পরিকল্পনাহীন অনলাইন ক্লাসে বিপর্যয় বাড়বে

তোড়জোড় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও বর্তমানে কমে এসেছে শিক্ষার্থী উপস্থিতির সংখ্যা। একটি সহযোগী দৈনিকের খবরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে অনলাইন ক্লাস শুরুর প্রথমদিকে ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থী ৪৫-৫০ শতাংশ থাকলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। বিশেষ করে, ঈদুল আজহার পর এ সংখ্যা কমে গেছে দ্বিগুণ হারে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকরা ‘মানসম্পন্ন’ ক্লাস না নিতে পারায় তারা ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে না। শিক্ষার্থীরা উপস্থিত না থাকায় শিক্ষকরাও পূর্বের মতো ক্লাস নিচ্ছেন না। এছাড়া শুরুর দিকে শিক্ষকদের গুগল ক্লাসে ‘রেকর্ডেড ভিডিও ক্লাস’ দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও এ কার্যক্রমে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাস অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ কিন্তু এ উদ্যোগটি নেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল যথার্থ পরিকল্পনায় একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী সমভাবে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনরকম পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। সীমিত পরিসরে চালানোর জন্য যে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দরকার সেটাও অনুপস্থিত। এই পরিকল্পনাহীন যাত্রা সংকটময় শিক্ষা অবস্থাকে আরও বৈষম্যময় করে তুলছে, যা শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশের অনলাইন ক্লাস অনিশ্চিত করে দিয়েছে। এটি সার্বিকভাবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর প্রথম শর্ত হলো একটা ডিভাইস যাতে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। তাই তাদের অনেকেরই অনলাইন ক্লাসের জন্য জরুরি স্মার্টফোন/ল্যাপটপ/ট্যাব নেয়ার সক্ষমতা নেই। এছাড়া গ্রামে দুর্বল ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, ডিভাইস সংকট, পারিবারিক সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, মানসিক প্রস্তুতির অভাব ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে না।

জুনের শুরুর দিকে ইউজিসির এক জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস নেয়ার অবস্থায় নেই। শিক্ষার্থীদের এককালীন সুদবিহীন ঋণদান এবং ঋণ অথবা কিস্তিতে ল্যাপটপ/ট্যাব/স্মার্টফোন কেনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল, যা করা হয়নি। করানোর সময়ে শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম আয়ের অংশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। তার ওপর রয়েছে ইন্টারনেটের ডাটা প্যাকেজ কেনার সামর্থ্য। নতুন বাজেটে মোবাইল সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধি করায় তা ইন্টারনেটের খরচ আরও ৫% বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়ার জন্য যে শিক্ষার্থীদের আর্থিক, মানসিক ও প্রযুক্তিগত অবস্থা এবং কার্যকরী নীতিমালা ও শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ থাকা দরকার সে রকম কোন অবস্থা তৈরি না করেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে। বস্তুত এর মাধ্যমে একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতিই প্রবর্তিত হয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু থাকলে অচিরেই এর কুফল সমাজে ছড়িয়ে পড়বে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।

আমরা কখনোই অনলাইন ক্লাসের বিপক্ষে নই। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাখতে হবে। এ কারণে অনলাইন ক্লাসকে সাময়িকভাবে স্বাভাবিক ক্লাসের বিকল্প ভাবা যেতে পারে। তবে এই শিক্ষা সব শিক্ষার্থীর সমভাবে প্রাপ্য। এ জন্য যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সমন্বিত প্রচেষ্টায় এগোতে হবে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার দরুন কোন শিক্ষার্থী যেন ক্লাসের বাইরে থেকে মানসিকভাবে হতাশায় না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সব শিক্ষার্থী যেন সমানভাবে অনলাইন শিক্ষার সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থীর অনলাইনে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার মতো ডিভাইস কেনার সামর্থ্য নেই তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ডিভাইস পৌঁছে দিতে হবে। অনলাইন ক্লাসের জন্য টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীবান্ধব ইন্টারনেট প্যাকেজ নিশ্চিত করা সম্ভব।

মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৮ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

পরিকল্পনাহীন অনলাইন ক্লাসে বিপর্যয় বাড়বে

তোড়জোড় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও বর্তমানে কমে এসেছে শিক্ষার্থী উপস্থিতির সংখ্যা। একটি সহযোগী দৈনিকের খবরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে অনলাইন ক্লাস শুরুর প্রথমদিকে ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থী ৪৫-৫০ শতাংশ থাকলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। বিশেষ করে, ঈদুল আজহার পর এ সংখ্যা কমে গেছে দ্বিগুণ হারে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকরা ‘মানসম্পন্ন’ ক্লাস না নিতে পারায় তারা ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে না। শিক্ষার্থীরা উপস্থিত না থাকায় শিক্ষকরাও পূর্বের মতো ক্লাস নিচ্ছেন না। এছাড়া শুরুর দিকে শিক্ষকদের গুগল ক্লাসে ‘রেকর্ডেড ভিডিও ক্লাস’ দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও এ কার্যক্রমে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাস অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ কিন্তু এ উদ্যোগটি নেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল যথার্থ পরিকল্পনায় একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী সমভাবে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনরকম পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। সীমিত পরিসরে চালানোর জন্য যে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দরকার সেটাও অনুপস্থিত। এই পরিকল্পনাহীন যাত্রা সংকটময় শিক্ষা অবস্থাকে আরও বৈষম্যময় করে তুলছে, যা শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশের অনলাইন ক্লাস অনিশ্চিত করে দিয়েছে। এটি সার্বিকভাবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর প্রথম শর্ত হলো একটা ডিভাইস যাতে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। তাই তাদের অনেকেরই অনলাইন ক্লাসের জন্য জরুরি স্মার্টফোন/ল্যাপটপ/ট্যাব নেয়ার সক্ষমতা নেই। এছাড়া গ্রামে দুর্বল ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, ডিভাইস সংকট, পারিবারিক সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, মানসিক প্রস্তুতির অভাব ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে না।

জুনের শুরুর দিকে ইউজিসির এক জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস নেয়ার অবস্থায় নেই। শিক্ষার্থীদের এককালীন সুদবিহীন ঋণদান এবং ঋণ অথবা কিস্তিতে ল্যাপটপ/ট্যাব/স্মার্টফোন কেনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল, যা করা হয়নি। করানোর সময়ে শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম আয়ের অংশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। তার ওপর রয়েছে ইন্টারনেটের ডাটা প্যাকেজ কেনার সামর্থ্য। নতুন বাজেটে মোবাইল সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধি করায় তা ইন্টারনেটের খরচ আরও ৫% বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়ার জন্য যে শিক্ষার্থীদের আর্থিক, মানসিক ও প্রযুক্তিগত অবস্থা এবং কার্যকরী নীতিমালা ও শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ থাকা দরকার সে রকম কোন অবস্থা তৈরি না করেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে। বস্তুত এর মাধ্যমে একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতিই প্রবর্তিত হয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু থাকলে অচিরেই এর কুফল সমাজে ছড়িয়ে পড়বে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।

আমরা কখনোই অনলাইন ক্লাসের বিপক্ষে নই। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাখতে হবে। এ কারণে অনলাইন ক্লাসকে সাময়িকভাবে স্বাভাবিক ক্লাসের বিকল্প ভাবা যেতে পারে। তবে এই শিক্ষা সব শিক্ষার্থীর সমভাবে প্রাপ্য। এ জন্য যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সমন্বিত প্রচেষ্টায় এগোতে হবে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার দরুন কোন শিক্ষার্থী যেন ক্লাসের বাইরে থেকে মানসিকভাবে হতাশায় না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সব শিক্ষার্থী যেন সমানভাবে অনলাইন শিক্ষার সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থীর অনলাইনে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার মতো ডিভাইস কেনার সামর্থ্য নেই তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ডিভাইস পৌঁছে দিতে হবে। অনলাইন ক্লাসের জন্য টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীবান্ধব ইন্টারনেট প্যাকেজ নিশ্চিত করা সম্ভব।