করোনার প্রথম ঢেউ থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঢেউ নিশ্চিত

বাংলাদেশে দীর্ঘ ছয় মাসেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঢেউ শেষ হয়নি। করোনার এই ঢেউ কবে নাগাদ শেষ হবে তাও বলতে পারছেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টরা। এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে এই মহামারী। অথচ ইউরোপীয় দেশগুলোয় করোনার প্রথম ঢেউ শেষে, দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েও তা শেষের দিকে।

সরকারি হাসপাতালের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপের শেষের দিকে যাচ্ছে। আগে দৈনিক ২২ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে করোনা শনাক্তের হার দৈনিক সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মৃত্যুর হার স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তবে করোনার শনাক্তের হার দৈনিক পাঁচ শতাংশের নিচে নামলে প্রথম ঢেউয়ের শেষ স্তরে পৌঁছবে। কিন্তু জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল না করা এবং মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে করোনার প্রথম ঢেউ দীর্ঘ হচ্ছে। এটি নিশ্চিত যে, করোনার প্রথম ঢেউ শেষে, দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। করোনা শনাক্তে দেশে কীটের ঘাটতি নেই। যেকোন কারণেই হোক মানুষ করোনা নমুনা পরীক্ষার ইচ্ছা করছেন না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রমে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। দেশগুলো দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিভাগ করোনা প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা করলেও বাস্তবায়ন করেনি। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটির অনীহা এবং মানুষের অবাধ চলাচলে করোনার প্রথম ঢেউ শেষ হচ্ছে না। হাসপাতালে ভোগান্তির কারণে করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে আসছেন মানুষ। গত কয়েকদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে করোনার নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষা ও শনাক্তের হার কমেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো, হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষ ভোগান্তিতে পড়ায় করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে আসছেন না।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই চলাচল করছেন, এতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা রয়ে গেছে। জার্মানি, ইতালি এবং ফ্রান্স কমবেশি তিন মাসে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এসব দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিলে প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে আরও কড়াকড়ি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে করোনা নিয়ে ঢিলেঢালাভাব চলছে। করোনার ঢেউ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিভাগের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। জানা গেছে, ইউরোপীয় দেশগুলো করোনা প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এলে সরকারি অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ খুলে দেয়। কিন্তু আমার করোনার প্রথম ঢেউ শেষ না হওয়ার আগেই সরকারি-বেসরকারি অফিস, রেস্তোরাঁ সবকিছু খুলে দিয়েছে। ফলে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘ হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ একবারে শেষ হয়ে যায় না। একবার করোনা চলে গেলে আবার দ্বিতীয় ঢেউ আসে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কোন দেশে ব্যাপক হয়, কোন দেশে সীমিত হয়। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ হবে না সীমিত আকারে হবে তা নিশ্চিত নয়। দেশে গত জুনে সরকারি- বেসরকারি অফিস, মার্কেটসহ সবকিছু খুলে দিয়েছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউন করা থেকেও সরকার সরে এসেছে। ফলে অর্থনৈতিক কিছু গতি সঞ্চার হলেও করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘদিন যাবত থাকছে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সংবাদকে বলেন, করোনার নমুনা পরীক্ষা করে দেশ থেকে প্রতিদিন বিদেশে মানুষ যাচ্ছে এবং মানুষ একের অধিক করোনার নমুনা পরীক্ষা করছেন। ফলে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রোগীর সংখ্যা বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং স্বাস্থ্য অধিদফতরের বর্তমান করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সারাদেশে করোনার রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভব নয়। এই ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যাবে না, দেশে এখন করোনা সংক্রমণ কমছে। আমাদের করোনা সংক্রমণ কমাতে বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রথম ঢেউ কমে এলে বলা যাবে, দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশ কোথায় পৌঁছাবে। মালয়েশিয়া একুশ দেশ থেকে জনবল নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে এরমধ্যে বাংলাদেশও আছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের শ্রম বাজার হুমকির মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণে কোন অবস্থা রয়েছে এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে যে পরিমাণ করোনার নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষা করা উচিত, সেটি করা হয়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনে স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর’বি এবং সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর জরিপে, ঢাকার ৯% লোকই করোনাভাইরাস সংক্রমিত। কিন্তু গত ছয় মাসেও করোনার সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য সারাদেশে করোনার জরিপ করা হয়নি। করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রমে স্বাস্থ্যবিভাগ হাল ছেড়ে দেয়া ভাব চলছে। এসব কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ করোনার অবস্থা কোথায় আছে, সেটি বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে অনুমানভিত্তিতে বলা যায়, এখনও করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপ শেষ হয়নি, দ্বিতীয় ধাপ কবে আসবে তা অনিশ্চিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে করোনা সংক্রমণ এবং নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম দেখালেও, বাস্তব চিত্র উল্টো। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তির তথ্যের তুলনায় দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বেশি। করোনা নিয়ন্ত্রণে হাল ছেড়ে দেয়ার ভাবের কারণে আগামীতে বড় সংক্রমণের ঝুঁকি মানুষের ওপর ঝুলে আছে।

তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ করোনা নমুনা পরীক্ষার আগ্রহী নয়। কারণ বেসরকারি হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষায় কমবেশি ৪ হাজার টাকা লাগে এবং সরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করতে মানুষ নানান বিড়ম্বনায় পড়ছেন। করোনা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ঠিক না ভুল সেটি নিয়ে মানুষের মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। করোনা সংক্রমণ কার্যক্রমে হাল ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ায় তিন মাসের মাথায় করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম সঠিক না হওয়ায়, ছয় মাসেও করোনা সংক্রমণ নি¤œমুখী হয়নি। যেকোন সময় করোনা সংক্রমণ হু হু করে বেড়ে যেতে পারে।

জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৫টি এলাকাকে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটি। এলাকাভিত্তিক লকডাউন করার কথা থাকলেও উত্তর সিটি করপোরেশনে পূর্ব রাজারবাগ এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ওয়ারীতে লকডাউন করা হয়। আর কোথাও লকডাউন করা হয়নি। স্বাস্থ্যবিভাগ ও অন্যান্য সংস্থা পরিকল্পনা করলেও বাস্তাবায়ন করেনি। এছাড়া করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নমুনা পরীক্ষার জন্য দুইশ’ টাকা ফি নির্ধারণ করে। বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র ডা. এবিএম শামছুজ্জামান সেলিম সংবাদকে বলেন, প্রথম ধাপে করোনা সংক্রমণ চলছে। দ্বিতীয় ধাপের পরিস্থিতি এখনও আসেনি। করোনা সংক্রমণ কমায় মানুষের মাঝে গাছাড়া ভাব এসেছে। লোকজন স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই চলাচল করছেন। দ্বিতীয় ধাপে করোনা সংক্রমণ হওয়ার আগেই যেন করোনা প্রতিরোধ ভ্যাকসিন দেশে চলে আসে। কার্যকরী ভ্যাকসিন পেলে দ্রুতই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করেন তিনি।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবুল হাসেম সংবাদকে বলেন, করোনার প্রথম ঢেউ চলছে, এটি তৃতীয় ধাপ। একটি পরিবারের মধ্যে যখন কোন ভাইরাস বিস্তার ঘটনায় সেটিকে বলা হয় প্রথম ধাপ, একটি এলাকায় ভাইরাসের বিস্তারকে দ্বিতীয় ধাপ। এখন আমরা করোনার প্রথম ঢেউয়ের তৃতীয় ধাপে আছি। দেশের অধিকাংশ জনগণ করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন। ভারত করোনা মহামারীর মধ্যে শীর্ষে আছে। এরমধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা রয়েছে। আপাতত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ রাখা উচিত।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) করোনাভাইরাস বিষয়ক পর্যবেক্ষণে বলছে, দেশে করোনাভাইরাস দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসের রূপান্তরের হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, বাংলাদেশে এই ভাইরাসের রূপান্তরের হার ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাস অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে।

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেছে, দেশে মোট মৃত্যু ৪ হাজার ৫১৬ জনে দাঁড়ালো। মোট শনাক্ত ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৭৩ জন। সুস্থ হয়েছেন ২ লাখ ২৪ হাজার ৫৭৩ জন। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৭২৪টি। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৬৮ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে প্রতিবেশি দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি সংকটজনক। করোনা ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। ভারতে প্রতিদিন রেকর্ড সংখ্যায় করোনা ছড়াচ্ছে। দৈনিক করোনা আক্রান্তে ফের বিশ্বের মধ্যে নতুন রেকর্ড ভারতের। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৮৬ হাজার ৪৩২ জন। এর সঙ্গেই ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ লাখ পেরিয়েছে। বিশ্বে করোনা সংক্রমণে ভারত ৩ নম্বরে থাকলেও খুব শীঘ্রই ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৮ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

করোনার প্রথম ঢেউ থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঢেউ নিশ্চিত

ফারুক আলম

বাংলাদেশে দীর্ঘ ছয় মাসেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঢেউ শেষ হয়নি। করোনার এই ঢেউ কবে নাগাদ শেষ হবে তাও বলতে পারছেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টরা। এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে এই মহামারী। অথচ ইউরোপীয় দেশগুলোয় করোনার প্রথম ঢেউ শেষে, দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েও তা শেষের দিকে।

সরকারি হাসপাতালের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপের শেষের দিকে যাচ্ছে। আগে দৈনিক ২২ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে করোনা শনাক্তের হার দৈনিক সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মৃত্যুর হার স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তবে করোনার শনাক্তের হার দৈনিক পাঁচ শতাংশের নিচে নামলে প্রথম ঢেউয়ের শেষ স্তরে পৌঁছবে। কিন্তু জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল না করা এবং মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে করোনার প্রথম ঢেউ দীর্ঘ হচ্ছে। এটি নিশ্চিত যে, করোনার প্রথম ঢেউ শেষে, দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। করোনা শনাক্তে দেশে কীটের ঘাটতি নেই। যেকোন কারণেই হোক মানুষ করোনা নমুনা পরীক্ষার ইচ্ছা করছেন না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রমে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। দেশগুলো দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিভাগ করোনা প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা করলেও বাস্তবায়ন করেনি। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটির অনীহা এবং মানুষের অবাধ চলাচলে করোনার প্রথম ঢেউ শেষ হচ্ছে না। হাসপাতালে ভোগান্তির কারণে করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে আসছেন মানুষ। গত কয়েকদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে করোনার নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষা ও শনাক্তের হার কমেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো, হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষ ভোগান্তিতে পড়ায় করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে আসছেন না।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই চলাচল করছেন, এতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা রয়ে গেছে। জার্মানি, ইতালি এবং ফ্রান্স কমবেশি তিন মাসে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এসব দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিলে প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে আরও কড়াকড়ি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে করোনা নিয়ে ঢিলেঢালাভাব চলছে। করোনার ঢেউ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিভাগের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। জানা গেছে, ইউরোপীয় দেশগুলো করোনা প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এলে সরকারি অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ খুলে দেয়। কিন্তু আমার করোনার প্রথম ঢেউ শেষ না হওয়ার আগেই সরকারি-বেসরকারি অফিস, রেস্তোরাঁ সবকিছু খুলে দিয়েছে। ফলে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘ হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ একবারে শেষ হয়ে যায় না। একবার করোনা চলে গেলে আবার দ্বিতীয় ঢেউ আসে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কোন দেশে ব্যাপক হয়, কোন দেশে সীমিত হয়। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ হবে না সীমিত আকারে হবে তা নিশ্চিত নয়। দেশে গত জুনে সরকারি- বেসরকারি অফিস, মার্কেটসহ সবকিছু খুলে দিয়েছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউন করা থেকেও সরকার সরে এসেছে। ফলে অর্থনৈতিক কিছু গতি সঞ্চার হলেও করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘদিন যাবত থাকছে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সংবাদকে বলেন, করোনার নমুনা পরীক্ষা করে দেশ থেকে প্রতিদিন বিদেশে মানুষ যাচ্ছে এবং মানুষ একের অধিক করোনার নমুনা পরীক্ষা করছেন। ফলে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রোগীর সংখ্যা বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং স্বাস্থ্য অধিদফতরের বর্তমান করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সারাদেশে করোনার রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভব নয়। এই ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যাবে না, দেশে এখন করোনা সংক্রমণ কমছে। আমাদের করোনা সংক্রমণ কমাতে বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রথম ঢেউ কমে এলে বলা যাবে, দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশ কোথায় পৌঁছাবে। মালয়েশিয়া একুশ দেশ থেকে জনবল নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে এরমধ্যে বাংলাদেশও আছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের শ্রম বাজার হুমকির মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণে কোন অবস্থা রয়েছে এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে যে পরিমাণ করোনার নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষা করা উচিত, সেটি করা হয়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনে স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর’বি এবং সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর জরিপে, ঢাকার ৯% লোকই করোনাভাইরাস সংক্রমিত। কিন্তু গত ছয় মাসেও করোনার সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য সারাদেশে করোনার জরিপ করা হয়নি। করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রমে স্বাস্থ্যবিভাগ হাল ছেড়ে দেয়া ভাব চলছে। এসব কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ করোনার অবস্থা কোথায় আছে, সেটি বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে অনুমানভিত্তিতে বলা যায়, এখনও করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপ শেষ হয়নি, দ্বিতীয় ধাপ কবে আসবে তা অনিশ্চিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে করোনা সংক্রমণ এবং নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম দেখালেও, বাস্তব চিত্র উল্টো। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তির তথ্যের তুলনায় দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বেশি। করোনা নিয়ন্ত্রণে হাল ছেড়ে দেয়ার ভাবের কারণে আগামীতে বড় সংক্রমণের ঝুঁকি মানুষের ওপর ঝুলে আছে।

তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ করোনা নমুনা পরীক্ষার আগ্রহী নয়। কারণ বেসরকারি হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষায় কমবেশি ৪ হাজার টাকা লাগে এবং সরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করতে মানুষ নানান বিড়ম্বনায় পড়ছেন। করোনা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ঠিক না ভুল সেটি নিয়ে মানুষের মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। করোনা সংক্রমণ কার্যক্রমে হাল ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ায় তিন মাসের মাথায় করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম সঠিক না হওয়ায়, ছয় মাসেও করোনা সংক্রমণ নি¤œমুখী হয়নি। যেকোন সময় করোনা সংক্রমণ হু হু করে বেড়ে যেতে পারে।

জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৫টি এলাকাকে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটি। এলাকাভিত্তিক লকডাউন করার কথা থাকলেও উত্তর সিটি করপোরেশনে পূর্ব রাজারবাগ এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ওয়ারীতে লকডাউন করা হয়। আর কোথাও লকডাউন করা হয়নি। স্বাস্থ্যবিভাগ ও অন্যান্য সংস্থা পরিকল্পনা করলেও বাস্তাবায়ন করেনি। এছাড়া করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নমুনা পরীক্ষার জন্য দুইশ’ টাকা ফি নির্ধারণ করে। বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র ডা. এবিএম শামছুজ্জামান সেলিম সংবাদকে বলেন, প্রথম ধাপে করোনা সংক্রমণ চলছে। দ্বিতীয় ধাপের পরিস্থিতি এখনও আসেনি। করোনা সংক্রমণ কমায় মানুষের মাঝে গাছাড়া ভাব এসেছে। লোকজন স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই চলাচল করছেন। দ্বিতীয় ধাপে করোনা সংক্রমণ হওয়ার আগেই যেন করোনা প্রতিরোধ ভ্যাকসিন দেশে চলে আসে। কার্যকরী ভ্যাকসিন পেলে দ্রুতই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করেন তিনি।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবুল হাসেম সংবাদকে বলেন, করোনার প্রথম ঢেউ চলছে, এটি তৃতীয় ধাপ। একটি পরিবারের মধ্যে যখন কোন ভাইরাস বিস্তার ঘটনায় সেটিকে বলা হয় প্রথম ধাপ, একটি এলাকায় ভাইরাসের বিস্তারকে দ্বিতীয় ধাপ। এখন আমরা করোনার প্রথম ঢেউয়ের তৃতীয় ধাপে আছি। দেশের অধিকাংশ জনগণ করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন। ভারত করোনা মহামারীর মধ্যে শীর্ষে আছে। এরমধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা রয়েছে। আপাতত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ রাখা উচিত।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) করোনাভাইরাস বিষয়ক পর্যবেক্ষণে বলছে, দেশে করোনাভাইরাস দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসের রূপান্তরের হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, বাংলাদেশে এই ভাইরাসের রূপান্তরের হার ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাস অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে।

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেছে, দেশে মোট মৃত্যু ৪ হাজার ৫১৬ জনে দাঁড়ালো। মোট শনাক্ত ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৭৩ জন। সুস্থ হয়েছেন ২ লাখ ২৪ হাজার ৫৭৩ জন। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৭২৪টি। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৬৮ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে প্রতিবেশি দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি সংকটজনক। করোনা ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। ভারতে প্রতিদিন রেকর্ড সংখ্যায় করোনা ছড়াচ্ছে। দৈনিক করোনা আক্রান্তে ফের বিশ্বের মধ্যে নতুন রেকর্ড ভারতের। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৮৬ হাজার ৪৩২ জন। এর সঙ্গেই ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ লাখ পেরিয়েছে। বিশ্বে করোনা সংক্রমণে ভারত ৩ নম্বরে থাকলেও খুব শীঘ্রই ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।