না’গঞ্জ গ্যাসলাইন

মিলল আরও একটি লিকেজ

নিয়ম না মেনে বিচ্ছিন্ন করা হয় সংযোগ ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি হতাহতের স্বজনদের

মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্যাস লিকেজ খুঁজতে দ্বিতীয় দিনের মতো খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। গতকাল দ্বিতীয় দিনের খোঁড়াখুঁড়িতে আরও একটি ছিদ্র (লিকেজ) পাওয়া গেছে। পূর্বে একই লাইনে পরপর দুটি ছিদ্র পাওয়া যায়। গতকাল দিনভর খোঁড়াখুঁড়ির পর প্রায় চার ফুট গভীরে একটি সংযোগ লাইন পুরোপুরি উন্মুক্ত করা গেছে। একই সঙ্গে মাটির পাঁচ ফুট গভীরে প্রধান লাইনের মূল সংযোগটিও খুঁজে পেয়েছেন শ্রমিকরা। পৌনে এক ইঞ্চির সংযোগ লাইনটি মসজিদের দক্ষিণ পূর্বকোণ থেকে উত্তর দিকে এবং প্রধান লাইনটি উত্তর পূর্বকোণে পাওয়া যায়। খোঁড়াখুঁড়ির কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও তিতাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তিন ইঞ্চি ব্যাসের প্রধান লাইনটি মসজিদের পূর্ব পাশের সড়কের নিচ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ দুই দিকে গেছে। এই লাইনের সঙ্গে মসজিদের উত্তরপাশের সড়কের নিচ দিয়ে পশ্চিমদিকে চলে যাওয়া প্রধান লাইনের মিলনস্থল হলো এই সংযোগ। প্রধান লাইন থেকে পশ্চিম দিকে যাওয়া দুটি সংযোগলাইন খুঁজে পান শ্রমিকরা। দুটি লাইনই যথাক্রমে ৮ ও ৫০ ফুট দূরত্ব গিয়ে শেষ হয়েছে। তবে লাইন দুটি মূল সংযোগ থেকে বন্ধ না করে মাঝামাঝি কেটে সকেট বন প্লাগ (ক্যাপ) পড়িয়ে বন্ধ করা হয়েছে। যা নিয়ম বহির্ভূত। যে দুটি স্থানে সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সেখানে দুটি রাইজার ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে লাইন দুটো কোন বাসায় সংযোগের জন্য নেয়া হয়েছিল বলে ধারণা করছেন তিতাসের কর্মরত শ্রমিকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, গ্যাস লাইনের সংযোগ কিংবা বিচ্ছিন্ন করার জন্য অনুমতি নিয়ে ব্যাংক ড্রাফট জমা করতে হয়। এই টাকা বাঁচাতেই এলাকাবাসী ঠিকাদারের মাধ্যমে এই কাজগুলো করিয়েছেন। অথচ সংযোগ লাইনগুলো কিন্তু প্রধান লাইন থেকে অল্প দূরত্বে ছিল। তিতাসকে জানানো হলে চাবি থেকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সংযোগগুলোর মুখ ওয়েল্ডিং করে বন্ধ করা যেত। নিয়মমাফিক কাজ না করাতে লাইনে গ্যাস থেকে যায়। যে কোন আঘাতে এসব লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে।

এদিকে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল তিতাসের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল ওয়াহাব তালুকদার বলেন, ‘মসজিদের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে তিনটি রাস্তা আছে। গ্যাস মসজিদের কোথা থেকে ঢুকছে ও গ্যাস লাইন মসজিদের চারপাশে কীভাবে আছে তা বের করার জন্যই এই খোঁড়াখুঁড়ি। মসজিদের উত্তর দিকে একটি আবাসিক সংযোগের বিপরীতে মসজিদের বেইজ থেকে ৬-৭ ইঞ্চি নিচে একটি সংযোগে দুটি ছিদ্র পেয়েছি। মসজিদের সামনে মূল পাইপ কোথায় আছে সেটির জন্য এখনও কাজ চলছে। মূল রাস্তায় এখনও গ্যাসের লাইন কোথায় আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। আরও খোঁড়াখুঁড়ির পর বোঝা যেতে পারে।’ তবে গ্যাসের এই লাইনগুলো বৈধ বলে জানান তিনি।

৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণই কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। এই বিষয়ে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নাই। আমরা মূলত মসজিদের অগ্নিকা-ের বিষয়ে ও গ্যাস লিকেজের বিষয়ে তদন্ত কমিটি হিসেবে কাজ করছি।’

গ্যাস লিকেজের বিষয়ে কেউ তিতাসকে জানিয়েছিল কিনা এবং ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবির বিষয়ে মসজিদ কমিটির লোকজনের সঙ্গে আলোচনা শেষে বলা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিতাসের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্ব ও উত্তর দিকের দুটি লাইনই ১৯৯৬ সালে বসানো হয়েছে। আর মসজিদটি স্থাপিত হয়েছিল ২০০০ সালের পরে। এমনই তথ্য আমরা পেয়েছি।’

বিকেলে মসজিদ কমিটির লোকজনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিতাস কর্তৃপক্ষ। যা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তিতাসের নারায়ণগঞ্জ জোনাল অফিসে এ বৈঠকে তদন্ত কমিটির প্রধান আবদুল ওয়াহাব তালুকদারও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আবদুল গফুর জানান, ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়ার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। এ সংক্রান্ত লিখিত বক্তব্য তিতাসের কাছে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, তিতাসের লোকজনের সঙ্গে আমি না আমার সেক্রেটারি (দগ্ধ হয়ে হাসপাতলে ভর্তি) কথা বলেছেন। তার কাছেই টাকা চেয়েছিল। আমার কাছে না।’ তবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে চাননি তিতাসের মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওয়াহাব তালুকদার।

বিস্ফোরণের ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। মামলায় বিদ্যুৎ, গ্যাস কর্মকর্তাসহ মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে অবহেলা গাফিলতির অভিযোগ করা হয়েছে। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মেহেদী ইমরান সিদ্দিকী বলেন, কাদের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে সুনির্দিষ্টভাবে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তিতাস মাটি খুঁড়ে দেখছে। প্রাথমিকভাবে মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি বলে জেনেছি। বিল্ডিং কোডও মানেনি। সবকিছু মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি। কয়েকটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। পুলিশও তদন্ত করছে। প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনই আমরা গুরুত্ব সহকারে নিব। সেখানে যাদেরকে অভিযুক্ত করা হবে তাদেরই আসামি করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে হতাহত পরিবারের স্বজনরা, সরকারি সহযোগিতা দাবি

দুপুরে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের স্বজনদের তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে। হতাহত পরিবারের পাশে যেন সরকার দাঁড়ায় এই আবেদন জানান তারা। রাষ্ট্রীয়ভাবে নিহত পরিবার প্রতি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের দাবি জানান। পাশাপাশি হতাহত পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে হতাহত সব পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিস্ফোরণের ঘটনার নিহত মসজিদের ইমাম আবদুল মালেকের ছেলে নাঈম ইসলাম ও ফাহিম ইসলাম। বিস্ফোরণের ওই রাতের ভয়াবহতা তুলে ধরেন নাঈম। তিনি বলেন, ‘সেদিন এশার নামাজে আমিও ছিলাম। নামাজ পড়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। আমার আব্বুও (ইমাম) পুড়ে মারা যান। সেদিন মোয়াজ্জিন সাহেব দু’চারজনকে বাঁচানোর জন্য কি পরিমাণ চেষ্টা করছেন তা আমি মুখে বলে বুঝাতে পারব না। তার শরীর সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি পোড়া অবস্থায় দু’তিনজনকে বের করেছিলেন মসজিদ থেকে। আবার বন্ধু সাব্বির ও তার ভাই জুবায়ের দু’জনই মারা গেছে। এখন তাদের মায়ের কী হবে? ইব্রাহিম বিশ্বাস নামে এক ভাই ছিলেন তাকে সেদিন চেনা যাচ্ছিল না।’

‘বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক বলছিলেন, এমন ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। বার্ন নিউনিটে কেউ কারও স্বার্থ দেখে নাই। কে কাকে বাঁচাবে, সেবা দিবে। আমি সেই বার্ন ইউনিটে মানবিকতা দেখছি। আমি সেই মানুষগুলোর জন্য দোয়া করি।’ যোগ করেন নাঈম।

হতাহত পরিবারের লোকজন মানসিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে সংকটে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টাইলস মিস্ত্রি মনির ভাই মসজিদের মেসে থাকতেন। তার পরিবার এখানে না থাকায় সে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এখনও অনেকে বার্ন ইউনিটে শয্যায় আছেন। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হোক। আমার বাবার যখন চিকিৎসা চলে তখন আমার বাবার জন্য ৬-৭ হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছিল। যারা হাসপাতালে এখনও ভর্তি আছেন তাদের ওষুধ কেনার টাকার ব্যবস্থা যেন সরকার করে। অনেক পরিবার আছে যাদের গত কয়েকদিন চুলা জ্বলেনি। আমাদের এই পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি।

বাবা হারানো ফাহিম বলেন, এ মর্মান্তিক ঘটনায় যদি তিতাসের কোন ভুল থেকে থাকে তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। যাতে আমাদের মতো অন্য কাউকে তার স্বজনদের হারাতে না হয়।

প্রশাসনের গণশুনানিতে আরও ২৫ জনের সাক্ষ্য, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল কাল

গতকাল বিকেলেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি ও সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার টিএম মোশারফ। তদন্ত কমিটির সদস্যরা উন্মুক্ত গ্যাস লাইন ও লিকেজগুলো ঘুরে দেখেন। পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির প্রধান খাদিজা তাহেরা বলেন, ‘তিতাস থেকে গ্যাসের লাইনগুলো বের করা হয়েছে। তদন্তের ক্ষেত্রে আমার কোনকিছুই বাদ দিচ্ছি না।’

তিনি জানান, প্রথম দিনের গণশুনানিতে ১৮ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছেন। দ্বিতীয় দিন আরও ২৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হতাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, যুগ্ম সম্পাদক আহসান হাবিব, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদা মালাও উপস্থিত ছিলেন। হতাহত পরিবার প্রতি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২০ হাজার ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দেন আনোয়ার হোসেন।

image
আরও খবর
গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ
প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশনা
রোহিঙ্গাদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল
পাওয়ার গ্রিডে আগুন, ময়মনসিংহ বিভাগ বিদ্যুৎহীন
মৃত্যু আরও ৩৬ শনাক্ত ১৮২৯ জন
১২ সেপ্টেম্বর থেকে ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে বিক্রি
একাদশ শ্রেণীতে সর্বোচ্চ ভর্তি ফি ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ
‘চুরি করতে গিয়ে ইউএনও’র ওপর হামলা বিশ্বাসযোগ্য নয়’
তদন্ত প্রতিবেদন ৭৪ বারের মতো পেছালো
বরিশালে দুই পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত
দেড়মাস পর রহস্য উদ্ঘাটন, খুনি বাবা-দাদা ও সৎমাসহ ৪ জন গ্রেফতার
ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতন মামলা
মৃতের সংখ্যা ২৮, চিকিৎসাধীন ৮ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক

বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৯ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

না’গঞ্জ গ্যাসলাইন

মিলল আরও একটি লিকেজ

নিয়ম না মেনে বিচ্ছিন্ন করা হয় সংযোগ ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি হতাহতের স্বজনদের

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

image

মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্যাস লিকেজ খুঁজতে দ্বিতীয় দিনের মতো খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। গতকাল দ্বিতীয় দিনের খোঁড়াখুঁড়িতে আরও একটি ছিদ্র (লিকেজ) পাওয়া গেছে। পূর্বে একই লাইনে পরপর দুটি ছিদ্র পাওয়া যায়। গতকাল দিনভর খোঁড়াখুঁড়ির পর প্রায় চার ফুট গভীরে একটি সংযোগ লাইন পুরোপুরি উন্মুক্ত করা গেছে। একই সঙ্গে মাটির পাঁচ ফুট গভীরে প্রধান লাইনের মূল সংযোগটিও খুঁজে পেয়েছেন শ্রমিকরা। পৌনে এক ইঞ্চির সংযোগ লাইনটি মসজিদের দক্ষিণ পূর্বকোণ থেকে উত্তর দিকে এবং প্রধান লাইনটি উত্তর পূর্বকোণে পাওয়া যায়। খোঁড়াখুঁড়ির কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও তিতাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তিন ইঞ্চি ব্যাসের প্রধান লাইনটি মসজিদের পূর্ব পাশের সড়কের নিচ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ দুই দিকে গেছে। এই লাইনের সঙ্গে মসজিদের উত্তরপাশের সড়কের নিচ দিয়ে পশ্চিমদিকে চলে যাওয়া প্রধান লাইনের মিলনস্থল হলো এই সংযোগ। প্রধান লাইন থেকে পশ্চিম দিকে যাওয়া দুটি সংযোগলাইন খুঁজে পান শ্রমিকরা। দুটি লাইনই যথাক্রমে ৮ ও ৫০ ফুট দূরত্ব গিয়ে শেষ হয়েছে। তবে লাইন দুটি মূল সংযোগ থেকে বন্ধ না করে মাঝামাঝি কেটে সকেট বন প্লাগ (ক্যাপ) পড়িয়ে বন্ধ করা হয়েছে। যা নিয়ম বহির্ভূত। যে দুটি স্থানে সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সেখানে দুটি রাইজার ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে লাইন দুটো কোন বাসায় সংযোগের জন্য নেয়া হয়েছিল বলে ধারণা করছেন তিতাসের কর্মরত শ্রমিকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, গ্যাস লাইনের সংযোগ কিংবা বিচ্ছিন্ন করার জন্য অনুমতি নিয়ে ব্যাংক ড্রাফট জমা করতে হয়। এই টাকা বাঁচাতেই এলাকাবাসী ঠিকাদারের মাধ্যমে এই কাজগুলো করিয়েছেন। অথচ সংযোগ লাইনগুলো কিন্তু প্রধান লাইন থেকে অল্প দূরত্বে ছিল। তিতাসকে জানানো হলে চাবি থেকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সংযোগগুলোর মুখ ওয়েল্ডিং করে বন্ধ করা যেত। নিয়মমাফিক কাজ না করাতে লাইনে গ্যাস থেকে যায়। যে কোন আঘাতে এসব লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে।

এদিকে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল তিতাসের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল ওয়াহাব তালুকদার বলেন, ‘মসজিদের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে তিনটি রাস্তা আছে। গ্যাস মসজিদের কোথা থেকে ঢুকছে ও গ্যাস লাইন মসজিদের চারপাশে কীভাবে আছে তা বের করার জন্যই এই খোঁড়াখুঁড়ি। মসজিদের উত্তর দিকে একটি আবাসিক সংযোগের বিপরীতে মসজিদের বেইজ থেকে ৬-৭ ইঞ্চি নিচে একটি সংযোগে দুটি ছিদ্র পেয়েছি। মসজিদের সামনে মূল পাইপ কোথায় আছে সেটির জন্য এখনও কাজ চলছে। মূল রাস্তায় এখনও গ্যাসের লাইন কোথায় আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। আরও খোঁড়াখুঁড়ির পর বোঝা যেতে পারে।’ তবে গ্যাসের এই লাইনগুলো বৈধ বলে জানান তিনি।

৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণই কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। এই বিষয়ে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নাই। আমরা মূলত মসজিদের অগ্নিকা-ের বিষয়ে ও গ্যাস লিকেজের বিষয়ে তদন্ত কমিটি হিসেবে কাজ করছি।’

গ্যাস লিকেজের বিষয়ে কেউ তিতাসকে জানিয়েছিল কিনা এবং ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবির বিষয়ে মসজিদ কমিটির লোকজনের সঙ্গে আলোচনা শেষে বলা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিতাসের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্ব ও উত্তর দিকের দুটি লাইনই ১৯৯৬ সালে বসানো হয়েছে। আর মসজিদটি স্থাপিত হয়েছিল ২০০০ সালের পরে। এমনই তথ্য আমরা পেয়েছি।’

বিকেলে মসজিদ কমিটির লোকজনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিতাস কর্তৃপক্ষ। যা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তিতাসের নারায়ণগঞ্জ জোনাল অফিসে এ বৈঠকে তদন্ত কমিটির প্রধান আবদুল ওয়াহাব তালুকদারও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আবদুল গফুর জানান, ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়ার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। এ সংক্রান্ত লিখিত বক্তব্য তিতাসের কাছে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, তিতাসের লোকজনের সঙ্গে আমি না আমার সেক্রেটারি (দগ্ধ হয়ে হাসপাতলে ভর্তি) কথা বলেছেন। তার কাছেই টাকা চেয়েছিল। আমার কাছে না।’ তবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে চাননি তিতাসের মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওয়াহাব তালুকদার।

বিস্ফোরণের ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। মামলায় বিদ্যুৎ, গ্যাস কর্মকর্তাসহ মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে অবহেলা গাফিলতির অভিযোগ করা হয়েছে। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মেহেদী ইমরান সিদ্দিকী বলেন, কাদের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে সুনির্দিষ্টভাবে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তিতাস মাটি খুঁড়ে দেখছে। প্রাথমিকভাবে মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি বলে জেনেছি। বিল্ডিং কোডও মানেনি। সবকিছু মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি। কয়েকটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। পুলিশও তদন্ত করছে। প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনই আমরা গুরুত্ব সহকারে নিব। সেখানে যাদেরকে অভিযুক্ত করা হবে তাদেরই আসামি করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে হতাহত পরিবারের স্বজনরা, সরকারি সহযোগিতা দাবি

দুপুরে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের স্বজনদের তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে। হতাহত পরিবারের পাশে যেন সরকার দাঁড়ায় এই আবেদন জানান তারা। রাষ্ট্রীয়ভাবে নিহত পরিবার প্রতি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের দাবি জানান। পাশাপাশি হতাহত পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে হতাহত সব পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিস্ফোরণের ঘটনার নিহত মসজিদের ইমাম আবদুল মালেকের ছেলে নাঈম ইসলাম ও ফাহিম ইসলাম। বিস্ফোরণের ওই রাতের ভয়াবহতা তুলে ধরেন নাঈম। তিনি বলেন, ‘সেদিন এশার নামাজে আমিও ছিলাম। নামাজ পড়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। আমার আব্বুও (ইমাম) পুড়ে মারা যান। সেদিন মোয়াজ্জিন সাহেব দু’চারজনকে বাঁচানোর জন্য কি পরিমাণ চেষ্টা করছেন তা আমি মুখে বলে বুঝাতে পারব না। তার শরীর সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি পোড়া অবস্থায় দু’তিনজনকে বের করেছিলেন মসজিদ থেকে। আবার বন্ধু সাব্বির ও তার ভাই জুবায়ের দু’জনই মারা গেছে। এখন তাদের মায়ের কী হবে? ইব্রাহিম বিশ্বাস নামে এক ভাই ছিলেন তাকে সেদিন চেনা যাচ্ছিল না।’

‘বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক বলছিলেন, এমন ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। বার্ন নিউনিটে কেউ কারও স্বার্থ দেখে নাই। কে কাকে বাঁচাবে, সেবা দিবে। আমি সেই বার্ন ইউনিটে মানবিকতা দেখছি। আমি সেই মানুষগুলোর জন্য দোয়া করি।’ যোগ করেন নাঈম।

হতাহত পরিবারের লোকজন মানসিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে সংকটে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টাইলস মিস্ত্রি মনির ভাই মসজিদের মেসে থাকতেন। তার পরিবার এখানে না থাকায় সে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এখনও অনেকে বার্ন ইউনিটে শয্যায় আছেন। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হোক। আমার বাবার যখন চিকিৎসা চলে তখন আমার বাবার জন্য ৬-৭ হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছিল। যারা হাসপাতালে এখনও ভর্তি আছেন তাদের ওষুধ কেনার টাকার ব্যবস্থা যেন সরকার করে। অনেক পরিবার আছে যাদের গত কয়েকদিন চুলা জ্বলেনি। আমাদের এই পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি।

বাবা হারানো ফাহিম বলেন, এ মর্মান্তিক ঘটনায় যদি তিতাসের কোন ভুল থেকে থাকে তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। যাতে আমাদের মতো অন্য কাউকে তার স্বজনদের হারাতে না হয়।

প্রশাসনের গণশুনানিতে আরও ২৫ জনের সাক্ষ্য, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল কাল

গতকাল বিকেলেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি ও সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার টিএম মোশারফ। তদন্ত কমিটির সদস্যরা উন্মুক্ত গ্যাস লাইন ও লিকেজগুলো ঘুরে দেখেন। পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির প্রধান খাদিজা তাহেরা বলেন, ‘তিতাস থেকে গ্যাসের লাইনগুলো বের করা হয়েছে। তদন্তের ক্ষেত্রে আমার কোনকিছুই বাদ দিচ্ছি না।’

তিনি জানান, প্রথম দিনের গণশুনানিতে ১৮ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছেন। দ্বিতীয় দিন আরও ২৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হতাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, যুগ্ম সম্পাদক আহসান হাবিব, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদা মালাও উপস্থিত ছিলেন। হতাহত পরিবার প্রতি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২০ হাজার ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দেন আনোয়ার হোসেন।