বাংলাদেশের পরম বন্ধু প্রণব মুখার্জির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোহাম্মদ শাহজাহান

চলে গেলেন ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি। ৩১ আগস্ট সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লির সেনা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এই নেতা লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতাও হয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতির এ বিশাল ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রীর পদটি ছাড়া মূলত প্রায় সব শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একজন ভারতীয় সাংবাদিক বলেছেন, প্রয়াত এই নেতার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পরম মিত্র। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। প্রণব মুখার্জির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ১ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে বাংলাদেশ সরকার। এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মিরাট গ্রামে জন্ম প্রণব মুখার্জির। রাজনীতিতে বা ব্যক্তি জীবনে কোন ধর্মীয় সংকীর্ণ ছিল না তাঁর মধ্যে। আজীবন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই ব্যতিক্রমী মানুষটি বলতেন, ‘ভারতের বৈচিত্র্যই ভারতের শক্তি।’ বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সমকালীন ভারতের রাজনীতিতে তিনি হয়ে ওঠেন এক মহিরুহ। রাজনৈতিক সুপরামর্শ পাওয়ার আশায় দলমত নির্বিশেষে সবাই যেতেন তার কাছে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন অজাতশত্রু। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে এক রাজনৈতিক যুগ ও সংস্কৃতির অবসান ঘটল। দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসের রাজনীতিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাম্প্রদায়িক বিজেপির কাছেও ছিলেন বিশেষভাবে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের চালচিত্রে তার অবদান কেউ কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবেন না।’ এক টুইট বার্তায় মোদি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শুরুর দিনগুলোয় তিনি প্রণব মুখার্জির মতো একজন মানুষের নির্দেশনা পাওয়ায় নিজেকে ধন্য মনে করেন।

প্রণব মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের দুর্দিনের বন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই নেতাকে বৈদেশিক জনমত গঠনের বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে তার নির্বাসিত সময়কালে প্রণব মুখার্জি ছিলেন তার অভিভাবক। ২০১০ সালে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শ্রদ্ধা জানাতে দিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন। দূরদর্শী ইন্দিরা গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে চিনতে ভুল করেননি। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯ সালে তাকে রাজ্যসভার সদস্য করেন। ইন্দিরার মন্ত্রিসভার সদস্য হন ১৯৭৩ সালে। সেই থেকে ধাপে ধাপে তার উত্তরণ ঘটে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ইন্দিরা হত্যার পর রাজীব-মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি প্রণব মুখার্জি। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হলে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক পুনর্জন্ম হয়। এ সময় তিনি দফায় দফায় সামলেছেন পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়। মনমোহন সিং সরকারের সময় তিনি হয়ে ওঠেন ত্রাণকর্তা বা মুশকিল আসানকারী। তখন এমন সময়ও গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের ৫২টি মন্ত্রী গোষ্ঠীর তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন।

প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে শোকে আপ্লুত ও স্মৃতিকাতর হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও শেখ হাসিনার নিজের বহু স্মৃতি প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমি সব সময় মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন, যে কোন প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে ফেরার পরও তিনি সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যে কোন সংকটে তিনি সাহস যুগিয়েছেন। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারাল একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারাল একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রণব মুখার্জির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।’

ব্যক্তিগত জীবনে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের নড়াইলে বিয়ে করেন। নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে প্রথমবারের মতো ভদ্রবিলায় শ্বশুরবাড়ি ঘুরে গেছেন তিনি। সেখানে নড়াইলের এই মহান জামাতাকে ‘উলু ধ্বনি’ ও মঙ্গল আরতির মতো প্রথাগত উপায়ে স্বাগত জানানো হয়। ওই সময় অসুস্থতা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে বসে নিজের জন্মভিটা শেষবারের মতো দেখে যান শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। দুই বছর পর ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে মারা যান শুভ্রা মুখোপাধ্যায়।

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার মতোই অনবদ্য অবদান রাখেন ভারতের এই বাঙালি নেতা। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি এবং মহান বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তার এই অবদানের কথা ভুলে যাননি। ২০১৩ সালে এই মহান বন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করে বাংলাদেশ। এই সেই প্রণব মুখার্জি যিনি ১৯৭১-এর ১৫ জুন ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিছুদিন আগে তার নিজের লেখায় তুলে ধরেছেন সেই যুদ্ধকালীন সময়ের কথা। প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘৩৬ বছর তখন আমার বয়স। অদ্ভুত এক আবেগ আমার হৃদয়ে সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ মনে পড়ে সেই স্মৃতিময় দিনটির কথা। রাজ্যসভায় আমার ওই বক্তৃতায় প্রস্তাব করি যে, ভারত সরকার যেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুজিবনগর অবস্থিত নির্বাসিত সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ওই সময় রাজ্যসভার একজন সদস্য জানতে চান, এই প্রস্তাব কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে? জবাবে বলেছিলামÑ এটা হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। এর অর্থ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা। ঐ সময় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেছি।’

আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন ভারতের সদ্য প্রয়াত এই মহান মানুষটি। তিনি লিখেছেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুবই কষ্ট পেয়েছি। ভোর বেলায় ওই নৃশংস-বর্বর হত্যার খবর শুনে শোকাহত এবং হতচকিত হয়ে যাই। মনে হয়েছিল, পরম বন্ধুকে হারিয়েছি। স্বজন হারিয়েছি। প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা এবং রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে ফ্রান্সে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন প্রণব মুখার্জি। এরপর (পঃ)জার্মানি ও যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে সেখানকার সরকারপ্রধান, গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের নিপীড়ন, নির্যাতন এবং বাংলাদেশের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং তখনকার রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে শরণার্থীদের থাকা, খাওয়া ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে উদ্যোগ নেন প্রণব মুখার্জি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা অনেকটা পরমাত্মীয়ের মতো। দিল্লির সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, ‘মনে আছে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। সাউথ ব্লকে তার ঘরে ঢুকে বললাম, প্রথম বাঙালি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন আপনি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক গাল হেসে বললেন, প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোনটি করেছেন, আর একজন বাঙালি, তিনি শেখ হাসিনা। সালটা ছিল ১৯৯৫। প্রণব বাবু বারবার বলতেন, বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্কটা নিছক দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক নয়। দুটি দেশের তো আসলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষাÑ সব নিয়ে নাড়ির বন্ধন। শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নয়, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিপন্ন শেখ হাসিনার প্রতি প্রণব মুখার্জির দরদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে। সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের মতে, ওই সময় প্রণব বাবুকে খুবই বিষণœ থাকতে দেখেছি। বার বার বলতেন, ‘শুধু তো শেখ হাসিনার জন্য নয়, খারাপ লাগছে শঙ্কা হচ্ছে বাংলাদেশের শান্তি ও গণতন্ত্রের বিপন্নতা নিয়ে।’ প্রণব মুখার্জি তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ ২০০৮ সালে ৬ দিনের সফরে দিল্লি আসেন। প্রণব মুখার্জি অন্যায়ভাবে আটক রাখা শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেয়ার জন্য সেনাপ্রধানকে অনুরোধ করেন। প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, উনি বলেছিলেন ইনফরমালি। প্রণব বাবুর অনুরোধের পর মইন উ আহমেদ বলেন, কিন্তু মুক্ত হয়ে ক্ষমতায় এসেই তাকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে তাড়িয়ে দেবেন। প্রণব বাবু লিখেছেন, তখন তিনি দায়িত্ব নিয়ে জেনারেল মইনকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিচ্ছি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলেও তাকে যাতে সরানো না হয়।

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রণব মুখার্জি ওই সময় নানাভাবে চেষ্টা করেন। পরের ইতিহাস সবার জানা। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। সেই থেকে টানা তিন টার্মে ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। কারামুক্ত শেখ হাসিনা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে প্রণব মুখার্জি খুব খুব খুশী হন। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কার্যকলাপ দেখে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে কয়েকজন নেতার কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রণব মুখার্জি তাদের ভর্ৎসনা পর্যন্ত করেন। তিনি বলতেন, শেখ হাসিনা আমার পারিবারিক বন্ধু। তিনি অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছেন।

ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত প্রণব মুখার্জির কর্মজীবন শুরু হয় পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে। এরপর প্রথমে হাইস্কুলে শিক্ষকতা এবং পরে বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শেষে বংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। কংগ্রেসের টিকিটে ১৯৬৯, ১৯৭৪, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালে পাঁচবার প্রণব মুখার্জি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে নির্বাচিত হন লোকসভার সদস্য। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে পরাজিত-বিপর্যস্ত ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দৃঢ়ভাবেই অবস্থান নেন প্রণব মুখার্জি। কংগ্রেসের দুর্দিনেও ইন্দিরা পরিবারের পাশে থেকেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে সীতারাম কেশরীকে সরিয়ে সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেসের সভানেত্রী করার মুখ্য কারিগর ছিলেন প্রণব মুখার্জি। মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভায়ও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আগেই বলেছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া আর বাকিসব পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রণব মুখার্জি। ২০১২ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে প্রণব মুখার্জি ভারতরতœ উপাধিতে ভূষিত হন। এর আগে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন জাতীয় নেতা ছিলেন। বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশের মানুষসহ পৃথিবীর সকল বাঙালি চিরকাল পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৯ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

বাংলাদেশের পরম বন্ধু প্রণব মুখার্জির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোহাম্মদ শাহজাহান

চলে গেলেন ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি। ৩১ আগস্ট সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লির সেনা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এই নেতা লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতাও হয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতির এ বিশাল ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রীর পদটি ছাড়া মূলত প্রায় সব শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একজন ভারতীয় সাংবাদিক বলেছেন, প্রয়াত এই নেতার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পরম মিত্র। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। প্রণব মুখার্জির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ১ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে বাংলাদেশ সরকার। এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মিরাট গ্রামে জন্ম প্রণব মুখার্জির। রাজনীতিতে বা ব্যক্তি জীবনে কোন ধর্মীয় সংকীর্ণ ছিল না তাঁর মধ্যে। আজীবন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই ব্যতিক্রমী মানুষটি বলতেন, ‘ভারতের বৈচিত্র্যই ভারতের শক্তি।’ বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সমকালীন ভারতের রাজনীতিতে তিনি হয়ে ওঠেন এক মহিরুহ। রাজনৈতিক সুপরামর্শ পাওয়ার আশায় দলমত নির্বিশেষে সবাই যেতেন তার কাছে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন অজাতশত্রু। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে এক রাজনৈতিক যুগ ও সংস্কৃতির অবসান ঘটল। দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসের রাজনীতিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাম্প্রদায়িক বিজেপির কাছেও ছিলেন বিশেষভাবে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের চালচিত্রে তার অবদান কেউ কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবেন না।’ এক টুইট বার্তায় মোদি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শুরুর দিনগুলোয় তিনি প্রণব মুখার্জির মতো একজন মানুষের নির্দেশনা পাওয়ায় নিজেকে ধন্য মনে করেন।

প্রণব মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের দুর্দিনের বন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই নেতাকে বৈদেশিক জনমত গঠনের বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে তার নির্বাসিত সময়কালে প্রণব মুখার্জি ছিলেন তার অভিভাবক। ২০১০ সালে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শ্রদ্ধা জানাতে দিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন। দূরদর্শী ইন্দিরা গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে চিনতে ভুল করেননি। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯ সালে তাকে রাজ্যসভার সদস্য করেন। ইন্দিরার মন্ত্রিসভার সদস্য হন ১৯৭৩ সালে। সেই থেকে ধাপে ধাপে তার উত্তরণ ঘটে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ইন্দিরা হত্যার পর রাজীব-মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি প্রণব মুখার্জি। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হলে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক পুনর্জন্ম হয়। এ সময় তিনি দফায় দফায় সামলেছেন পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়। মনমোহন সিং সরকারের সময় তিনি হয়ে ওঠেন ত্রাণকর্তা বা মুশকিল আসানকারী। তখন এমন সময়ও গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের ৫২টি মন্ত্রী গোষ্ঠীর তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন।

প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে শোকে আপ্লুত ও স্মৃতিকাতর হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও শেখ হাসিনার নিজের বহু স্মৃতি প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমি সব সময় মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন, যে কোন প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে ফেরার পরও তিনি সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যে কোন সংকটে তিনি সাহস যুগিয়েছেন। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারাল একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারাল একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রণব মুখার্জির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।’

ব্যক্তিগত জীবনে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের নড়াইলে বিয়ে করেন। নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে প্রথমবারের মতো ভদ্রবিলায় শ্বশুরবাড়ি ঘুরে গেছেন তিনি। সেখানে নড়াইলের এই মহান জামাতাকে ‘উলু ধ্বনি’ ও মঙ্গল আরতির মতো প্রথাগত উপায়ে স্বাগত জানানো হয়। ওই সময় অসুস্থতা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে বসে নিজের জন্মভিটা শেষবারের মতো দেখে যান শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। দুই বছর পর ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে মারা যান শুভ্রা মুখোপাধ্যায়।

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার মতোই অনবদ্য অবদান রাখেন ভারতের এই বাঙালি নেতা। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি এবং মহান বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তার এই অবদানের কথা ভুলে যাননি। ২০১৩ সালে এই মহান বন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করে বাংলাদেশ। এই সেই প্রণব মুখার্জি যিনি ১৯৭১-এর ১৫ জুন ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিছুদিন আগে তার নিজের লেখায় তুলে ধরেছেন সেই যুদ্ধকালীন সময়ের কথা। প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘৩৬ বছর তখন আমার বয়স। অদ্ভুত এক আবেগ আমার হৃদয়ে সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ মনে পড়ে সেই স্মৃতিময় দিনটির কথা। রাজ্যসভায় আমার ওই বক্তৃতায় প্রস্তাব করি যে, ভারত সরকার যেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুজিবনগর অবস্থিত নির্বাসিত সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ওই সময় রাজ্যসভার একজন সদস্য জানতে চান, এই প্রস্তাব কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে? জবাবে বলেছিলামÑ এটা হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। এর অর্থ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা। ঐ সময় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেছি।’

আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন ভারতের সদ্য প্রয়াত এই মহান মানুষটি। তিনি লিখেছেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুবই কষ্ট পেয়েছি। ভোর বেলায় ওই নৃশংস-বর্বর হত্যার খবর শুনে শোকাহত এবং হতচকিত হয়ে যাই। মনে হয়েছিল, পরম বন্ধুকে হারিয়েছি। স্বজন হারিয়েছি। প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা এবং রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে ফ্রান্সে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন প্রণব মুখার্জি। এরপর (পঃ)জার্মানি ও যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে সেখানকার সরকারপ্রধান, গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের নিপীড়ন, নির্যাতন এবং বাংলাদেশের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং তখনকার রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে শরণার্থীদের থাকা, খাওয়া ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে উদ্যোগ নেন প্রণব মুখার্জি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা অনেকটা পরমাত্মীয়ের মতো। দিল্লির সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, ‘মনে আছে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। সাউথ ব্লকে তার ঘরে ঢুকে বললাম, প্রথম বাঙালি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন আপনি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক গাল হেসে বললেন, প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোনটি করেছেন, আর একজন বাঙালি, তিনি শেখ হাসিনা। সালটা ছিল ১৯৯৫। প্রণব বাবু বারবার বলতেন, বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্কটা নিছক দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক নয়। দুটি দেশের তো আসলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষাÑ সব নিয়ে নাড়ির বন্ধন। শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নয়, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিপন্ন শেখ হাসিনার প্রতি প্রণব মুখার্জির দরদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে। সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের মতে, ওই সময় প্রণব বাবুকে খুবই বিষণœ থাকতে দেখেছি। বার বার বলতেন, ‘শুধু তো শেখ হাসিনার জন্য নয়, খারাপ লাগছে শঙ্কা হচ্ছে বাংলাদেশের শান্তি ও গণতন্ত্রের বিপন্নতা নিয়ে।’ প্রণব মুখার্জি তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ ২০০৮ সালে ৬ দিনের সফরে দিল্লি আসেন। প্রণব মুখার্জি অন্যায়ভাবে আটক রাখা শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেয়ার জন্য সেনাপ্রধানকে অনুরোধ করেন। প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, উনি বলেছিলেন ইনফরমালি। প্রণব বাবুর অনুরোধের পর মইন উ আহমেদ বলেন, কিন্তু মুক্ত হয়ে ক্ষমতায় এসেই তাকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে তাড়িয়ে দেবেন। প্রণব বাবু লিখেছেন, তখন তিনি দায়িত্ব নিয়ে জেনারেল মইনকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিচ্ছি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলেও তাকে যাতে সরানো না হয়।

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রণব মুখার্জি ওই সময় নানাভাবে চেষ্টা করেন। পরের ইতিহাস সবার জানা। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। সেই থেকে টানা তিন টার্মে ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। কারামুক্ত শেখ হাসিনা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে প্রণব মুখার্জি খুব খুব খুশী হন। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কার্যকলাপ দেখে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে কয়েকজন নেতার কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রণব মুখার্জি তাদের ভর্ৎসনা পর্যন্ত করেন। তিনি বলতেন, শেখ হাসিনা আমার পারিবারিক বন্ধু। তিনি অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছেন।

ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত প্রণব মুখার্জির কর্মজীবন শুরু হয় পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে। এরপর প্রথমে হাইস্কুলে শিক্ষকতা এবং পরে বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শেষে বংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। কংগ্রেসের টিকিটে ১৯৬৯, ১৯৭৪, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালে পাঁচবার প্রণব মুখার্জি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে নির্বাচিত হন লোকসভার সদস্য। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে পরাজিত-বিপর্যস্ত ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দৃঢ়ভাবেই অবস্থান নেন প্রণব মুখার্জি। কংগ্রেসের দুর্দিনেও ইন্দিরা পরিবারের পাশে থেকেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে সীতারাম কেশরীকে সরিয়ে সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেসের সভানেত্রী করার মুখ্য কারিগর ছিলেন প্রণব মুখার্জি। মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভায়ও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আগেই বলেছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া আর বাকিসব পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রণব মুখার্জি। ২০১২ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে প্রণব মুখার্জি ভারতরতœ উপাধিতে ভূষিত হন। এর আগে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন জাতীয় নেতা ছিলেন। বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশের মানুষসহ পৃথিবীর সকল বাঙালি চিরকাল পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com