৫০ হাজার টাকা না দেয়ায় লিকেজ মেরামত করেনি তিতাস

তদন্তে গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী

মসজিদে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় স্থানীয় ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির লোকজন দায়ী করছেন তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে। মসজিদের মেঝের নিচে লাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হওয়ার কথা তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে জানানো হলেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি অভিযোগ করে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর বলেন, ৯-১০ দিন আগে বৃষ্টির পানি যখন মসজিদের ভেতর ঢুকে যায় তখন বুদ বুদ থেকে গ্যাস লিকেজের বিষয়টি নিশ্চিত হই। তৎক্ষণাৎ বিষয়টি তিতাসকে জানানো হলে তারা ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় লিকেজ মেরামত করা হয়নি। এদিকে শুক্রবার রাত ও শনিবার সকালে সরজমিনে দেখা যায়, মসজিদের দুই পাশের ছয়টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র বিস্ফোরিত হয়েছে। এসিগুলোরে ভেতরের অংশ বিস্ফোরিত হলেও বাইরের অংশগুলো ছিল অক্ষত। বিস্ফোরণের ঘটনায় মসজিদের ভেতরের দরজা-জানালার কাঁচ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পুড়ে গেছে মসজিদের ভেতরের জায়নামাজ ও কয়েকটি কিতাব। মানুষের ঝলসে যাওয়া চামড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মসজিদের ভেতর। মেঝেতে জমে থাকা পানি রক্তে লাল হয়ে আছে। বিস্ফোরণের এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয়দের মনে। মসজিদটি ঘিরে ভিড় করেছেন উৎসুক জনতা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তল্লা এলাকার বাসিন্দা মো. রতন জানান, এশার ফরজ নামাজ আদায় সবেমাত্র শেষ হয়েছে। সুন্নত ও নফল নামাজ আদায় করছিলেন মুসুল্লিরা। এমন সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। দগ্ধ মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছিলেন পার্শ্ববর্তী রাস্তায় জমা পানিতে। রতন বলেন, ‘চেহারার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল যে কাউকে চেনা যাচ্ছিল না। এমন দৃশ্য ভোলার নয়। মানুষগুলোর আর্তচিৎকার এখনও কানে বাজছে।’

খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের শীর্ষ কর্মকর্তারা। মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে তিতাস গ্যাসের লাইন গিয়েছে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, মসজিদের মেঝের নিচ থেকে তিতাস গ্যাসের একটি লাইন গিয়েছে। মসজিদের ভেতর গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে, কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর

বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এ সময় তিনি বিস্ফোরণে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। তিনি বলেন, এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে অনেক অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। নি¤œমানের জিআই পাইপ দিয়ে লাইনগুলো টানা হয়েছে। কারও কোন মিটার নাই। আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন করার। সবার আগে মানুষদের সচেতন হতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা থামানো যাবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমার বিভাগের কোন কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারলাম এখান দিয়ে গ্যাস লাইন গিয়েছে। তদন্তের পর বোঝা যাবে কোথা থেকে কোন গ্যাসলাইন এসেছে। তদন্তে সঠিক তথ্যটা বের হবে। তবে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মসজিদে এতগুলো এসি ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনই পরীক্ষা দরকার।

শামীম ওসমানের আশঙ্কা

মসজিদে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান। বিস্ফোরণের ঘটনা ‘নাশকতামূলক’ কিনা আশঙ্কা করছেন তিনি। বিস্ফোরণের ঘটনায় ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে তদন্তের দাবি করেন সরকারদলীয় এই সংসদ সদস্য।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি এ ঘটনাটি নাশকতামূলক বলে আশঙ্কা করছি। কারণ গ্যাস জমে ৪৫ জন মানুষ পুড়ে যাবে এটা সম্ভব না। ২০০১ সালে আমার সঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। চুন খেয়ে যার মুখ পুড়ে সে সব জায়গায় চুনের গন্ধ পায়। আমি এখানে চুনের গন্ধ পাচ্ছি। এ ধরনের ঘটনা শাহ জালাল বাবার দরগায়ও ঘটেছে দেখলাম, এজন্য কয়েকজনকে ধরাও হয়েছে। আমি বলছি না, এটা ওটার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিন্তু আমার মনে হয়, তদন্ত আরও গভীরভাবে হওয়া উচিত।’

মেয়র আইভির শোক প্রকাশ

মর্মান্তিক এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তিনি। বিস্ফোরণে হতাহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মেয়র।

ঘটনাস্থলের আলামত সংগ্রহ করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) এন্টি টেররিজম ইউনিট, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। বিস্ফোরণের উৎস ও কারণ জানতে পৃথক চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, ডিপিডিসি, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।

রবিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৬ মহররম ১৪৪২, ২০ ভাদ্র ১৪২৭

অভিযোগ

৫০ হাজার টাকা না দেয়ায় লিকেজ মেরামত করেনি তিতাস

তদন্তে গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী

প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ

মসজিদে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় স্থানীয় ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির লোকজন দায়ী করছেন তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে। মসজিদের মেঝের নিচে লাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হওয়ার কথা তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে জানানো হলেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি অভিযোগ করে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর বলেন, ৯-১০ দিন আগে বৃষ্টির পানি যখন মসজিদের ভেতর ঢুকে যায় তখন বুদ বুদ থেকে গ্যাস লিকেজের বিষয়টি নিশ্চিত হই। তৎক্ষণাৎ বিষয়টি তিতাসকে জানানো হলে তারা ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় লিকেজ মেরামত করা হয়নি। এদিকে শুক্রবার রাত ও শনিবার সকালে সরজমিনে দেখা যায়, মসজিদের দুই পাশের ছয়টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র বিস্ফোরিত হয়েছে। এসিগুলোরে ভেতরের অংশ বিস্ফোরিত হলেও বাইরের অংশগুলো ছিল অক্ষত। বিস্ফোরণের ঘটনায় মসজিদের ভেতরের দরজা-জানালার কাঁচ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পুড়ে গেছে মসজিদের ভেতরের জায়নামাজ ও কয়েকটি কিতাব। মানুষের ঝলসে যাওয়া চামড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মসজিদের ভেতর। মেঝেতে জমে থাকা পানি রক্তে লাল হয়ে আছে। বিস্ফোরণের এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয়দের মনে। মসজিদটি ঘিরে ভিড় করেছেন উৎসুক জনতা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তল্লা এলাকার বাসিন্দা মো. রতন জানান, এশার ফরজ নামাজ আদায় সবেমাত্র শেষ হয়েছে। সুন্নত ও নফল নামাজ আদায় করছিলেন মুসুল্লিরা। এমন সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। দগ্ধ মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছিলেন পার্শ্ববর্তী রাস্তায় জমা পানিতে। রতন বলেন, ‘চেহারার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল যে কাউকে চেনা যাচ্ছিল না। এমন দৃশ্য ভোলার নয়। মানুষগুলোর আর্তচিৎকার এখনও কানে বাজছে।’

খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের শীর্ষ কর্মকর্তারা। মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে তিতাস গ্যাসের লাইন গিয়েছে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, মসজিদের মেঝের নিচ থেকে তিতাস গ্যাসের একটি লাইন গিয়েছে। মসজিদের ভেতর গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে, কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর

বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এ সময় তিনি বিস্ফোরণে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। তিনি বলেন, এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে অনেক অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। নি¤œমানের জিআই পাইপ দিয়ে লাইনগুলো টানা হয়েছে। কারও কোন মিটার নাই। আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন করার। সবার আগে মানুষদের সচেতন হতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা থামানো যাবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমার বিভাগের কোন কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারলাম এখান দিয়ে গ্যাস লাইন গিয়েছে। তদন্তের পর বোঝা যাবে কোথা থেকে কোন গ্যাসলাইন এসেছে। তদন্তে সঠিক তথ্যটা বের হবে। তবে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মসজিদে এতগুলো এসি ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনই পরীক্ষা দরকার।

শামীম ওসমানের আশঙ্কা

মসজিদে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান। বিস্ফোরণের ঘটনা ‘নাশকতামূলক’ কিনা আশঙ্কা করছেন তিনি। বিস্ফোরণের ঘটনায় ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে তদন্তের দাবি করেন সরকারদলীয় এই সংসদ সদস্য।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি এ ঘটনাটি নাশকতামূলক বলে আশঙ্কা করছি। কারণ গ্যাস জমে ৪৫ জন মানুষ পুড়ে যাবে এটা সম্ভব না। ২০০১ সালে আমার সঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। চুন খেয়ে যার মুখ পুড়ে সে সব জায়গায় চুনের গন্ধ পায়। আমি এখানে চুনের গন্ধ পাচ্ছি। এ ধরনের ঘটনা শাহ জালাল বাবার দরগায়ও ঘটেছে দেখলাম, এজন্য কয়েকজনকে ধরাও হয়েছে। আমি বলছি না, এটা ওটার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিন্তু আমার মনে হয়, তদন্ত আরও গভীরভাবে হওয়া উচিত।’

মেয়র আইভির শোক প্রকাশ

মর্মান্তিক এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তিনি। বিস্ফোরণে হতাহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মেয়র।

ঘটনাস্থলের আলামত সংগ্রহ করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) এন্টি টেররিজম ইউনিট, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। বিস্ফোরণের উৎস ও কারণ জানতে পৃথক চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, ডিপিডিসি, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।