বিদায় অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়

গোপাল অধিকারী

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, বিদায় নাহি দিতে চাই, তবু দিতে হয়, তবু চলে যায়। বিদায় নিলেন ভারতের রাজনীতিতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র আর বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়। ৩১ আগস্ট সোমবার নয়াদিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে ভারত সরকার সোমবার থেকে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকারও ২ সেপ্টেম্বর একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। ১৫ আগস্টে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, ২৫ আগস্ট চলে গেলেন জাতীর বীর সন্তান সি আর দত্ত বীরউত্তম আর ৩১ আগস্ট বিদায় নিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আগস্টের পাল্লায় যেন বেদনায় কমতি রইল না।

গত ৯ আগস্ট রাতে দিল্লির বাড়িতে বার্থরুমে পড়ে গুরুতর আহত হন প্রণব মুখার্জি। পর দিন সকাল থেকে তার স্নায়ুতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। ১৩ আগস্ট থেকে তিনি গভীর কোমায় চলে যান।

প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাবেক এ রাষ্ট্রপতির পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার ছবি পোস্ট করে টুইটারে মোদি লেখেন, ‘ভারতরত্ন শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে ভারত শোক প্রকাশ করছে। তিনি দেশের উন্নয়নের গতিপথে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।’ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শাসকবিরোধী সব দলের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা।

সাবেক এ প্রেসিডেন্টর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারালো একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারালো একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।

জীবনে চলার পথে অনেকেই বন্ধু হয় আবার অনেকেই বন্ধু হতে চায়। হোক সেটা ব্যক্তি বা রাষ্ট্র নামক জীবনে। তবে সব বন্ধুই অকৃত্রিম হয় না আবার হতে পারেও না। নিঃস্বার্থ নির্দ্বিধায় যিনি ভালোবাসেন তিনিই অকৃত্রিম বন্ধু হতে পারে। তাই বন্ধু নির্বাচনেও সতর্কতা প্রয়োজন হয়। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হবার নয়। ওই সময়ে রাজ্যসভার তরণি সদস্য হিসেবে ভারত সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের স্বীকৃতি আদায়ে সরব হয়ে ওঠেন তিনি। আর সে কারণেই তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’র একটি অধ্যায়ে এ কথা নিজেই জানিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, এরপরই তাকে একের পর এক দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিভিন্ন দেশ সফরে পাঠান ইন্দিরা। আর এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে অকৃত্রিম বাধনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ইস্যুতে ভূমিকা রেখে ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি সবসময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার খোঁজখবর রাখতেন এবং যে কোনো প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০১৩ সালের মার্চে তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেয়া হয়।

ব্যক্তিজীবনে সফল এ মানুষটির জন্ম ও রাজনৈতিক ইতিহাস সমৃদ্ধ। জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯৩৫ অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে। তার পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া প্রণব মুখোপাধ্যায় সুরি বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষালাভ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতার কাছে ছোট একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরুর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ওই সময়ে তিনি বাংলাভাষায় একটি মাসিক সাময়িকীর সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন।

রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির যাত্রা শুরু কিন্তু ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাত ধরে নয়। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার তিনি রাজ্য সভার (ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ) সদস্য নির্বাচিত হন আলাদা দল বাংলা কংগ্রেস থেকে। পরে অবশ্য দলটি কংগ্রেসের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন। পরে ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে চার মেয়াদে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৪ সালে তা ছেড়ে দেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সংসদ সদস্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই বছরই তিনি লোকসভা (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) নির্বাচনে জয় পান। টানা নির্বাচিত হয়ে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে তিনি দেশটির ১৩তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১২-২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়। প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী। প্রণব মুখোপাধ্যায় তার রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, পররাষ্ট্র, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

দশ বছর বয়সে নড়াইলের ভদ্রবিলা থেকে পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হওয়া শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে প্রথমবারের মতো ভদ্রবিলায় শ্বশুরবাড়ি ঘুরেও গেছেন তিনি।

সেখানে তাকে ‘উলু ধ্বনি’ ও ‘মঙ্গল আরতি’র মতো প্রথাগত উপায়ে স্বাগত জানানো হয়। ওই সময়ে অসুস্থতা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে চড়ে নিজের জন্মভিটায় ঘুরে যান শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। স্বামীর সঙ্গে সেটাই ছিল তার শেষ বিদেশ সফর। এর দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান শুভ্রা। তার হাত ধরেই ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেছিল সন্দেশের মতো বাঙালি মিষ্টি খাবার।

প্রণব-শুভ্রা দম্পত্তির দুই ছেলে ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় ও অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও একমাত্র মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের জাঙ্গিপুর আসন থেকে দুইবার কংগ্রেসের মনোনয়নে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া শর্মিষ্ঠা মুখার্জি একজন কত্থক নৃত্যশিল্পী। কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন তিনিও।

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় হন কয়েক বছর আগেই। সোমবার এই পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকেও বিদায় নিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনে আজও ফুল ফুটছে ‘তার নামে’। তিনি প্রণব মুখার্জি।

রাষ্ট্রপ্রতি থাকাকালীন সময় রাষ্ট্রপতি ভবন ছিল ফুলে ফুলে ভরা। ফুল ভালোবাসতেন তিনি। তাই ফুলের বাগানের অতিরিক্ত দেখভাল করতেন। সেই সময়েই দুটি গোলাপ চারাকে সযতেœ বাড়িয়ে তোলেন প্রণব। সেই দুটি গোলাপ গাছের একটির নামকরণ করা হয় ‘প্রেসিডেন্ট প্রণব’। আরেকটি তার স্ত্রী শুভ্রার নামে। আজ পুরো ভারতবাসীর মতো হয়তো ওই বাগানের ফুল দুটিও শোকাহত। আজ প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের নাগরিক না হলেও তার জন্য আমরাও শোকাহত। আমারও অনুভব করছি তার অভাব, স্মরণ করছি তার কৃতকর্ম। হে মহান বন্ধু, তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট]

gopalodikari1213@gmail.com

রবিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৬ মহররম ১৪৪২, ২০ ভাদ্র ১৪২৭

বিদায় অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়

গোপাল অধিকারী

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, বিদায় নাহি দিতে চাই, তবু দিতে হয়, তবু চলে যায়। বিদায় নিলেন ভারতের রাজনীতিতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র আর বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়। ৩১ আগস্ট সোমবার নয়াদিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে ভারত সরকার সোমবার থেকে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকারও ২ সেপ্টেম্বর একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। ১৫ আগস্টে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, ২৫ আগস্ট চলে গেলেন জাতীর বীর সন্তান সি আর দত্ত বীরউত্তম আর ৩১ আগস্ট বিদায় নিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আগস্টের পাল্লায় যেন বেদনায় কমতি রইল না।

গত ৯ আগস্ট রাতে দিল্লির বাড়িতে বার্থরুমে পড়ে গুরুতর আহত হন প্রণব মুখার্জি। পর দিন সকাল থেকে তার স্নায়ুতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। ১৩ আগস্ট থেকে তিনি গভীর কোমায় চলে যান।

প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাবেক এ রাষ্ট্রপতির পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার ছবি পোস্ট করে টুইটারে মোদি লেখেন, ‘ভারতরত্ন শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে ভারত শোক প্রকাশ করছে। তিনি দেশের উন্নয়নের গতিপথে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।’ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শাসকবিরোধী সব দলের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা।

সাবেক এ প্রেসিডেন্টর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারালো একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারালো একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।

জীবনে চলার পথে অনেকেই বন্ধু হয় আবার অনেকেই বন্ধু হতে চায়। হোক সেটা ব্যক্তি বা রাষ্ট্র নামক জীবনে। তবে সব বন্ধুই অকৃত্রিম হয় না আবার হতে পারেও না। নিঃস্বার্থ নির্দ্বিধায় যিনি ভালোবাসেন তিনিই অকৃত্রিম বন্ধু হতে পারে। তাই বন্ধু নির্বাচনেও সতর্কতা প্রয়োজন হয়। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হবার নয়। ওই সময়ে রাজ্যসভার তরণি সদস্য হিসেবে ভারত সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের স্বীকৃতি আদায়ে সরব হয়ে ওঠেন তিনি। আর সে কারণেই তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’র একটি অধ্যায়ে এ কথা নিজেই জানিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, এরপরই তাকে একের পর এক দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিভিন্ন দেশ সফরে পাঠান ইন্দিরা। আর এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে অকৃত্রিম বাধনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ইস্যুতে ভূমিকা রেখে ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি সবসময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার খোঁজখবর রাখতেন এবং যে কোনো প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০১৩ সালের মার্চে তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেয়া হয়।

ব্যক্তিজীবনে সফল এ মানুষটির জন্ম ও রাজনৈতিক ইতিহাস সমৃদ্ধ। জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯৩৫ অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে। তার পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া প্রণব মুখোপাধ্যায় সুরি বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষালাভ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতার কাছে ছোট একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরুর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ওই সময়ে তিনি বাংলাভাষায় একটি মাসিক সাময়িকীর সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন।

রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির যাত্রা শুরু কিন্তু ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাত ধরে নয়। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার তিনি রাজ্য সভার (ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ) সদস্য নির্বাচিত হন আলাদা দল বাংলা কংগ্রেস থেকে। পরে অবশ্য দলটি কংগ্রেসের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন। পরে ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে চার মেয়াদে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৪ সালে তা ছেড়ে দেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সংসদ সদস্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই বছরই তিনি লোকসভা (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) নির্বাচনে জয় পান। টানা নির্বাচিত হয়ে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে তিনি দেশটির ১৩তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১২-২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়। প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী। প্রণব মুখোপাধ্যায় তার রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, পররাষ্ট্র, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

দশ বছর বয়সে নড়াইলের ভদ্রবিলা থেকে পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হওয়া শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে প্রথমবারের মতো ভদ্রবিলায় শ্বশুরবাড়ি ঘুরেও গেছেন তিনি।

সেখানে তাকে ‘উলু ধ্বনি’ ও ‘মঙ্গল আরতি’র মতো প্রথাগত উপায়ে স্বাগত জানানো হয়। ওই সময়ে অসুস্থতা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে চড়ে নিজের জন্মভিটায় ঘুরে যান শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। স্বামীর সঙ্গে সেটাই ছিল তার শেষ বিদেশ সফর। এর দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান শুভ্রা। তার হাত ধরেই ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেছিল সন্দেশের মতো বাঙালি মিষ্টি খাবার।

প্রণব-শুভ্রা দম্পত্তির দুই ছেলে ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় ও অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও একমাত্র মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের জাঙ্গিপুর আসন থেকে দুইবার কংগ্রেসের মনোনয়নে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া শর্মিষ্ঠা মুখার্জি একজন কত্থক নৃত্যশিল্পী। কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন তিনিও।

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় হন কয়েক বছর আগেই। সোমবার এই পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকেও বিদায় নিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনে আজও ফুল ফুটছে ‘তার নামে’। তিনি প্রণব মুখার্জি।

রাষ্ট্রপ্রতি থাকাকালীন সময় রাষ্ট্রপতি ভবন ছিল ফুলে ফুলে ভরা। ফুল ভালোবাসতেন তিনি। তাই ফুলের বাগানের অতিরিক্ত দেখভাল করতেন। সেই সময়েই দুটি গোলাপ চারাকে সযতেœ বাড়িয়ে তোলেন প্রণব। সেই দুটি গোলাপ গাছের একটির নামকরণ করা হয় ‘প্রেসিডেন্ট প্রণব’। আরেকটি তার স্ত্রী শুভ্রার নামে। আজ পুরো ভারতবাসীর মতো হয়তো ওই বাগানের ফুল দুটিও শোকাহত। আজ প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের নাগরিক না হলেও তার জন্য আমরাও শোকাহত। আমারও অনুভব করছি তার অভাব, স্মরণ করছি তার কৃতকর্ম। হে মহান বন্ধু, তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট]

gopalodikari1213@gmail.com