গ্রেড-১ এ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নেই

বিভিন্ন সংস্থা ও অধিদফতরের শীর্ষপদ গ্রেড-১’এ (সচিব সমমর্যাদার) উন্নীত হলেও প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা গ্রেড-১’এ পদোন্নতি পাচ্ছেন না। সচিব সমপর্যায়ের সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন না। তাদের ‘চলতি দায়িত্ব’ ও ‘অতিরিক্ত’ হিসেবে শীর্ষ পদে চাকরি করতে হচ্ছে। বর্তমানে ১২টি সংস্থায় শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাই গ্রেড-১ পদে চাকরি করছেন।

প্রায় ছয় বছর আগে একসঙ্গে সরকারের ৩০টি অধিদফতর ও সংস্থার শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ এ উন্নীত করা হয়। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১২টি সংস্থায় গ্রেড-১ এর কর্মকর্তা পদায়ন রয়েছেন, যাদের প্রায় সবাই প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। সংখ্যাগত দিক দিয়ে সবচেয়ে বৃহৎ ক্যাডার হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারে শীর্ষ পদগুলোতে গ্রেড-১ এর মর্যাদার কর্মকর্তা নেই। আবার পদ হারানোর ভয়ে অনেকেই দ্বিতীয় গ্রেড বা প্রথম গ্রেডে পদোন্নতির আবেদন এবং চেষ্টা-তদবিরও করছেন না। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য, দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ থাকলেও তা নিরসনে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ ক্যাডার নেতাদের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘২৬ ক্যাডার বিসিএস সমন্বয় কমিটি’র আহ্বায়ক ও গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের মূল দাবি ছিল ১৩/১৪টি সংস্থার শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ উন্নীত করার এবং ওইসব পদে স্ব স্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি সাপেক্ষে পদায়নের দাবি ছিল। এই সুযোগে আমলারা নিজেদের পদায়নের সুবিধার্থে ৩০টি সংস্থার শীর্ষ পদকে গ্রড-১ উন্নীত করল। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখন গ্রেড-১ এর সুবিধা ভোগ করার সুযোগই পাচ্ছে না।’

জানা গেছে, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসকসহ (প্রকৃচি) ২৬টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় পরিষদ’র দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৩০টি শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ এবং ২০টি পদকে গ্রেড-২ তে উন্নীত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রশাসনে গ্রেড-১ সচিব এবং গ্রেড-২ অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পদ।

‘২৬ ক্যাডার বিসিএস সমন্বয় কমিটি’র ওই আন্দোলনে অন্যতম শীর্ষ ভূমিকায় ছিলেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাবশালী ও ত্যাগী নেতা অধ্যাপক মাসুমে রাব্বানী খান। বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ পদগুলো গ্রেড-১ এ উন্নীত হওয়া সত্ত্বেও ওইসব পদের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রথম গ্রেডে পদোন্নতি কার্যকর না হওয়ার কারণ সর্ম্পকে অধ্যাপক মাসুমে রাব্বানী খান সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে ৩০টি সংস্থার শীর্ষ পদগুলো গ্রেড-১ করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দফতরগুলোর প্রধানদের ব্যর্থতার কারণেই এটি কার্যকর হচ্ছে না।’

সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দফতর প্রধানরা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন নাÑ অভিযোগ করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক এই মহাসচিব আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমরা শীর্ষ পদগুলোর যুক্তিকতা বুঝাতে সক্ষম হয়। এরপর তার নির্দেশেই শীর্ষ পদগুলোর গ্রেড উন্নীত হয়। কিন্তু আমরা ওইসব সংস্থা প্রধান হিসেবে এমন কর্মকর্তাদের বসালাম যারা পদগুলোর মর্যাদাই অনুধাবন করতে পারছেন না। তাদের ব্যর্থতার পাশাপাশি হয়তো সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এ কারণেই তারা পদমর্যাদা বৃদ্ধির প্রস্তাবই পাঠাচ্ছেন না।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ এর। এই পদে প্রায় দেড় বছর ধরে তৃতীয় গ্রেডেই অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক চলতি দায়িত্বে আছেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় আড়াইশ’ অধ্যাপককে ডিঙ্গিয়ে ওই অধ্যাপককে মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়ায় অসন্তোষ রয়েছে। এই অবস্থায় চলতি দায়িত্বের মহাপরিচালকের গ্রেড-২ বা গ্রেড-১ এ উন্নীত করলে শিক্ষা ক্যাডারে অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে-এই আশঙ্কায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার পদোন্নতির উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় ১৬ হাজার সদস্য রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদটিও গ্রেড-১ এর। কিন্তু সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) মাধ্যমে নিয়োগ না হওয়ায় ওই অধিদফতরের মহাপরিচাকের পদেও সম্প্রতি চলতি দায়িত্ব হিসেবে মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার গ্রেড-৩। ‘চিকিৎসা ক্যাডারে’ প্রায় ২২ হাজার সদস্য রয়েছেন।

ডাক বিভাগের মহাপরিচালকের পদটিও গ্রেড-১ এর। কিন্তু এ বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র এখন গ্রেড-২ এ চাকরি করছেন। তিনি ‘ডাক ক্যাডার’র সদস্য, এ ক্যাডারে প্রায় ২০০ সদস্য রয়েছেন।

ডাক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা-তদবির করে মহাপরিচালক গ্রেড-২ পেয়েছেন, তিনি আর পদোন্নতির চেষ্টা করবেন কিনা বলা কঠিন।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়মানুযায়ী অধিদফতরগুলোর ডিজি (মহাপরিচালক) নিয়োগ হওয়ার কথা এসএসবির মাধ্যমে। কিন্তু ক্যাডারগুলোতে চলে লোভনীয় পদে বসার প্রতিযোগিতা। এ কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হচ্ছে মহাপরিচালক, পালন করছেন চলতি দায়িত্ব। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের শীর্ষ পদগুলোতে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা খুব কমই নিয়োগ পাচ্ছে।

কয়েকটি ক্যাডারের সাতজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন অধিদফতরে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অধীনে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদায়নের কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও দলাদলি চলছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও জনসেবা। সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এই ধরনের অসঙ্গতির কারণে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এসিআরও মূল্যায়ন করছেন কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, এসএসবির মাধ্যমে ডিজি নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ন্যূনতম দশ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করে এসএসবির সভাপতি অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠাতে হয়। এরপর প্রস্তাবিত কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর), চাকরির জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও একাডেমিক ক্যারিয়ারসহ সার্বিক কার্যক্রম মূল্যায়ন করে মহাপরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।

‘২৬ ক্যাডারের’ নেতারা জানান, সরকার ২০১৫ সালে নবম পে- স্কেল (বেতন কাঠামো) বাস্তবায়ন করলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া কয়েকটি ক্যাডারে নির্দিষ্ট কিছু পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া রোধ হয়। এ কারণে বেতন-ভাতা বাড়লেও কয়েকটি ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ‘মর্যাদা’ বাড়েনি, ক্ষেত্রবিশেষ মর্যাদার অবমাননাও ঘটেছে। যদিও প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির সোপানে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি।

নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নের আগে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের মাধ্যমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপকরা ৪-গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে ৩য় গ্রেডে উন্নীত হতেন। দীর্ঘদিন গ্রেড আপগ্রেডেশন (পদমর্যাদা বৃদ্ধি) থেকে বঞ্চিত হওয়ায় শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৫ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১২টি সংস্থার প্রধান অর্থাৎ মহাপরিচালক বা চেয়ারম্যান গ্রেড-১ এর মর্যাদা পেয়েছেন। এসব পদে কর্মরত আছেন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা। দফতর বা সংস্থাগুলো হলো-পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি, বিএসটিআই, লোকপ্রশাসন অধিদফতর, কেমিক্যাল ইন্ড্রাটিজ করপোরেশন, সমাজসেবা অধিদফতর, স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, এনজিওবিষয়ক বুরে‌্যা, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এবং চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।

গ্রেড-১ এ উন্নীত পদগুলো হলো- অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সদস্যের চারটি পদ (আয়কর এবং শুল্ক ও আবগারি চারটি, প্রত্যেক ক্যাডার থেকে দুটি করে), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান, কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক, বিএসটিআই’র মহাপরিচালক, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক, ডাক বিভাগের মহাপরিচালক, তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য অফিসার, বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক। অন্য পদগুলোর মধ্যে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী, মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী, রেলওয়ের মহাপরিচালক, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, কম্পট্রোলার জেনারেল অব ডিফেন্স ফাইন্যান্সের মহাপরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি অধিদফতরের মহাপরিচালক, কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি সংস্থা ও দফতরের শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ উন্নীত করা হয়।

বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৭ মহররম ১৪৪২, ২৯ ভাদ্র ১৪২৭

প্রশাসনের ক্যাডার ছাড়া

গ্রেড-১ এ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নেই

রাকিব উদ্দিন

বিভিন্ন সংস্থা ও অধিদফতরের শীর্ষপদ গ্রেড-১’এ (সচিব সমমর্যাদার) উন্নীত হলেও প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা গ্রেড-১’এ পদোন্নতি পাচ্ছেন না। সচিব সমপর্যায়ের সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন না। তাদের ‘চলতি দায়িত্ব’ ও ‘অতিরিক্ত’ হিসেবে শীর্ষ পদে চাকরি করতে হচ্ছে। বর্তমানে ১২টি সংস্থায় শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাই গ্রেড-১ পদে চাকরি করছেন।

প্রায় ছয় বছর আগে একসঙ্গে সরকারের ৩০টি অধিদফতর ও সংস্থার শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ এ উন্নীত করা হয়। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১২টি সংস্থায় গ্রেড-১ এর কর্মকর্তা পদায়ন রয়েছেন, যাদের প্রায় সবাই প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। সংখ্যাগত দিক দিয়ে সবচেয়ে বৃহৎ ক্যাডার হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারে শীর্ষ পদগুলোতে গ্রেড-১ এর মর্যাদার কর্মকর্তা নেই। আবার পদ হারানোর ভয়ে অনেকেই দ্বিতীয় গ্রেড বা প্রথম গ্রেডে পদোন্নতির আবেদন এবং চেষ্টা-তদবিরও করছেন না। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য, দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ থাকলেও তা নিরসনে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ ক্যাডার নেতাদের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘২৬ ক্যাডার বিসিএস সমন্বয় কমিটি’র আহ্বায়ক ও গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের মূল দাবি ছিল ১৩/১৪টি সংস্থার শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ উন্নীত করার এবং ওইসব পদে স্ব স্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি সাপেক্ষে পদায়নের দাবি ছিল। এই সুযোগে আমলারা নিজেদের পদায়নের সুবিধার্থে ৩০টি সংস্থার শীর্ষ পদকে গ্রড-১ উন্নীত করল। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখন গ্রেড-১ এর সুবিধা ভোগ করার সুযোগই পাচ্ছে না।’

জানা গেছে, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসকসহ (প্রকৃচি) ২৬টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় পরিষদ’র দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৩০টি শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ এবং ২০টি পদকে গ্রেড-২ তে উন্নীত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রশাসনে গ্রেড-১ সচিব এবং গ্রেড-২ অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পদ।

‘২৬ ক্যাডার বিসিএস সমন্বয় কমিটি’র ওই আন্দোলনে অন্যতম শীর্ষ ভূমিকায় ছিলেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাবশালী ও ত্যাগী নেতা অধ্যাপক মাসুমে রাব্বানী খান। বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ পদগুলো গ্রেড-১ এ উন্নীত হওয়া সত্ত্বেও ওইসব পদের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রথম গ্রেডে পদোন্নতি কার্যকর না হওয়ার কারণ সর্ম্পকে অধ্যাপক মাসুমে রাব্বানী খান সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে ৩০টি সংস্থার শীর্ষ পদগুলো গ্রেড-১ করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দফতরগুলোর প্রধানদের ব্যর্থতার কারণেই এটি কার্যকর হচ্ছে না।’

সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দফতর প্রধানরা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন নাÑ অভিযোগ করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক এই মহাসচিব আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমরা শীর্ষ পদগুলোর যুক্তিকতা বুঝাতে সক্ষম হয়। এরপর তার নির্দেশেই শীর্ষ পদগুলোর গ্রেড উন্নীত হয়। কিন্তু আমরা ওইসব সংস্থা প্রধান হিসেবে এমন কর্মকর্তাদের বসালাম যারা পদগুলোর মর্যাদাই অনুধাবন করতে পারছেন না। তাদের ব্যর্থতার পাশাপাশি হয়তো সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এ কারণেই তারা পদমর্যাদা বৃদ্ধির প্রস্তাবই পাঠাচ্ছেন না।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ এর। এই পদে প্রায় দেড় বছর ধরে তৃতীয় গ্রেডেই অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক চলতি দায়িত্বে আছেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় আড়াইশ’ অধ্যাপককে ডিঙ্গিয়ে ওই অধ্যাপককে মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়ায় অসন্তোষ রয়েছে। এই অবস্থায় চলতি দায়িত্বের মহাপরিচালকের গ্রেড-২ বা গ্রেড-১ এ উন্নীত করলে শিক্ষা ক্যাডারে অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে-এই আশঙ্কায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার পদোন্নতির উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় ১৬ হাজার সদস্য রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদটিও গ্রেড-১ এর। কিন্তু সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) মাধ্যমে নিয়োগ না হওয়ায় ওই অধিদফতরের মহাপরিচাকের পদেও সম্প্রতি চলতি দায়িত্ব হিসেবে মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার গ্রেড-৩। ‘চিকিৎসা ক্যাডারে’ প্রায় ২২ হাজার সদস্য রয়েছেন।

ডাক বিভাগের মহাপরিচালকের পদটিও গ্রেড-১ এর। কিন্তু এ বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র এখন গ্রেড-২ এ চাকরি করছেন। তিনি ‘ডাক ক্যাডার’র সদস্য, এ ক্যাডারে প্রায় ২০০ সদস্য রয়েছেন।

ডাক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা-তদবির করে মহাপরিচালক গ্রেড-২ পেয়েছেন, তিনি আর পদোন্নতির চেষ্টা করবেন কিনা বলা কঠিন।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়মানুযায়ী অধিদফতরগুলোর ডিজি (মহাপরিচালক) নিয়োগ হওয়ার কথা এসএসবির মাধ্যমে। কিন্তু ক্যাডারগুলোতে চলে লোভনীয় পদে বসার প্রতিযোগিতা। এ কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হচ্ছে মহাপরিচালক, পালন করছেন চলতি দায়িত্ব। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের শীর্ষ পদগুলোতে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা খুব কমই নিয়োগ পাচ্ছে।

কয়েকটি ক্যাডারের সাতজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন অধিদফতরে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অধীনে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদায়নের কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও দলাদলি চলছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও জনসেবা। সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এই ধরনের অসঙ্গতির কারণে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এসিআরও মূল্যায়ন করছেন কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, এসএসবির মাধ্যমে ডিজি নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ন্যূনতম দশ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করে এসএসবির সভাপতি অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠাতে হয়। এরপর প্রস্তাবিত কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর), চাকরির জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও একাডেমিক ক্যারিয়ারসহ সার্বিক কার্যক্রম মূল্যায়ন করে মহাপরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।

‘২৬ ক্যাডারের’ নেতারা জানান, সরকার ২০১৫ সালে নবম পে- স্কেল (বেতন কাঠামো) বাস্তবায়ন করলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া কয়েকটি ক্যাডারে নির্দিষ্ট কিছু পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া রোধ হয়। এ কারণে বেতন-ভাতা বাড়লেও কয়েকটি ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ‘মর্যাদা’ বাড়েনি, ক্ষেত্রবিশেষ মর্যাদার অবমাননাও ঘটেছে। যদিও প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির সোপানে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি।

নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নের আগে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের মাধ্যমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপকরা ৪-গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে ৩য় গ্রেডে উন্নীত হতেন। দীর্ঘদিন গ্রেড আপগ্রেডেশন (পদমর্যাদা বৃদ্ধি) থেকে বঞ্চিত হওয়ায় শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৫ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১২টি সংস্থার প্রধান অর্থাৎ মহাপরিচালক বা চেয়ারম্যান গ্রেড-১ এর মর্যাদা পেয়েছেন। এসব পদে কর্মরত আছেন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা। দফতর বা সংস্থাগুলো হলো-পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি, বিএসটিআই, লোকপ্রশাসন অধিদফতর, কেমিক্যাল ইন্ড্রাটিজ করপোরেশন, সমাজসেবা অধিদফতর, স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, এনজিওবিষয়ক বুরে‌্যা, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এবং চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।

গ্রেড-১ এ উন্নীত পদগুলো হলো- অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সদস্যের চারটি পদ (আয়কর এবং শুল্ক ও আবগারি চারটি, প্রত্যেক ক্যাডার থেকে দুটি করে), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান, কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক, বিএসটিআই’র মহাপরিচালক, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক, ডাক বিভাগের মহাপরিচালক, তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য অফিসার, বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক। অন্য পদগুলোর মধ্যে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী, মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী, রেলওয়ের মহাপরিচালক, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, কম্পট্রোলার জেনারেল অব ডিফেন্স ফাইন্যান্সের মহাপরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি অধিদফতরের মহাপরিচালক, কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি সংস্থা ও দফতরের শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ উন্নীত করা হয়।