এই মহাদুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে মহাবিপর্যয়ে পড়তে হবে

দেশে যে পুকুরচুরি এখন অপ্রতিহত গতিতে মহাসাগর চুরির দিকে ধাবিত হচ্ছে, সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় সেটা প্রমাণিত হলো। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় একটি তালার দাম পড়েছে পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা, একটি প্লাস্টিকের বালতি কিনতে লেগেছে এক হাজার ৮৯০ টাকা আর সাধারণ ফুঁ দেয়া বাঁশি কেনা হয়েছে ৪১৫ টাকায়। এমন টাকার অঙ্ক দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কর্তারা সাধারণ তালা, বালতি কিংবা বাঁশি ক্রয় করেননি, যেগুলো ক্রয় করেছেন সেগুলোর মধ্যে সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি অংশও রয়েছে। না হলে এই অবিশ্বাস্য দাম হবে কেন! ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কোন কোন ক্ষেত্রে ৩৩ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে কেনা হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের বিভিন্ন মাল কেনাকাটাসহ অন্যান্য বিষয়ে পরীক্ষা করে। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মিলেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে বেশি দামে মালপত্র কেনা হয়েছে। এতে তছরূপ হয়েছে সরকারের ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় পুকুরচুরির খবরটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তবে এদেশে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। একইভাবে দেশের প্রায় সব সেক্টরেই অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, যা পত্রিকার পাতায় ভালোভাবে চোখ রাখলেই দেখা যায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ-কা-ের ঘটনা উদ্ঘাটনের পরে প্রশাসনসহ গোটা দেশে একটা হইচই সৃষ্টি হয়েছিল। তখন পর্যন্ত জনমনে একটা ধারণা ছিল যে একটি বালিশকেনায় ৬ হাজার টাকা খরচ কাগজে-কলমে দেখানোর মতো সীমাহীন দুর্নীতি নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু সময়ের আবর্তে সেটিই এখন স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রশাসন দুর্নীতির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।

অনিয়ম সংঘটনে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে তাদের মধ্যে সাধারণ ভয়-ডরও উধাও হতে চলেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখেই তারা এখন দুর্নীতি করছেন। কারণ তারা জানেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় তাদের শাস্তি হবে না।

এ ধরনের চুরি বা দুর্নীতি যে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অপরাধ তা বলাই বাহুল্য। এসব অপরাধ প্রশাসনে প্রতিনিয়ত ঘটছে কিন্তু রহস্যজনক কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। কারও বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণে প্রশাসনে দুর্নীতিও বেপরোয়াভাবে বেড়েই চলেছে, পুকুরচুরি থেকে সাগরচুরি এখন মহাসাগর চুরিতে হাত পাকিয়ে ফেলছে প্রশাসন।

সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধে সরকার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট এবং ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, এ ব্যবস্থার ফলে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা কেনাকাটায় অবনতিশীল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি তো হ্রাস পায়নি বরং সরকারি কেনাকাটায় পুকুরচুরি কিংবা সাগরচুরির ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

এখন তো এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া এমন বেপরোয়া দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। বস্তুত দুর্নীতি নামক সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী মহাদানবের থাবা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে মূলত: তিনটি কারণে। এক. বিচারহীনতা। দুই. রাজনৈতিক প্রভাব। তিন. প্রশাসন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অশুভ চক্রের অশুভ আঁতাতের কারণে।

গত বৃহস্পতিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটি ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই এবং আপনাদেরই এই শুদ্ধাচারের পরিকল্পনা করতে হবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এবং প্রত্যাশার সঙ্গে আমরাও আশাবাদী হতে চাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরগণ কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা পূরণ করবার জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবেন? এর আগে সালে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছিল, সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে নিজস্ব গাড়ি কেনার সুবিধা দেয়া হয়েছিল। সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বেতন বাড়ানো হয়েছে [প্রায় দ্বিগুণ] আশা করছি দুর্নীতি কমবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবাও যে হবে আমাদের ভরসা কম।

বস্তুত প্রশাসনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে দুটি কাজ করতে হবে সরকারকে-এক. ছোট বড় সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির বিচার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এবং দুই. সরকারি কেনাকাটায় রাজনৈতিক প্রভাব কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। এবং সরকারি ক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত পূর্বে উল্লিখিত অশুভ চক্র ও অশুভ আঁতাত ভাঙতে হবে। সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে।

শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৯ মহররম ১৪৪২, ০১ আশ্বিন ১৪২৭

সরকারি কেনাকাটায় এখন ‘মহাসাগর চুরি’

এই মহাদুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে মহাবিপর্যয়ে পড়তে হবে

দেশে যে পুকুরচুরি এখন অপ্রতিহত গতিতে মহাসাগর চুরির দিকে ধাবিত হচ্ছে, সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় সেটা প্রমাণিত হলো। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় একটি তালার দাম পড়েছে পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা, একটি প্লাস্টিকের বালতি কিনতে লেগেছে এক হাজার ৮৯০ টাকা আর সাধারণ ফুঁ দেয়া বাঁশি কেনা হয়েছে ৪১৫ টাকায়। এমন টাকার অঙ্ক দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কর্তারা সাধারণ তালা, বালতি কিংবা বাঁশি ক্রয় করেননি, যেগুলো ক্রয় করেছেন সেগুলোর মধ্যে সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি অংশও রয়েছে। না হলে এই অবিশ্বাস্য দাম হবে কেন! ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কোন কোন ক্ষেত্রে ৩৩ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে কেনা হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের বিভিন্ন মাল কেনাকাটাসহ অন্যান্য বিষয়ে পরীক্ষা করে। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মিলেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে বেশি দামে মালপত্র কেনা হয়েছে। এতে তছরূপ হয়েছে সরকারের ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কেনাকাটায় পুকুরচুরির খবরটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তবে এদেশে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। একইভাবে দেশের প্রায় সব সেক্টরেই অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, যা পত্রিকার পাতায় ভালোভাবে চোখ রাখলেই দেখা যায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ-কা-ের ঘটনা উদ্ঘাটনের পরে প্রশাসনসহ গোটা দেশে একটা হইচই সৃষ্টি হয়েছিল। তখন পর্যন্ত জনমনে একটা ধারণা ছিল যে একটি বালিশকেনায় ৬ হাজার টাকা খরচ কাগজে-কলমে দেখানোর মতো সীমাহীন দুর্নীতি নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু সময়ের আবর্তে সেটিই এখন স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রশাসন দুর্নীতির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।

অনিয়ম সংঘটনে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে তাদের মধ্যে সাধারণ ভয়-ডরও উধাও হতে চলেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখেই তারা এখন দুর্নীতি করছেন। কারণ তারা জানেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় তাদের শাস্তি হবে না।

এ ধরনের চুরি বা দুর্নীতি যে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অপরাধ তা বলাই বাহুল্য। এসব অপরাধ প্রশাসনে প্রতিনিয়ত ঘটছে কিন্তু রহস্যজনক কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। কারও বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণে প্রশাসনে দুর্নীতিও বেপরোয়াভাবে বেড়েই চলেছে, পুকুরচুরি থেকে সাগরচুরি এখন মহাসাগর চুরিতে হাত পাকিয়ে ফেলছে প্রশাসন।

সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধে সরকার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট এবং ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, এ ব্যবস্থার ফলে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা কেনাকাটায় অবনতিশীল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি তো হ্রাস পায়নি বরং সরকারি কেনাকাটায় পুকুরচুরি কিংবা সাগরচুরির ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

এখন তো এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া এমন বেপরোয়া দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। বস্তুত দুর্নীতি নামক সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী মহাদানবের থাবা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে মূলত: তিনটি কারণে। এক. বিচারহীনতা। দুই. রাজনৈতিক প্রভাব। তিন. প্রশাসন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অশুভ চক্রের অশুভ আঁতাতের কারণে।

গত বৃহস্পতিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটি ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই এবং আপনাদেরই এই শুদ্ধাচারের পরিকল্পনা করতে হবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এবং প্রত্যাশার সঙ্গে আমরাও আশাবাদী হতে চাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরগণ কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা পূরণ করবার জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবেন? এর আগে সালে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছিল, সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে নিজস্ব গাড়ি কেনার সুবিধা দেয়া হয়েছিল। সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বেতন বাড়ানো হয়েছে [প্রায় দ্বিগুণ] আশা করছি দুর্নীতি কমবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবাও যে হবে আমাদের ভরসা কম।

বস্তুত প্রশাসনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে দুটি কাজ করতে হবে সরকারকে-এক. ছোট বড় সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির বিচার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এবং দুই. সরকারি কেনাকাটায় রাজনৈতিক প্রভাব কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। এবং সরকারি ক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত পূর্বে উল্লিখিত অশুভ চক্র ও অশুভ আঁতাত ভাঙতে হবে। সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে।