বড়দিনের বড় শিক্ষা

মিথুশিলাক মুরমু

পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের কাছেই কোভিড-১৯ কী বার্তা দিতে চেয়েছে! বছরজুড়ে আমরা মানুষ বৈশ্বিক মহামারীর থাবাতে জবুথবু হয়ে পড়েছি; ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করছি; কিন্তু এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের করাল গ্রাস থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারিনি। প্রতিটি ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা স্রষ্টার কাছে আকূল মিনতি জানিয়ে আসছে, বোঝার চেষ্টা করেছে; ঈশ্বর মানুষকে কী বলতে চেয়েছেন! খ্রিস্টধর্মের ধর্মগুরুরা খ্রিস্টানুসারীদের সামনে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করেছেন ‘ফিরিয়া আইস’ অর্থাৎ ঈশ্বর তার সৃষ্টির মানুষকে ফিরে আসতে, অন্বেষণ করতে, শিক্ষা ও আদর্শকে অনুসরণ করতে অনুযোগ করছেন। আমাদের পুরোহিতগণ ধর্মীয় উপদেশে স্রষ্টার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব, মানুষে মানুষে দূরত্ব, সৃষ্টির সৌন্দর্য-সেটি হতে পারে প্রাণীজগৎ, জীবজগৎ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ইত্যাদির প্রতি আমাদের উদাসীনতাকেই দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। সৃষ্টির সূচনালগ্নে ঈশ্বর তার সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, ‘পরে ঈশ্বর আপনার নির্মিত বস্তু সবার প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সবই অতি উত্তম।’ আমরা মানুষ, আমাদের তিনি নিজ প্রতিমূর্তিতে তৈরি করেছেন, নিজের মুখের অক্সিজেন আমাদের নাকে ফুঁ দিয়ে সজীব করেছেন; আমরা সৃষ্টির সেরা, ‘আশরাফুল মাকলুকাত’ হয়েছি। বোধ করি, স্রষ্টা ঈশ্বর পুনর্বার আমাদের সেই শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মানদন্ডে যাচাই করে

নিচ্ছেন। সৃষ্টিকালীন মানুষের প্রতি ঈশ্বরের প্রত্যাশা ছিল- মানুষেরা তার মতো মমতায় চারিদিকের সব কিছুকে দেখভাল করবে; কর্তৃত্ব করবে। আদম-হবাকে জীবনদানের পর মুহূর্তেই ঈশ্বর তাদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ববান করে তুললেন, ‘ঈশ্বর কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও, এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভূত কর, আর সমুদ্রের মৎসগণের উপরে, আকাশের পক্ষিগণের উপরে, এবং ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবজন্তুর উপরে কর্তৃত্ব কর।...আমি সমস্ত ভূতলে স্থিত যাবতীয় বীজোৎপাদক ওষধি ও যাবতীয় সবিজ ফলদায়ী বৃক্ষ তোমাদিগকে দিলাম, তাহা তোমাদের খাদ্য হইবে।’

কর্তৃত্বের নামে আমরা ঈশ্বরের আদিষ্ট সব নিয়মানুবর্তিতাকে অবজ্ঞা করেছি, ঈশ্বরের অপছন্দের বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে ক্রমশই স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ভক্ষণীয় নয় এমন কিছুই নেই, হিংস্র পশু থেকে পোষমানা ক্ষুদ্র কী বৃহৎ সর্বপ্রকার প্রাণীই আমরা দেদারসে সাবাড় করে চলেছি। দুমুর্খেরা বলে থাকে, মানুষ জলের জাহাজ বা আকাশের জাহাজ ব্যতিত সবই হজম করতে পারে। আমরা পশুদের বিষয়ে কতটুকু সংবেদনশীল! আমরা প্রাণিজগতে রক্ষার জন্য কতটুকু দায়িত্ব পালন করি! পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করে আমাদের সচেতন করার প্রয়াস চালিয়েছে; কিন্তু কর্তৃত্বের দাম্ভিকতা আমাদের মোহবিষ্ট করে তুলেছে। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য আমরা মানুষেরাই দায়ী।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যেন দিন দিনই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। আমাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, অন্যের বিষয়ে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে, নৈতিক দায়িত্ব জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছি। আবার কখনও অন্যের অর্থ-সহায়-সম্পত্তি দখলবাজ, ভূমিদস্যুতা, চরিত্রহীনতা, গুন্ডামি এবং হত্যার মতো বর্বরতম কাজ করতেও আমরা মানুষেরা উল্লাসিত হই; তখনই স্র্রষ্টা পৃথিবীর দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি, আপনি, আমরা হয়তো মনে করি, আমাদের পক্ষে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো অসম্ভব! ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের অযোগ্য মনে করি! মনে করি, আপনি ভালো তো জগৎ ভালো।

বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর অজস্র মানুষের কাছে ঈশ্বর তার নবীর মাধ্যমে আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন, ‘হে মনুষ্য, যাহা ভালো, তাহা তিনি তোমাকে জানাইয়াছেন; বস্তুত ন্যায্য আচরণ, দয়ায় অনুরাগ ও নম্রভাবে তোমার ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন, ইহা ব্যতিরেকে সদাপ্রভু তোমার কাছে আর কিসের অনুসন্ধান করেন’ (মীখা ৬:৮)? তবে কী, সত্যে কথা বলতে স্র্রষ্টা আশান্বিত হয়ে পুনর্বার আমাদের জানিয়েছেন, ‘তোমরা যিরূশালেমের সড়কে সড়কে দৌড়াদৌড়ি কর, দেখ, জ্ঞাত হও, এবং তথাকার সব চকে অন্বেষণ কর; যদি এমন একজনকেও পাইতে পার, যে ন্যায়াচরণ করে, সত্যের অনুশীলন করে, তবে আমি নগরকে ক্ষমা করিব’ (যিরমিয় ৫:১)। একটি শহরকে, নগরকে, দেশকে রক্ষা করতে ঈশ্বর একজন মানুষের প্রত্যাশা করে। করোনাভাইরাসের পর্যুদস্তু বড়দিনে একজন মানুষের বড় প্রয়োজন, যিনি সর্বদা সত্য, ন্যায় ও ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে পরিবার, সমাজ, জাতি ও দেশের দিশারী হয়ে নেতৃত্ব দেবেন; যিনি স্রষ্টা ও মানুষকে ভালোবেসে পৃথিবীকে ভূস্বর্গতে পরিণত করবেন।

করোনাকালীন বড়দিন কীভাবে ভালোবাসার সর্বোচ্চ নিদর্শন হতে পারে! ভালোবাসায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন, আবার কখনও ভালোবাসার নিদর্শন উজ্জ্বলতম হয়ে ওঠে। পবিত্র বাইবেলে প্রাপ্ত হই, প্রভু যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীর মানুষকে পাপের বন্ধন থেকে বাঁচাতে আত্মাহুতি দিয়েছেন, মিথ্যার সঙ্গে আপোস না করার আদর্শ দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতিহীন ও আইনবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থার প্রতি ষড়যন্ত্রের সন্দেহকে সুস্পষ্ট করেছেন; সরকারের আজ্ঞাবহ সৈন্যসামন্তকে নিঃশর্তে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর এ সব কিছুই সম্ভবপর হয়েছে আমাদের প্রতি তার শতভাগ ভালোবাসার জন্য। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রেমে ভয় নাই বরং সিদ্ধ প্রেম ভয়কে বাহির করিয়া দেয়’ (১ম যোহন ৪:১৭)।

যিশুর ভালোবাসায় অন্ধেরা চোখের আলো পেয়েছে, খঞ্জরা হাঁটতে পেরেছে, খাদ্যহীনরা খাবার পেয়েছে, নারী-শিশুদের অধিকার সমাজের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীরা অপব্যাখ্যায় লজ্জিত হয়েছে, অচ্ছুত ও নিগৃহতদের ঈশ্বরের রাজ্যের নাগরিক হওয়ার অধিকার দিয়েছেন। সামাজিক বৈষম্য, জাতি ভেদাভেদ, অর্থনৈতিক সাম্যতা, নৈতিকতার রাজনীতির দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য, সৎ কর্ম করার চেতনা এবং স্রষ্টার সঙ্গে আত্মিক মেলবন্ধনের সেতুকে তিনি পাকাপোক্ত করেছেন। পৃথিবীর মানুষের প্রতি, প্রতিবেশীর প্রতি করণীয়ের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, সেটিকে চলমান রাখা এবং অনুশীলন করা তার অনুসারীদের আবশ্যিক। খ্রিষ্টকে শতভাগ ভালোবাসতে পারলে সব বাধা-বিপত্তিকেই উৎরানো সম্ভবপর হবে।

করোনাকালীন বড়দিন আমাদের জন্য শতভাগ ভালোবাসা প্রদর্শনের বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছে। আমি কী আমাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত আছি! হয়তো বৈশ্বিক মহামারীতে নিকটজনকে হারিয়েছি, সেটি জাগতিকভাবে কষ্টদায়ক ও মনোব্যথার কারণ হতে পারে কিন্তু খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জন্য আনন্দদায়ক। বিশ্বাসীরা প্রভুর সান্নিধ্যে থেকে গৌরব প্রশংসায় অংশী হতে পারে। গোটা বিশ্ব কোভিড- ১৯ করাল গ্রাসে ক্ষত-বিক্ষত, মানুষকূল-ই নয়, জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ ও পরিবেশের ভারসাম্যকে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনধারণের অনুপযুক্ত করে তুলেছি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার মানবকুলকে হুঁশিয়ারি করেছে, দায়িত্বপালনে যত্নবান হতে আহ্বান জানাচ্ছে। বড়দিন ভালোবাসা প্রকাশের দিন। মানুষের প্রতি মানুষের, সব সৃষ্টির প্রতি; ঈশ্বরের ‘উত্তম’ সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। প্রভু যীশু আমাদের আদেশ দিয়েছেন, ‘তুমি তোমার সব অন্তঃকরণ, তোমার সব প্রাণ, তোমার সব শক্তি ও তোমার সব চিত্ত দিয়ে তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে, এবং তোমার প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করিবে।’ প্রতিবেশী বলতে শুধুমাত্র মানুষ নয়, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুকেই ভালোবাসাতে বলেছেন। শুভ বড়দিন ও নববর্ষ আমাদের জন্য বয়ে আনুক- শান্তি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা।

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ০৯ রবিউস সানি ১৪৪২

বড়দিনের বড় শিক্ষা

মিথুশিলাক মুরমু

image

পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের কাছেই কোভিড-১৯ কী বার্তা দিতে চেয়েছে! বছরজুড়ে আমরা মানুষ বৈশ্বিক মহামারীর থাবাতে জবুথবু হয়ে পড়েছি; ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করছি; কিন্তু এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের করাল গ্রাস থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারিনি। প্রতিটি ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা স্রষ্টার কাছে আকূল মিনতি জানিয়ে আসছে, বোঝার চেষ্টা করেছে; ঈশ্বর মানুষকে কী বলতে চেয়েছেন! খ্রিস্টধর্মের ধর্মগুরুরা খ্রিস্টানুসারীদের সামনে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করেছেন ‘ফিরিয়া আইস’ অর্থাৎ ঈশ্বর তার সৃষ্টির মানুষকে ফিরে আসতে, অন্বেষণ করতে, শিক্ষা ও আদর্শকে অনুসরণ করতে অনুযোগ করছেন। আমাদের পুরোহিতগণ ধর্মীয় উপদেশে স্রষ্টার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব, মানুষে মানুষে দূরত্ব, সৃষ্টির সৌন্দর্য-সেটি হতে পারে প্রাণীজগৎ, জীবজগৎ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ইত্যাদির প্রতি আমাদের উদাসীনতাকেই দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। সৃষ্টির সূচনালগ্নে ঈশ্বর তার সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, ‘পরে ঈশ্বর আপনার নির্মিত বস্তু সবার প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সবই অতি উত্তম।’ আমরা মানুষ, আমাদের তিনি নিজ প্রতিমূর্তিতে তৈরি করেছেন, নিজের মুখের অক্সিজেন আমাদের নাকে ফুঁ দিয়ে সজীব করেছেন; আমরা সৃষ্টির সেরা, ‘আশরাফুল মাকলুকাত’ হয়েছি। বোধ করি, স্রষ্টা ঈশ্বর পুনর্বার আমাদের সেই শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মানদন্ডে যাচাই করে

নিচ্ছেন। সৃষ্টিকালীন মানুষের প্রতি ঈশ্বরের প্রত্যাশা ছিল- মানুষেরা তার মতো মমতায় চারিদিকের সব কিছুকে দেখভাল করবে; কর্তৃত্ব করবে। আদম-হবাকে জীবনদানের পর মুহূর্তেই ঈশ্বর তাদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ববান করে তুললেন, ‘ঈশ্বর কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও, এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভূত কর, আর সমুদ্রের মৎসগণের উপরে, আকাশের পক্ষিগণের উপরে, এবং ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবজন্তুর উপরে কর্তৃত্ব কর।...আমি সমস্ত ভূতলে স্থিত যাবতীয় বীজোৎপাদক ওষধি ও যাবতীয় সবিজ ফলদায়ী বৃক্ষ তোমাদিগকে দিলাম, তাহা তোমাদের খাদ্য হইবে।’

কর্তৃত্বের নামে আমরা ঈশ্বরের আদিষ্ট সব নিয়মানুবর্তিতাকে অবজ্ঞা করেছি, ঈশ্বরের অপছন্দের বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে ক্রমশই স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ভক্ষণীয় নয় এমন কিছুই নেই, হিংস্র পশু থেকে পোষমানা ক্ষুদ্র কী বৃহৎ সর্বপ্রকার প্রাণীই আমরা দেদারসে সাবাড় করে চলেছি। দুমুর্খেরা বলে থাকে, মানুষ জলের জাহাজ বা আকাশের জাহাজ ব্যতিত সবই হজম করতে পারে। আমরা পশুদের বিষয়ে কতটুকু সংবেদনশীল! আমরা প্রাণিজগতে রক্ষার জন্য কতটুকু দায়িত্ব পালন করি! পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করে আমাদের সচেতন করার প্রয়াস চালিয়েছে; কিন্তু কর্তৃত্বের দাম্ভিকতা আমাদের মোহবিষ্ট করে তুলেছে। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য আমরা মানুষেরাই দায়ী।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যেন দিন দিনই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। আমাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, অন্যের বিষয়ে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে, নৈতিক দায়িত্ব জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছি। আবার কখনও অন্যের অর্থ-সহায়-সম্পত্তি দখলবাজ, ভূমিদস্যুতা, চরিত্রহীনতা, গুন্ডামি এবং হত্যার মতো বর্বরতম কাজ করতেও আমরা মানুষেরা উল্লাসিত হই; তখনই স্র্রষ্টা পৃথিবীর দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি, আপনি, আমরা হয়তো মনে করি, আমাদের পক্ষে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো অসম্ভব! ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের অযোগ্য মনে করি! মনে করি, আপনি ভালো তো জগৎ ভালো।

বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর অজস্র মানুষের কাছে ঈশ্বর তার নবীর মাধ্যমে আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন, ‘হে মনুষ্য, যাহা ভালো, তাহা তিনি তোমাকে জানাইয়াছেন; বস্তুত ন্যায্য আচরণ, দয়ায় অনুরাগ ও নম্রভাবে তোমার ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন, ইহা ব্যতিরেকে সদাপ্রভু তোমার কাছে আর কিসের অনুসন্ধান করেন’ (মীখা ৬:৮)? তবে কী, সত্যে কথা বলতে স্র্রষ্টা আশান্বিত হয়ে পুনর্বার আমাদের জানিয়েছেন, ‘তোমরা যিরূশালেমের সড়কে সড়কে দৌড়াদৌড়ি কর, দেখ, জ্ঞাত হও, এবং তথাকার সব চকে অন্বেষণ কর; যদি এমন একজনকেও পাইতে পার, যে ন্যায়াচরণ করে, সত্যের অনুশীলন করে, তবে আমি নগরকে ক্ষমা করিব’ (যিরমিয় ৫:১)। একটি শহরকে, নগরকে, দেশকে রক্ষা করতে ঈশ্বর একজন মানুষের প্রত্যাশা করে। করোনাভাইরাসের পর্যুদস্তু বড়দিনে একজন মানুষের বড় প্রয়োজন, যিনি সর্বদা সত্য, ন্যায় ও ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে পরিবার, সমাজ, জাতি ও দেশের দিশারী হয়ে নেতৃত্ব দেবেন; যিনি স্রষ্টা ও মানুষকে ভালোবেসে পৃথিবীকে ভূস্বর্গতে পরিণত করবেন।

করোনাকালীন বড়দিন কীভাবে ভালোবাসার সর্বোচ্চ নিদর্শন হতে পারে! ভালোবাসায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন, আবার কখনও ভালোবাসার নিদর্শন উজ্জ্বলতম হয়ে ওঠে। পবিত্র বাইবেলে প্রাপ্ত হই, প্রভু যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীর মানুষকে পাপের বন্ধন থেকে বাঁচাতে আত্মাহুতি দিয়েছেন, মিথ্যার সঙ্গে আপোস না করার আদর্শ দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতিহীন ও আইনবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থার প্রতি ষড়যন্ত্রের সন্দেহকে সুস্পষ্ট করেছেন; সরকারের আজ্ঞাবহ সৈন্যসামন্তকে নিঃশর্তে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর এ সব কিছুই সম্ভবপর হয়েছে আমাদের প্রতি তার শতভাগ ভালোবাসার জন্য। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রেমে ভয় নাই বরং সিদ্ধ প্রেম ভয়কে বাহির করিয়া দেয়’ (১ম যোহন ৪:১৭)।

যিশুর ভালোবাসায় অন্ধেরা চোখের আলো পেয়েছে, খঞ্জরা হাঁটতে পেরেছে, খাদ্যহীনরা খাবার পেয়েছে, নারী-শিশুদের অধিকার সমাজের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীরা অপব্যাখ্যায় লজ্জিত হয়েছে, অচ্ছুত ও নিগৃহতদের ঈশ্বরের রাজ্যের নাগরিক হওয়ার অধিকার দিয়েছেন। সামাজিক বৈষম্য, জাতি ভেদাভেদ, অর্থনৈতিক সাম্যতা, নৈতিকতার রাজনীতির দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য, সৎ কর্ম করার চেতনা এবং স্রষ্টার সঙ্গে আত্মিক মেলবন্ধনের সেতুকে তিনি পাকাপোক্ত করেছেন। পৃথিবীর মানুষের প্রতি, প্রতিবেশীর প্রতি করণীয়ের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, সেটিকে চলমান রাখা এবং অনুশীলন করা তার অনুসারীদের আবশ্যিক। খ্রিষ্টকে শতভাগ ভালোবাসতে পারলে সব বাধা-বিপত্তিকেই উৎরানো সম্ভবপর হবে।

করোনাকালীন বড়দিন আমাদের জন্য শতভাগ ভালোবাসা প্রদর্শনের বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছে। আমি কী আমাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত আছি! হয়তো বৈশ্বিক মহামারীতে নিকটজনকে হারিয়েছি, সেটি জাগতিকভাবে কষ্টদায়ক ও মনোব্যথার কারণ হতে পারে কিন্তু খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জন্য আনন্দদায়ক। বিশ্বাসীরা প্রভুর সান্নিধ্যে থেকে গৌরব প্রশংসায় অংশী হতে পারে। গোটা বিশ্ব কোভিড- ১৯ করাল গ্রাসে ক্ষত-বিক্ষত, মানুষকূল-ই নয়, জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ ও পরিবেশের ভারসাম্যকে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনধারণের অনুপযুক্ত করে তুলেছি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার মানবকুলকে হুঁশিয়ারি করেছে, দায়িত্বপালনে যত্নবান হতে আহ্বান জানাচ্ছে। বড়দিন ভালোবাসা প্রকাশের দিন। মানুষের প্রতি মানুষের, সব সৃষ্টির প্রতি; ঈশ্বরের ‘উত্তম’ সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। প্রভু যীশু আমাদের আদেশ দিয়েছেন, ‘তুমি তোমার সব অন্তঃকরণ, তোমার সব প্রাণ, তোমার সব শক্তি ও তোমার সব চিত্ত দিয়ে তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে, এবং তোমার প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করিবে।’ প্রতিবেশী বলতে শুধুমাত্র মানুষ নয়, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুকেই ভালোবাসাতে বলেছেন। শুভ বড়দিন ও নববর্ষ আমাদের জন্য বয়ে আনুক- শান্তি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা।