আবুলের বাঁশকল

পঞ্চাশ বছর ধরে ফসলের শত্রু ইঁদুর নিধন করেন

সাদাসিধে মানুষ কৃষকবান্ধব আবুল হোসেন জোয়ার্দার। বয়স ৮২। পেশায় পল্লী পশু চিকিৎসক। সেই সঙ্গে বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে মানুষের ফসলের শত্রু ইঁদুর নিধন করে আসছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেন নিজের তৈরি বাঁশকল বা (ফাঁদ) মৃত ইঁদুরের লেজ জমা দিয়ে সরকারি ইঁদুর নিধন দিবসে উপজেলা থেকে কয়েকবার সম্মাননাও পেয়েছেন। বয়োবৃদ্ধ আবুল হোসেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের জামাল ইউনিয়নের উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা।

গত শনিবার সরেজমিনে আবুল হোসেনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তার বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা রয়েছে প্রায় শতাধিক বাঁশকল বা ফাঁদ। বাড়ির অন্যপাশে তৈরি করা হচ্ছে আরও অনেকগুলো। বসতবাড়ি ও ফসলি খেতে ইঁদুরের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার কৃষকরা তার বাড়িতে এসে বিনামূল্যে বাঁশকল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। টিনের তৈরি একটি চালা ঘরে বেশ কিছু টিনের কৌটার মধ্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে মরা ইঁদুরের অসংখ্য শুকনো লেজ। যা তিনি উপজেলাতে জমা দেয়ার অপেক্ষায় আছেন।

আবুল হোসেন জোয়ার্দার জানান, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের বাবুনগর মাদ্রাসা থেকে ফাযিল পাস করে পল্লী পশু চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ কোর্স শেষ করেন। এরপর বিভিন্ন এলাকায় শুরু করেন পশু চিকিৎসেবা। এ কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে শুরু করেন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল নিধনের শত্রু ইঁদুর নিধন। তিনি বলেন, কৃষকরা অনেক কষ্ট করে পয়সা ব্যয় করে ফসল উৎপাদন করেন। সেই ফসল ইঁদুরে বিনষ্ট করে। এটা তাদের জন্য বড় ধরনের এক ক্ষতি। তাই কৃষকদের উপকারে তিনি শুরু করেন ইঁদুর নিধন। যা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রথমে বাজারের কেনা কল বা ফাঁদ ব্যবহার করতেন। এ ফাঁদে তেমন একটা কাজ করে না। তাছাড়া ব্যয়বহুল হওয়ায় পরে মাথা খাটিয়ে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন বিশেষ ফাঁদ বাঁশকল। তার এ চেষ্টা আজ সফল হয়েছে। এলাকায় এটা আবুলের বাঁশকল হিসেবে ব্যপক পরিচিত। ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষের সময় এ ফাঁদগুলো নিজের উদ্যোগে মাঠের বিভিন্ন খেতে নিজ উদ্যোগে পেতে রাখেন। কয়েক দিন পর দেখেন অনেক ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়েছে। অনেকগুলো মারাও গেছে। আবার অনেকে তার বাড়িতে এসে বলে যান খেতে বেশি ইঁদুর বাসা করলে। সময় বুঝে অনেকগুলো কল নিয়ে বসে থেকে তিনি চালান বিশেষ অভিযান।

আবুল হোসেন আরও জানান, এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের মাঠে তার কয়েক হাজার বাঁশকল পাতা আছে। এখন আমন ধানের মৌসুম চলছে। মৌসুম শেষ হচ্ছে প্রত্যেক মাঠ থেকে বাঁশকলগুলো বাড়িতে আনা শুরু করেছেন। আবার রবিশস্য পাকলে দেয়া হবে। এ মৌসুম শেষ হতে না হতেই আবার বোরো মৌসুমের ধান পাকা শুরু হবে। তখন আবার সেখানে ফাঁদগুলো পাতা হবে। তিনি আরও বলেন, শুধু পেতে আসলেই হয় না। মাঝে মধ্যে আবার মাঠের ফাঁদগুলো দেখে আসতে হয়। বাঁশকলের মধ্যে খাবার ফুরিয়ে গেলে আবার খাবার দেয়া লাগে। আর আটকা পড়া ইঁদুরগুলো বের করে নিয়ে লেজ কেটে নিয়ে দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা ও পরিবেশ সুরক্ষায় মাটি খানিকটা গর্ত করে মরা ইঁদুরের দেহাবশেষ পুতে রাখেন। লেজগুলো বাড়িতে এনে প্রথমে রোদে শুকান। পরে এগুলোকে জ্বলন্ত আগুনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছেকে জীবাণুমুক্ত করে শুকিয়ে বিশেষ কৌটায় ভরে রাখেন। বছরের ইঁদুর নিধন সপ্তাহে ইউএনও অফিসের মাধ্যমে কৃষি অফিসে জমা দেন। লেজ জমা দিয়ে এ পর্যন্ত তিনিই প্রতিবছর সেরা হন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এসে ফাঁদ নিয়ে যায়। এটা তিনি কৃষকসেবা হিসেবে মনে করেন। ইঁদুর একটি ইতর প্রাণী। এর শরীরে রোগজীবাণু থাকতে পারে। আর মূলদেহ মাটিতে গর্ত করে পুতে রাখেন। লেজগুলো প্রথমে ভালো করে রোদে শুকান। পরে আগুনে সেক দিয়ে শুকনা করে কৌটায় ভরে রাখেন। ইঁদুরের শরীরে নানা রোগ-জীবাণু রয়েছে। কামড়ও দিয়েছে অনেকবার কিন্তু নিজে সরে আসেননি। প্রথম দিকে পরিবারের সবাই বাধা দিতেন। কিন্ত এখন কৃষকের সেবার কথা ভেবে আর কেউ কিছু বলেন না। তিনি বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। তার দাবি- এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২ লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছেন। আগে লেজসহ মরা ইঁদুর মাটিতে পুতে রাখতেন। কিন্তু সরকারিভাবে যেদিন থেকে ইঁদুর নিধনের গুরুত দেয়া হয়েছে সেদিন থেকেই আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছেন।

উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মোমিন জানান, আমি ছোটবেলা থেকে গ্রামের আবুল হোসেনকে দেখছি পশুপাখি চিকিৎসাসহ কৃষকের ফসলি খেত, বসতবাড়ির ইঁদুর মেরে সেবা দিচ্ছেন। তার তৈরি ইঁদুর মারার বাঁশকল বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ বিনামূল্যে নিয়ে যান। কোন কোন সময়ে তিনি বিভিন্ন গ্রামের মাঠে গিয়ে নিজের বাঁশকল পেতে একটু দূরে বসে থাকেন। তার এ সেবাটা সবার জন্য উপকারে আসে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হুমায়ন কবির জানান, কৃষকদের ফসলি খেতের জন্য ইঁদুর অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া কমপক্ষে ৬০ রোগের জীবাণু বহন করে। এই ইঁদুর নিধনে আবুল হোসেন নিজের তৈরি বাঁশকল দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর তিনি প্রচুর পরিমাণ ইঁদুরের লেজ জমা দেন। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক তথ্যে জেনেছেন ইঁদুর খুব দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটায়। ইঁদুরের গর্ভধারণকাল ১৮-থেকে ২২ দিন পর্যন্ত হয়। বাচ্চা প্রসবের পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার গর্ভধারণ করতে পারে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে নিধন করা কতটা জরুরি। যে কাজটি আবুল হোসেন বিনা পারিশ্রমিকে করে থাকেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মুহাম্মদ মোহায়মেন আক্তার জানান, ইঁদুর পাকা ধান, গম, রবিশস্য, সবজি, বাসা-বাড়ির কাগজপত্র, কাপড়-চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট করে। কৃষি জরিপে দেখা গেছে, ইঁদুর বেশিরভাগ সেচনালা গর্ত করে পানির অপচয় ঘটায়। ফসল কাটার আগে ধান খেত ৫ থেকে ১৭ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট করে। অবাক তথ্য দিয়ে বলেন, ১০০টি ইঁদুর বছরে ১ টন খাদ্য খেয়ে ফেলতে পারে। এ ইঁদুর নিধনের জন্য উপকারী প্রাণী পেঁচা, শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, সাপ, গুই সাপ, বিড়ালজাতীয় প্রাণী কমে যাওয়ায় মাঠে ও বাসা-বাড়িতে ইঁদুর বেড়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। কিন্ত স্বেচ্চায় আবুল হোসেন তার উদ্ভাবিত বাঁশকল দিয়ে কৃষকদের সেবা প্রদান করছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূবর্ণা রানী সাহা জানান, ফসলি খেতের জন্য ইঁদুর একটি ভয়ানক শত্রু। প্রতিবছর সরকারিভাবে ইঁদুরনিধন সপ্তাহ দিয়ে ইঁদুর নিধনে কাজ করা হয়। কৃষকদের ইঁদুর নিধনে উৎসাহিত করতে মরা ইঁদুরের লেজ জমা নিয়ে জমাদানকারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ উপজেলায় আবুল হোসেন জোয়ার্দার প্রতিবছরই সবার চেয়ে বেশি জমা দিয়ে আসছেন। তার নিজের প্রযুক্তিতে তৈরি বাঁশকল এলাকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। বিনা পারিশ্রমিকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে সেবাটা দিচ্ছেন। বলা যায় আবুল হোসেনই কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু। তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

image
আরও খবর
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তুরস্কের সম্পৃক্ততার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
গণপরিবহনে শৃঙ্খলার জন্য ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
তিস্তার পানিবণ্টন অচিরেই সীমান্ত হত্যাও শূন্যে আসবে
সমরাস্ত্র বিনিয়োগে আগ্রহী তুরস্ক
কাশ্মীরের স্থানীয় নির্বাচনে মোদিবিরোধী জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা
দুদকের নজরদারিতে পিকে হালদারের এক বান্ধবী
রেলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহনের সুপারিশ
রাজধানীর উপকণ্ঠে হবে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল দুই মেয়র
রাজউক পরিচালককে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ
‘অস্তিত্ব নেই’ এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে সতর্কতা জারি
নির্যাতনে প্রতিবন্ধী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সড়ক অবরোধ

বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ , ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪২

আবুলের বাঁশকল

পঞ্চাশ বছর ধরে ফসলের শত্রু ইঁদুর নিধন করেন

সাবজাল হোসেন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)

image

সাদাসিধে মানুষ কৃষকবান্ধব আবুল হোসেন জোয়ার্দার। বয়স ৮২। পেশায় পল্লী পশু চিকিৎসক। সেই সঙ্গে বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে মানুষের ফসলের শত্রু ইঁদুর নিধন করে আসছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেন নিজের তৈরি বাঁশকল বা (ফাঁদ) মৃত ইঁদুরের লেজ জমা দিয়ে সরকারি ইঁদুর নিধন দিবসে উপজেলা থেকে কয়েকবার সম্মাননাও পেয়েছেন। বয়োবৃদ্ধ আবুল হোসেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের জামাল ইউনিয়নের উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা।

গত শনিবার সরেজমিনে আবুল হোসেনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তার বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা রয়েছে প্রায় শতাধিক বাঁশকল বা ফাঁদ। বাড়ির অন্যপাশে তৈরি করা হচ্ছে আরও অনেকগুলো। বসতবাড়ি ও ফসলি খেতে ইঁদুরের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার কৃষকরা তার বাড়িতে এসে বিনামূল্যে বাঁশকল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। টিনের তৈরি একটি চালা ঘরে বেশ কিছু টিনের কৌটার মধ্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে মরা ইঁদুরের অসংখ্য শুকনো লেজ। যা তিনি উপজেলাতে জমা দেয়ার অপেক্ষায় আছেন।

আবুল হোসেন জোয়ার্দার জানান, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের বাবুনগর মাদ্রাসা থেকে ফাযিল পাস করে পল্লী পশু চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ কোর্স শেষ করেন। এরপর বিভিন্ন এলাকায় শুরু করেন পশু চিকিৎসেবা। এ কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে শুরু করেন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল নিধনের শত্রু ইঁদুর নিধন। তিনি বলেন, কৃষকরা অনেক কষ্ট করে পয়সা ব্যয় করে ফসল উৎপাদন করেন। সেই ফসল ইঁদুরে বিনষ্ট করে। এটা তাদের জন্য বড় ধরনের এক ক্ষতি। তাই কৃষকদের উপকারে তিনি শুরু করেন ইঁদুর নিধন। যা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রথমে বাজারের কেনা কল বা ফাঁদ ব্যবহার করতেন। এ ফাঁদে তেমন একটা কাজ করে না। তাছাড়া ব্যয়বহুল হওয়ায় পরে মাথা খাটিয়ে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন বিশেষ ফাঁদ বাঁশকল। তার এ চেষ্টা আজ সফল হয়েছে। এলাকায় এটা আবুলের বাঁশকল হিসেবে ব্যপক পরিচিত। ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষের সময় এ ফাঁদগুলো নিজের উদ্যোগে মাঠের বিভিন্ন খেতে নিজ উদ্যোগে পেতে রাখেন। কয়েক দিন পর দেখেন অনেক ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়েছে। অনেকগুলো মারাও গেছে। আবার অনেকে তার বাড়িতে এসে বলে যান খেতে বেশি ইঁদুর বাসা করলে। সময় বুঝে অনেকগুলো কল নিয়ে বসে থেকে তিনি চালান বিশেষ অভিযান।

আবুল হোসেন আরও জানান, এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের মাঠে তার কয়েক হাজার বাঁশকল পাতা আছে। এখন আমন ধানের মৌসুম চলছে। মৌসুম শেষ হচ্ছে প্রত্যেক মাঠ থেকে বাঁশকলগুলো বাড়িতে আনা শুরু করেছেন। আবার রবিশস্য পাকলে দেয়া হবে। এ মৌসুম শেষ হতে না হতেই আবার বোরো মৌসুমের ধান পাকা শুরু হবে। তখন আবার সেখানে ফাঁদগুলো পাতা হবে। তিনি আরও বলেন, শুধু পেতে আসলেই হয় না। মাঝে মধ্যে আবার মাঠের ফাঁদগুলো দেখে আসতে হয়। বাঁশকলের মধ্যে খাবার ফুরিয়ে গেলে আবার খাবার দেয়া লাগে। আর আটকা পড়া ইঁদুরগুলো বের করে নিয়ে লেজ কেটে নিয়ে দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা ও পরিবেশ সুরক্ষায় মাটি খানিকটা গর্ত করে মরা ইঁদুরের দেহাবশেষ পুতে রাখেন। লেজগুলো বাড়িতে এনে প্রথমে রোদে শুকান। পরে এগুলোকে জ্বলন্ত আগুনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছেকে জীবাণুমুক্ত করে শুকিয়ে বিশেষ কৌটায় ভরে রাখেন। বছরের ইঁদুর নিধন সপ্তাহে ইউএনও অফিসের মাধ্যমে কৃষি অফিসে জমা দেন। লেজ জমা দিয়ে এ পর্যন্ত তিনিই প্রতিবছর সেরা হন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এসে ফাঁদ নিয়ে যায়। এটা তিনি কৃষকসেবা হিসেবে মনে করেন। ইঁদুর একটি ইতর প্রাণী। এর শরীরে রোগজীবাণু থাকতে পারে। আর মূলদেহ মাটিতে গর্ত করে পুতে রাখেন। লেজগুলো প্রথমে ভালো করে রোদে শুকান। পরে আগুনে সেক দিয়ে শুকনা করে কৌটায় ভরে রাখেন। ইঁদুরের শরীরে নানা রোগ-জীবাণু রয়েছে। কামড়ও দিয়েছে অনেকবার কিন্তু নিজে সরে আসেননি। প্রথম দিকে পরিবারের সবাই বাধা দিতেন। কিন্ত এখন কৃষকের সেবার কথা ভেবে আর কেউ কিছু বলেন না। তিনি বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। তার দাবি- এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২ লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছেন। আগে লেজসহ মরা ইঁদুর মাটিতে পুতে রাখতেন। কিন্তু সরকারিভাবে যেদিন থেকে ইঁদুর নিধনের গুরুত দেয়া হয়েছে সেদিন থেকেই আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছেন।

উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মোমিন জানান, আমি ছোটবেলা থেকে গ্রামের আবুল হোসেনকে দেখছি পশুপাখি চিকিৎসাসহ কৃষকের ফসলি খেত, বসতবাড়ির ইঁদুর মেরে সেবা দিচ্ছেন। তার তৈরি ইঁদুর মারার বাঁশকল বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ বিনামূল্যে নিয়ে যান। কোন কোন সময়ে তিনি বিভিন্ন গ্রামের মাঠে গিয়ে নিজের বাঁশকল পেতে একটু দূরে বসে থাকেন। তার এ সেবাটা সবার জন্য উপকারে আসে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হুমায়ন কবির জানান, কৃষকদের ফসলি খেতের জন্য ইঁদুর অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া কমপক্ষে ৬০ রোগের জীবাণু বহন করে। এই ইঁদুর নিধনে আবুল হোসেন নিজের তৈরি বাঁশকল দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর তিনি প্রচুর পরিমাণ ইঁদুরের লেজ জমা দেন। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক তথ্যে জেনেছেন ইঁদুর খুব দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটায়। ইঁদুরের গর্ভধারণকাল ১৮-থেকে ২২ দিন পর্যন্ত হয়। বাচ্চা প্রসবের পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার গর্ভধারণ করতে পারে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে নিধন করা কতটা জরুরি। যে কাজটি আবুল হোসেন বিনা পারিশ্রমিকে করে থাকেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মুহাম্মদ মোহায়মেন আক্তার জানান, ইঁদুর পাকা ধান, গম, রবিশস্য, সবজি, বাসা-বাড়ির কাগজপত্র, কাপড়-চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট করে। কৃষি জরিপে দেখা গেছে, ইঁদুর বেশিরভাগ সেচনালা গর্ত করে পানির অপচয় ঘটায়। ফসল কাটার আগে ধান খেত ৫ থেকে ১৭ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট করে। অবাক তথ্য দিয়ে বলেন, ১০০টি ইঁদুর বছরে ১ টন খাদ্য খেয়ে ফেলতে পারে। এ ইঁদুর নিধনের জন্য উপকারী প্রাণী পেঁচা, শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, সাপ, গুই সাপ, বিড়ালজাতীয় প্রাণী কমে যাওয়ায় মাঠে ও বাসা-বাড়িতে ইঁদুর বেড়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। কিন্ত স্বেচ্চায় আবুল হোসেন তার উদ্ভাবিত বাঁশকল দিয়ে কৃষকদের সেবা প্রদান করছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূবর্ণা রানী সাহা জানান, ফসলি খেতের জন্য ইঁদুর একটি ভয়ানক শত্রু। প্রতিবছর সরকারিভাবে ইঁদুরনিধন সপ্তাহ দিয়ে ইঁদুর নিধনে কাজ করা হয়। কৃষকদের ইঁদুর নিধনে উৎসাহিত করতে মরা ইঁদুরের লেজ জমা নিয়ে জমাদানকারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ উপজেলায় আবুল হোসেন জোয়ার্দার প্রতিবছরই সবার চেয়ে বেশি জমা দিয়ে আসছেন। তার নিজের প্রযুক্তিতে তৈরি বাঁশকল এলাকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। বিনা পারিশ্রমিকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে সেবাটা দিচ্ছেন। বলা যায় আবুল হোসেনই কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু। তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।