গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ

গণশুনানিতে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় সকাল ১০টা থেকে শুরু হলেও দুপুর ২টা পর্যন্ত কেউই আসেননি। বেলা আড়াইটার দিকে কিছু লোক জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সামনে এসে জড়ো হন। সবাই একত্রে কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষের দিকে যান। শেষ এক ঘণ্টায় ১৮ জন গণশুনানিতে সাক্ষ্য দেন।

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গণশুনানির আয়োজন করে। গতকাল সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি।

আড়াইটার পর একদল লোক আসেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে তাদের লিখিত সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্য দিতে আসা কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি ‘সংগঠিত’ বলে পরিলক্ষিত হয়।

অনুসন্ধানে অভিযোগ পাওয়া যায়, বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটা পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাত জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুরের অনুসারী আল-আমিন, নাইম, বাবু এই সাক্ষীদের নিয়ে এসেছেন। যারা সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তাদের অধিকাংশই আবদুল গফুরের অনুসারী। অন্যদের ম্যানেজ করে আনা হয়েছে। আসা-যাওয়ার ইজিবাইক ও রিকশা ভাড়াও বহন করেছেন গফুর মেম্বার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাক্ষ্য দিতে আসা এক ব্যক্তি জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী হওয়াতে শনিবার মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সহ-সভাপতির সঙ্গে তারও লিখিত সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। গতকাল তাকে জেলা প্রশাসন থেকে ডাকা হয়নি। এলাকার কিছু যুবক তাকে জোর করে তাদের কথামতো সাক্ষ্য দেয়াতে নিয়ে আসেন। যদিও পূর্বে সাক্ষ্য দেয়ার কারণে গণশুনানিতে তার সাক্ষ্য নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস কক্ষের সামনে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গণ্যমাধ্যম কর্মীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে উপস্থিত হন বাবু নামে এক ব্যক্তি। সে মসজিদ কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুরের অনুসারী। এ প্রতিবেদকের সামনে প্রত্যক্ষদর্শী ওই ব্যক্তিকে এসে ধমকান বাবু। পরে ‘আমার নাম বাবু। আমার লগে প্যাচাইয়া কথা কইবা না। বেশি কথা বলা ভালো না। সবার খোঁজই কিন্তু রাখা হইতাছে।’ এই বলে চলে যান ওই ব্যক্তি।

পরে বিস্ফোরণের ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভীত হয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আর কথা বলতে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, ‘দেখলেনই তো। এরপরও কথা বললে আমি ঝামেলাই পইড়া যামু। কেবল একটা কথাই কই, পুরা ঘটনা এখন গ্যাসের দিকে নিতে চাইতাছে তারা। যেন আর কারও দোষ নাই।’

কথা হয় সাক্ষ্য দিতে আসা আরও কয়েকজনের সঙ্গে। কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। বিদ্যুতের দুটি সংযোগ, মসজিদ নির্মাণ প্রসঙ্গে তারা কিছু জানেন না বলেন। সবার মুখেই একটাই কথা ‘গ্যাস লাইনের লিকেজ ছিল। মসজিদের গেটের দিক দিয়ে গ্যাস বের হইতো। সেই গ্যাস জমেই বিস্ফোরণ।’

প্রথমে নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও পরে নিজের নাম আব্দুস সোবহান বলে জানান গণশুনানিতে সাক্ষ্য দিতে আসা এক ব্যক্তি। তিনিও বলেন, ‘মসজিদ কেমনে কী হইছে জানি না। গ্যাসের লাইনের লিকেজের কথা শুনছি। সেইটাই ভিতরে কইছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি বলেন, ‘সংগঠিতভাবে সাক্ষীদের আনা হয়েছে, আমার এমনটা মনে হয়নি। তাছাড়া সকলেই সদিচ্ছা অনুযায়ী লিখিত সাক্ষী দিয়েছেন। তাদের মোবাইল নম্বরও রাখা হয়েছে।’

তিনি বলেন, গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সময় শেষ হয়ে গেলেও কেউ যদি সাক্ষ্য দিতে চায় তাও আমরা শুনব। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, মসজিদের নির্মাণসহ সম্ভাব্য সব বিষয়কে সামনে রেখেই আমরা তদন্ত চালাচ্ছি। কোনটাই বাদ রাখছি না। পুরো তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। তিতাসের গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে জমা হওয়া গ্যাস থেকে বিস্ফোরণটি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে গতকাল মসজিদের পাশেই মাটি খুঁড়ে গ্যাস লাইনের পাইপে দুটি লিকেজ পাওয়া যায়। তবে এই মসজিদের নির্মাণ কাঠামো ও বৈদ্যুতিক সংযোগ নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। মসজিদের ভেতরে দুটি বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকলেও মিটার রয়েছে একটি। দ্বিতীয় সংযোগটির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে লিখিত কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। মসজিদ নির্মাণের নকশা ও ভিত্তিপ্রস্তরের অনুমতি কাগজপত্র দেখাতে পারেনি বর্তমান পরিচালনা কমিটি।

মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৮ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

মসজিদে বিস্ফোরণ

গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ

প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ

গণশুনানিতে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় সকাল ১০টা থেকে শুরু হলেও দুপুর ২টা পর্যন্ত কেউই আসেননি। বেলা আড়াইটার দিকে কিছু লোক জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সামনে এসে জড়ো হন। সবাই একত্রে কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষের দিকে যান। শেষ এক ঘণ্টায় ১৮ জন গণশুনানিতে সাক্ষ্য দেন।

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গণশুনানির আয়োজন করে। গতকাল সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি।

আড়াইটার পর একদল লোক আসেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে তাদের লিখিত সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্য দিতে আসা কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি ‘সংগঠিত’ বলে পরিলক্ষিত হয়।

অনুসন্ধানে অভিযোগ পাওয়া যায়, বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটা পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাত জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুরের অনুসারী আল-আমিন, নাইম, বাবু এই সাক্ষীদের নিয়ে এসেছেন। যারা সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তাদের অধিকাংশই আবদুল গফুরের অনুসারী। অন্যদের ম্যানেজ করে আনা হয়েছে। আসা-যাওয়ার ইজিবাইক ও রিকশা ভাড়াও বহন করেছেন গফুর মেম্বার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাক্ষ্য দিতে আসা এক ব্যক্তি জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী হওয়াতে শনিবার মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সহ-সভাপতির সঙ্গে তারও লিখিত সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। গতকাল তাকে জেলা প্রশাসন থেকে ডাকা হয়নি। এলাকার কিছু যুবক তাকে জোর করে তাদের কথামতো সাক্ষ্য দেয়াতে নিয়ে আসেন। যদিও পূর্বে সাক্ষ্য দেয়ার কারণে গণশুনানিতে তার সাক্ষ্য নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস কক্ষের সামনে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গণ্যমাধ্যম কর্মীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে উপস্থিত হন বাবু নামে এক ব্যক্তি। সে মসজিদ কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুরের অনুসারী। এ প্রতিবেদকের সামনে প্রত্যক্ষদর্শী ওই ব্যক্তিকে এসে ধমকান বাবু। পরে ‘আমার নাম বাবু। আমার লগে প্যাচাইয়া কথা কইবা না। বেশি কথা বলা ভালো না। সবার খোঁজই কিন্তু রাখা হইতাছে।’ এই বলে চলে যান ওই ব্যক্তি।

পরে বিস্ফোরণের ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভীত হয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আর কথা বলতে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, ‘দেখলেনই তো। এরপরও কথা বললে আমি ঝামেলাই পইড়া যামু। কেবল একটা কথাই কই, পুরা ঘটনা এখন গ্যাসের দিকে নিতে চাইতাছে তারা। যেন আর কারও দোষ নাই।’

কথা হয় সাক্ষ্য দিতে আসা আরও কয়েকজনের সঙ্গে। কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। বিদ্যুতের দুটি সংযোগ, মসজিদ নির্মাণ প্রসঙ্গে তারা কিছু জানেন না বলেন। সবার মুখেই একটাই কথা ‘গ্যাস লাইনের লিকেজ ছিল। মসজিদের গেটের দিক দিয়ে গ্যাস বের হইতো। সেই গ্যাস জমেই বিস্ফোরণ।’

প্রথমে নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও পরে নিজের নাম আব্দুস সোবহান বলে জানান গণশুনানিতে সাক্ষ্য দিতে আসা এক ব্যক্তি। তিনিও বলেন, ‘মসজিদ কেমনে কী হইছে জানি না। গ্যাসের লাইনের লিকেজের কথা শুনছি। সেইটাই ভিতরে কইছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি বলেন, ‘সংগঠিতভাবে সাক্ষীদের আনা হয়েছে, আমার এমনটা মনে হয়নি। তাছাড়া সকলেই সদিচ্ছা অনুযায়ী লিখিত সাক্ষী দিয়েছেন। তাদের মোবাইল নম্বরও রাখা হয়েছে।’

তিনি বলেন, গণশুনানিতে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সময় শেষ হয়ে গেলেও কেউ যদি সাক্ষ্য দিতে চায় তাও আমরা শুনব। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, মসজিদের নির্মাণসহ সম্ভাব্য সব বিষয়কে সামনে রেখেই আমরা তদন্ত চালাচ্ছি। কোনটাই বাদ রাখছি না। পুরো তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। তিতাসের গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে জমা হওয়া গ্যাস থেকে বিস্ফোরণটি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে গতকাল মসজিদের পাশেই মাটি খুঁড়ে গ্যাস লাইনের পাইপে দুটি লিকেজ পাওয়া যায়। তবে এই মসজিদের নির্মাণ কাঠামো ও বৈদ্যুতিক সংযোগ নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। মসজিদের ভেতরে দুটি বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকলেও মিটার রয়েছে একটি। দ্বিতীয় সংযোগটির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে লিখিত কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। মসজিদ নির্মাণের নকশা ও ভিত্তিপ্রস্তরের অনুমতি কাগজপত্র দেখাতে পারেনি বর্তমান পরিচালনা কমিটি।