পাল্টে দেবে দক্ষিণের অর্থনীতি ও জীবনধারা

বেসরকারি বিনিয়োগের উদ্যোগ জমি কেনা শুরু জাজিরা থেকে মোংলা

প্রমত্তা পদ্মার বুকে জমে থাকা হাজারো দীর্ঘশ্বাস এখন আবেগের অশ্রু হয়ে জমা হয়েছে খুলনা অঞ্চলের মানুষের চোখে। স্বপ্ন আজ সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। সরকার আশা করছে ২০২২ সালের জুনে সেতুতে গাড়ি চলবে। সহজ হবে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ। এছাড়া এ অঞ্চলে আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প বিশেষ করে বাগেরহাটের ফয়লায় বিমান বন্দর, খুলনা-মোংলা রেললাইন, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরে দুটি ইপিজেড, খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পাইপলাইনে গ্যাস, দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, শিল্পশহর নওয়াপাড়া নদীবন্দর, বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, ভোমরা ও দর্শনা স্থলবন্দরের উন্নয়ন, বেনাপোল থেকে সরাসরি ঢাকা ট্রেন যোগাযোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খুলনার সদ্যবিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে বেসরকারি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। বিনিয়োগকারীরা জাজিরা প্রান্ত থেকে শুরু করে মোংলা বন্দরের আশপাশের এলাকায় জমি কিনতে শুরু করেছেন। গড়ে উঠছে অসংখ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান। রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। পরিবহন ও কৃষি সেক্টরও উজ্জীবিত হবে। এতে অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে উত্তরের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে খুলনা ও বরিশাল। পিছিয়ে থাকার জন্য অবকাঠামোর দুর্বলতাকেই দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। এক সময় খুলনাকে বলা হতো শিল্পনগরী। কিন্তু যোগাযোগ, অবকাঠামো ও গ্যাস না থাকায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একে একে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে অনেক শিল্প-কারখানা অস্তিত্ব হারিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েছে খুলনা। খুলনা ছেড়ে মানুষ ঢাকাসহ অন্য এলাকায় গেছে কাজের খোঁজে। নদীর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করেছে খুলনা অঞ্চলের মানুষ। এসব আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। অরাজনৈতিক এই সংগঠনটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, এই একটি সেতুতে কতো মানুষের আবেগ-ভালোবাসা জড়িত এটা বোঝানো সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপনের দৃশ্য দেখে আনন্দে চোখের পানি ফেলেছি। আমার মতো অনেকের চোখেই আনন্দ অশ্রু ঝরেছে। পদ্মা সেতুতে চলাচল শুরু হলে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হবে। তখন সকালে খুলনা থেকে বের হয়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ সেরে বিকেলেই খুলনায় ফেরা যাবে।

আশরাফ উজ জামান বলেন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গ্যাসের অভাবে খুলনা অঞ্চলে বড় কোন শিল্প-কারখানা তৈরি হয়নি। মোংলার সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বন্দরও গতি পায়নি। পদ্মা সেতুর কারণে সেই সংকট দূর হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকাসহ অন্য অঞ্চলে দ্রুত পণ্য পাঠানো সহজ হওয়ায় মোংলা বন্দর দ্রুত গতিশীল হবে। মোংলা বন্দর কাছে থাকায় অন্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও এখানে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হবেন। খুলনা বিভাগীয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিচালক প্রণব কুমার রায় বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। এর ফলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।

তিনি বলেন, গত চার বছরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১১৪টি ছোট, বড় ও মাঝারি শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিনিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজার ২২৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার ৫৪৯ জনের।

প্রণব বলেন, নতুন গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইস মিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, প্রোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, উড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডকইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টকস অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টকস, নির্মাণ শিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্লান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি-আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন।

কাজী আমিন বলেন, পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বাড়বে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা হলে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হবে। এমনকি ভুটান, পূর্ব নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশের জন্য পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, খুলনার হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্প থেকে আয় আরও বাড়বে। কমে যাবে পণ্য পরিবহনের খরচ। সেতুতে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন, সাধারণ মানুষের যাতায়াতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। বিনিয়োগ বাড়বে, দ্রুত শিল্প-কারখানা তৈরি হবে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

কাজী আমিন বলেন, মোংলা বন্দরসহ আশপাশের এলাকায় দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপের জমি কেনা রয়েছে। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন। খানজাহান আলী বিমানবন্দর এবং চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, সেতুটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশের উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাবে খুলনাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার বাড়বে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর ফলে এ অঞ্চলের উন্নয়নের নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের প্রধান প্রফেসর ড. মো. নাসিফ আহসান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর উজ্জীবিত হবে। রাজধানীর সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ঢাকা-মোংলা বন্দরের অন্তত ৮৭ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। ব্যবসায়ীরা সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। আবার খুলনায় ফিরতে শুরু করবে মানুষ। নাসিফ বলেন, বর্তমান অবস্থায় মোংলা বন্দর থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন বাণিজ্য সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হলে তা বেড়ে ১০ বিলিয়নে চলে যাবে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর, সুন্দরবনসহ এ অঞ্চলে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠবে।

সার্বিকভাবে দক্ষিণাঞ্চল একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। যা দেশের জিডিপিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মামুন অর রশিদ বলেন, পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ কররে। যা শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এই সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ছে। মামুন বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও বেশি জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। এই অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জীবনমানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। মামুন বলেন, ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হবে। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও উন্নয়ন ঘটবে। এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের গতি বাড়ার পাশাপাশি আয়ের বৈষম্যও কমবে।

শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ , ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ১০ রবিউস সানি ১৪৪২

পদ্মা সেতু

পাল্টে দেবে দক্ষিণের অর্থনীতি ও জীবনধারা

বেসরকারি বিনিয়োগের উদ্যোগ জমি কেনা শুরু জাজিরা থেকে মোংলা

শুভ্র শচীন, খুলনা

প্রমত্তা পদ্মার বুকে জমে থাকা হাজারো দীর্ঘশ্বাস এখন আবেগের অশ্রু হয়ে জমা হয়েছে খুলনা অঞ্চলের মানুষের চোখে। স্বপ্ন আজ সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। সরকার আশা করছে ২০২২ সালের জুনে সেতুতে গাড়ি চলবে। সহজ হবে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ। এছাড়া এ অঞ্চলে আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প বিশেষ করে বাগেরহাটের ফয়লায় বিমান বন্দর, খুলনা-মোংলা রেললাইন, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরে দুটি ইপিজেড, খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পাইপলাইনে গ্যাস, দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, শিল্পশহর নওয়াপাড়া নদীবন্দর, বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, ভোমরা ও দর্শনা স্থলবন্দরের উন্নয়ন, বেনাপোল থেকে সরাসরি ঢাকা ট্রেন যোগাযোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খুলনার সদ্যবিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে বেসরকারি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। বিনিয়োগকারীরা জাজিরা প্রান্ত থেকে শুরু করে মোংলা বন্দরের আশপাশের এলাকায় জমি কিনতে শুরু করেছেন। গড়ে উঠছে অসংখ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান। রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। পরিবহন ও কৃষি সেক্টরও উজ্জীবিত হবে। এতে অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে উত্তরের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে খুলনা ও বরিশাল। পিছিয়ে থাকার জন্য অবকাঠামোর দুর্বলতাকেই দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। এক সময় খুলনাকে বলা হতো শিল্পনগরী। কিন্তু যোগাযোগ, অবকাঠামো ও গ্যাস না থাকায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একে একে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে অনেক শিল্প-কারখানা অস্তিত্ব হারিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েছে খুলনা। খুলনা ছেড়ে মানুষ ঢাকাসহ অন্য এলাকায় গেছে কাজের খোঁজে। নদীর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করেছে খুলনা অঞ্চলের মানুষ। এসব আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। অরাজনৈতিক এই সংগঠনটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, এই একটি সেতুতে কতো মানুষের আবেগ-ভালোবাসা জড়িত এটা বোঝানো সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপনের দৃশ্য দেখে আনন্দে চোখের পানি ফেলেছি। আমার মতো অনেকের চোখেই আনন্দ অশ্রু ঝরেছে। পদ্মা সেতুতে চলাচল শুরু হলে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হবে। তখন সকালে খুলনা থেকে বের হয়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ সেরে বিকেলেই খুলনায় ফেরা যাবে।

আশরাফ উজ জামান বলেন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গ্যাসের অভাবে খুলনা অঞ্চলে বড় কোন শিল্প-কারখানা তৈরি হয়নি। মোংলার সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বন্দরও গতি পায়নি। পদ্মা সেতুর কারণে সেই সংকট দূর হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকাসহ অন্য অঞ্চলে দ্রুত পণ্য পাঠানো সহজ হওয়ায় মোংলা বন্দর দ্রুত গতিশীল হবে। মোংলা বন্দর কাছে থাকায় অন্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও এখানে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হবেন। খুলনা বিভাগীয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিচালক প্রণব কুমার রায় বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। এর ফলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।

তিনি বলেন, গত চার বছরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১১৪টি ছোট, বড় ও মাঝারি শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিনিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজার ২২৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার ৫৪৯ জনের।

প্রণব বলেন, নতুন গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইস মিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, প্রোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, উড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডকইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টকস অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টকস, নির্মাণ শিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্লান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি-আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন।

কাজী আমিন বলেন, পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বাড়বে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা হলে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হবে। এমনকি ভুটান, পূর্ব নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশের জন্য পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, খুলনার হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্প থেকে আয় আরও বাড়বে। কমে যাবে পণ্য পরিবহনের খরচ। সেতুতে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন, সাধারণ মানুষের যাতায়াতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। বিনিয়োগ বাড়বে, দ্রুত শিল্প-কারখানা তৈরি হবে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

কাজী আমিন বলেন, মোংলা বন্দরসহ আশপাশের এলাকায় দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপের জমি কেনা রয়েছে। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন। খানজাহান আলী বিমানবন্দর এবং চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, সেতুটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশের উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাবে খুলনাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার বাড়বে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর ফলে এ অঞ্চলের উন্নয়নের নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের প্রধান প্রফেসর ড. মো. নাসিফ আহসান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর উজ্জীবিত হবে। রাজধানীর সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ঢাকা-মোংলা বন্দরের অন্তত ৮৭ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। ব্যবসায়ীরা সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। আবার খুলনায় ফিরতে শুরু করবে মানুষ। নাসিফ বলেন, বর্তমান অবস্থায় মোংলা বন্দর থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন বাণিজ্য সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হলে তা বেড়ে ১০ বিলিয়নে চলে যাবে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর, সুন্দরবনসহ এ অঞ্চলে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠবে।

সার্বিকভাবে দক্ষিণাঞ্চল একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। যা দেশের জিডিপিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মামুন অর রশিদ বলেন, পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ কররে। যা শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এই সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ছে। মামুন বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও বেশি জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। এই অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জীবনমানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। মামুন বলেন, ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হবে। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও উন্নয়ন ঘটবে। এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের গতি বাড়ার পাশাপাশি আয়ের বৈষম্যও কমবে।