স্মরণসভায় বক্তারা

খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে সমাজ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা

খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে সমাজ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

দৈনিক সংবাদ-এর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামানের স্মরণে এক ভার্চুয়াল স্মরণসভায় দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকরা এ কথা বলেন। সংবাদ পরিবারের পক্ষ থেকে এ সভার আয়োজন করা হয়। সংবাদ-এর সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক সংবাদ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ূন। সভা সঞ্চালনা করেন দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক কাজী রফিক।

স্মরণসভায় যুক্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে সমাজ গড়ার একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি বাংলাদেশের ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণদের অন্যতম, যারা সমাজকে পরিবর্তিত করেছেন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সাইফুদ্দিন মানিক ও মোহাম্মদ ফরহাদের হাতেগড়া এ তরুণরা বাংলাদেশের প্রতিটি উচ্চপদে কর্মরত আছেন। মুনীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ছাত্ররাজনীতি, উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি বৈষয়িক মানুষ ছিলেন না। সংসার ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতি তার আকর্ষণ ছিল কম। তার দায়িত্ববোধ ছিল খুবই বেশি। তিনি আগরতলা হতে এসে আমাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন। দায়িত্ববোধের সামনে তার কোন ভয় বা শঙ্কা ছিল না।’

বক্তব্যের এক পর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘তার মতো মানুষ আর আসবে না। তার চিন্তা, কর্ম-উদ্দীপনা, আদর্শ ধরে রাখতে পারলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’

সাহিত্যিক, গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘খন্দকার মুনীরুজ্জামান আমার বাল্যবন্ধু। তিনি খুবই দক্ষ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও আন্দোলন ও বিপ্লবের সমন¦য়ক ছিলেন। সেন্ট গ্রেগরি ও কলেজিয়েট স্কুলের সে সময়কার ছাত্র সেলিম, মুকুল, মাহফুজ, মন্টু ও মুনীর একই সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছিল। তখনকার সময়ে ঢাবির ভিসি সাজ্জাদ হোসাইনের প্রেরণায় অনেকে আইসিএসওএনএসএফ-এ যোগ দিলেও সে এবং তার বন্ধুরা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আন্দোলনে তারা অংশ নিয়েছিল। সবার মধ্যে মুনীর ছিল বহুমাত্রিক ব্যক্তি।’

শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, সাংবাদিকতা, মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আদর্শিক যুবক গঠনের জন্য ব্যায়ামাগার ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় খন্দকার মুনীরুজ্জামানের অবদান ছিল উল্লেখ করে মফিদুল হক বলেন, ‘সে দায়িত্ব-সচেতন ছিল, একতায় কাজ করার সময় ২৫ মাচের্র কালরাত্রিতে সে প্রেসের পত্রিকা ছাপানোর কাজে নিয়োজিত ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আদেশ না দিলে সে হয়তো প্রেস ছেড়ে যেত না। সে ছোট থেকেই ‘সংবাদ’ পত্রিকা পড়ত। সংবাদে যোগ দেয়ার মাধ্যমে সে তার জীবনের একটি বৃত্তকে পূর্ণ করে।’

সাংবাদিক চপল বাশার বলেন, ‘১৯৬০ সাল থেকে আমি তাকে চিনি। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ১৯৬৬-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। ওই সময়কার ছাত্র ইউনিয়নের এ কমিটিতে খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিল প্রচার সম্পাদক। এ কমিটি খুবই শক্তিশালী ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সমস্ত স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাবশালী ছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বেধে ওঠছিল। প্রায় সব জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে সংগঠনটি ছিল প্রধান নিয়ামক শক্তি। মুনীর এ সংগঠনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সব আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল। মুনীর একটি শোষণহীন, শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা করেছিল। আমি আশাবাদী একদিন তার আদর্শ অনুসারে সমাজ পরিবর্তিত হবে।’

বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয়দাশ গুপ্ত বলেন, ‘মুনীর ভাই ১৯৯৪ সালের দিকে তুমুল জনপ্রিয় পত্রিকা যায়যায়দিনের সাংবাদিক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘একতার’ দায়িত্বে ছিলেন । শফিক রেহমান তার পেশাগত দক্ষতার কারণেই তাকে যায়যায়দিনে নিয়োগ দেন। তিনি হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে এনএসএফ-এর ‘মাইরপিট বাহিনীর’ বিরুদ্ধেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘মুনীর ভাই একজন নির্লোভ, সৎ এবং দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বে থাকাকালে আমার মতো সাধারণ কর্মীরও খবর রাখতেন। আমার বাবার মৃত্যুতে তিনি আমাকে সান্ত¡না দিয়ে চিঠিও দেন। সাংবাদিক হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টির মহানগর কমিটির নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তিনি আমাকে আমার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং উজলা ম্যাচ ফ্যাক্টরির বিভিন্ন এলাকাতে নিয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন এ দায়িত্বে থাকতে হলে আমাকে সঠিকভাবে শ্রমিক-মজুরদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, যা সংবাদিক হিসেবে হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দায়িত্ব-সচেতন এ মানুষটির উচ্চপদের প্রতি কোন মোহ ছিল না।’

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘সম্পাদক পরিষদের দায়িত্ব পালনকালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি খুবই মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। সম্পাদক পরিষদের উপকমিটিতেও তার সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি ঢাকার বাইরে কোন সাংবাদিকদের প্রতি কোন অবিচার, অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদ করতে বলতেন। তিনি আমার লেখারও প্রশংসা করতেন। তার মৃত্যুতে সংবাদপত্র এবং মিডিয়া জগৎ একজন নিরলস কর্মী ও প্রিয়জনকে হারালো।’

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) কাইউম খান বলেন, ‘১৯৬৯ এবং ১৯৭০-এর আন্দোলনে তার সঙ্গে একসাথে কাজ করেছি। তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনুসারে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার লেখা বইয়ের অনুবাদও তিনি করেছেন। তিনি একজন দক্ষ অনুবাদক ছিলেন।’

ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, “আমি ‘খেলাঘর’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়ে আমার সঙ্গে সংবাদের সম্পৃক্ততা শুরু। খন্দকার মুনীরুজ্জামারে স্ত্রী ডা. রোকেয়া খাতুন আপা আমাদের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের গাইড দিতেন। মানুষের বিশ্বাস, চেতনা ও জ্ঞান মানুষকে যেমন একটি বিশেষ দিকে চালিত করে। তেমনি মুনীর ভাই এবং তার স্ত্রী আমার জীবনের একটি স্তম্ভ। তিনি আমাকে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহ দিতেন।”

ডা. রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘তিনি সারাজীবন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবাক এবং প্রফেশনালিজমে বিশ্বাস করতেন। ধর্মের নামে যারা অপব্যাখ্যা দেন তাদের প্রতিরোধের মাধ্যমে এবং তার আদর্শের প্রচারের মাধ্যমেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’

স্মরণসভার সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাশেম হুমায়ূন বলেন, ‘যারা সংবাদকে ভালোবাসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভালোবাসেন তাদের জন্য খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যু একটি বিশাল ক্ষতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সংবাদপত্র প্রাতিষ্ঠানিক জগতে তার শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। আমরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।’

স্মরণসভার শুরুতে প্রয়াত খন্দকার মুনীরুজ্জামানের প্রতি দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শ্রদ্ধা জানান সংবাদ পরিবারের প্রতিটি বিভাগ থেকে প্রধান প্রতিবেদক সালাম জুবায়ের, সিনিয়র রিপোর্টার বাকী বিল্লাহ, ক্রীড়া বিভাগের কাশীনাথ বসাক, সাহিত্য সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ, সম্পাদনা সহকারী বিভাগের রেজাউল করিম, কম্পিউটার বিভাগের হাবিবুর রহমান মিলন।

image
আরও খবর
প্রধানমন্ত্রী ‘ধ্রুবতারা’ উদ্বোধন করবেন আজ
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের হার কমছে
বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ পেলেন ৭ বিশিষ্ট ব্যক্তি
কবি সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন আজ
জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ ঘোষণা
অভিনেতা আবদুল কাদেরের মৃত্যু
আ’লীগের নেতৃত্বে থাকবেন ত্যাগীরাই তথ্যমন্ত্রী
পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার : ড. রাজ্জাক
তৃতীয় ধাপের ৬৪ পৌরসভায় নৌকার টিকিট পেলেন যারা
নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতায় নিহত ১
ডিএমপির ২২ পরিদর্শকের বদলি
সব অবৈধ স্থাপনা দু’দিনের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ চসিকের
দেশের ৯০ ভাগ মানুষের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য নেই জি.এম কাদের

রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ , ১২ পৌষ ১৪২৭, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

স্মরণসভায় বক্তারা

খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে সমাজ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে সমাজ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

দৈনিক সংবাদ-এর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামানের স্মরণে এক ভার্চুয়াল স্মরণসভায় দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকরা এ কথা বলেন। সংবাদ পরিবারের পক্ষ থেকে এ সভার আয়োজন করা হয়। সংবাদ-এর সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক সংবাদ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ূন। সভা সঞ্চালনা করেন দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক কাজী রফিক।

স্মরণসভায় যুক্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে সমাজ গড়ার একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি বাংলাদেশের ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণদের অন্যতম, যারা সমাজকে পরিবর্তিত করেছেন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সাইফুদ্দিন মানিক ও মোহাম্মদ ফরহাদের হাতেগড়া এ তরুণরা বাংলাদেশের প্রতিটি উচ্চপদে কর্মরত আছেন। মুনীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ছাত্ররাজনীতি, উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি বৈষয়িক মানুষ ছিলেন না। সংসার ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতি তার আকর্ষণ ছিল কম। তার দায়িত্ববোধ ছিল খুবই বেশি। তিনি আগরতলা হতে এসে আমাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন। দায়িত্ববোধের সামনে তার কোন ভয় বা শঙ্কা ছিল না।’

বক্তব্যের এক পর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘তার মতো মানুষ আর আসবে না। তার চিন্তা, কর্ম-উদ্দীপনা, আদর্শ ধরে রাখতে পারলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’

সাহিত্যিক, গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘খন্দকার মুনীরুজ্জামান আমার বাল্যবন্ধু। তিনি খুবই দক্ষ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও আন্দোলন ও বিপ্লবের সমন¦য়ক ছিলেন। সেন্ট গ্রেগরি ও কলেজিয়েট স্কুলের সে সময়কার ছাত্র সেলিম, মুকুল, মাহফুজ, মন্টু ও মুনীর একই সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছিল। তখনকার সময়ে ঢাবির ভিসি সাজ্জাদ হোসাইনের প্রেরণায় অনেকে আইসিএসওএনএসএফ-এ যোগ দিলেও সে এবং তার বন্ধুরা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আন্দোলনে তারা অংশ নিয়েছিল। সবার মধ্যে মুনীর ছিল বহুমাত্রিক ব্যক্তি।’

শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, সাংবাদিকতা, মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আদর্শিক যুবক গঠনের জন্য ব্যায়ামাগার ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় খন্দকার মুনীরুজ্জামানের অবদান ছিল উল্লেখ করে মফিদুল হক বলেন, ‘সে দায়িত্ব-সচেতন ছিল, একতায় কাজ করার সময় ২৫ মাচের্র কালরাত্রিতে সে প্রেসের পত্রিকা ছাপানোর কাজে নিয়োজিত ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আদেশ না দিলে সে হয়তো প্রেস ছেড়ে যেত না। সে ছোট থেকেই ‘সংবাদ’ পত্রিকা পড়ত। সংবাদে যোগ দেয়ার মাধ্যমে সে তার জীবনের একটি বৃত্তকে পূর্ণ করে।’

সাংবাদিক চপল বাশার বলেন, ‘১৯৬০ সাল থেকে আমি তাকে চিনি। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ১৯৬৬-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। ওই সময়কার ছাত্র ইউনিয়নের এ কমিটিতে খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিল প্রচার সম্পাদক। এ কমিটি খুবই শক্তিশালী ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সমস্ত স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাবশালী ছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বেধে ওঠছিল। প্রায় সব জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে সংগঠনটি ছিল প্রধান নিয়ামক শক্তি। মুনীর এ সংগঠনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সব আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল। মুনীর একটি শোষণহীন, শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা করেছিল। আমি আশাবাদী একদিন তার আদর্শ অনুসারে সমাজ পরিবর্তিত হবে।’

বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয়দাশ গুপ্ত বলেন, ‘মুনীর ভাই ১৯৯৪ সালের দিকে তুমুল জনপ্রিয় পত্রিকা যায়যায়দিনের সাংবাদিক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘একতার’ দায়িত্বে ছিলেন । শফিক রেহমান তার পেশাগত দক্ষতার কারণেই তাকে যায়যায়দিনে নিয়োগ দেন। তিনি হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে এনএসএফ-এর ‘মাইরপিট বাহিনীর’ বিরুদ্ধেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘মুনীর ভাই একজন নির্লোভ, সৎ এবং দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বে থাকাকালে আমার মতো সাধারণ কর্মীরও খবর রাখতেন। আমার বাবার মৃত্যুতে তিনি আমাকে সান্ত¡না দিয়ে চিঠিও দেন। সাংবাদিক হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টির মহানগর কমিটির নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তিনি আমাকে আমার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং উজলা ম্যাচ ফ্যাক্টরির বিভিন্ন এলাকাতে নিয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন এ দায়িত্বে থাকতে হলে আমাকে সঠিকভাবে শ্রমিক-মজুরদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, যা সংবাদিক হিসেবে হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দায়িত্ব-সচেতন এ মানুষটির উচ্চপদের প্রতি কোন মোহ ছিল না।’

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘সম্পাদক পরিষদের দায়িত্ব পালনকালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি খুবই মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। সম্পাদক পরিষদের উপকমিটিতেও তার সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি ঢাকার বাইরে কোন সাংবাদিকদের প্রতি কোন অবিচার, অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদ করতে বলতেন। তিনি আমার লেখারও প্রশংসা করতেন। তার মৃত্যুতে সংবাদপত্র এবং মিডিয়া জগৎ একজন নিরলস কর্মী ও প্রিয়জনকে হারালো।’

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) কাইউম খান বলেন, ‘১৯৬৯ এবং ১৯৭০-এর আন্দোলনে তার সঙ্গে একসাথে কাজ করেছি। তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনুসারে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার লেখা বইয়ের অনুবাদও তিনি করেছেন। তিনি একজন দক্ষ অনুবাদক ছিলেন।’

ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, “আমি ‘খেলাঘর’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়ে আমার সঙ্গে সংবাদের সম্পৃক্ততা শুরু। খন্দকার মুনীরুজ্জামারে স্ত্রী ডা. রোকেয়া খাতুন আপা আমাদের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের গাইড দিতেন। মানুষের বিশ্বাস, চেতনা ও জ্ঞান মানুষকে যেমন একটি বিশেষ দিকে চালিত করে। তেমনি মুনীর ভাই এবং তার স্ত্রী আমার জীবনের একটি স্তম্ভ। তিনি আমাকে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহ দিতেন।”

ডা. রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘তিনি সারাজীবন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবাক এবং প্রফেশনালিজমে বিশ্বাস করতেন। ধর্মের নামে যারা অপব্যাখ্যা দেন তাদের প্রতিরোধের মাধ্যমে এবং তার আদর্শের প্রচারের মাধ্যমেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’

স্মরণসভার সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাশেম হুমায়ূন বলেন, ‘যারা সংবাদকে ভালোবাসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভালোবাসেন তাদের জন্য খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যু একটি বিশাল ক্ষতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সংবাদপত্র প্রাতিষ্ঠানিক জগতে তার শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। আমরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।’

স্মরণসভার শুরুতে প্রয়াত খন্দকার মুনীরুজ্জামানের প্রতি দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শ্রদ্ধা জানান সংবাদ পরিবারের প্রতিটি বিভাগ থেকে প্রধান প্রতিবেদক সালাম জুবায়ের, সিনিয়র রিপোর্টার বাকী বিল্লাহ, ক্রীড়া বিভাগের কাশীনাথ বসাক, সাহিত্য সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ, সম্পাদনা সহকারী বিভাগের রেজাউল করিম, কম্পিউটার বিভাগের হাবিবুর রহমান মিলন।