির্ভিল সার্জনদের সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার সির্ভিল সার্জন সংবাদকে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরা কমিটির কেরানির দায়িত্ব পালন করি। রোগীর কাছে যাওয়া-আসা ছাড়া সবকিছুই হয় জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তে।’ নানা মহলের অর্ধশত সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নেতৃত্বে গত ১৭ এপ্রিল ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’ গঠন করলেও ওই কমিটির অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়ন বা কার্যকর হয়নি। এসব কারণেই দেশে করোনা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী সংকটে রূপ নিচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব সংবাদকে বলেন, ‘যখন প্রয়োজন ছিল তারা (স্বাস্থ্য প্রশাসন) তখন কমিটি গঠন করেছে; কিন্তু ওইসব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে কীনা, কার্যকর করা হবে কীনা সেটা তাদেরই ব্যাপার। তারা প্রয়োজন মনে করলে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে।’

কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠনের আগে গত ১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে ২৬ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়, যার সদস্যদের মধ্যে আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। এটিই সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি; যার প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তাদের ভূমিকা হলো কর্মকৌশল বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা এবং নতুন নির্দেশনা জারি করা। এ কমিটির কয়েকটি বৈঠক হলেও তাদের নেয়া অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই কিছু জানতেন না কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ৬ এপ্রিল সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ায় আমাকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। তবে আমাকে না জানিয়েই কমিটির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে। কারখানা বন্ধ করার, মসজিদে জামাতে নামাজ না পড়ার এবং গণপরিবহন বন্ধ করার সিদ্ধান্তগুলোও আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই নেয়া হয়েছে। আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাব দিতে পারি না; কমিটির প্রধান হওয়া সত্ত্বেও আমি কিছু জানি না বলে আমাকে দোষারোপ করা হয়।’

মন্ত্রীদের নিয়ে ৩১ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের আরেক কমিটি গঠন করা হলেও ওই কমিটির দৃশ্যমান কার্যক্রম প্রকাশ পায়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহকে প্রধান উপদেষ্টা করে অপর একটি কমিটি গঠন করা হয়।

অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ ১ সেপ্টেম্বর সংবাদকে বলেছেন, ‘আমি ওই কমিটিতে যাই না। আমি কোন কমিটিতেই নেই।’ ওই কমিটির কোন বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, না; আমি ওইসব কমিটিতে নেই।’

বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর ১৮ মার্চ করোনায় প্রথম একজনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপরই বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। প্রথমদিকে করোনা সংক্রান্ত সরকারি সবধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে; আমলাতান্ত্রিক পন্থায়।

এক পর্যায়ে করোনার বিস্তার ও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধে এবং হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বাড়াতে সুপারিশ দেয়ার জন্য গত ১৮ এপ্রিল সরকার ১৭ সদস্যের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটি ১০/১১ বার বৈঠক করে নানা পরামর্শ ও কর্মকৌশলের কথা জানায়। কিন্তু কমিটির বেশিরভাগ পরামর্শই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর আমলে নেয়নি। পরবর্তীতে কারিগরি পরামর্শ কমিটির পাঁচটি উপকমিটি গঠন করা হলেও ওইসব উপকমিটির কোন সুপারিশ বা মতামতও আমলে নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

করোনা প্রতিরোধে গঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিগুলোর মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে গঠিত দুটি কমিটি কাজ করছে। অন্য কমিটির মধ্যে জাতীয় পরিকল্পনার ১৩টি কমিটি। গত ২৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও ১০টি কোর কমিটি করে, যেগুলো হলো কোভিড-১৯ কোর কমিটিগুলোর সমন্বয় কমিটি; জোনিং সিস্টেম বিষয়ক গ্রুপ; সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ক কমিটি; সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ, মান ও মূল্য নির্ধারণ ও তদারকি কমিটি; অত্যাবশ্যকীয় ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কমিটি; তথ্য ব্যবস্থাপনা, গণসংযোগ ও কমিউনিটি মোবিলাইজেশন কমিটি; মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কমিটি; কোভিড-১৯ ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি; হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও পরিবেশ সংক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ কমিটি এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটি।

এই দশ কমিটিকে একীভূত করতে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েকদিন পর করোনা নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৫ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি করোনার বিস্তার রোধ, যেকোন নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের সেবা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে বলে কমিটির প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কিন্তু দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে যে ধরনের কমিটি হয়েছে; এখনো হচ্ছে, তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি, হবেও না। করোনা মোকাবিলায় কী কাজ করতে হবে, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে জাতীয় পরিকল্পনা দলিলে। সেই দলিল অনুসরণ না করে অন্ধের মতো কমিটি তৈরি করছে। অধিক কমিটি পরিস্থিতি পাল্টাতে পারবে বলে মনে হয় না।’

করোনা মোকাবিলায় গত মার্চের শুরুতেই ‘ন্যাশনাল প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্ল্যান ফর কোভিড-১৯’ (জাতীয় পরিকল্পনা দলিল) তৈরি করে সরকার। প্রথমে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা ছাড়াই দলিলটি তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে দলিলটির ৭/৮টি সংস্করণ করা হয়।

বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গত ২৬ জুলাই ৯ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স (শক্তিশালী কমিটি) গঠন করা হয়। করোনা প্রতিরোধে ও আক্রান্ত রোগীদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ পর্যন্ত জারিকৃত পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশনা এবং যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন অগ্রগতি তদারকি করতেই এই টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (জনস্বাস্থ্য) আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সে আছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন করে যুগ্মসচিব; এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিবকে (জনস্বাস্থ্য-১) সদস্য রাখা হয়েছে।

এই টাস্কফোর্স স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি হওয়া বিভিন্ন পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশনা ও যেসব কমটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকি করবে; এছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত অভিযোগ ও তথ্য পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ, বিভিন্ন কমিটির সিদ্ধান্তের সমন্বয়, যেসব হাসপাতাল ও ল্যাবে কোভিড পরীক্ষা হয়, তাদের লাইসেন্স পরীক্ষা করা এবং সরকার নির্ধারিত ফি যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কিনা সেটা তদারকি, যেসব হাসপাতাল ও ল্যাবে কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয় সেখানে পর্যাপ্ত জনবল ও পরীক্ষার যথাযথ সুবিধা রয়েছে কিনা সেটা যাচাই করবে এবং এসব বিষয় কমিটি দু’মাসে কমপক্ষে একবার সভা করবে।

এর আগে গত ২৮ জুন করোনাকালে গঠিত ১০ কমিটির পুনর্গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের করোনা বিষয়ক কমিটির সংখ্যা ন্যূনতম ৪২/৪৩টি। এত কমিটির কাজ কী, আদৌ এত কমিটির প্রয়োজন রয়েছে কী না, তা নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন ছিল। বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে যত কমিটি হয়েছে, বিশ্বের কোন দেশেই এত কমিটি হয়নি বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য :

বিশে^র করোনা সংক্রমিত দেশগুলোর তুলনায় দেশে নমুনা পরীক্ষা কম হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে- টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বারবার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে; বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিল; কিন্তু একদিনও ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার কোটায় পৌঁছাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

করোনা পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে গত ১৭ এপ্রিল ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়।

সংক্রমণ পরিস্থিতি সামনে খারাপ হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে বড় পরিসরে লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটি। সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদের আগে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে পশুর হাট স্থাপন না করার পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি। তা আমলে নেয়া হয়নি। ফলে ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

গত ১০ জুলাই ৮টি সুপারিশ করে পরামর্শক কমিটি। এর আগে গত ১০ জুন ৫টি সুপারিশ এবং গত এপ্রিলে ৮টি সুপারিশ করেছিল। গত ১০ জুন কারিগরি পরামর্শক কমিটি পাঁচ সুপারিশের মধ্যে ছিল,করোনাভাইরাসের বিস্তার বন্ধে পূর্ণ লকডাউন আরোপ করা; অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে সব হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেন থেরাপীর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে চিকিৎসা চালু করা; চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা ব্যাপকহারে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের জীবনাবসান ঘটেছে। তাঁদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। হাই-ফ্লো অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় উপকরনসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল চালু করা এবং নমুনা পরীক্ষার মান্নোয়ন ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা। এসব সুপারিশের খুব একটা বাস্তবায়ন হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট কারিগরি পরামর্শক কমিটি বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের টিকার ট্রায়াল আয়োজনের সুপারিশ করেছে। তবে এ সুপারিশটি আমলে নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ওই কমিটিও পুনর্গঠন করেছে বলে জানা গেছে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে করোনাভাইরাসের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে হওয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠান বা দেশ টিকার ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে, টিকা বাজারে আসার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়া নিশ্চিত করতে তাদের সাথে এখনই যোগাযোগ করার সুপারিশ করেছে কমিটি। টিকা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সিরিঞ্জ উৎপাদন বা কেনার প্রস্তুতি রাখা, টিকা পাওয়ার পর তা সংরক্ষণ, বিতরণের পরিকল্পনা ঠিক করে রাখা এবং টিকা পাওয়ার পর জনসংখ্যার কারা অগ্রাধিকার পাবে তা এখনই ঠিক করে রাখার পরামর্শ দেয় কারিগরি কমিটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, কয়েকটি সংস্থার টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি বাংলাদেশে হলে দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তা প্রমাণের সুযোগ তৈরি হবে। আর টিকা সফল হিসেবে প্রমাণিত হলে তা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়ার সুযোগও থাকবে।

গত ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনে হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব।

বর্তমানে বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। করোনার উৎপত্তিস্থল হলেও এখন এর সংক্রমণ থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত চীন।