খিচুড়ি নিয়ে মাতম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জন্য খিচুড়ি রান্না ও তার বিতরণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে এক হাজার কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বিদেশ সফর করানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে ভবন দেখার জন্য ৩০ জন সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব করা হয়েছে; জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ প্রকল্পে গ্রামের লোকদের হাত ধোয়া শেখানোর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা; একই বিষয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবত রাখা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। গরু-ছাগল পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ৫০ জনকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। পুকুরে ভর্তি বাংলাদেশে পুকুর কাটার কায়দা শেখার জন্য বিদেশে লোক পাঠানোর প্রস্তাব সংবলিত প্রকল্পের খবরও আমরা পত্রিকায় দেখেছি। নিরাপদ পানিবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা সফর করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৪১ জন কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সনের মধ্যে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার চালু করার প্রতিশ্রুতি ছিল; তদনুযায়ী মন্ত্রিসভায় স্কুল ফিডিং পলিসি অনুমোদিতও হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফরিদাবাদ স্কুলে আমি বহু বছর ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম; তখন একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে গভর্নর ড. আতিউর রহমান ছাত্রছাত্রীদের এক বেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব কী না- তা আমার কাছে জানতে চান, আমি রাজি হইনি। আমার রাজি না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল- ছাত্রছাত্রী ভর্তি করার সময় আমাদের হাজার রকমের প্রেসার মোকাবিলা করতে হয়েছে, কোথাও কোথাও আপস করেছি, না করে উপায় ছিল না। এই অবস্থায় খাবার সরবরাহের জন্য স্থানীয় লোকেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে সারা বছর মারামারি করবে বলে আমার ধারণা হয়েছিল। বাইরের কাউকে সংশ্লিষ্ট না করে স্কুলকে খাবার সংগ্রহ ও বিতরণের কাজে জড়িত করা হলে লেখাপড়ার চেয়ে শিক্ষকেরা কেনাকাটায় বেশি উৎসাহী হয়ে উঠতো। অন্যদিকে চার হাজার ছাত্রছাত্রীকে খাবার বিতরণের হাঙ্গামা এবং সময় নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হাত ধোয়া প্রকল্পে জনবহুল জায়গায় সস্তা হোটেলগুলোর মতো লম্বা বেসিন তৈরির জন্য বরাদ্দ রাখা আছে। জনবহুল জায়গায় হাত ধোয়ার বেসিন বসানো হলে মন্দ হয় না। কিন্তু সেখানে সাবানও তো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। সরকারের কোন জিনিসটি বেশি দিন যথাযথভাবে চলে না। ছয় মাস পরে বেসিন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হবে, তাতে হাত ধোয়া হলে বরং স্বাস্থ্যবিধি নষ্ট হবে।

বর্তমান সরকারের আমলে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। উন্নয়ন করতে গেলেই প্রকল্প প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন অপরিহার্য। প্রকল্প ছাড়া বিদেশি সহায়তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবেই। তবে বিদেশি পরামর্শক যে অর্থ হাতিয়ে নেয় তার তুলনায় প্রশিক্ষণর খরচ নগণ্য। কিন্তু তাই বলে প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার অপচয়ের চিত্র কোন সরকারের জন্য সুখকর নয়। অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে জরুরি কাজগুলো অনিষ্পন্ন থেকে যাবে; কারণ সরকারের কাছে অফুরন্ত টাকা নেই। সরকারকে তার সীমিত বাজেট দিয়ে অসংখ্য কাজের মধ্যে জরুরি ও প্রয়োজনীয় কাজগুলো বেছে নিতে হয়। বিগত ১০ বছরে নাকি তিন হাজার সেতু ও কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু সবগুলো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন একটি সেতুর ছবি দেখলাম যার দুইপাশে রাস্তা নেই। এই সেতুটি না করে যদি ছাত্রছাত্রীর স্কুল পথের বাঁশের নড়বড় সাঁকোর জায়গায় একটি পাকা সেতু তৈরি করা হতো অর্থ ও প্রকল্পের যথার্থতা প্রমাণ হতো।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করার পরেও ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। কারণ সরকার জনগণের আস্থা হারালে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ আমলাদের কিচ্ছু যায় আসে না। যে দলই ক্ষমতায় এসেছে সেই দলই প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের লোক বসানোর চেষ্টা করেছে, এই জন্য প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ধ্বংস হয়েছে, সততা আর দক্ষতার চেয়ে আনুগত্য বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তাই মতিঝিল পাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলা ক্যাসিনো খেলা বন্ধ করতে পুলিশ সাহস করেনি, শাহেদ আর সাবরিনার অপরাধের খবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ কিছু জেনেও না জানার ভান করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক লেবাসধারী আবদুল মালেকসহ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর ৪৫ জন কোটিপতি তো একদিনে হয়নি, পাপিয়া পাঁচতারা হোটেলের স্যুট ভাড়া করে দিনের পর দিন আসর বসিয়েছে- অথচ কেউ কিছু দেখেনি, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর লেবাসধারী নূরজাহান আক্তার কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট অফিসের কেউ কিছু জানে না। বাস-ট্রাকের এককালের হেলপার ফরিদপুরের দুই ভাই রুবেল ও বরকত ১৯৯১ সনে বিএনপির আমল থেকেই বিএনপির স্থানীয় নেতার প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, - মানুষের হাত কেটেছে, মাথা কেটেছে, টেন্ডারবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে, বর্তমানে তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় বড় নেতা হয়েছে- অথচ তাদের অপরাধী কার্যক্রমের কিচ্ছু কারও নজরে আসেনি। সাংগঠনিক দুর্বলতার এই দায় কেউ নেবে না। অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তার ক্রসফায়ারে মৃত্যু হলে কক্সবাজারের ওসি প্রদীপ সম্পর্কে আমরা সবাই জানলাম, তার আগে বিএনপির আমলেও এ ওসি প্রদীপ তার কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি ব্রিটিশ আমলেও ছিল, পাকিস্তান আমলেও হয়েছে, বাংলাদেশ আমলে আরেকটু বেড়েছে। কিন্তু বাড়ার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না।

বাংলাদেশে চোরও চোরকে গালি দেয়, ঘুষখোর ছিনতাইকারীকে ঘৃণা করে, ডাকাত রাজনীতিবিদদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে, লম্পট পতিতাদের অস্পৃশ্য মনে করে। সৎ এবং ভালো লোকের সঙ্গে এই খারাপ লোকগুলোও অন্যের ছিদ্রান্বেষণ করতে ব্যস্ত থাকে। সবাই চায়, বাংলাদেশ সুইডেন হোক, নরওয়ে হোক, কানাডা হোক- দায়িত্ব সব অন্যের, নিজেরা শুদ্ধ হবে না। প্রকল্পের প্রস্তাব শুধু এই সরকারের আমলেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়- সব সরকারের আমলেই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। সব প্রকল্পেই বিদেশ ভ্রমণ থাকে। বর্তমানে ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহর। পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে থাকে, তাহলে পরিবেশ উন্নত না হয়ে ঢাকা শহরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে কেন? বায়ুদুষণ, শব্দদূষণ কমানোর প্রকল্পের কাজে কাজ কিছুই হয় না। বিদেশ ভ্রমণ অপরাধ নয়। বিদেশে সততা আছে, সময়নিষ্ঠতা আছে। বিদেশে গিয়ে চোখ, কান খোলা রেখে হেঁটে আসলেও ঘুষের মাত্রা কমার কথা, দুর্নীতি হ্রাস পাওয়ার কথা; তা কিন্তু লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের অফুরন্ত সম্পদ থাকলে সব নাগরিককে একবার অন্য দেশ থেকে ঘুরিয়ে আনা যেত। সম্পদ সীমিত হওয়ায় বিনা কারণে বিদেশ পাঠানোর নীতি পরিবর্তন করতে হবে; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ কোন সরকারের আমলেই নেয়া হয়নি। এই বিধান যত দিন প্রকল্পে টিকিয়ে রাখা যাবে, তত দিন বিদেশ ভ্রমণের কম্পুনেন্ট থাকবেই- হতে পারে তা আনবিক চুল্লি বিষয়ক বা ন্যাকড়া দিয়ে টেবিল মোছার পদ্ধতিবিষয়ক।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী

পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৮ মহররম ১৪৪২, ০৯ আশ্বিন ১৪২৭

খিচুড়ি নিয়ে মাতম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জন্য খিচুড়ি রান্না ও তার বিতরণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে এক হাজার কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বিদেশ সফর করানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে ভবন দেখার জন্য ৩০ জন সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব করা হয়েছে; জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ প্রকল্পে গ্রামের লোকদের হাত ধোয়া শেখানোর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা; একই বিষয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবত রাখা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। গরু-ছাগল পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ৫০ জনকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। পুকুরে ভর্তি বাংলাদেশে পুকুর কাটার কায়দা শেখার জন্য বিদেশে লোক পাঠানোর প্রস্তাব সংবলিত প্রকল্পের খবরও আমরা পত্রিকায় দেখেছি। নিরাপদ পানিবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা সফর করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৪১ জন কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সনের মধ্যে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার চালু করার প্রতিশ্রুতি ছিল; তদনুযায়ী মন্ত্রিসভায় স্কুল ফিডিং পলিসি অনুমোদিতও হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফরিদাবাদ স্কুলে আমি বহু বছর ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম; তখন একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে গভর্নর ড. আতিউর রহমান ছাত্রছাত্রীদের এক বেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব কী না- তা আমার কাছে জানতে চান, আমি রাজি হইনি। আমার রাজি না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল- ছাত্রছাত্রী ভর্তি করার সময় আমাদের হাজার রকমের প্রেসার মোকাবিলা করতে হয়েছে, কোথাও কোথাও আপস করেছি, না করে উপায় ছিল না। এই অবস্থায় খাবার সরবরাহের জন্য স্থানীয় লোকেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে সারা বছর মারামারি করবে বলে আমার ধারণা হয়েছিল। বাইরের কাউকে সংশ্লিষ্ট না করে স্কুলকে খাবার সংগ্রহ ও বিতরণের কাজে জড়িত করা হলে লেখাপড়ার চেয়ে শিক্ষকেরা কেনাকাটায় বেশি উৎসাহী হয়ে উঠতো। অন্যদিকে চার হাজার ছাত্রছাত্রীকে খাবার বিতরণের হাঙ্গামা এবং সময় নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হাত ধোয়া প্রকল্পে জনবহুল জায়গায় সস্তা হোটেলগুলোর মতো লম্বা বেসিন তৈরির জন্য বরাদ্দ রাখা আছে। জনবহুল জায়গায় হাত ধোয়ার বেসিন বসানো হলে মন্দ হয় না। কিন্তু সেখানে সাবানও তো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। সরকারের কোন জিনিসটি বেশি দিন যথাযথভাবে চলে না। ছয় মাস পরে বেসিন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হবে, তাতে হাত ধোয়া হলে বরং স্বাস্থ্যবিধি নষ্ট হবে।

বর্তমান সরকারের আমলে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। উন্নয়ন করতে গেলেই প্রকল্প প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন অপরিহার্য। প্রকল্প ছাড়া বিদেশি সহায়তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবেই। তবে বিদেশি পরামর্শক যে অর্থ হাতিয়ে নেয় তার তুলনায় প্রশিক্ষণর খরচ নগণ্য। কিন্তু তাই বলে প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার অপচয়ের চিত্র কোন সরকারের জন্য সুখকর নয়। অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে জরুরি কাজগুলো অনিষ্পন্ন থেকে যাবে; কারণ সরকারের কাছে অফুরন্ত টাকা নেই। সরকারকে তার সীমিত বাজেট দিয়ে অসংখ্য কাজের মধ্যে জরুরি ও প্রয়োজনীয় কাজগুলো বেছে নিতে হয়। বিগত ১০ বছরে নাকি তিন হাজার সেতু ও কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু সবগুলো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন একটি সেতুর ছবি দেখলাম যার দুইপাশে রাস্তা নেই। এই সেতুটি না করে যদি ছাত্রছাত্রীর স্কুল পথের বাঁশের নড়বড় সাঁকোর জায়গায় একটি পাকা সেতু তৈরি করা হতো অর্থ ও প্রকল্পের যথার্থতা প্রমাণ হতো।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করার পরেও ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। কারণ সরকার জনগণের আস্থা হারালে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ আমলাদের কিচ্ছু যায় আসে না। যে দলই ক্ষমতায় এসেছে সেই দলই প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের লোক বসানোর চেষ্টা করেছে, এই জন্য প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ধ্বংস হয়েছে, সততা আর দক্ষতার চেয়ে আনুগত্য বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তাই মতিঝিল পাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলা ক্যাসিনো খেলা বন্ধ করতে পুলিশ সাহস করেনি, শাহেদ আর সাবরিনার অপরাধের খবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ কিছু জেনেও না জানার ভান করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক লেবাসধারী আবদুল মালেকসহ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর ৪৫ জন কোটিপতি তো একদিনে হয়নি, পাপিয়া পাঁচতারা হোটেলের স্যুট ভাড়া করে দিনের পর দিন আসর বসিয়েছে- অথচ কেউ কিছু দেখেনি, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর লেবাসধারী নূরজাহান আক্তার কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট অফিসের কেউ কিছু জানে না। বাস-ট্রাকের এককালের হেলপার ফরিদপুরের দুই ভাই রুবেল ও বরকত ১৯৯১ সনে বিএনপির আমল থেকেই বিএনপির স্থানীয় নেতার প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, - মানুষের হাত কেটেছে, মাথা কেটেছে, টেন্ডারবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে, বর্তমানে তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় বড় নেতা হয়েছে- অথচ তাদের অপরাধী কার্যক্রমের কিচ্ছু কারও নজরে আসেনি। সাংগঠনিক দুর্বলতার এই দায় কেউ নেবে না। অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তার ক্রসফায়ারে মৃত্যু হলে কক্সবাজারের ওসি প্রদীপ সম্পর্কে আমরা সবাই জানলাম, তার আগে বিএনপির আমলেও এ ওসি প্রদীপ তার কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি ব্রিটিশ আমলেও ছিল, পাকিস্তান আমলেও হয়েছে, বাংলাদেশ আমলে আরেকটু বেড়েছে। কিন্তু বাড়ার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না।

বাংলাদেশে চোরও চোরকে গালি দেয়, ঘুষখোর ছিনতাইকারীকে ঘৃণা করে, ডাকাত রাজনীতিবিদদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে, লম্পট পতিতাদের অস্পৃশ্য মনে করে। সৎ এবং ভালো লোকের সঙ্গে এই খারাপ লোকগুলোও অন্যের ছিদ্রান্বেষণ করতে ব্যস্ত থাকে। সবাই চায়, বাংলাদেশ সুইডেন হোক, নরওয়ে হোক, কানাডা হোক- দায়িত্ব সব অন্যের, নিজেরা শুদ্ধ হবে না। প্রকল্পের প্রস্তাব শুধু এই সরকারের আমলেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়- সব সরকারের আমলেই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। সব প্রকল্পেই বিদেশ ভ্রমণ থাকে। বর্তমানে ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহর। পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে থাকে, তাহলে পরিবেশ উন্নত না হয়ে ঢাকা শহরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে কেন? বায়ুদুষণ, শব্দদূষণ কমানোর প্রকল্পের কাজে কাজ কিছুই হয় না। বিদেশ ভ্রমণ অপরাধ নয়। বিদেশে সততা আছে, সময়নিষ্ঠতা আছে। বিদেশে গিয়ে চোখ, কান খোলা রেখে হেঁটে আসলেও ঘুষের মাত্রা কমার কথা, দুর্নীতি হ্রাস পাওয়ার কথা; তা কিন্তু লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের অফুরন্ত সম্পদ থাকলে সব নাগরিককে একবার অন্য দেশ থেকে ঘুরিয়ে আনা যেত। সম্পদ সীমিত হওয়ায় বিনা কারণে বিদেশ পাঠানোর নীতি পরিবর্তন করতে হবে; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ কোন সরকারের আমলেই নেয়া হয়নি। এই বিধান যত দিন প্রকল্পে টিকিয়ে রাখা যাবে, তত দিন বিদেশ ভ্রমণের কম্পুনেন্ট থাকবেই- হতে পারে তা আনবিক চুল্লি বিষয়ক বা ন্যাকড়া দিয়ে টেবিল মোছার পদ্ধতিবিষয়ক।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী

পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com