ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হয়নি

সাড়ে ১৯ লাখ মে. টনের লক্ষ্যমাত্রায় মাত্র পৌনে ১০ লাখ মে.টন সংগ্রহ দায়ী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও অব্যবস্থাপনা

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও খাদ্য প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণে সময় বাড়িয়েও বোরো মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি খাদ্য প্রশাসন। সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চালের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র পৌনে দশ লাখ মেট্রিক টন সংগ্রহ হয়েছে। এই ঘাটতি মেটানো ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে মিল মালিকদের মধ্যে যারা সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ধান-চাল সরবরাহ করেনি তারা এখন বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির বিরোধিতা করছেন। বোরো মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের সময়সীমা গত ৩১ আগস্ট শেষ হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় সময় ১৫ দিন বাড়ানো হয়। কিন্তু সময় বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জন করতে পারেনি খাদ্য মন্ত্রণালয়। যেসব যেসব মিল মালিক চুক্তি করেও সরকারকে ধান-চাল সরবরাহ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সারোয়ার মাহমুদ সংবাদকে বলেছেন, ‘যারা চুক্তি অনুযায়ী আমাদের ধান-চাল দিয়েছে তাদের পুরস্কৃত করা হবে, উৎসাহ দেয়া হবে।’

এবার মৌসুমে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন ধান, সিদ্ধ চাল ও আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময়ে প্রায় ৮ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহে সক্ষম হয়। এ কারণে খাদ্যশস্য সংগ্রহণের সময়সীমা ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার মোট ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহ বা ক্রয় করতে পেরেছে। এ হিসেবে সরকারের গুদামে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও প্রায় পৌনে ১০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি রয়েছে।

খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ধান-চাল সংগ্রহের অভিযান গত মে মাসে শুরু হয়। এই বোরো মৌসুমে ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান, ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। কিন্তু বর্ধিত সময় শেষে অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধান ২ লাখ ১৯ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন, সিন্ধ চাল ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন এবং আতপ চাল ৯৯ হাজার ১১৮ মেট্রিক টন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৬ সেপ্টেম্বর তার নির্বাচনী এলাকায় নওগাঁয়ে চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সারাদেশে ধান-চালের মজুদ পরিস্থিতি যাচাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আমদানি করা হবে। কোনভাবেই চালের দরে সিন্ডিকেট সহ্য করা হবে না।’

বোরো মৌসুমের সংগ্রহ উদ্দেশ্য সফল হয়েছে দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তবে চুক্তি করেও যেসব মিলার চাল সরবরাহ করেননি তাদের বিষয়ে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৬টি দল সব সময় বাজার মনিটরিং করছে। তারা চাল এবং পিয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।’ মতবিনিময় সভায় মিল মালিকরা চাল আমদানি না করার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি চাল পরিশোধে ব্যর্থ মিলারদের প্রতি সদয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয় মিল মালিকদের পক্ষ থেকে।

ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে চালকল মালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা আবদুল হামিদ বাবু সংবাদকে বলেন, ‘দেশে খাদ্য সংকট হলে সরকার চাল আমদানি করতেই পারে। কিন্তু দেশের খাদ্যশস্যের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে চাল আমদানি করলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এদিকে রাশিয়া থেকে জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে ২ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ খাতে মোট ৪৩৭ কোটি ৫৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। ১৬ সেপ্টেম্বর গম ক্রয় সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ওইদিন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়।

মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন খাদ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্য কর্মকর্তা ও চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, সরকার ঘোষিত মূল্যের চেয়ে খোলা বাজারে মোটা চালের মূল্য বেশি হওয়া, বন্যা, করোনা পরিস্থিতি এবং খাদ্যশস্য সংগ্রহকালীন সময়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি, ফুড), উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, এলএসডি), আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি, ফুড) পদে শতাধিক কর্মকর্তা বদলি করা, খাদ্য প্রশাসনের কাছে বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য মজুদের প্রকৃত তথ্য না থাকার কারণে খাদ্যশস্য ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এক শ্রেণীর খাদ্য পরিদর্শক মাঠে না গিয়ে বেসরকারি মজুদের মনগড়া তথ্য সরকারের কাছে দিয়েছে। এতে মজুদ সিন্ডিকেট সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে খাদ্য প্রশাসন।

ধান ও চাল সংগ্রহণের অভিযান পুরোপুরি সফল না হওয়ায় প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে কী না জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘মনে হয় না বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন হবে। কারণ এখনও সরকারের কাছে ১৪/১৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। সামনে আমন মৌসুমেও ধান-চাল সংগ্রহ করা যাবে। তাছাড়া কোভিড-১৯ সিচুয়েশন (পরিস্থিতি) ও বন্যার কারণে চালের চাহিদা বেশি ছিল। সামনে কোন সুর্যোগ নেই, সম্ভাবনাও কম। ফলে ধান-চালের তেমন চাহিদা থাকবে না।’

খাদ্যশস্য অভিযান সফল না হওয়ার প্রধান কারণ জানতে চাইলে সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের অভিযান অনেকটাই সফল হয়েছে। দেশের উন্নতি হয়েছে, মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। তারা এখন মোটা চাল খেতে চান না, চিকন চাল খান। এ কারণে চালের কোয়ালিটি (চিকন বা ভালোমানের) বেড়েছে, কৃষকরাও এখন চিকন চাল বেশি উৎপাদন করছেন। চিকন চালের দাম বেশি পান। বাজারে চিকন চালের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে।’

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংগ্রহের জন্য এবার প্রতি কেজি চালের (মোটা) মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু কৃষি বিপণন অধিদফতরের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে মোটা চালের (সিদ্ধ) পাইকারী মূল্য প্রতি কেজি ৪০ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে ৪১ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়। আর প্রতি কেজি মোটা চাল (সিদ্ধ) খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়।

সরকার আপদকালীন মজুতের জন্য আমন ও বোরো মৌসুমে প্রতিবার স্থানীয় চালকল মালিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে চাল সংগ্রহ করে। করোনা মহামারীর কারণে এবার বোরো মৌসুমে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বিগত বছরের তুলনায় বেশি নির্ধারণ করা হয়। আর সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে খাদ্যশস্য সংগ্রহের সিন্ধান্ত নেয়া হয়। লটারির আয়োজনেই প্রায় দেড় মাস চলে যায়। এই সুযোগে কৃষকের ধান অসাধু ব্যবসায়ী অর্থাৎ মজুতদার সিন্ডিকেট কিনে নেয় বলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

চালকল মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে খোলাবাজারে মোটা চালের দাম প্রতি কেজিতে ৪/৫ টাকা বেশি হওয়ায় কৃষকরা সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করেনি।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিটি কার্যদিবস ও ছুটির দিনসহ সারাদেশের ৫৯৫টি এলএসডি গুদাম, ১২টি সিএসডি গুদাম, ৫টি সাইলো, একটি ফ্লাওয়ার মিল ও একটি বহুতল ওয়ারহাউজসহ ৬১৪টি স্থাপনা খোলা রাখা হয়েছে।

আরও খবর
ছয় মাসেও দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র নেই
দায় তিতাস ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটির
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ার প্রত্যয় প্রধানমন্ত্রীর
পিয়াজের দাম কমছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
পিয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় অনুতপ্ত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অর্থনীতি সম্পর্কে এডিবির মূল্যায়ন নিয়ে অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন
‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের ভূমিকায় বাংলাদেশ হতাশ’
মৃত্যু ৩৬, নতুন শনাক্ত ১,৫৯৩
কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে তরুণীকে গণধর্ষণ
চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা
৯৩ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরল ৭২ হাজার
রবিউল জবানবন্দি দেয়নি, ফের রিমান্ডে
অস্ত্র মামলায় সাহেদের যাবজ্জীবন চায় রাষ্ট্রপক্ষ
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ার প্রত্যয় প্রধানমন্ত্রীর

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৮ মহররম ১৪৪২, ৩০ ভাদ্র ১৪২৭

১৫ দিন সময় বাড়িয়েও

ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হয়নি

সাড়ে ১৯ লাখ মে. টনের লক্ষ্যমাত্রায় মাত্র পৌনে ১০ লাখ মে.টন সংগ্রহ দায়ী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও অব্যবস্থাপনা

রাকিব উদ্দিন

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও খাদ্য প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণে সময় বাড়িয়েও বোরো মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি খাদ্য প্রশাসন। সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চালের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র পৌনে দশ লাখ মেট্রিক টন সংগ্রহ হয়েছে। এই ঘাটতি মেটানো ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে মিল মালিকদের মধ্যে যারা সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ধান-চাল সরবরাহ করেনি তারা এখন বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির বিরোধিতা করছেন। বোরো মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের সময়সীমা গত ৩১ আগস্ট শেষ হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় সময় ১৫ দিন বাড়ানো হয়। কিন্তু সময় বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জন করতে পারেনি খাদ্য মন্ত্রণালয়। যেসব যেসব মিল মালিক চুক্তি করেও সরকারকে ধান-চাল সরবরাহ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সারোয়ার মাহমুদ সংবাদকে বলেছেন, ‘যারা চুক্তি অনুযায়ী আমাদের ধান-চাল দিয়েছে তাদের পুরস্কৃত করা হবে, উৎসাহ দেয়া হবে।’

এবার মৌসুমে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন ধান, সিদ্ধ চাল ও আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময়ে প্রায় ৮ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহে সক্ষম হয়। এ কারণে খাদ্যশস্য সংগ্রহণের সময়সীমা ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার মোট ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহ বা ক্রয় করতে পেরেছে। এ হিসেবে সরকারের গুদামে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও প্রায় পৌনে ১০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি রয়েছে।

খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ধান-চাল সংগ্রহের অভিযান গত মে মাসে শুরু হয়। এই বোরো মৌসুমে ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান, ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। কিন্তু বর্ধিত সময় শেষে অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধান ২ লাখ ১৯ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন, সিন্ধ চাল ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন এবং আতপ চাল ৯৯ হাজার ১১৮ মেট্রিক টন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৬ সেপ্টেম্বর তার নির্বাচনী এলাকায় নওগাঁয়ে চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সারাদেশে ধান-চালের মজুদ পরিস্থিতি যাচাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আমদানি করা হবে। কোনভাবেই চালের দরে সিন্ডিকেট সহ্য করা হবে না।’

বোরো মৌসুমের সংগ্রহ উদ্দেশ্য সফল হয়েছে দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তবে চুক্তি করেও যেসব মিলার চাল সরবরাহ করেননি তাদের বিষয়ে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৬টি দল সব সময় বাজার মনিটরিং করছে। তারা চাল এবং পিয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।’ মতবিনিময় সভায় মিল মালিকরা চাল আমদানি না করার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি চাল পরিশোধে ব্যর্থ মিলারদের প্রতি সদয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয় মিল মালিকদের পক্ষ থেকে।

ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে চালকল মালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা আবদুল হামিদ বাবু সংবাদকে বলেন, ‘দেশে খাদ্য সংকট হলে সরকার চাল আমদানি করতেই পারে। কিন্তু দেশের খাদ্যশস্যের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে চাল আমদানি করলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এদিকে রাশিয়া থেকে জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে ২ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ খাতে মোট ৪৩৭ কোটি ৫৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। ১৬ সেপ্টেম্বর গম ক্রয় সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ওইদিন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়।

মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন খাদ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্য কর্মকর্তা ও চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, সরকার ঘোষিত মূল্যের চেয়ে খোলা বাজারে মোটা চালের মূল্য বেশি হওয়া, বন্যা, করোনা পরিস্থিতি এবং খাদ্যশস্য সংগ্রহকালীন সময়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি, ফুড), উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, এলএসডি), আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি, ফুড) পদে শতাধিক কর্মকর্তা বদলি করা, খাদ্য প্রশাসনের কাছে বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য মজুদের প্রকৃত তথ্য না থাকার কারণে খাদ্যশস্য ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এক শ্রেণীর খাদ্য পরিদর্শক মাঠে না গিয়ে বেসরকারি মজুদের মনগড়া তথ্য সরকারের কাছে দিয়েছে। এতে মজুদ সিন্ডিকেট সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে খাদ্য প্রশাসন।

ধান ও চাল সংগ্রহণের অভিযান পুরোপুরি সফল না হওয়ায় প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে কী না জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘মনে হয় না বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন হবে। কারণ এখনও সরকারের কাছে ১৪/১৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। সামনে আমন মৌসুমেও ধান-চাল সংগ্রহ করা যাবে। তাছাড়া কোভিড-১৯ সিচুয়েশন (পরিস্থিতি) ও বন্যার কারণে চালের চাহিদা বেশি ছিল। সামনে কোন সুর্যোগ নেই, সম্ভাবনাও কম। ফলে ধান-চালের তেমন চাহিদা থাকবে না।’

খাদ্যশস্য অভিযান সফল না হওয়ার প্রধান কারণ জানতে চাইলে সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের অভিযান অনেকটাই সফল হয়েছে। দেশের উন্নতি হয়েছে, মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। তারা এখন মোটা চাল খেতে চান না, চিকন চাল খান। এ কারণে চালের কোয়ালিটি (চিকন বা ভালোমানের) বেড়েছে, কৃষকরাও এখন চিকন চাল বেশি উৎপাদন করছেন। চিকন চালের দাম বেশি পান। বাজারে চিকন চালের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে।’

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংগ্রহের জন্য এবার প্রতি কেজি চালের (মোটা) মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু কৃষি বিপণন অধিদফতরের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে মোটা চালের (সিদ্ধ) পাইকারী মূল্য প্রতি কেজি ৪০ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে ৪১ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়। আর প্রতি কেজি মোটা চাল (সিদ্ধ) খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়।

সরকার আপদকালীন মজুতের জন্য আমন ও বোরো মৌসুমে প্রতিবার স্থানীয় চালকল মালিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে চাল সংগ্রহ করে। করোনা মহামারীর কারণে এবার বোরো মৌসুমে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বিগত বছরের তুলনায় বেশি নির্ধারণ করা হয়। আর সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে খাদ্যশস্য সংগ্রহের সিন্ধান্ত নেয়া হয়। লটারির আয়োজনেই প্রায় দেড় মাস চলে যায়। এই সুযোগে কৃষকের ধান অসাধু ব্যবসায়ী অর্থাৎ মজুতদার সিন্ডিকেট কিনে নেয় বলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

চালকল মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে খোলাবাজারে মোটা চালের দাম প্রতি কেজিতে ৪/৫ টাকা বেশি হওয়ায় কৃষকরা সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করেনি।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিটি কার্যদিবস ও ছুটির দিনসহ সারাদেশের ৫৯৫টি এলএসডি গুদাম, ১২টি সিএসডি গুদাম, ৫টি সাইলো, একটি ফ্লাওয়ার মিল ও একটি বহুতল ওয়ারহাউজসহ ৬১৪টি স্থাপনা খোলা রাখা হয়েছে।