আবুল কাসেম
প্রথমে ব্যাপারটা ছিল প্রতীকী। জেনারেল করোনাকে কমান্ডার ইন চিফের ব্যাজ পরিয়ে দিলেন সাঙসি। একটা গোপন বৈঠক শেষে করোনা ভাইরাস সৃষ্টির প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা হাততালির মাধ্যমে এভাবেই শুরু করা হয়।
তাদের উদ্দেশ্য অবশ্য খারাপ ছিল না। গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া তাদের কাছে একটি ভয়াবহ সংবাদ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাগরম প্রশাসন চীনের শক্তিশালী অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে নানা প্রকাশ্য প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি গোপনে এক ধরনের ভাইরাস সৃষ্টি করছে। এ ভাইরাস চীনা অর্থনীতির মূলকেন্দ্র, যেমন উৎপাদন এলাকা এবং বহিঃবাণিজ্য ক্ষেত্রে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাবে। উদ্দেশ্য, মানব মৃত্যু নয়, শ্রমিক ব্যবস্থাপকদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। তাতে উৎপাদন ও বিপণন ব্যাহত হবে। অর্থনীতি দুর্বল হবে।
প্রথমে অবশ্য মার্কিনিদের পরিকল্পনা ছিল কম্পিউটার ভাইরাস ছড়াবার। কম্পিউটার প্রযুক্তিতে চীন তাদের চেয়ে অগ্রসর। বিশেষজ্ঞরা তাই এ পরিকল্পনা বাদ দেন। প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি তাতে ক্ষুব্ধ হন। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীকে ভাইরাস উদ্ভাবনের নির্দেশ দিয়ে দেন।
এ সংবাদ পেয়ে চীনের পলিটব্যুরো সাঙসির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। সামরিক-বেসামরিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির বৈঠকে বসেন সাঙসি। সকলের বক্তব্যের মধ্যে সামরিক জীবাণু অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মাওঝেনের কথা পছন্দ হয় সাঙসির। মাওঝেন বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মার্কিনিরা মারণাস্ত্র হিসেবে ভাইরাস ছড়াবার কথা ভাবছে না। তারা নিষ্ক্রিয় করে দিতে চাইছে চীনা অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে। আমাদের উচিত হবে আক্রমণাত্মক নয়, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়া।
কী করতে চাও তুমি? প্রশ্ন করেন সাঙসি।
মাওঝেন বললেন, ট্রজানহর্সের মতো আমরা একটা জীবাণু অস্ত্র উদ্ভাবন করব।
ট্রজানহর্স? অবাক হলেন সাঙসি, অন্যরা উৎকর্ণ।
হ্যাঁ ট্রজানহর্স, ট্রয়ের যুদ্ধে যা ব্যবহার করা হয়েছিল। আমাদের প্রতিটা অর্থনৈতিক স্থাপনায় এ রকম হর্সের উপস্থিতি থাকবে। মার্কিন ভাইরাস দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসগুলো হর্স থেকে বের হয়ে সেগুলোকে ভক্ষণ করবে।
পলিটব্যুরোর প্রতিনিধি বললেন, খুব মজার তো ব্যাপারটা, সবাই পছন্দ করলেন মাওঝেনের পরিকল্পনা। সাঙসি তা অনুমোদন করে দেন।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের প্রশ্ন এলো। প্রথমেই সাঙসি জানতে চাইলেন, এ অস্ত্র তৈরি হবে কোথায়?
মাওঝেন বললেন, এটি সামরিক অস্ত্র নয় এবং সামরিক যুদ্ধও নয়, অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। তাই বেসামরিক ল্যাবেই এ ভাইরাস সৃষ্টি হতে পারে। এ অণুজীব অস্ত্র উদ্ভাবনের জন্য উপযুক্ত স্থান হবে উহান।
দুই.
উহান হুবেই প্রদেশের রাজধানী। ২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৫৬০ ডিগ্রি আর্দ্রতার উহান সিটি ইয়াংজে নদীর তীরে অবস্থিত। পাহাড়-জঙ্গল হ্রদ আর নানা দৃষ্টিনন্দন ফুল-পাখি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে রেখেছে স্থানটিকে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে এখানে জনপদ সৃষ্টি হয়। ঐতিহ্যবাহী নানা নির্দশন এবং দৃষ্টিনন্দন স্থান বলে সব সময়ই পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে।
২০০৮ সালে চীন সরকার উহানে বায়োলেক প্রতিষ্ঠা করে। এই বায়োলেকে বেশ কয়েকটি পার্কের মধ্যে রয়েছে বায়োইনোভেশন এবং বায়োহেলথ পার্ক। এসব পার্ক মূলত গবেষণা কেন্দ্র। সংরক্ষিত এলাকা।
২০১৯ সাল ছিল উহানে একটি উৎসবের বছর। এ সময়ে এখানে ওয়ার্ল্ড মিলিটারি গেমস-এর আসর বসে। জেনারেল মাওঝেনের পরামর্শে উৎসবের অন্তরালে এখানেই চীন ভাইরাস উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করে।
ভাইরাস আবিষ্কারে ব্যবহার করা হয় অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির রোবট টেকনোলজি। নিয়োজিত করা হয় দক্ষ অণুজীব বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি তিনটি অভিজ্ঞ রোবটকে। এদের নাম দেয়া হয় স্টুপিড রোবট-১, স্টুপিড রোবট-২ এবং স্টুপিড রোবট-৩। এরকম নামকরণ করার কারণ আছে। এরা নির্বোধের মতোই কথা শোনে বলে মনে করা হয়। এছাড়া স্টুপিড শুনতে শুনতে এরা আসলেই স্টুপিড হয়ে যায়।
এদেরকে ট্রজান হর্সের ধারণা দেয়া হয়। অণুজীব বিজ্ঞানী ওলান এবং সি-পিং অণুজীবগুলোর সংস্পর্শের বাইরে থাকাকল্পে (না হয় সংক্রমিত হয়ে এরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে) নির্বোধ বলে কথিত রোবটগুলোকে দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়া ইচ্ছেমতো কাজটি আদায় করে নিতে উদ্যোগী হলেন।
রোবটদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে (শিশুদের যেন ক্লাসে লেখার কাজ দিয়ে) দুই শিক্ষক গল্পে মেতে উঠলেন। এক পর্যায়ে সি-পিং বললেন, তোমার নাম ওলান কেন? খুবই সেকেলে অচল পয়সার মতো।
ওলান এতে কিছু মনে করলেন না। বললেন, আমার বাবা আমেরিকান লেখিকা পার্ল এস, বাকের ‘গুডআর্থ’ উপন্যাসের নায়িকার নামে আমার নাম রেখেছেন। আমরা ঝেনঝিয়াং-এর মানুষ। সেটাই ছিল উপন্যাসটির পটভূমি।
আমি খুবই দুঃখিত ওলান, আমার এ রকম মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। এ নাম তো দেখছি গৌরবময় উর্বরভূমিতে গজানো এক চন্দন বৃক্ষের চারা।
না, না আমি কিছু মনে করিনি। আমার বাবা চেয়েছিলেন বাকের মতো আমিও খ্যাতিমান লেখিকা হয়ে নোবেল-টোবেল পেয়ে যাই, বলে হাসলেন তিনি। পরে বললেন, নোবেল-বুকার পেলেও উপন্যাসটি চীনের মানুষ পছন্দ করেনি।
সি-পিং বললেন, আমিও শুনেছি উপন্যাসটি বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং বাস্তবতা বর্জিত।
লেখিক ছিলেন একজন বিদেশি, নানের মেয়ে, চার দেয়ালে যার বসবাস। হতে পারে গির্জায় বসে তার পক্ষে চীনের মানুষের বাস্তব জীবন এবং এই জীবনের গভীরতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব ছিল না।
আমারও তাই মনে হয়েছে। সি-পিং পরে হেসে দিয়ে আবার বললেন, তোমার কি কোনো ওয়াংলাঙের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে? না, দুর্ভাগ্য আমার। বলে হাসল ওলান। এটা দুর্ভাগ্য নয়, এই ৩৫ বছরেও আমার কোনো ওলানের সঙ্গে পরিচয় হয়নি।
এখন তো হলো। বলে কেমন যেন লজ্জা পেলেন ওলান। সি-পিং এগিয়ে এসে তার হাত ধরলেন। উহানের দুরন্ত বাতাস যেন ওলানের মাথার লম্বা চুলের মতো মনকেও এলোমেলো করে দিল।
তিন.
অণুজীব বিজ্ঞানীদের দেয়া নামটি রোবটদের পছন্দ হয়নি। কারণ এদের হিউম্যান
সেন্সাবিলিটি বা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। অণুজীব বিজ্ঞানীদের তা জানা ছিল না। রোবটগুলো যারা বাছাই করেছেন, তারাই ভুল করেছেন। এ রোবটগুলো মোটেই অথর্ব নয়, খুবই বুদ্ধিমান। এরা অপমানবোধ থেকে অণুজীব বিজ্ঞানীদের বেঁধে দেয়া ফরমুলা বাদ দিয়ে তাদের ভেতর স্টোর করা তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে যায় অবাক করা সব তথ্য। সূর্যপৃষ্ঠের করোনার কথা। সেইন্ট করোনাকে শত শত বছর ধরে মনে করা হয় মহামারীর সেইন্ট। করোনা শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ক্রাউন থেকে- যার অর্থ মুকুট। সেইন্ট করোনা ছিলেন একজন খ্রিস্টান, যাকে দ্বিতীয় শতকে হত্যা করা হয়। করোনার ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একটি হুমকি। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম কুয়েত দখলের পর বুশ সাদ্দামকে বলেছিলেন কুয়েত ছাড়, নইলে করোনা দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে ইরাককে।
সেটি ৩০ বছর আগের কথা।
এই সূত্রে এরা আমেরিকার তথ্যভাণ্ডারে ঢুকে পড়ল। স্টুপিট রোবট-২ বলল এত পুরোনো তথ্য পাওয়া কঠিন হবে।
স্টুপিড রোবট-৩ কোনো কথা না বলে চেষ্টা চালাল। কিছুক্ষণ পর প্রায় চেঁচিয়ে বলল পেয়ে গেছি।
অন্য দুটি দৌড়ে এলো তার কাছে। সত্যিই পাওয়া গেছে। তবে এগুলো এত আগের যে সব কিছু বুঝে ওঠা কঠিন। তবু এরা আশাবাদী। কাজে লেগে গেল।
এ পর্যন্ত ছয়টি করোনার পরিচয় পাওয়া গেছে। আমেরিকান করোনাটি প্রথম এবং ষষ্ঠটি পর্যন্ত এসবের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। কোনো কোনোটি এখনও টিকে আছে। দুটি (পঞ্চম ও ষষ্ঠ)কে নিয়ে পশ্চিমারা সিনেমা পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে। রোবটগুলো পূর্ববর্তী করোনাগুলোর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতি বিবেচনা করে প্রথম, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ করোনার জ্ঞান কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠল। প্রথমে এরা হোস্ট সেলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত অণুগুলো ভেঙে জেনোম সিকোয়েন্সিং এক মাধ্যমে আরএনএ ভাইরাস সৃষ্টি করে মিউটেশনে মডিফাইড নতুন জেনারেশন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়ে যায়। ল্যাবের পরীক্ষায় তার রেপ্লিকেশনও সম্ভব হয়। সংক্রমণ এবং বংশবিস্তারের ঘটনা এদের উল্লসিত করে তোলে। এভাবেই এরা অণুুজীব বিজ্ঞানীদের চোখে ধুলো দিয়ে সৃষ্টি করে এমন এক মডিফাইড করোনাভাইরাস, যা মারাত্মক মারমুখী, বংশবিস্তারে সক্ষম এবং কয়েকটি করোনার সমন্বয়ে সৃষ্ট বলে স্থান কাল ও অবস্থা ভেদে রূপ ও প্রকৃতি পরিবর্তনে সক্ষম।
এরা কম্পিউটার ল্যাবে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণি, পিপীলিকার একটি বিগ্রহ এঁকে তার মুখে তার ১০ গুণ ওজনের একটি পতঙ্গ তুলে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখাতে চাইল, যার বেশি ওজনই হোক সে শুধু একটি বস্তুর ভারই বহন করতে পারে। বোঝাতে চাইল সকল প্রাণিই একটিমাত্র জীবকোষ পরিবাহী, মানুষ তার ব্যতিক্রম। তাকে এ ভাইরাস বহন করতে দিলে তা দ্রুত ছড়াবে। তাই এরা মানুষকেই ভাইরাস ছড়াবার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির প্রকাশ ঘটে করমর্দন, কোলাকুলি এবং চুম্বনের মাধ্যমে। এরা এ তিনটি ব্যাপারকেই সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। অন্যসব ভাইরাস সংক্রমণ ঘটায় বাতাসে, রক্তে কিংবা খাবারে। এ ভাইরাস ব্যতিক্রম। মানুষের মাধ্যমে সমগ্র মানুষের বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযান। পারমাণবিক শক্তির চাইতেও এই ভাইরাসের শক্তি অনেক বেশি। পরমাণু বোমা ধ্বংস করে একটি নির্দিষ্ট এলাকা। আর করোনার কমান্ড এরিয়া একই সঙ্গে সারা বিশ্ব।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অণুজীব বিজ্ঞানীদের কাছে গোপন রাখা হয়েছে। তারা জানে স্টুপিড রোবটগুলো তাদের কমান্ড মেনে আমেরিকার ভাইরাসভুক অহিংস মিউটেশন সৃষ্টি করে সাফল্য পেতে যাচ্ছে। রোবটগুলো যখন দেখিয়ে দিল যে, নানা রকম পরিবেশে ভাইরাসগুলো শুধু সারভাইভ-ই করছে না, তাদের প্রকৃতি, চরিত্র এবং কার্যকারিতার মধ্যেও পরিবর্তন ঘটছে এবং বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রজন্মের মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠছে, অণুজীব বিজ্ঞানীরা তখন এই আবিষ্কারের মধ্যে নিজেদের সাফল্য খুঁজে পেলেন। ওলান এ সাফল্যে শিপিংকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অভিনন্দন তোমাকে। জবাবে শিপিং ওলানের গালে একটা চুম্বন একে দিয়ে বললেন, আমাকে কি এখন ওয়াং লাঙ ভাবতে আপত্তি আছে?
ওলান অপ্রস্তুত হয়ে শুধু হাসলেন। এ হাসি লজ্জা মিশ্রিত।
চার.
এখন ভাইরাসটির বাস্তব কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সময়। ল্যাবের বাইরে উন্মুক্ত করে দিতেই ঘটে যত বিপত্তি। কোনো ভাইরাসই ট্রজানহর্স থেকে বের হয়ে শত্রু ভাইরাসকে ভক্ষণ করছে না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আরও দেখা গেল এ ভাইরাসগুলো পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ এবং প্রাণঘাতী হানাহানিতে লিপ্ত। শান্ত সুবোধ চরিত্রের বদলে পেয়েছে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি। তাই ট্রজানহর্সে ফিরে না এসে লাফিয়ে লাফিয়ে নানা জায়গায় পালিয়ে থাকছে।
বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন অণুুজীব বিজ্ঞানীরা। রোবটদের কাজকর্ম পরীক্ষা করলেন। রোবটগুলো নির্বোধের অভিনয়ই করল। নিজেদের দুষ্টু বুদ্ধির কথা একেবারেই বুঝতে দিল না। বিজ্ঞানীরা সাব্যস্ত করলেন রোবটদের দিয়েই কাজটা আবার করাবেন। হয়ত কোথাও ভুল হয়েছে। সন্দেহটা রোবটদের ওপরই। সি পিং রাগ করে বললেন, তোদের স্টুপিড নাম দেয়া একদম ঠিক হয়েছে। অপদার্থের দল। রোবটেরা অর্থপূর্ণভাবে শুধু পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ী করল।
কাজটা পুনরায় করার সময় প্রযুক্তিগতভাবে রোবটগুলো আরও অগ্রসর হয়ে যায়। অণুজীবগুলোর মধ্যে এরা বাড়তি কিছু শক্তি যুক্ত করে। মানব জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রোবটগুলো কৃতার্থবোধ করে। ছয় প্রজন্মের দায়ভার যেন ‘মুকুটমনি’ নামধারী এই সাত নম্বর ভাইরাসটির কাঁধে চেপে বসেছে।
দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায়ও একই ফল পাওয়া গেল। এবারে অণুজীব বিজ্ঞানীরা আর ক্ষিপ্ত হলেন না। ব্যর্থতার দায়ে তাদের কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু উপায় কী। ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য এরা পজিটিভ ফলাফল দেখিয়ে সাঙসির কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন। রিপোর্টের নিচে বি. দ্র. বলে ভাইরাসগুলো সময়ে সময়ে রূপ ও প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে- এ কথা লিখে দিলেন।
তারপরই সাঙসি জেনারেল করোনাকে কমান্ডার-ইন-চিফ-এর ব্যাজ পরিয়ে দেন। প্রত্যাশা, এই জেনারেল তার দলবল নিয়ে ভাইরাস যুদ্ধে আমেরিকার ভাইরাসগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। এসবের মধ্য দিয়ে ১৫ দিন কেটে গেছে। পালিয়ে যাওয়া ভাইরাসের কতগুলো অণুজীব বিজ্ঞানীদের পোশাকে আশ্রয় করে ১৪ দিন আগে উহান মার্কেটে চলে যায়। এরা অণুজীব বিজ্ঞানীদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারেনি, কারণ এরা পিপিই ব্যবহার করেছিলেন। বাজারে গিয়ে তারা যাদের সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন ওদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। ইনকিউবেশনের ঠিক ১৫ দিন পর সংক্রমণের আলামত দেখা যেতে শুরু করে, মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় এবং ব্যাপকহারে মারা যেতে থাকে।
চীন আত্মরক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে। সাঙসি নিজে অণুজীব বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা বলেন যে, রিপোর্টেই আছে ভাইরাসটি রূপ এবং প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। সুপারভিশন যারা করছিলেন সাঙসি তাদের একচোট নিলেন। বললেন, পরিণতির জন্য সবাই অপেক্ষা কর। অণুজীব বিজ্ঞানীরা উহান নগরী ত্যাগ করে পালিয়ে ঝেনঝিয়াং প্রদেশে চলে যান।
পাঁচ.
চীন ভাইরাসজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠলেও আসল সত্য গোপন করে যায়। ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারটি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানোর নিয়ম থাকলেও চীন তা জানায় প্রায় এক মাস পর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের নাম দেয় কোভিড-১৯।
চীন উহানের ল্যাবটি বন্ধ করে দেয়। যথারীতি রোবটগুলো তখনও ল্যাবরেটরিতে অবস্থান করছিল। এখানে এরা বসে না থেকে কম্পিউটার মনিটরে ভাইরাসগুলোর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে। ভাইরাসগুলো তাদের পরিকল্পনা মতো কাজ করছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। চীনের নতুন ভাইরাস শনাক্ত হয় ৭ জানুয়ারি। প্রথম মৃত্যু ৯ জানুয়ারি চীনের বাইরে, থাইল্যান্ডে ১৩ জানুয়ারি। প্রথম মৃত্যু চীনের বাইরে, ফিলিপাইনে ২ ফেব্রুয়ারি। কম্পিউটারে সবই রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত সংখ্যার চাইতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ সংখ্যাটা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
ল্যাব বন্ধ থাকা অবস্থায় সাঙসি ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি উপলব্ধি করে জেনারেল করোনার ব্যাজ খুলে নিয়ে তাকে কমান্ডচ্যুত করেন।
এদিকে অণুজীব বিজ্ঞানী ওলান এবং সি-পিং ঝেনঝিয়াং-এ পৌঁছেই পরস্পরকে বিয়ে করে ফেলেন। তাদের কেন যেন মনে হতে থাকে চীন প্রশাসন তাদের খুঁজে বের করবেই এবং যথারীতি মৃত্যুদণ্ড দেবে। যে ক’টা দিন বেঁচে আছেন প্রেম আর বিবাহিত জীবনের স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। আরেকটি ভয়ও আছে, সংক্রমণ। তাতেও নির্ঘাত মৃত্যু। মৃত্যু নিয়ে চীন মিথ্যে বলছে। কারও রক্ষা নেই। তাই ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের নায়ক-নায়িকার মতো একসঙ্গে জড়াজড়ি করে মরতে চান। এটা স্পষ্ট মৃত্যু তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করছে। তাই এরা ভোগ-উপভোগে বেপরোয়া।
ছয়.
রোবটগুলোর ভূমিকা আগ্রাসী ধরনের। এরা করোনার শক্তি বাড়াতে নানা মাত্রা যুক্ত করতে থাকে। পৃথিবীর মানচিত্র দেখে দেখে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা বিবেচনায় বেশ কয়েকটি সংস্করণ তৈরি করে। স্টুপিড-৩ একটি গেম বানাচ্ছে। সে বলল, করোনার এতগুলো সংস্করণ কেন?
তুমি কী করছ? স্টুপিড-১ প্রশ্ন করে।
গেম বানাচ্ছি।
দেখি দেখি।
দেখা যাচ্ছে চীন ছেড়ে ভাইরাসগুলো প্লেনে চেপে মানবদেহের মধ্য দিয়ে কীভাবে চীনের বাইরে অভিযান করেছে। বিভিন্ন দেশে সংক্রমণটা দেখাচ্ছে সবুজ কতগুলো বলের মধ্যে লাল দুটো বলের সংঘর্ষ ঘটিয়ে লাল বলগুলো সবুজ বলগুলোকে টোকা মেরে লাল করে দিয়ে নিজের দলে টানছে এবং তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় একশ’ ভাগে তা উন্নীত হয়।
আইডিয়াটা মন্দ না। তবে একই বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস সকল পরিবেশে টেকসই হবে না, সারভাইভ করবে না এরা শুধু একই পরিবেশে টিকে থাকবে এবং বংশবিস্তার করবে। সারা বিশ্বে তাকে ছড়িয়ে দিয়ে কার্যকর করে দিতে চাইলে বৈশিষ্ট্যে নানা মাত্রা যুক্ত করতে হবে। আর আমরা কোথায় কোথায় বেশি ধ্বংসটা চাইছি তাও মিসাইল টেকনোলজির মাধ্যমে স্থির করে দিতে হবে। এসো আমার সঙ্গে।
স্টুপিড রোবট-১ অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে সম্ভাব্য সংক্রমণ মানচিত্র তৈরি করে ইউরোপ আমেরিকার আক্রমণের এগ্রেসিভ মুভ অব অ্যাকশনটা দেখিয়ে দেয়। পুটনোটে আবহাওয়া ও পরিবেশ বিবেচনায় রেখে ভাইরাসগুলোর রূপ এবং গুণাগুণ পাল্টে দেয়া হয়।
স্টুপিড-২ তাদের নিয়ে যায় তার কম্পিউটারে। সেখানে আরো বিচিত্রভাবে সংক্রমণের মানচিত্র চিহ্নিত করা আছে। ইউরোপ, আমেরিকা এবং আফ্রিকাকে রাখা হয়েছে রেড জোনে। তবে সারা বিশ্বেই সংক্রমণ এলাকা হিসেবে কমান্ড এরিয়া ঘোষিত। সবুজ এলাকাগুলো কীভাবে নীল থেকে কমলা এবং পরে লাল বর্ণ ধারণ করছে- এখানে তা স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বব্যাপী অভিযানের নানা ভৌগোলিক মানচিত্রে চিহ্নিত দৃশ্যের সঙ্গে এসব দৃশ্যের মিল রয়েছে। এছাড়া সমস্ত প্রোগ্রামটা এমনভাবে সেট করা আছে যে, মাঠের সঙ্গে ল্যাব কম্পিউটারের যোগাযোগটা ঘটছে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
সাত.
কয়েক দিন পর চীন নিজের দেশের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। নতুন সংক্রমণ নেই বললেই চলে। চীন এখন বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। অবস্থা ভয়াবহ। চীনের আর্থিক ক্ষতি কম হয়নি। অর্থনৈতিক ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে তৎপর হয়ে ওঠে চীনের অর্থ প্রশাসন।
সাঙসি এ উদ্দেশ্যে কমিটির একটা বৈঠক আহ্বান করলেন। বৈঠকে চীনে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হলো। বিশ্বব্যাপী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য যারা চীনকে দূষছেন তাদের সমালোচনা করা হলো। পাশাপাশি সবাইকে চমকে দিয়ে সাঙসি বললেন, জেনারেল করোনাকে আবার কমান্ডার ইন চিফের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হোক।
চমকে উঠলেও কেউ তার কারণ জানতে চাইলেন না। সাঙসি আবার বললেন, অর্থনৈতিক মন্দায় আমরা পড়েছি সন্দেহ নেই। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকা খাদে পড়েছে। হাতি খাদে পড়লে আর উঠতে পারে না, আমেরিকার এখন সে দশা। বাকি দুনিয়ার অবস্থাও ভালো না। আমি তোমাদের সার্স ভাইরাসের সময়ে সিঙ্গাপুর যা করেছিল যে কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। ওরা প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন) তৈরি করেই বড়লোক হয়ে যায়।
একজন সদস্য প্রশ্ন করলেন, আমরা কি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছি।
আহ, প্রশ্ন কেন কর? শুনে যাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে ইতালির পর করোনার মূল কেন্দ্র হবে আমেরিকা। ট্রাম্প প্রকারান্তরে তা স্বীকার করেও নিয়েছেন। তাতে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো তার অসহায়ত্বও প্রকাশ পেয়েছে। পার্থক্য শুধু দেখা গেছে, ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো ট্রাম্প কান্নাকাটি করেননি।
এবার আমরা কাজের কথায় আসি। আজ থেকে হুবেই প্রদেশের লকডাউন তুলে নেয়া হলো। প্রাচ্যে একটা কথা চালু আছে- ‘মানুষ যেখানে আছাড় খায়, সেখানেই উঠে দাঁড়ায়।’ আমরা উহান থেকেই উঠে দাঁড়াব। এতদিন যা মনের ভেতর ছিল তাই বলছি, বিশ্ব অর্থনীতির ১ নম্বর স্থানটি আমাদের চাই। করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমাদের হাতে। বিধ্বস্ত বিশ্ববাজার আমাদের ইশারায় ওঠা-নামা করবে। এ সম্পর্কে কেন্দ্র থেকে নিশ্চয়ই নির্দেশনা আসবে। আমাদের পরিকল্পনার বাইরে করোনার ক্ষেত্রে দৈবক্রমে যা ঘটে গেছে তাকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। কথায় আছে যা ঘটে তা ভালোর জন্যই ঘটে।
আমাদের কী করতে হবে? জেনারেল মাওঝেন প্রশ্ন করলেন। সাঙসি বললেন, আমরা এখন ল্যাবে যাব। বন্ধ ল্যাব আবার চালু করতে হবে। স্টুপিড রোবটগুলোকেই কাজে লাগাতে হবে। ল্যাবের দু’জন অণুজীব বিজ্ঞানীকে ধরে আনা হয়েছে। এরা সম্প্রতি বিয়ে করেছে। তারা ভুলের জন্য পালিয়ে ছিল। এরকম ভুল আবার করবে। অতীতে অনেক ভুলই ভালো কিছুর জন্ম দিয়েছে। তাদের ভুলগুলো এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে আমাদের। এখন তোমরা আমার সঙ্গে এসো।
আট.
তোমার কি মনে হয়, এরা কি আমাদের হত্যা করবে?
ওলানের প্রশ্নের জবাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে এলেন সি-পিং। তার হাত ধরলেন। বললেন, সাহস রাখো, মরলে দুজনই একসাথে মরব।
মৃত্যুটা এ সময়ে আমি চাই না। জীবনের স্বাদ যখন পেতে শুরু করেছি তখনই মৃত্যু, তা কেন হবে। এটা অন্যায়।
তার ওপর তো আমাদের হাত নেই। যাদের হাত আছে এরা নিষ্ঠুর, চরম নিষ্ঠুর।
এ সময় এদের ডাক এলো। এরা আবেগে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। একজন আরেকজনের হাত শক্তভাবে ধরলেন এবং দৃঢ়পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন। যেন ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছেন।
কিন্তু অবাক হলেন এরা। অদ্ভুত ব্যাপার। তাদের প্রতি কোনো নিষ্ঠুরতা দেখানো হলো না। দুর্ব্যবহারও না। সাঙসি শান্ত গলায় বললেন, বিয়ের জন্য অভিনন্দন। আমাদেরকে অনুসরণ কর। ল্যাবে যেতে হবে।
ল্যাবরেটরির দরজা খুলে সবাই অবাক হয়ে গেলেন।রোবটগুলোর দুটি কম্পিউটারে বিলিয়াড খেলছে। আরেকটি মাথার নিচে দু’হাত দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে এক পায়ের ওপর অন্য পা রেখে চোখ বুজে কী যেন ভাবছে।
সাঙসি বললেন, এ্যাবসার্ড নাটকের কুশীলবদের মতো অর্থহীন খেলা আর ভাবনা ছেড়ে আসল কাজে মন দাও। এখন তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সময়।
এরা আসলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেই রেখেছে। কম্পিউটার টাচ করতেই দেখা গেল জেনারেল করোনা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তার কাঁধে ফিল্ড মার্শাল জেনারেলের ব্যাজও শোভা পাচ্ছে। এর আগে থেকেই তা সেট করে রেখেছে। আস্কারা পেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ফ্রন্টে করোনা বিস্তারের একটি যুদ্ধ মানচিত্র তুলে ধরল সকলের সামনে।
দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল প্রোগ্রামটা এরা বেশ কয়েক দিন ধরেই করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের কর্মক্ষেত্র। আক্রান্ত এলাকাগুলো লাল কালি, আক্রান্ত হয়নি এমন এলাকা সবুজ কালি এবং আক্রান্ত হতে যাচ্ছে এমন এলাকাগুলো চিহ্নিত নীল কালিতে চিহ্নিত। যে এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- তা গাঢ় কালিতে রঙিন করে তোলা হয়েছে। যেমন- আমেরিকা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ।
সাঙসি অবাক হয়ে বললেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানলো কেমন করে যে, ইউরোপের পর আমেরিকাই হবে করোনার মূল কেন্দ্র বা যুদ্ধক্ষেত্র?
কেউ এ কথার উত্তর দিল না। উত্তরের জন্য তিনি এই প্রশ্ন করেনও নি। ল্যাবে কাজের সুবিধার্থে বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। কম্পিউটার মনিটর এবং ক্ষুদ্র ফোকাস লাইটের আলোয় আলো-আঁধারি ভাব। মনিটরের আলো রোবট থেকে সাঙসি পর্যন্ত সকলের মুখে পরিহিত মুখোশ ও নিরাপত্তা পোশাকের ওপর নানা রঙে খেলা করে যাচ্ছে। তা মুখোশের মধ্যেও যেন উপলব্ধি করা যাচ্ছে। সাঙসি তাদের সাফল্যে মুগ্ধ হাসি হাসছেন। তিনি সাধারণত হাসেন না।
হঠাৎ খবর পাওয়া গেল রেড আর্মির লোকেরা ডক্টর লি ওয়েনলিয়াঙ নামে একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি ল্যাব থেকে বাইরে এলেন। মনে একটা বিজয়ীর ভাব। উহানের প্রকৃতি এবং বিকেলের দুরন্ত বাতাস তার মনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। রেড আর্মির লোকেরা বিজ্ঞানীকে তার সামনে নিয়ে এলো। বিজ্ঞানীর চোখেমুখে আবিষ্কারের গর্ব লেকের স্বচ্ছ সুন্দর জলের মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
রেড আর্মির লোকদের অভিযোগ, এ ব্যক্তি করোনার ওষুধ আবিষ্কারের দাবি করছে এবং তা বাজারে ছেড়ে দিয়েছে।
সাঙসি জিজ্ঞেস করলেন, কী ওষুধ?
ড. লি উৎসাহ প্রকাশ করে জবাব দিলেন, প্রাকৃতিক ওষুধ। পাঁচ হাজার বছর আগে বিখ্যাত চিকিৎসক ডিভাইন হিলার শ্যান নাঙ যা আবিষ্কার করেছিলেন। তখন আরাধনার অনুষঙ্গ ছিল চা। চায়ের ধোঁয়া ভাবজগতে পৌঁছে দিত আরাধনাকারীকে। গন্ধ এবং স্বাদ স্বর্গীয়, অনুভূতি এনে দিত। যেমন কবে নৈশকালে অন্ধকারে বকুল ফুলের গন্ধ অনুসরণ করে দর্শনার্থীরা চেয়ারম্যান মাওয়ের কাছে পৌঁছে যেত।
সাঙসির রাগ হলো ড. লির এত কথা শুনে। শক্ত কণ্ঠে বললেন, ওষুধ সম্পর্কে বলুন।
চায়ের মধ্যে রয়েছে তিনটি কার্যকর উপাদান : থিয়োব্রোমাই, থিয়োফাইলিন এবং মিথাইলজান থিন। এগুলো করোনা আক্রমণরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
প্রতিষেধক না নিরাময় হিসেবে?
দুটোই।
আমরা তা পরীক্ষা করে দেখব। তোমরা তাকে নিয়ে যাও।
ড. লি বড় আশাহত হলেন।
এরা চলে গেলে সাঙসি আবার বললেন, এ তথ্য যেন দুনিয়ার কেউ না জানে। আমরা তার ওপর এই ওষুধের প্রয়োগ করে দেখাব যে, তার আবিষ্কার কার্যকর নয়।
ল্যাব-ইন-চার্জ বললেন, ড. লি তো করোনায় আক্রান্ত নন।
সাঙসি বললেন, আক্রান্ত নন, তো আক্রান্ত হবেন। তার শাস্তি হওয়া উচিত। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওষুধ বাজারজাত করেছেন। আর তিনি কি জানেন চীনের কত বড় ক্ষতি করতে যাচ্ছেন?
দুনিয়ার সব মানুষ পরে জানতে পেরেছে ড. লির মৃত্যু হয়েছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে।
বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২০ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭
আবুল কাসেম
প্রথমে ব্যাপারটা ছিল প্রতীকী। জেনারেল করোনাকে কমান্ডার ইন চিফের ব্যাজ পরিয়ে দিলেন সাঙসি। একটা গোপন বৈঠক শেষে করোনা ভাইরাস সৃষ্টির প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা হাততালির মাধ্যমে এভাবেই শুরু করা হয়।
তাদের উদ্দেশ্য অবশ্য খারাপ ছিল না। গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া তাদের কাছে একটি ভয়াবহ সংবাদ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাগরম প্রশাসন চীনের শক্তিশালী অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে নানা প্রকাশ্য প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি গোপনে এক ধরনের ভাইরাস সৃষ্টি করছে। এ ভাইরাস চীনা অর্থনীতির মূলকেন্দ্র, যেমন উৎপাদন এলাকা এবং বহিঃবাণিজ্য ক্ষেত্রে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাবে। উদ্দেশ্য, মানব মৃত্যু নয়, শ্রমিক ব্যবস্থাপকদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। তাতে উৎপাদন ও বিপণন ব্যাহত হবে। অর্থনীতি দুর্বল হবে।
প্রথমে অবশ্য মার্কিনিদের পরিকল্পনা ছিল কম্পিউটার ভাইরাস ছড়াবার। কম্পিউটার প্রযুক্তিতে চীন তাদের চেয়ে অগ্রসর। বিশেষজ্ঞরা তাই এ পরিকল্পনা বাদ দেন। প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি তাতে ক্ষুব্ধ হন। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীকে ভাইরাস উদ্ভাবনের নির্দেশ দিয়ে দেন।
এ সংবাদ পেয়ে চীনের পলিটব্যুরো সাঙসির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। সামরিক-বেসামরিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির বৈঠকে বসেন সাঙসি। সকলের বক্তব্যের মধ্যে সামরিক জীবাণু অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মাওঝেনের কথা পছন্দ হয় সাঙসির। মাওঝেন বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মার্কিনিরা মারণাস্ত্র হিসেবে ভাইরাস ছড়াবার কথা ভাবছে না। তারা নিষ্ক্রিয় করে দিতে চাইছে চীনা অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে। আমাদের উচিত হবে আক্রমণাত্মক নয়, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়া।
কী করতে চাও তুমি? প্রশ্ন করেন সাঙসি।
মাওঝেন বললেন, ট্রজানহর্সের মতো আমরা একটা জীবাণু অস্ত্র উদ্ভাবন করব।
ট্রজানহর্স? অবাক হলেন সাঙসি, অন্যরা উৎকর্ণ।
হ্যাঁ ট্রজানহর্স, ট্রয়ের যুদ্ধে যা ব্যবহার করা হয়েছিল। আমাদের প্রতিটা অর্থনৈতিক স্থাপনায় এ রকম হর্সের উপস্থিতি থাকবে। মার্কিন ভাইরাস দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসগুলো হর্স থেকে বের হয়ে সেগুলোকে ভক্ষণ করবে।
পলিটব্যুরোর প্রতিনিধি বললেন, খুব মজার তো ব্যাপারটা, সবাই পছন্দ করলেন মাওঝেনের পরিকল্পনা। সাঙসি তা অনুমোদন করে দেন।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের প্রশ্ন এলো। প্রথমেই সাঙসি জানতে চাইলেন, এ অস্ত্র তৈরি হবে কোথায়?
মাওঝেন বললেন, এটি সামরিক অস্ত্র নয় এবং সামরিক যুদ্ধও নয়, অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। তাই বেসামরিক ল্যাবেই এ ভাইরাস সৃষ্টি হতে পারে। এ অণুজীব অস্ত্র উদ্ভাবনের জন্য উপযুক্ত স্থান হবে উহান।
দুই.
উহান হুবেই প্রদেশের রাজধানী। ২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৫৬০ ডিগ্রি আর্দ্রতার উহান সিটি ইয়াংজে নদীর তীরে অবস্থিত। পাহাড়-জঙ্গল হ্রদ আর নানা দৃষ্টিনন্দন ফুল-পাখি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে রেখেছে স্থানটিকে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে এখানে জনপদ সৃষ্টি হয়। ঐতিহ্যবাহী নানা নির্দশন এবং দৃষ্টিনন্দন স্থান বলে সব সময়ই পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে।
২০০৮ সালে চীন সরকার উহানে বায়োলেক প্রতিষ্ঠা করে। এই বায়োলেকে বেশ কয়েকটি পার্কের মধ্যে রয়েছে বায়োইনোভেশন এবং বায়োহেলথ পার্ক। এসব পার্ক মূলত গবেষণা কেন্দ্র। সংরক্ষিত এলাকা।
২০১৯ সাল ছিল উহানে একটি উৎসবের বছর। এ সময়ে এখানে ওয়ার্ল্ড মিলিটারি গেমস-এর আসর বসে। জেনারেল মাওঝেনের পরামর্শে উৎসবের অন্তরালে এখানেই চীন ভাইরাস উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করে।
ভাইরাস আবিষ্কারে ব্যবহার করা হয় অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির রোবট টেকনোলজি। নিয়োজিত করা হয় দক্ষ অণুজীব বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি তিনটি অভিজ্ঞ রোবটকে। এদের নাম দেয়া হয় স্টুপিড রোবট-১, স্টুপিড রোবট-২ এবং স্টুপিড রোবট-৩। এরকম নামকরণ করার কারণ আছে। এরা নির্বোধের মতোই কথা শোনে বলে মনে করা হয়। এছাড়া স্টুপিড শুনতে শুনতে এরা আসলেই স্টুপিড হয়ে যায়।
এদেরকে ট্রজান হর্সের ধারণা দেয়া হয়। অণুজীব বিজ্ঞানী ওলান এবং সি-পিং অণুজীবগুলোর সংস্পর্শের বাইরে থাকাকল্পে (না হয় সংক্রমিত হয়ে এরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে) নির্বোধ বলে কথিত রোবটগুলোকে দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়া ইচ্ছেমতো কাজটি আদায় করে নিতে উদ্যোগী হলেন।
রোবটদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে (শিশুদের যেন ক্লাসে লেখার কাজ দিয়ে) দুই শিক্ষক গল্পে মেতে উঠলেন। এক পর্যায়ে সি-পিং বললেন, তোমার নাম ওলান কেন? খুবই সেকেলে অচল পয়সার মতো।
ওলান এতে কিছু মনে করলেন না। বললেন, আমার বাবা আমেরিকান লেখিকা পার্ল এস, বাকের ‘গুডআর্থ’ উপন্যাসের নায়িকার নামে আমার নাম রেখেছেন। আমরা ঝেনঝিয়াং-এর মানুষ। সেটাই ছিল উপন্যাসটির পটভূমি।
আমি খুবই দুঃখিত ওলান, আমার এ রকম মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। এ নাম তো দেখছি গৌরবময় উর্বরভূমিতে গজানো এক চন্দন বৃক্ষের চারা।
না, না আমি কিছু মনে করিনি। আমার বাবা চেয়েছিলেন বাকের মতো আমিও খ্যাতিমান লেখিকা হয়ে নোবেল-টোবেল পেয়ে যাই, বলে হাসলেন তিনি। পরে বললেন, নোবেল-বুকার পেলেও উপন্যাসটি চীনের মানুষ পছন্দ করেনি।
সি-পিং বললেন, আমিও শুনেছি উপন্যাসটি বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং বাস্তবতা বর্জিত।
লেখিক ছিলেন একজন বিদেশি, নানের মেয়ে, চার দেয়ালে যার বসবাস। হতে পারে গির্জায় বসে তার পক্ষে চীনের মানুষের বাস্তব জীবন এবং এই জীবনের গভীরতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব ছিল না।
আমারও তাই মনে হয়েছে। সি-পিং পরে হেসে দিয়ে আবার বললেন, তোমার কি কোনো ওয়াংলাঙের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে? না, দুর্ভাগ্য আমার। বলে হাসল ওলান। এটা দুর্ভাগ্য নয়, এই ৩৫ বছরেও আমার কোনো ওলানের সঙ্গে পরিচয় হয়নি।
এখন তো হলো। বলে কেমন যেন লজ্জা পেলেন ওলান। সি-পিং এগিয়ে এসে তার হাত ধরলেন। উহানের দুরন্ত বাতাস যেন ওলানের মাথার লম্বা চুলের মতো মনকেও এলোমেলো করে দিল।
তিন.
অণুজীব বিজ্ঞানীদের দেয়া নামটি রোবটদের পছন্দ হয়নি। কারণ এদের হিউম্যান
সেন্সাবিলিটি বা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। অণুজীব বিজ্ঞানীদের তা জানা ছিল না। রোবটগুলো যারা বাছাই করেছেন, তারাই ভুল করেছেন। এ রোবটগুলো মোটেই অথর্ব নয়, খুবই বুদ্ধিমান। এরা অপমানবোধ থেকে অণুজীব বিজ্ঞানীদের বেঁধে দেয়া ফরমুলা বাদ দিয়ে তাদের ভেতর স্টোর করা তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে যায় অবাক করা সব তথ্য। সূর্যপৃষ্ঠের করোনার কথা। সেইন্ট করোনাকে শত শত বছর ধরে মনে করা হয় মহামারীর সেইন্ট। করোনা শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ক্রাউন থেকে- যার অর্থ মুকুট। সেইন্ট করোনা ছিলেন একজন খ্রিস্টান, যাকে দ্বিতীয় শতকে হত্যা করা হয়। করোনার ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একটি হুমকি। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম কুয়েত দখলের পর বুশ সাদ্দামকে বলেছিলেন কুয়েত ছাড়, নইলে করোনা দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে ইরাককে।
সেটি ৩০ বছর আগের কথা।
এই সূত্রে এরা আমেরিকার তথ্যভাণ্ডারে ঢুকে পড়ল। স্টুপিট রোবট-২ বলল এত পুরোনো তথ্য পাওয়া কঠিন হবে।
স্টুপিড রোবট-৩ কোনো কথা না বলে চেষ্টা চালাল। কিছুক্ষণ পর প্রায় চেঁচিয়ে বলল পেয়ে গেছি।
অন্য দুটি দৌড়ে এলো তার কাছে। সত্যিই পাওয়া গেছে। তবে এগুলো এত আগের যে সব কিছু বুঝে ওঠা কঠিন। তবু এরা আশাবাদী। কাজে লেগে গেল।
এ পর্যন্ত ছয়টি করোনার পরিচয় পাওয়া গেছে। আমেরিকান করোনাটি প্রথম এবং ষষ্ঠটি পর্যন্ত এসবের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। কোনো কোনোটি এখনও টিকে আছে। দুটি (পঞ্চম ও ষষ্ঠ)কে নিয়ে পশ্চিমারা সিনেমা পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে। রোবটগুলো পূর্ববর্তী করোনাগুলোর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতি বিবেচনা করে প্রথম, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ করোনার জ্ঞান কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠল। প্রথমে এরা হোস্ট সেলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত অণুগুলো ভেঙে জেনোম সিকোয়েন্সিং এক মাধ্যমে আরএনএ ভাইরাস সৃষ্টি করে মিউটেশনে মডিফাইড নতুন জেনারেশন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়ে যায়। ল্যাবের পরীক্ষায় তার রেপ্লিকেশনও সম্ভব হয়। সংক্রমণ এবং বংশবিস্তারের ঘটনা এদের উল্লসিত করে তোলে। এভাবেই এরা অণুুজীব বিজ্ঞানীদের চোখে ধুলো দিয়ে সৃষ্টি করে এমন এক মডিফাইড করোনাভাইরাস, যা মারাত্মক মারমুখী, বংশবিস্তারে সক্ষম এবং কয়েকটি করোনার সমন্বয়ে সৃষ্ট বলে স্থান কাল ও অবস্থা ভেদে রূপ ও প্রকৃতি পরিবর্তনে সক্ষম।
এরা কম্পিউটার ল্যাবে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণি, পিপীলিকার একটি বিগ্রহ এঁকে তার মুখে তার ১০ গুণ ওজনের একটি পতঙ্গ তুলে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখাতে চাইল, যার বেশি ওজনই হোক সে শুধু একটি বস্তুর ভারই বহন করতে পারে। বোঝাতে চাইল সকল প্রাণিই একটিমাত্র জীবকোষ পরিবাহী, মানুষ তার ব্যতিক্রম। তাকে এ ভাইরাস বহন করতে দিলে তা দ্রুত ছড়াবে। তাই এরা মানুষকেই ভাইরাস ছড়াবার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির প্রকাশ ঘটে করমর্দন, কোলাকুলি এবং চুম্বনের মাধ্যমে। এরা এ তিনটি ব্যাপারকেই সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। অন্যসব ভাইরাস সংক্রমণ ঘটায় বাতাসে, রক্তে কিংবা খাবারে। এ ভাইরাস ব্যতিক্রম। মানুষের মাধ্যমে সমগ্র মানুষের বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযান। পারমাণবিক শক্তির চাইতেও এই ভাইরাসের শক্তি অনেক বেশি। পরমাণু বোমা ধ্বংস করে একটি নির্দিষ্ট এলাকা। আর করোনার কমান্ড এরিয়া একই সঙ্গে সারা বিশ্ব।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অণুজীব বিজ্ঞানীদের কাছে গোপন রাখা হয়েছে। তারা জানে স্টুপিড রোবটগুলো তাদের কমান্ড মেনে আমেরিকার ভাইরাসভুক অহিংস মিউটেশন সৃষ্টি করে সাফল্য পেতে যাচ্ছে। রোবটগুলো যখন দেখিয়ে দিল যে, নানা রকম পরিবেশে ভাইরাসগুলো শুধু সারভাইভ-ই করছে না, তাদের প্রকৃতি, চরিত্র এবং কার্যকারিতার মধ্যেও পরিবর্তন ঘটছে এবং বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রজন্মের মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠছে, অণুজীব বিজ্ঞানীরা তখন এই আবিষ্কারের মধ্যে নিজেদের সাফল্য খুঁজে পেলেন। ওলান এ সাফল্যে শিপিংকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অভিনন্দন তোমাকে। জবাবে শিপিং ওলানের গালে একটা চুম্বন একে দিয়ে বললেন, আমাকে কি এখন ওয়াং লাঙ ভাবতে আপত্তি আছে?
ওলান অপ্রস্তুত হয়ে শুধু হাসলেন। এ হাসি লজ্জা মিশ্রিত।
চার.
এখন ভাইরাসটির বাস্তব কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সময়। ল্যাবের বাইরে উন্মুক্ত করে দিতেই ঘটে যত বিপত্তি। কোনো ভাইরাসই ট্রজানহর্স থেকে বের হয়ে শত্রু ভাইরাসকে ভক্ষণ করছে না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আরও দেখা গেল এ ভাইরাসগুলো পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ এবং প্রাণঘাতী হানাহানিতে লিপ্ত। শান্ত সুবোধ চরিত্রের বদলে পেয়েছে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি। তাই ট্রজানহর্সে ফিরে না এসে লাফিয়ে লাফিয়ে নানা জায়গায় পালিয়ে থাকছে।
বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন অণুুজীব বিজ্ঞানীরা। রোবটদের কাজকর্ম পরীক্ষা করলেন। রোবটগুলো নির্বোধের অভিনয়ই করল। নিজেদের দুষ্টু বুদ্ধির কথা একেবারেই বুঝতে দিল না। বিজ্ঞানীরা সাব্যস্ত করলেন রোবটদের দিয়েই কাজটা আবার করাবেন। হয়ত কোথাও ভুল হয়েছে। সন্দেহটা রোবটদের ওপরই। সি পিং রাগ করে বললেন, তোদের স্টুপিড নাম দেয়া একদম ঠিক হয়েছে। অপদার্থের দল। রোবটেরা অর্থপূর্ণভাবে শুধু পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ী করল।
কাজটা পুনরায় করার সময় প্রযুক্তিগতভাবে রোবটগুলো আরও অগ্রসর হয়ে যায়। অণুজীবগুলোর মধ্যে এরা বাড়তি কিছু শক্তি যুক্ত করে। মানব জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রোবটগুলো কৃতার্থবোধ করে। ছয় প্রজন্মের দায়ভার যেন ‘মুকুটমনি’ নামধারী এই সাত নম্বর ভাইরাসটির কাঁধে চেপে বসেছে।
দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায়ও একই ফল পাওয়া গেল। এবারে অণুজীব বিজ্ঞানীরা আর ক্ষিপ্ত হলেন না। ব্যর্থতার দায়ে তাদের কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু উপায় কী। ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য এরা পজিটিভ ফলাফল দেখিয়ে সাঙসির কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন। রিপোর্টের নিচে বি. দ্র. বলে ভাইরাসগুলো সময়ে সময়ে রূপ ও প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে- এ কথা লিখে দিলেন।
তারপরই সাঙসি জেনারেল করোনাকে কমান্ডার-ইন-চিফ-এর ব্যাজ পরিয়ে দেন। প্রত্যাশা, এই জেনারেল তার দলবল নিয়ে ভাইরাস যুদ্ধে আমেরিকার ভাইরাসগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। এসবের মধ্য দিয়ে ১৫ দিন কেটে গেছে। পালিয়ে যাওয়া ভাইরাসের কতগুলো অণুজীব বিজ্ঞানীদের পোশাকে আশ্রয় করে ১৪ দিন আগে উহান মার্কেটে চলে যায়। এরা অণুজীব বিজ্ঞানীদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারেনি, কারণ এরা পিপিই ব্যবহার করেছিলেন। বাজারে গিয়ে তারা যাদের সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন ওদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। ইনকিউবেশনের ঠিক ১৫ দিন পর সংক্রমণের আলামত দেখা যেতে শুরু করে, মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় এবং ব্যাপকহারে মারা যেতে থাকে।
চীন আত্মরক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে। সাঙসি নিজে অণুজীব বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা বলেন যে, রিপোর্টেই আছে ভাইরাসটি রূপ এবং প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। সুপারভিশন যারা করছিলেন সাঙসি তাদের একচোট নিলেন। বললেন, পরিণতির জন্য সবাই অপেক্ষা কর। অণুজীব বিজ্ঞানীরা উহান নগরী ত্যাগ করে পালিয়ে ঝেনঝিয়াং প্রদেশে চলে যান।
পাঁচ.
চীন ভাইরাসজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠলেও আসল সত্য গোপন করে যায়। ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারটি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানোর নিয়ম থাকলেও চীন তা জানায় প্রায় এক মাস পর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের নাম দেয় কোভিড-১৯।
চীন উহানের ল্যাবটি বন্ধ করে দেয়। যথারীতি রোবটগুলো তখনও ল্যাবরেটরিতে অবস্থান করছিল। এখানে এরা বসে না থেকে কম্পিউটার মনিটরে ভাইরাসগুলোর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে। ভাইরাসগুলো তাদের পরিকল্পনা মতো কাজ করছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। চীনের নতুন ভাইরাস শনাক্ত হয় ৭ জানুয়ারি। প্রথম মৃত্যু ৯ জানুয়ারি চীনের বাইরে, থাইল্যান্ডে ১৩ জানুয়ারি। প্রথম মৃত্যু চীনের বাইরে, ফিলিপাইনে ২ ফেব্রুয়ারি। কম্পিউটারে সবই রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত সংখ্যার চাইতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ সংখ্যাটা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
ল্যাব বন্ধ থাকা অবস্থায় সাঙসি ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি উপলব্ধি করে জেনারেল করোনার ব্যাজ খুলে নিয়ে তাকে কমান্ডচ্যুত করেন।
এদিকে অণুজীব বিজ্ঞানী ওলান এবং সি-পিং ঝেনঝিয়াং-এ পৌঁছেই পরস্পরকে বিয়ে করে ফেলেন। তাদের কেন যেন মনে হতে থাকে চীন প্রশাসন তাদের খুঁজে বের করবেই এবং যথারীতি মৃত্যুদণ্ড দেবে। যে ক’টা দিন বেঁচে আছেন প্রেম আর বিবাহিত জীবনের স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। আরেকটি ভয়ও আছে, সংক্রমণ। তাতেও নির্ঘাত মৃত্যু। মৃত্যু নিয়ে চীন মিথ্যে বলছে। কারও রক্ষা নেই। তাই ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের নায়ক-নায়িকার মতো একসঙ্গে জড়াজড়ি করে মরতে চান। এটা স্পষ্ট মৃত্যু তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করছে। তাই এরা ভোগ-উপভোগে বেপরোয়া।
ছয়.
রোবটগুলোর ভূমিকা আগ্রাসী ধরনের। এরা করোনার শক্তি বাড়াতে নানা মাত্রা যুক্ত করতে থাকে। পৃথিবীর মানচিত্র দেখে দেখে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা বিবেচনায় বেশ কয়েকটি সংস্করণ তৈরি করে। স্টুপিড-৩ একটি গেম বানাচ্ছে। সে বলল, করোনার এতগুলো সংস্করণ কেন?
তুমি কী করছ? স্টুপিড-১ প্রশ্ন করে।
গেম বানাচ্ছি।
দেখি দেখি।
দেখা যাচ্ছে চীন ছেড়ে ভাইরাসগুলো প্লেনে চেপে মানবদেহের মধ্য দিয়ে কীভাবে চীনের বাইরে অভিযান করেছে। বিভিন্ন দেশে সংক্রমণটা দেখাচ্ছে সবুজ কতগুলো বলের মধ্যে লাল দুটো বলের সংঘর্ষ ঘটিয়ে লাল বলগুলো সবুজ বলগুলোকে টোকা মেরে লাল করে দিয়ে নিজের দলে টানছে এবং তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় একশ’ ভাগে তা উন্নীত হয়।
আইডিয়াটা মন্দ না। তবে একই বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস সকল পরিবেশে টেকসই হবে না, সারভাইভ করবে না এরা শুধু একই পরিবেশে টিকে থাকবে এবং বংশবিস্তার করবে। সারা বিশ্বে তাকে ছড়িয়ে দিয়ে কার্যকর করে দিতে চাইলে বৈশিষ্ট্যে নানা মাত্রা যুক্ত করতে হবে। আর আমরা কোথায় কোথায় বেশি ধ্বংসটা চাইছি তাও মিসাইল টেকনোলজির মাধ্যমে স্থির করে দিতে হবে। এসো আমার সঙ্গে।
স্টুপিড রোবট-১ অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে সম্ভাব্য সংক্রমণ মানচিত্র তৈরি করে ইউরোপ আমেরিকার আক্রমণের এগ্রেসিভ মুভ অব অ্যাকশনটা দেখিয়ে দেয়। পুটনোটে আবহাওয়া ও পরিবেশ বিবেচনায় রেখে ভাইরাসগুলোর রূপ এবং গুণাগুণ পাল্টে দেয়া হয়।
স্টুপিড-২ তাদের নিয়ে যায় তার কম্পিউটারে। সেখানে আরো বিচিত্রভাবে সংক্রমণের মানচিত্র চিহ্নিত করা আছে। ইউরোপ, আমেরিকা এবং আফ্রিকাকে রাখা হয়েছে রেড জোনে। তবে সারা বিশ্বেই সংক্রমণ এলাকা হিসেবে কমান্ড এরিয়া ঘোষিত। সবুজ এলাকাগুলো কীভাবে নীল থেকে কমলা এবং পরে লাল বর্ণ ধারণ করছে- এখানে তা স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বব্যাপী অভিযানের নানা ভৌগোলিক মানচিত্রে চিহ্নিত দৃশ্যের সঙ্গে এসব দৃশ্যের মিল রয়েছে। এছাড়া সমস্ত প্রোগ্রামটা এমনভাবে সেট করা আছে যে, মাঠের সঙ্গে ল্যাব কম্পিউটারের যোগাযোগটা ঘটছে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
সাত.
কয়েক দিন পর চীন নিজের দেশের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। নতুন সংক্রমণ নেই বললেই চলে। চীন এখন বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। অবস্থা ভয়াবহ। চীনের আর্থিক ক্ষতি কম হয়নি। অর্থনৈতিক ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে তৎপর হয়ে ওঠে চীনের অর্থ প্রশাসন।
সাঙসি এ উদ্দেশ্যে কমিটির একটা বৈঠক আহ্বান করলেন। বৈঠকে চীনে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হলো। বিশ্বব্যাপী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য যারা চীনকে দূষছেন তাদের সমালোচনা করা হলো। পাশাপাশি সবাইকে চমকে দিয়ে সাঙসি বললেন, জেনারেল করোনাকে আবার কমান্ডার ইন চিফের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হোক।
চমকে উঠলেও কেউ তার কারণ জানতে চাইলেন না। সাঙসি আবার বললেন, অর্থনৈতিক মন্দায় আমরা পড়েছি সন্দেহ নেই। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকা খাদে পড়েছে। হাতি খাদে পড়লে আর উঠতে পারে না, আমেরিকার এখন সে দশা। বাকি দুনিয়ার অবস্থাও ভালো না। আমি তোমাদের সার্স ভাইরাসের সময়ে সিঙ্গাপুর যা করেছিল যে কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। ওরা প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন) তৈরি করেই বড়লোক হয়ে যায়।
একজন সদস্য প্রশ্ন করলেন, আমরা কি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছি।
আহ, প্রশ্ন কেন কর? শুনে যাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে ইতালির পর করোনার মূল কেন্দ্র হবে আমেরিকা। ট্রাম্প প্রকারান্তরে তা স্বীকার করেও নিয়েছেন। তাতে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো তার অসহায়ত্বও প্রকাশ পেয়েছে। পার্থক্য শুধু দেখা গেছে, ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো ট্রাম্প কান্নাকাটি করেননি।
এবার আমরা কাজের কথায় আসি। আজ থেকে হুবেই প্রদেশের লকডাউন তুলে নেয়া হলো। প্রাচ্যে একটা কথা চালু আছে- ‘মানুষ যেখানে আছাড় খায়, সেখানেই উঠে দাঁড়ায়।’ আমরা উহান থেকেই উঠে দাঁড়াব। এতদিন যা মনের ভেতর ছিল তাই বলছি, বিশ্ব অর্থনীতির ১ নম্বর স্থানটি আমাদের চাই। করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমাদের হাতে। বিধ্বস্ত বিশ্ববাজার আমাদের ইশারায় ওঠা-নামা করবে। এ সম্পর্কে কেন্দ্র থেকে নিশ্চয়ই নির্দেশনা আসবে। আমাদের পরিকল্পনার বাইরে করোনার ক্ষেত্রে দৈবক্রমে যা ঘটে গেছে তাকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। কথায় আছে যা ঘটে তা ভালোর জন্যই ঘটে।
আমাদের কী করতে হবে? জেনারেল মাওঝেন প্রশ্ন করলেন। সাঙসি বললেন, আমরা এখন ল্যাবে যাব। বন্ধ ল্যাব আবার চালু করতে হবে। স্টুপিড রোবটগুলোকেই কাজে লাগাতে হবে। ল্যাবের দু’জন অণুজীব বিজ্ঞানীকে ধরে আনা হয়েছে। এরা সম্প্রতি বিয়ে করেছে। তারা ভুলের জন্য পালিয়ে ছিল। এরকম ভুল আবার করবে। অতীতে অনেক ভুলই ভালো কিছুর জন্ম দিয়েছে। তাদের ভুলগুলো এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে আমাদের। এখন তোমরা আমার সঙ্গে এসো।
আট.
তোমার কি মনে হয়, এরা কি আমাদের হত্যা করবে?
ওলানের প্রশ্নের জবাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে এলেন সি-পিং। তার হাত ধরলেন। বললেন, সাহস রাখো, মরলে দুজনই একসাথে মরব।
মৃত্যুটা এ সময়ে আমি চাই না। জীবনের স্বাদ যখন পেতে শুরু করেছি তখনই মৃত্যু, তা কেন হবে। এটা অন্যায়।
তার ওপর তো আমাদের হাত নেই। যাদের হাত আছে এরা নিষ্ঠুর, চরম নিষ্ঠুর।
এ সময় এদের ডাক এলো। এরা আবেগে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। একজন আরেকজনের হাত শক্তভাবে ধরলেন এবং দৃঢ়পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন। যেন ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছেন।
কিন্তু অবাক হলেন এরা। অদ্ভুত ব্যাপার। তাদের প্রতি কোনো নিষ্ঠুরতা দেখানো হলো না। দুর্ব্যবহারও না। সাঙসি শান্ত গলায় বললেন, বিয়ের জন্য অভিনন্দন। আমাদেরকে অনুসরণ কর। ল্যাবে যেতে হবে।
ল্যাবরেটরির দরজা খুলে সবাই অবাক হয়ে গেলেন।রোবটগুলোর দুটি কম্পিউটারে বিলিয়াড খেলছে। আরেকটি মাথার নিচে দু’হাত দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে এক পায়ের ওপর অন্য পা রেখে চোখ বুজে কী যেন ভাবছে।
সাঙসি বললেন, এ্যাবসার্ড নাটকের কুশীলবদের মতো অর্থহীন খেলা আর ভাবনা ছেড়ে আসল কাজে মন দাও। এখন তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সময়।
এরা আসলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেই রেখেছে। কম্পিউটার টাচ করতেই দেখা গেল জেনারেল করোনা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তার কাঁধে ফিল্ড মার্শাল জেনারেলের ব্যাজও শোভা পাচ্ছে। এর আগে থেকেই তা সেট করে রেখেছে। আস্কারা পেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ফ্রন্টে করোনা বিস্তারের একটি যুদ্ধ মানচিত্র তুলে ধরল সকলের সামনে।
দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল প্রোগ্রামটা এরা বেশ কয়েক দিন ধরেই করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের কর্মক্ষেত্র। আক্রান্ত এলাকাগুলো লাল কালি, আক্রান্ত হয়নি এমন এলাকা সবুজ কালি এবং আক্রান্ত হতে যাচ্ছে এমন এলাকাগুলো চিহ্নিত নীল কালিতে চিহ্নিত। যে এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- তা গাঢ় কালিতে রঙিন করে তোলা হয়েছে। যেমন- আমেরিকা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ।
সাঙসি অবাক হয়ে বললেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানলো কেমন করে যে, ইউরোপের পর আমেরিকাই হবে করোনার মূল কেন্দ্র বা যুদ্ধক্ষেত্র?
কেউ এ কথার উত্তর দিল না। উত্তরের জন্য তিনি এই প্রশ্ন করেনও নি। ল্যাবে কাজের সুবিধার্থে বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। কম্পিউটার মনিটর এবং ক্ষুদ্র ফোকাস লাইটের আলোয় আলো-আঁধারি ভাব। মনিটরের আলো রোবট থেকে সাঙসি পর্যন্ত সকলের মুখে পরিহিত মুখোশ ও নিরাপত্তা পোশাকের ওপর নানা রঙে খেলা করে যাচ্ছে। তা মুখোশের মধ্যেও যেন উপলব্ধি করা যাচ্ছে। সাঙসি তাদের সাফল্যে মুগ্ধ হাসি হাসছেন। তিনি সাধারণত হাসেন না।
হঠাৎ খবর পাওয়া গেল রেড আর্মির লোকেরা ডক্টর লি ওয়েনলিয়াঙ নামে একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি ল্যাব থেকে বাইরে এলেন। মনে একটা বিজয়ীর ভাব। উহানের প্রকৃতি এবং বিকেলের দুরন্ত বাতাস তার মনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। রেড আর্মির লোকেরা বিজ্ঞানীকে তার সামনে নিয়ে এলো। বিজ্ঞানীর চোখেমুখে আবিষ্কারের গর্ব লেকের স্বচ্ছ সুন্দর জলের মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
রেড আর্মির লোকদের অভিযোগ, এ ব্যক্তি করোনার ওষুধ আবিষ্কারের দাবি করছে এবং তা বাজারে ছেড়ে দিয়েছে।
সাঙসি জিজ্ঞেস করলেন, কী ওষুধ?
ড. লি উৎসাহ প্রকাশ করে জবাব দিলেন, প্রাকৃতিক ওষুধ। পাঁচ হাজার বছর আগে বিখ্যাত চিকিৎসক ডিভাইন হিলার শ্যান নাঙ যা আবিষ্কার করেছিলেন। তখন আরাধনার অনুষঙ্গ ছিল চা। চায়ের ধোঁয়া ভাবজগতে পৌঁছে দিত আরাধনাকারীকে। গন্ধ এবং স্বাদ স্বর্গীয়, অনুভূতি এনে দিত। যেমন কবে নৈশকালে অন্ধকারে বকুল ফুলের গন্ধ অনুসরণ করে দর্শনার্থীরা চেয়ারম্যান মাওয়ের কাছে পৌঁছে যেত।
সাঙসির রাগ হলো ড. লির এত কথা শুনে। শক্ত কণ্ঠে বললেন, ওষুধ সম্পর্কে বলুন।
চায়ের মধ্যে রয়েছে তিনটি কার্যকর উপাদান : থিয়োব্রোমাই, থিয়োফাইলিন এবং মিথাইলজান থিন। এগুলো করোনা আক্রমণরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
প্রতিষেধক না নিরাময় হিসেবে?
দুটোই।
আমরা তা পরীক্ষা করে দেখব। তোমরা তাকে নিয়ে যাও।
ড. লি বড় আশাহত হলেন।
এরা চলে গেলে সাঙসি আবার বললেন, এ তথ্য যেন দুনিয়ার কেউ না জানে। আমরা তার ওপর এই ওষুধের প্রয়োগ করে দেখাব যে, তার আবিষ্কার কার্যকর নয়।
ল্যাব-ইন-চার্জ বললেন, ড. লি তো করোনায় আক্রান্ত নন।
সাঙসি বললেন, আক্রান্ত নন, তো আক্রান্ত হবেন। তার শাস্তি হওয়া উচিত। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওষুধ বাজারজাত করেছেন। আর তিনি কি জানেন চীনের কত বড় ক্ষতি করতে যাচ্ছেন?
দুনিয়ার সব মানুষ পরে জানতে পেরেছে ড. লির মৃত্যু হয়েছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে।