গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

১০ লাখ পোশাক শ্রমিক বেকার য় অনেক প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ : গবেষণা

মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর এপ্রিল, মে, জুনে একেবারে লকডাউন পরিস্থিতি বিরাজ করে। এরপর ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। জুলাই ও আগস্ট মাসে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। একদিকে রয়েছে দেশের বেকার সমস্যা, সম্প্রতি একটি গবেষণায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনায় প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বেকার হতে পারে। ইতোমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। অন্যদিকে যোগ হয়েছে, কর্মহীন হওয়া প্রবাসী কর্মীরা। ইতোমধ্যে কিছু প্রবাসী কর্মহীন হয়ে বিদেশেই অবস্থান করছে। আবার কেউ দেশে ফিরে বেকার জীবনযাপন করছে। যারা এতদিন শহরে বা বিদেশে কর্মসংস্থান করে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্মৃদ্ধ করতো, তারাই আজ গ্রামে ফিরে গ্রামীণ অর্থনীতির বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদেরা। দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনায় প্রায় ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরমধ্যে গার্মেন্ট কারখানা ১ হাজার ৯১৫টি। অন্যান্য কারখানা ১৪ হাজার ৫০টি। এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় ১০ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিক। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই বর্তমানে বেকার। বন্ধ হওয়া প্রায় ২ হাজার গার্মেন্ট কারখানার মধ্যে বেশির ভাগই রপ্তানিমুখী। তবে এ তালিকায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক মালিকের বাইরেও বিপুলসংখ্যক কারখানা রয়েছে। সেসব কারখানার হিসেব করলে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে।

এছাড়াও জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বিদেশে কর্মরত। করোনায় সেসব দেশে লকডাউনের কারণে অধিকাংশ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এসব প্রবাসীর মধ্যে অধিকাংশ দেশে ফিরে এসেছে। আবার কেউ কেউ সেখানেই অবস্থান করছে। যারা এক সময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখতেন, তারা বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতির বোঝা হিসেবে চেপে বসেছে। সেসব বেকার শ্রমিকদের কাজে লাগানো সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এটা সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে রুর‌্যাল ডেভেলপমেন্টের আওতায় যেসব বরাদ্দ রয়েছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে একটা ভালো খবর হলোÑ গার্মেন্ট কারখানাগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছিল, সেগুলো আবার ফিরে এসেছে। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে ধীরে ধীরে। এখন সরকারকে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের প্রতি নজর দিতে হবে। যারা কাজ হারিয়েছে, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে চাহিদা বাড়বে। তবে সরবরাহ যদি না বাড়ে তখন আবার সমস্যা সৃষ্টি হবে। এরজন্য উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক জরিপে দেখা যায়, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে দেশের তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন মানুষ চাকরি হারিয়েছে। সাধারণ ছুটির আগে দেশে মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ। ছুটির ৬৬ দিনেই ‘নবদরিদ্র’ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখের বেশি। সাধারণ ছুটির কারণে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ যেমন, ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা, চা-পান-সিগারেট, খুদে দোকান, মুদি দোকান, ক্ষুদ্র হোটেল, রেস্তোরাঁ, মাঝারি পাইকারি ব্যবসা। সারাদেশে এ ধরনের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৮৬ লাখের ওপরে। তাদের ওপর নির্ভরশীল ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। এদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) হিসাবে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘শুধু করোনার সময়ই নয়, গ্রামের অর্থনীতিকে অনেক আগেই ডাইভার্সিফাই করা দরকার ছিল। এখনও গ্রামের অর্থনীতি শুধু কৃষির উপর নির্ভরশীল। এটা ঠিক নয়। কৃষির পাশাপাশি শিল্প কারখানাও করা উচিত ছিল। কারণ শিল্প কারখানায় মানুষের কর্মসংস্থান বেশি হয়। যেসব শহর ফেরত মানুষ এখন গ্রামের জন্য বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, তারা আজ সম্পদে পরিনত হতো। বিশ্বে কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের দেশে তেমন হয়নি। আমাদের কৃষি একেবারে কাঁচা অবস্থায় থেকে গেছে। যেমন একজন খামারি দুগ্ধ উৎপাদন করলো, সেই দুধ শহরে প্রক্রিয়াজাত হলো। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে খামারেই ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানেই দুধ থেকে অন্যান্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। একইভাবে গ্রামের মানুষ ফল চাষ করল। সেই ফলের জুস তৈরি করতে তাকে শহরে আসতে হচ্ছে। গ্রামেই যদি ছোট ছোট পণ্যের কারখানা থাকতো, তাহলে সেই কৃষক তার পণ্যের নায্যমূল্যও পেত আবার কারখানা সৃষ্টি হওয়ায় বেশি মানুষের কর্মসংস্থানও হতো। তাই এগ্রিকালচারে আরও বরাদ্দ দেয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। তাই এগ্রিকালচার প্রসেসিংয়ে উন্নত না হলে উন্নয়ন টেকশই হবে না। দেশের জন্য তা ভালোও হবে না।’

করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকট থেকে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প রক্ষা করতে বিভিন্ন খাতে সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবেই বা কিভাবে? ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার যে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেটাই তো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সেখানে অন্যভাবে কর্মসংস্থান কিভাবে আশা করতে পারি। প্যাকেজ বাস্তবায়নে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। এবং সেটা দ্রুত করতেই হবে। নইতো একের পর এক নীতিমালা নেয়া হবে ঠিকই, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।’

২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে দেখা যায়, রাজধানীর জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের হিসেবে দেখা যায়, রাজধানীর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষই বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করে। সে হিসেবে ঢাকা শহরে ভাড়া বাসায় বসবাস করে ১ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ। করোনা পরিস্থিতির পর ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখের বেশি পরিবার ঢাকা চেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। গ্রামে ফিরে যাওয়া এই বিশাল জনগোষ্ঠীও গ্রামীণ অর্থনীতির বোঝা হিসেবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অথচ এই জনগোষ্ঠীই রাজধানী ঢাকায় আয় রোজগার করে গ্রামে টাকা পাঠাতো।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। যেমন সেফটি নেটের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটাতে আরও জোর দেয়া প্রয়োজন। ক্যাশ ট্রান্সফার প্রোগ্রাম যেটা আছে, সেটার আওতায় আরও মানুষকে নিয়ে আসা প্রয়োজন। যারা গ্রামে ফিরে কর্মহীন হয়েছে, তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এরজন্য গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে তাদের কর্মসংস্থান করতে পারে সরকার। যেমন গ্রামের রাস্তাঘাট মেরাতমসহ অন্যান্য অবকাঠামো মেরামতে জোর দিতে হবে। এতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং নিম্ন আয়ের কর্মহীন মানুষ কাজ পাবে। এছাড়া সরকার যেসব ঋণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, সেই ঋণ যেন সহজে মানুষ পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব প্রবাসী কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরেছে, তাদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করার কথা আমরা বলেছিলাম। এটা হলে প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে যেসব কাজ করতো বা সে যে কাজে অভিজ্ঞ সেই কাজে দেশে কর্মসংস্থান করা যেতে পারে। অনেক কোম্পানি দক্ষ জনবল খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। সেই ডাটাবেজ হলে তাদের খুঁজে খুঁজে কর্মসংস্থান করা সহজ হবে।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৮১ শতাংশই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিভিন্ন দেশের সরকার চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, বিশ্বের বড় প্রায় সব অর্থনীতির এবারে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হবে। চীন ও ভারত বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি না হলেও অর্থনীতির গতি রেকর্ডহারে কমে যাবে। কোন কোন অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশও এ পরিস্থিতির বাইরে নয়। ওসব দেশ বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্যস্থল। বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। এরই মধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নি¤œআয়ের দেশগুলোর বেকাররা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব ইকোনমি রিকভারি করতে হবে যেন যে যেখানে কর্মরত ছিল সে সেখানে কাজে ফিরতে পারে। মালিকরা তো চাইবে তার আগের কর্মচারীকে নিতে। আগের যে ডেভেলপ প্রডাকশন ছিল কারখানাগুলো যদি সেই প্রডাকশনে যেতে পারে তাহলে কর্মহীনরা আবার কর্ম ফিরে পাবে। আর যদি বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি করতে পারি তাহলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু আমরা তো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছি না।’

এছাড়াও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপের দেখা যায়, গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) কমপক্ষে ১৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বেকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আর নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন ২১ শতাংশ মানুষ। ডিসেম্বরের মধ্যে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও চরম আকার ধারণ করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এছাড়া আইএলও’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৭০ শতাংশ কর্মীই কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও মোটেই সুখকর নয়। নতুন করে কতসংখ্যক মানুষ বেকার হবেন এর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশও উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের অত্যন্ত ২ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবে। আর এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বেকারত্বের সঙ্গে বাড়বে সামাজিক সংকটও। ইতোমধ্যেই বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। করোনার আগে যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ ফুটপাথে চা বিক্রি করতো সে এখন আর তা করতে পারছে না। কারণ করোনার মধ্যে মানুষ জরুরি প্রয়োজন না হলে রাস্তায় বের হচ্ছে না। এমন অনেক পেশা রয়েছে যেগুলো ফুটপাতে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে। তারা আজ বেশি সমস্যার সম্মুখীন। এসব শ্রেণী পেশার মানুষের কর্মসংস্থান বেশি হুমকির মুখে।

এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থনীতি যদি পুনরুদ্ধার হয়, তাহলে কারখানার চাকা ঘুরবে। তখন মানুষের সমাগম বৃদ্ধি হবে। তখনই এসব শ্রেণী পেশার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কবে অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে তা তো বলা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে সব কিছু স্বাভাবিক হতে পারে।’

জানা গেছে, প্রবাসী কর্মী যারা ইতোমধ্যে কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর যারা ফেরত যেতে পারছেন না, তাদের স্থানীয়ভাবে কাজের ব্যবস্থা করা হবে। এক্ষেত্রে আত্মকর্মসংস্থানকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীসহ স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ইতোমধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়ও করা হয়েছে, যা কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে বিতরণ করা হবে।

এছাড়া কর্মহীন জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকার একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২৪ অগাস্ট পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকার ছোট ঋণের মধ্যে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বার বার তাগাদা দেয়ার পরও সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা যদি ঋণ না পান, তাহলে তারা তাদের ব্যবস্যা চালু করতে পারবে না। আর তারা ব্যবস্যা চালু করতে না পারলে নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান হবে না।

এই প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এর মূল সমস্যা হলো, বড় ও ছোট উভয় ঋণের জন্য ৯ শতাংশ সুদারোপ করা। ছোট ঋণে যেহেতু ব্যাংকের খরচ বেশি, শ্রম বেশি, ঝুঁকি বেশি তাই সুদ বেশি হওয়া দরকার। যখন ছোট ঋণে সুদের পরিমাণ বড় ঋণের থেকে বেশি হবে তখন ব্যাংকগুলো বেশি লাভের আসায় ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে আগ্রহী হবে। আমরা নীতিমালা করি কিন্তু বাস্তবতা অন্য জিনিস। নীতিমালাগুলো বাস্তবতার নিরিখে হওয়া দরকার। ছোট ঋণে বেশি মার্জিন রাখতে হয়। পকেট থেকে পয়সা দিয়ে তো ব্যাংক তার ব্যবসা করবে না, সেটা হয়তো সরকার করতে পারে।’

গ্রামীণ উন্নয়নের আওতায় থাকা প্রকল্পগুলোর

সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

—— মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম

আরও খবর
প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশনা
রোহিঙ্গাদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল
পাওয়ার গ্রিডে আগুন, ময়মনসিংহ বিভাগ বিদ্যুৎহীন
মৃত্যু আরও ৩৬ শনাক্ত ১৮২৯ জন
১২ সেপ্টেম্বর থেকে ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে বিক্রি
একাদশ শ্রেণীতে সর্বোচ্চ ভর্তি ফি ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ
‘চুরি করতে গিয়ে ইউএনও’র ওপর হামলা বিশ্বাসযোগ্য নয়’
তদন্ত প্রতিবেদন ৭৪ বারের মতো পেছালো
বরিশালে দুই পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত
মিলল আরও একটি লিকেজ
দেড়মাস পর রহস্য উদ্ঘাটন, খুনি বাবা-দাদা ও সৎমাসহ ৪ জন গ্রেফতার
ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতন মামলা
মৃতের সংখ্যা ২৮, চিকিৎসাধীন ৮ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক

বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৯ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

১০ লাখ পোশাক শ্রমিক বেকার য় অনেক প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ : গবেষণা

রেজাউল করিম

মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর এপ্রিল, মে, জুনে একেবারে লকডাউন পরিস্থিতি বিরাজ করে। এরপর ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। জুলাই ও আগস্ট মাসে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। একদিকে রয়েছে দেশের বেকার সমস্যা, সম্প্রতি একটি গবেষণায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনায় প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বেকার হতে পারে। ইতোমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। অন্যদিকে যোগ হয়েছে, কর্মহীন হওয়া প্রবাসী কর্মীরা। ইতোমধ্যে কিছু প্রবাসী কর্মহীন হয়ে বিদেশেই অবস্থান করছে। আবার কেউ দেশে ফিরে বেকার জীবনযাপন করছে। যারা এতদিন শহরে বা বিদেশে কর্মসংস্থান করে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্মৃদ্ধ করতো, তারাই আজ গ্রামে ফিরে গ্রামীণ অর্থনীতির বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদেরা। দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনায় প্রায় ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরমধ্যে গার্মেন্ট কারখানা ১ হাজার ৯১৫টি। অন্যান্য কারখানা ১৪ হাজার ৫০টি। এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় ১০ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিক। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই বর্তমানে বেকার। বন্ধ হওয়া প্রায় ২ হাজার গার্মেন্ট কারখানার মধ্যে বেশির ভাগই রপ্তানিমুখী। তবে এ তালিকায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক মালিকের বাইরেও বিপুলসংখ্যক কারখানা রয়েছে। সেসব কারখানার হিসেব করলে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে।

এছাড়াও জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বিদেশে কর্মরত। করোনায় সেসব দেশে লকডাউনের কারণে অধিকাংশ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এসব প্রবাসীর মধ্যে অধিকাংশ দেশে ফিরে এসেছে। আবার কেউ কেউ সেখানেই অবস্থান করছে। যারা এক সময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখতেন, তারা বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতির বোঝা হিসেবে চেপে বসেছে। সেসব বেকার শ্রমিকদের কাজে লাগানো সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এটা সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে রুর‌্যাল ডেভেলপমেন্টের আওতায় যেসব বরাদ্দ রয়েছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে একটা ভালো খবর হলোÑ গার্মেন্ট কারখানাগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছিল, সেগুলো আবার ফিরে এসেছে। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে ধীরে ধীরে। এখন সরকারকে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের প্রতি নজর দিতে হবে। যারা কাজ হারিয়েছে, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে চাহিদা বাড়বে। তবে সরবরাহ যদি না বাড়ে তখন আবার সমস্যা সৃষ্টি হবে। এরজন্য উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক জরিপে দেখা যায়, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে দেশের তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন মানুষ চাকরি হারিয়েছে। সাধারণ ছুটির আগে দেশে মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ। ছুটির ৬৬ দিনেই ‘নবদরিদ্র’ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখের বেশি। সাধারণ ছুটির কারণে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ যেমন, ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা, চা-পান-সিগারেট, খুদে দোকান, মুদি দোকান, ক্ষুদ্র হোটেল, রেস্তোরাঁ, মাঝারি পাইকারি ব্যবসা। সারাদেশে এ ধরনের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৮৬ লাখের ওপরে। তাদের ওপর নির্ভরশীল ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। এদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) হিসাবে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘শুধু করোনার সময়ই নয়, গ্রামের অর্থনীতিকে অনেক আগেই ডাইভার্সিফাই করা দরকার ছিল। এখনও গ্রামের অর্থনীতি শুধু কৃষির উপর নির্ভরশীল। এটা ঠিক নয়। কৃষির পাশাপাশি শিল্প কারখানাও করা উচিত ছিল। কারণ শিল্প কারখানায় মানুষের কর্মসংস্থান বেশি হয়। যেসব শহর ফেরত মানুষ এখন গ্রামের জন্য বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, তারা আজ সম্পদে পরিনত হতো। বিশ্বে কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের দেশে তেমন হয়নি। আমাদের কৃষি একেবারে কাঁচা অবস্থায় থেকে গেছে। যেমন একজন খামারি দুগ্ধ উৎপাদন করলো, সেই দুধ শহরে প্রক্রিয়াজাত হলো। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে খামারেই ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানেই দুধ থেকে অন্যান্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। একইভাবে গ্রামের মানুষ ফল চাষ করল। সেই ফলের জুস তৈরি করতে তাকে শহরে আসতে হচ্ছে। গ্রামেই যদি ছোট ছোট পণ্যের কারখানা থাকতো, তাহলে সেই কৃষক তার পণ্যের নায্যমূল্যও পেত আবার কারখানা সৃষ্টি হওয়ায় বেশি মানুষের কর্মসংস্থানও হতো। তাই এগ্রিকালচারে আরও বরাদ্দ দেয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। তাই এগ্রিকালচার প্রসেসিংয়ে উন্নত না হলে উন্নয়ন টেকশই হবে না। দেশের জন্য তা ভালোও হবে না।’

করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকট থেকে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প রক্ষা করতে বিভিন্ন খাতে সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবেই বা কিভাবে? ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার যে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেটাই তো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সেখানে অন্যভাবে কর্মসংস্থান কিভাবে আশা করতে পারি। প্যাকেজ বাস্তবায়নে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। এবং সেটা দ্রুত করতেই হবে। নইতো একের পর এক নীতিমালা নেয়া হবে ঠিকই, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।’

২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে দেখা যায়, রাজধানীর জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের হিসেবে দেখা যায়, রাজধানীর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষই বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করে। সে হিসেবে ঢাকা শহরে ভাড়া বাসায় বসবাস করে ১ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ। করোনা পরিস্থিতির পর ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখের বেশি পরিবার ঢাকা চেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। গ্রামে ফিরে যাওয়া এই বিশাল জনগোষ্ঠীও গ্রামীণ অর্থনীতির বোঝা হিসেবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অথচ এই জনগোষ্ঠীই রাজধানী ঢাকায় আয় রোজগার করে গ্রামে টাকা পাঠাতো।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। যেমন সেফটি নেটের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটাতে আরও জোর দেয়া প্রয়োজন। ক্যাশ ট্রান্সফার প্রোগ্রাম যেটা আছে, সেটার আওতায় আরও মানুষকে নিয়ে আসা প্রয়োজন। যারা গ্রামে ফিরে কর্মহীন হয়েছে, তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এরজন্য গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে তাদের কর্মসংস্থান করতে পারে সরকার। যেমন গ্রামের রাস্তাঘাট মেরাতমসহ অন্যান্য অবকাঠামো মেরামতে জোর দিতে হবে। এতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং নিম্ন আয়ের কর্মহীন মানুষ কাজ পাবে। এছাড়া সরকার যেসব ঋণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, সেই ঋণ যেন সহজে মানুষ পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব প্রবাসী কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরেছে, তাদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করার কথা আমরা বলেছিলাম। এটা হলে প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে যেসব কাজ করতো বা সে যে কাজে অভিজ্ঞ সেই কাজে দেশে কর্মসংস্থান করা যেতে পারে। অনেক কোম্পানি দক্ষ জনবল খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। সেই ডাটাবেজ হলে তাদের খুঁজে খুঁজে কর্মসংস্থান করা সহজ হবে।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৮১ শতাংশই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিভিন্ন দেশের সরকার চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, বিশ্বের বড় প্রায় সব অর্থনীতির এবারে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হবে। চীন ও ভারত বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি না হলেও অর্থনীতির গতি রেকর্ডহারে কমে যাবে। কোন কোন অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশও এ পরিস্থিতির বাইরে নয়। ওসব দেশ বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্যস্থল। বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। এরই মধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নি¤œআয়ের দেশগুলোর বেকাররা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব ইকোনমি রিকভারি করতে হবে যেন যে যেখানে কর্মরত ছিল সে সেখানে কাজে ফিরতে পারে। মালিকরা তো চাইবে তার আগের কর্মচারীকে নিতে। আগের যে ডেভেলপ প্রডাকশন ছিল কারখানাগুলো যদি সেই প্রডাকশনে যেতে পারে তাহলে কর্মহীনরা আবার কর্ম ফিরে পাবে। আর যদি বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি করতে পারি তাহলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু আমরা তো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছি না।’

এছাড়াও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপের দেখা যায়, গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) কমপক্ষে ১৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বেকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আর নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন ২১ শতাংশ মানুষ। ডিসেম্বরের মধ্যে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও চরম আকার ধারণ করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এছাড়া আইএলও’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৭০ শতাংশ কর্মীই কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও মোটেই সুখকর নয়। নতুন করে কতসংখ্যক মানুষ বেকার হবেন এর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশও উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের অত্যন্ত ২ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবে। আর এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বেকারত্বের সঙ্গে বাড়বে সামাজিক সংকটও। ইতোমধ্যেই বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। করোনার আগে যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ ফুটপাথে চা বিক্রি করতো সে এখন আর তা করতে পারছে না। কারণ করোনার মধ্যে মানুষ জরুরি প্রয়োজন না হলে রাস্তায় বের হচ্ছে না। এমন অনেক পেশা রয়েছে যেগুলো ফুটপাতে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে। তারা আজ বেশি সমস্যার সম্মুখীন। এসব শ্রেণী পেশার মানুষের কর্মসংস্থান বেশি হুমকির মুখে।

এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থনীতি যদি পুনরুদ্ধার হয়, তাহলে কারখানার চাকা ঘুরবে। তখন মানুষের সমাগম বৃদ্ধি হবে। তখনই এসব শ্রেণী পেশার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কবে অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে তা তো বলা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে সব কিছু স্বাভাবিক হতে পারে।’

জানা গেছে, প্রবাসী কর্মী যারা ইতোমধ্যে কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর যারা ফেরত যেতে পারছেন না, তাদের স্থানীয়ভাবে কাজের ব্যবস্থা করা হবে। এক্ষেত্রে আত্মকর্মসংস্থানকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীসহ স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ইতোমধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়ও করা হয়েছে, যা কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে বিতরণ করা হবে।

এছাড়া কর্মহীন জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকার একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২৪ অগাস্ট পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকার ছোট ঋণের মধ্যে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বার বার তাগাদা দেয়ার পরও সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা যদি ঋণ না পান, তাহলে তারা তাদের ব্যবস্যা চালু করতে পারবে না। আর তারা ব্যবস্যা চালু করতে না পারলে নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান হবে না।

এই প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এর মূল সমস্যা হলো, বড় ও ছোট উভয় ঋণের জন্য ৯ শতাংশ সুদারোপ করা। ছোট ঋণে যেহেতু ব্যাংকের খরচ বেশি, শ্রম বেশি, ঝুঁকি বেশি তাই সুদ বেশি হওয়া দরকার। যখন ছোট ঋণে সুদের পরিমাণ বড় ঋণের থেকে বেশি হবে তখন ব্যাংকগুলো বেশি লাভের আসায় ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে আগ্রহী হবে। আমরা নীতিমালা করি কিন্তু বাস্তবতা অন্য জিনিস। নীতিমালাগুলো বাস্তবতার নিরিখে হওয়া দরকার। ছোট ঋণে বেশি মার্জিন রাখতে হয়। পকেট থেকে পয়সা দিয়ে তো ব্যাংক তার ব্যবসা করবে না, সেটা হয়তো সরকার করতে পারে।’

গ্রামীণ উন্নয়নের আওতায় থাকা প্রকল্পগুলোর

সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

—— মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম