ভারতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ে প্রশ্ন

পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর হার কম দেখানো হচ্ছে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মে মাসেই করোনা সংক্রমণ ৬৪ লাখ ছাড়িয়েছে : আইসিএমআর

বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত ১৩০ কোটি মানুষের বাস। করোনা আক্রান্তে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং মৃত্যুর হারে তৃতীয় স্থানে ভারত। অন্যান্য দেশে ১শ’ জন করোনা রোগী শনাক্তে মৃত্যুর হারের চেয়ে কয়েকগুণ কম মৃত্যুর হার ভারতে। মৃত্যুর হার নিয়ে ভারত জুড়ে এক রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকারের করোনাভাইরাসের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশটির জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, করোনা নমুনার যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না। ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে করোনার মৃত্যুর হার কম দেখাচ্ছে।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ভারতে যে হারে করোনা সংক্রমিত হচ্ছে, একই হারে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত হয়ে ৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ইতালিতে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন। এছাড়াও দৈনিক আমেরিকা বা ব্রাজিলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেখানে ৩৯ হাজার এবং ৫৩ হাজার, সেখানে ভারতে ৯৭ হাজারের বেশি। ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেশি হলেও মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যা অনুসারে, মে মাসে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ১৫২ জন। কিন্তু ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের (আইসিএমআর) সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। প্রতিবেদন অনুসারে, মে মাসেই ভারতে মোট সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৬৪ লাখ ছাড়িয়েছে। কলকাতাভিত্তিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে।

জানা গেছে, গত ২৫ মে থেকে টানা ৬৮ দিনের সম্পূর্ণ লকডাউন জারি ছিল ভারতে। কার্যত সেই সময়ে ১১ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত একটি সার্ভে চালায় আইসিএমআর। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে দেশে মোট পূর্ণবয়স্ক সম্ভাব্য আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ লাখ ৬৮ হাজার ৩৮৮। ভারত সরকারি তথ্য অনুসারে, সমীক্ষা শুরুর দিন ১১ মে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার এবং ৪ জুন সমীক্ষার শেষ দিন সেই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার ৯১৯।

ভারতে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান : ভারতের স্বাস্থ্যবিভাগের দাবি, দেশটিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা কমছে। এপ্রিলে ১শ’ জন করোনা আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ৪ শতাংশ, আগস্টে এসে তা কমে ২ দশমিক ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়। সেপ্টম্বরে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তবে ভারতের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্বাস্থ্যবিভাগের দুর্বলতার কারণে করোনার প্রকৃত মৃত্যুর হার সামনে আসছে না। মৃত্যুর হারের পরিসংখ্যান ভুল আছে।

করোনায় মৃত্যুর হার কম হওয়ায় সংকট মোকাবিলায় সাফল্য বয়ে আনবে এমনটি মনে করে আগস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃত্যুর হার দিন দিন কমে আসছে, দ্রুতই ১ শতাংশের নিচে মৃত্যুর হার নেমে আসবে। ভারতে করোনা রোগী মৃত্যুর হার নিয়ে বেশকিছু বিজ্ঞানী সতর্ক করে বলেন, করোনা আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা গরমিল আছে। সরকারের দেয়া তথ্য বিভ্রান্তিকর। এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে ভারতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর)- সার্ভেতে রক্তের সিরাম সংগ্রহ করে ইমিউনোগ্লোবিন জি (আইজিজি) অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়। কারও শরীরে এই অ্যান্টিবডি টেস্ট পজেটিভ হলে অর্থাৎ শরীরে করোনার অ্যান্টিবডির উপস্থিতি থাকলে ধরে নেয়া হয়, অন্তত গত দু’মাসের মধ্যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রায় এক মাস ধরে দেশের ২১টি রাজ্যের ৭০টি জেলার ৭০০টি গ্রাম ও পৌরসভার ওয়ার্ডে সমীক্ষা চালিয়েছিল আইসিএমআর। ৩০ হাজার ২৮৩টি বাড়ি ঘুরে মোট ২৮ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাদের কোভিড ‘এলাইজা’ পদ্ধতিতে টেস্ট করা হয়। তারমধ্যে ২৫৬ জনের রিপোর্ট পজেটিভ এসেছিল। ৬৯ জনের রিপোর্ট নির্ধারণ করা যায়নি। করোনা আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। ১৬ শতাংশ শহরের বস্তি এলাকার এবং বাকি ১৪ শতাংশ শহরাঞ্চলেরই বস্তি ছাড়া অন্য এলাকার। ওই সময়েই গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংক্রমণের হার বেশি। করোনা পজেটিভিটি ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের (৪৩.৩%)। ৩৯.৫ শতাংশ আক্রান্তের বয়স ৪৬ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। আর সংক্রমণের হার সবচেয়ে কম ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে (১৭.২%)।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মার্চ মাসের দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। জুনে করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে মহামারী তীব্র আকার ধারণ করে। পহেলা জুলাই এসে ১০ লাখ করোনা শনাক্ত হয়। এরপর তিন সপ্তাহের মধ্যেই ২০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত। এরপরে মাত্র ১৬ দিনেই ৩০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়। সর্বশেষ সেপ্টম্বর মাসের এই ১২ দিনে ৪০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে।

ভারতের জনবহুল শহর নয়াদিল্লি ও মুম্বাই। করোনার কারণে মার্চ মাসে দু’শহরের লকডাউনে লাখ লাখ মানুষ বাধ্য হয়েই ঘরে বসে ছিলেন। এই পদক্ষেপে অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লে বাধ্য হয়েই মে মাসে লকডাউন তুলে নেয় ভারত সরকার। করোনাকালীন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে জুলাই মাসে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছিলেন, ভারতের অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করা দরকার। কারণ করোনার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, কারখানা বন্ধ ছিল মানুষ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি পড়েছেন। এখন ভারতের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নজর দিতে হবে।

জানা গেছে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর জুলাই মাসেই ভারতে পাতাল রেল চলাচল শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে খেলাধুলা, বিনোদন, সংস্কৃতি, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান চালুর অনুমতি দিয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে ১শ’র বেশি মানুষ সমাগম করতে পারবেন না।

ভারতের কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. হেমন্ত শেওয়াদ বলেছেন, বছরের পর বছর নাগরিকের মৃত্যুর সঠিক রেকর্ড রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত সরকার। দেশব্যাপী ৮৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু নিবন্ধিত হয় না। বিভিন্ন কারণে মাত্র ২২ শতাংশ মৃত্যু নিবন্ধিত হয়। কারণ ভারতে বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হাসপাতালে নয়, বাড়িতে বা অন্য জায়গায় মৃত্যু হচ্ছে। সাধারণ মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের চিকিৎসক সেখানে উপস্থিত থাকছেন না।

ডা. হেমন্ত শেওয়াদ বলেন, মৃত্যুর কারণের মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসিসিডি) ওয়েব সাইটে মৃত্যুর সঠিকভাবে নিবন্ধিত হচ্ছে না। হাসপাতালে মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণে বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের হাসপাতালে এই সমস্যা প্রকট। ভারতের রাজধানী দিল্লিতেই মাত্র ৬৩ শতাংশ মৃত্যুর কারণ নিবন্ধিত হয়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে ৩৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ নিবন্ধিত হয়। অধিকাংশ এলাকায় মানুষের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাচ্ছে না। সুতরাং করোনাভাইরাসে মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র সরকারের পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠেনি।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র গবেষক ডা. রমনান লক্ষ্মী নারায়ণ বলেন, ভারতে অপর্যাপ্ত করোনা নমুনা পরীক্ষা এবং দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে মৃত্যুর হিসাব কম দেখানো হচ্ছে। সুতরং এটি স্পষ্ট যে, অন্য দেশের মতো ভারতেও করোনা রোগীর মৃত্যু বাড়ছে। মুম্বাইয়ে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি বস্তিতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

ডা. রমনান লক্ষ্মী নারায়ণ বলেন, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, আগস্টে ভারতে করোনা নমুনা পরীক্ষা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে এখনও বিশ্বের মাথাপিছু পরীক্ষার সর্বনিম্ব হারের মধ্যে রয়েছে। প্রতিদিন ১ লাখের ওপরে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। ভারত সরকার মোট ৪৯ লাখ করোনা রোগী শনাক্ত করেছে কিন্তু সংখ্যাটি ১০০ কোটির উপরে হতে পারে। আগস্টের শুরুতে একদিনে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫০ জন। চলতি সপ্তাহে লাফিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছেন।

ভারতের জনস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক গিরিধর বাবু বলেন, করোনায় মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে, এটা যদি দেখা না যায় তাহলে ধরে নিতে হবে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর যে সংখ্যা দেখান হচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বিশ্ব জুড়ে যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে ভারতে দেখা যাচ্ছে এক অন্য চিত্র।

ভারতে কত সংখ্যক মানুষ করোনা আক্রান্তে মৃত্যু হয়েছে : ভারত জনবহুল দেশ। করোনায় মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব নয়। স্থানীয়, জেলা এবং রাজ্য সরকার মৃত্যুর কারণ জানতে ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে পারবেন না।

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৬ মহররম ১৪৪২, ২৮ ভাদ্র ১৪২৭

ভারতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ে প্রশ্ন

পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর হার কম দেখানো হচ্ছে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মে মাসেই করোনা সংক্রমণ ৬৪ লাখ ছাড়িয়েছে : আইসিএমআর

সংবাদ ডেস্ক |

বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত ১৩০ কোটি মানুষের বাস। করোনা আক্রান্তে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং মৃত্যুর হারে তৃতীয় স্থানে ভারত। অন্যান্য দেশে ১শ’ জন করোনা রোগী শনাক্তে মৃত্যুর হারের চেয়ে কয়েকগুণ কম মৃত্যুর হার ভারতে। মৃত্যুর হার নিয়ে ভারত জুড়ে এক রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকারের করোনাভাইরাসের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশটির জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, করোনা নমুনার যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না। ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে করোনার মৃত্যুর হার কম দেখাচ্ছে।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ভারতে যে হারে করোনা সংক্রমিত হচ্ছে, একই হারে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত হয়ে ৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ইতালিতে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন। এছাড়াও দৈনিক আমেরিকা বা ব্রাজিলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেখানে ৩৯ হাজার এবং ৫৩ হাজার, সেখানে ভারতে ৯৭ হাজারের বেশি। ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেশি হলেও মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যা অনুসারে, মে মাসে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ১৫২ জন। কিন্তু ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের (আইসিএমআর) সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। প্রতিবেদন অনুসারে, মে মাসেই ভারতে মোট সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৬৪ লাখ ছাড়িয়েছে। কলকাতাভিত্তিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে।

জানা গেছে, গত ২৫ মে থেকে টানা ৬৮ দিনের সম্পূর্ণ লকডাউন জারি ছিল ভারতে। কার্যত সেই সময়ে ১১ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত একটি সার্ভে চালায় আইসিএমআর। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে দেশে মোট পূর্ণবয়স্ক সম্ভাব্য আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ লাখ ৬৮ হাজার ৩৮৮। ভারত সরকারি তথ্য অনুসারে, সমীক্ষা শুরুর দিন ১১ মে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার এবং ৪ জুন সমীক্ষার শেষ দিন সেই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার ৯১৯।

ভারতে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান : ভারতের স্বাস্থ্যবিভাগের দাবি, দেশটিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা কমছে। এপ্রিলে ১শ’ জন করোনা আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ৪ শতাংশ, আগস্টে এসে তা কমে ২ দশমিক ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়। সেপ্টম্বরে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তবে ভারতের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্বাস্থ্যবিভাগের দুর্বলতার কারণে করোনার প্রকৃত মৃত্যুর হার সামনে আসছে না। মৃত্যুর হারের পরিসংখ্যান ভুল আছে।

করোনায় মৃত্যুর হার কম হওয়ায় সংকট মোকাবিলায় সাফল্য বয়ে আনবে এমনটি মনে করে আগস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃত্যুর হার দিন দিন কমে আসছে, দ্রুতই ১ শতাংশের নিচে মৃত্যুর হার নেমে আসবে। ভারতে করোনা রোগী মৃত্যুর হার নিয়ে বেশকিছু বিজ্ঞানী সতর্ক করে বলেন, করোনা আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা গরমিল আছে। সরকারের দেয়া তথ্য বিভ্রান্তিকর। এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে ভারতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর)- সার্ভেতে রক্তের সিরাম সংগ্রহ করে ইমিউনোগ্লোবিন জি (আইজিজি) অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়। কারও শরীরে এই অ্যান্টিবডি টেস্ট পজেটিভ হলে অর্থাৎ শরীরে করোনার অ্যান্টিবডির উপস্থিতি থাকলে ধরে নেয়া হয়, অন্তত গত দু’মাসের মধ্যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রায় এক মাস ধরে দেশের ২১টি রাজ্যের ৭০টি জেলার ৭০০টি গ্রাম ও পৌরসভার ওয়ার্ডে সমীক্ষা চালিয়েছিল আইসিএমআর। ৩০ হাজার ২৮৩টি বাড়ি ঘুরে মোট ২৮ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাদের কোভিড ‘এলাইজা’ পদ্ধতিতে টেস্ট করা হয়। তারমধ্যে ২৫৬ জনের রিপোর্ট পজেটিভ এসেছিল। ৬৯ জনের রিপোর্ট নির্ধারণ করা যায়নি। করোনা আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। ১৬ শতাংশ শহরের বস্তি এলাকার এবং বাকি ১৪ শতাংশ শহরাঞ্চলেরই বস্তি ছাড়া অন্য এলাকার। ওই সময়েই গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংক্রমণের হার বেশি। করোনা পজেটিভিটি ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের (৪৩.৩%)। ৩৯.৫ শতাংশ আক্রান্তের বয়স ৪৬ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। আর সংক্রমণের হার সবচেয়ে কম ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে (১৭.২%)।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মার্চ মাসের দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। জুনে করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে মহামারী তীব্র আকার ধারণ করে। পহেলা জুলাই এসে ১০ লাখ করোনা শনাক্ত হয়। এরপর তিন সপ্তাহের মধ্যেই ২০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত। এরপরে মাত্র ১৬ দিনেই ৩০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়। সর্বশেষ সেপ্টম্বর মাসের এই ১২ দিনে ৪০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে।

ভারতের জনবহুল শহর নয়াদিল্লি ও মুম্বাই। করোনার কারণে মার্চ মাসে দু’শহরের লকডাউনে লাখ লাখ মানুষ বাধ্য হয়েই ঘরে বসে ছিলেন। এই পদক্ষেপে অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লে বাধ্য হয়েই মে মাসে লকডাউন তুলে নেয় ভারত সরকার। করোনাকালীন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে জুলাই মাসে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছিলেন, ভারতের অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করা দরকার। কারণ করোনার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, কারখানা বন্ধ ছিল মানুষ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি পড়েছেন। এখন ভারতের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নজর দিতে হবে।

জানা গেছে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর জুলাই মাসেই ভারতে পাতাল রেল চলাচল শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে খেলাধুলা, বিনোদন, সংস্কৃতি, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান চালুর অনুমতি দিয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে ১শ’র বেশি মানুষ সমাগম করতে পারবেন না।

ভারতের কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. হেমন্ত শেওয়াদ বলেছেন, বছরের পর বছর নাগরিকের মৃত্যুর সঠিক রেকর্ড রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত সরকার। দেশব্যাপী ৮৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু নিবন্ধিত হয় না। বিভিন্ন কারণে মাত্র ২২ শতাংশ মৃত্যু নিবন্ধিত হয়। কারণ ভারতে বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হাসপাতালে নয়, বাড়িতে বা অন্য জায়গায় মৃত্যু হচ্ছে। সাধারণ মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের চিকিৎসক সেখানে উপস্থিত থাকছেন না।

ডা. হেমন্ত শেওয়াদ বলেন, মৃত্যুর কারণের মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসিসিডি) ওয়েব সাইটে মৃত্যুর সঠিকভাবে নিবন্ধিত হচ্ছে না। হাসপাতালে মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণে বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের হাসপাতালে এই সমস্যা প্রকট। ভারতের রাজধানী দিল্লিতেই মাত্র ৬৩ শতাংশ মৃত্যুর কারণ নিবন্ধিত হয়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে ৩৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ নিবন্ধিত হয়। অধিকাংশ এলাকায় মানুষের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাচ্ছে না। সুতরাং করোনাভাইরাসে মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র সরকারের পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠেনি।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র গবেষক ডা. রমনান লক্ষ্মী নারায়ণ বলেন, ভারতে অপর্যাপ্ত করোনা নমুনা পরীক্ষা এবং দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে মৃত্যুর হিসাব কম দেখানো হচ্ছে। সুতরং এটি স্পষ্ট যে, অন্য দেশের মতো ভারতেও করোনা রোগীর মৃত্যু বাড়ছে। মুম্বাইয়ে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি বস্তিতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

ডা. রমনান লক্ষ্মী নারায়ণ বলেন, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, আগস্টে ভারতে করোনা নমুনা পরীক্ষা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে এখনও বিশ্বের মাথাপিছু পরীক্ষার সর্বনিম্ব হারের মধ্যে রয়েছে। প্রতিদিন ১ লাখের ওপরে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। ভারত সরকার মোট ৪৯ লাখ করোনা রোগী শনাক্ত করেছে কিন্তু সংখ্যাটি ১০০ কোটির উপরে হতে পারে। আগস্টের শুরুতে একদিনে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫০ জন। চলতি সপ্তাহে লাফিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছেন।

ভারতের জনস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক গিরিধর বাবু বলেন, করোনায় মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে, এটা যদি দেখা না যায় তাহলে ধরে নিতে হবে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর যে সংখ্যা দেখান হচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বিশ্ব জুড়ে যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে ভারতে দেখা যাচ্ছে এক অন্য চিত্র।

ভারতে কত সংখ্যক মানুষ করোনা আক্রান্তে মৃত্যু হয়েছে : ভারত জনবহুল দেশ। করোনায় মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব নয়। স্থানীয়, জেলা এবং রাজ্য সরকার মৃত্যুর কারণ জানতে ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে পারবেন না।