চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হোক

আশাফা সেলিম

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। এই নামটি শোনামাত্র এমন একজন সাংবাদিকের কর্মময় জীবনের প্রতিচ্ছবি স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, যিনি কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় তিনি নিজেকে গভীরভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। এতটাই মিশিয়ে ফেলেছিলেন যে শুধু মৃত্যুই তাকে তার পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে।

যে খবর বা সংবাদ জনমনে আগ্রহের সৃষ্টি করে, পাঠকের কৌতূহলী মন সে সম্পর্র্কে আরও বিস্তারিত জানতে চায়। উৎসুক হয়ে ওঠে জানতে নেপথ্য কাহিনী বা সেসব তথ্য যার কারণে ঘটনাটির সূত্রপাত। আর এসব তথ্য বা সংবাদই নেপথ্য সংবাদ, শেকড় সংবাদ বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। মোনাজাত ভাই এই ‘নেপথ্য সংবাদ’ আর ‘শেকড় সংবাদ’ শব্দ দুটিকে পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও অনিবার্য করে তুলেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন যার নাম ‘সংবাদ নেপথ্য’।

প্রায় ৬ বছর (১৯৯০-৯৫) মোনাজাত ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালী সময়। তার সান্নিধ্যে থাকার সুবাদে দেখেছি, সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যাপারে তিনি কতো ভিন্ন মাত্রার তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন! ছিলেন আপাদমস্তক এক সৃজনশীল মানুষ! সংবাদপত্র ছাড়াও, শিল্প-সাহিত্যের নানান শাখায় তার উজ্জ্বল বিচরণই তার সৃজনশীলতার সাক্ষ্য বহন করে। তার হাতের লেখা বা হস্তলিপি যেমন সুন্দর ছিল, তেমনি তিনি ছিলেন ছড়া এবং নাটক রচনায়ও পারদর্শী। বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত তার লেখা নাটক প্রশংসিত হয়েছে। সাইনবোর্ড, বইয়ের প্রচ্ছদ ইত্যাদি ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উত্তরাধুনিক। রংপুরের নাট্য সংগঠন ‘শিখা সংসদ’, ‘সারথি নাট্য সম্প্রদায়’, বইয়ের দোকান ‘ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি’র সাইনবোর্ডেও ডিজাইনসহ তার সৃষ্টি অনেক ডিজাইনই এখনও তার সৃজনশীলতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

কোন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা প্রকাশের পূর্বেই, তথ্যটি পেলে মোনাজাত ভাই ব্যস্ত হয়ে উঠতেন ঘটনার নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে। কী কারণে ঘটনাটি ঘটলো, পেছনের কারণ/ফ্যাক্টরগুলো কী ছিল তা খুঁজে বের করতেন। খবরের শেকড় অনুসন্ধানটি ছিল তার রক্তে মেশা নেশার মতো। অনুসন্ধানকৃত তথ্য সংবলিত ফলোআপ রিপোর্টটি যখন ছাপা হয়, তখন তাকে অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলা হয়। হয়তো ছাপা হলো ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সরা ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘটে নেমেছেন’। নিউজটির ভেতরে হয়তো সাধারণ কারণগুলো রয়েছে। আছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রোগীদের দুর্ভোগের কথাও। কিন্তু এই সংবাদের পেছনের সুরঙ্গ দিয়ে ঢুকলে হয়তো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে রহস্যের জাল। বেরিয়ে আসবে সংবাদ সৃষ্টির পেছনের অনেক অজানা তথ্য, যা থেকে মানুষ খুঁজে পাবে ঘটনার পেছনের ঘটনা। রাষ্ট্র খুঁজে পাবে সমস্যা সমাধানের পথ। মোনাজাতউদ্দিনের আগ্রহটা বেশি থাকতো অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেইসব অজানা তথ্যকে আলোয় নিয়ে আসার প্রতি। আর এই আগ্রহের পথ ধরেই তাকে চলে যেতে হয়েছে পরপারে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে, কর্মরত অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সরেজমিন প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নাম মোনাজাতউদ্দিন। তার পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি টেবিল মেড রিপোর্ট, লোকমুখে বা সহকর্মীদের মুখ থেকে শুনে রিপোর্ট অর্থাৎ ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ জাতীয় রিপোর্ট করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। বিব্রত হয়েছিলেন। তিনি তার একটি বইয়ে ‘দাড়িতে মৌচাক’ আর্টিকেলে এ বিষয়ে লিখেছেন। লেখাটির সারাংশ: পরিচিত কারো কাছে শুনেছেন কোন এক গ্রামে একজনের দাড়িতে মৌচাক বসেছে। অর্থাৎ মৌমাছিরা বাসা বেঁধেছে। তাই দেখতে উৎসুক জনতা দলে দলে ছুটে যাচ্ছে সেখানে। তথ্যটি পেয়ে, মোনাজাত ভাই ঘটনাস্থলে না গিয়ে, তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করেই ‘এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট’ হিসেবে ‘দাড়িতে মৌচাক’ শিরোনামে তার পত্রিকায় পাঠান। রিপোর্টটি গুরুত্ব সহকারে বক্স করে ছাপা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এ রিপোর্ট না পাঠানোয়, অন্য পত্রিকার সাংবাদিকদের নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভীষণ বকাঝকা খেতে ও জবাবদিহি করতে হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তথ্যটি ছিল বানোয়াট। তথ্যদাতা রসিকতার মাধ্যমে তাকে বিব্রত করতেই বানানো তথ্যটি দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি যে কোন রিপোর্টের ক্ষেত্রে সরেজমিন-এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। অর্থাৎ ঘটনাস্থল বা স্পটে না গিয়ে তিনি কোন তথ্যের উপরই পুরোপুরি নির্ভর করতেন না বা সে বিষয়ে সাধারণত রিপোর্ট করতেন না। এই ঘটনাটিসহ তিনি সাংবাদিকতা জীবনে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেছেন তার প্রথম বই ‘পথ থেকে পথে’র আর্টিকেলগুলোতে। এছাড়াও তার রচিত সর্বমোট ১০টি বইয়ের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা জগতের আরও নানা অনুষঙ্গ।

ঢাকার বাইরের কোন এক অবহেলিত জেলা রংপুরে (যাকে সেসময় ‘মফস্বল’ বলা হতো) অবস্থান করেই তিনি তার স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্মনিষ্ঠা, ধ্যান ও সাধনাক্রমে সে মাথা এতোটাই উঁচু হয়েছিল যে, ‘মফস্বল সাংবাদিকতা’র সীমানা (গ্লানি?) পেরিয়ে, তা দেশের গণ্ডিও ছাড়িয়েছিল। কর্মএলাকা উত্তরাঞ্চল হলেও, সংবাদশিকারী হয়ে তিনি সমগ্র উত্তরাঞ্চল ছাড়াও সারা দেশের মাঠেঘাটে প্রান্তরে জনপদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর তার পুরস্কার ও স্বীকৃতিস্বরূপ আখ্যায়িত হয়েছেন অনবদ্য এক সম্মানজনক অভিধায়- ‘চারণ সাংবাদিক’। এই উপাধি বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই অর্জন করেছেন। তিনি জীবদ্দশায় বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিপস পুরস্কার, জহুর হোসেন স্মৃতি স্বর্ণপদক, পদ্মার ঢেউ, অশোকা ফেলোশিপ ইত্যাদি। মরণোত্তর ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন দেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল স্বীকৃতি ‘একুশে পদক’।

মোনাজাত ভাই তার প্রায় তিন দশকের কর্মচঞ্চল সাংবাদিকতা জীবনে অনবদ্য নিরলস নিষ্ঠা ও নিরন্তর চেষ্টায় এদেশের সংবাদপত্র জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। এতটাই উজ্জ্বল যে, তার সে আলোয় আজ ও আগামীকালের সংবাদকর্মীদের আলোকিত না হয়ে উপায় নেই।

সাংবাদিকতা পেশাটিতে তিনি এমনভাবে মিশে গিয়েছিলেন যে, সয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু সেই বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিত্তবৈভবের নেশা তাকে এতটুকু ছোঁয়নি। প্রায় তিন দশক সাংবাদিকতা করেও তার নিজ শহর রংপুরে নিজে একটি বাড়ি করে যেতে পারেননি। কিন্তু ভাবির (নাসিমা মোনাজাত ইতি) কাছ থেকেই শুনেছি, তা নিয়ে মোনাজাত ভাইয়ের ভেতরে ভেতরে কিছুটা আফসোস বা অনুশোচনা থাকলেও তিনি কখনোই সংসার বিরাগী বা উদাসীন ছিলেন না মোটেই। বরং ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী এবং তিনটি মেধাবী সন্তানের গর্বিত পিতা। তার দুটি মেয়ে এমবিবিএস ডাক্তার এবং একটি ছেলে (বুয়েটের মেধাবী ছাত্র, প্রয়াত)। ভাবি এবং সংসার ও সন্তানদের প্রতি মোনাজাত ভাইয়ের গভীর ভালোবাসা, মনোযোগ ও দায়িত্বশীলতায় কোন কমতি বা ঘটতি ছিল না। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গিয়ে ভাবি বলেন, তিনি রংপুরের বাইরে থাকলেও ‘১৪ ডিসেম্বর’ (তাদের বিবাহবার্ষিকী) তারিখটিকে ঠিকই মনে রাখতেন; এবং পালন করতেন অন্যভাবে। শুধু তাই নয়; তিনি দেশের যে প্রান্তেই থাকতেন সেখান থেকেই দিনে ৪/৫ বার ল্যান্ড ফোনে বাড়ির সবার খোঁজ নিতেন। দিনের বেলায় এত ঘন ঘন ফোন পেয়ে ভাবি হয়তো কখনও বিরক্ত হয়েই বলতেন ‘এত বারবার তোমার ফোন ধরতে ধরতে চুলোয় আমার তরকারি পুড়ে যাচ্ছে’।

মোনাজাত ভাই রংপুরের বাইরে থাকলে, হয়তো মুকুল ভাইকে (মোনাজাত ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ জুনিয়র ফ্রেন্ড, রংপুরের প্রয়াত সাংবাদিক-রাজনীতিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মোস্তাফিজ) বলতেন, ‘মুকুল, ১৪ ডিসেম্বর তুমি আমার বাসায় গিয়ে কলিং বেল টিপবে; তোমার ভাবি বের হলে, ‘শুভ বিবাহবার্ষিকী’ বলে ফুল দিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। মুকুল ভাইও সেই মোতাবেক ১৪ তারিখে মোনাজাত ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ভাবিকে চমকে দিতেন। ভাবির জন্মদিন উদ্যাপন করতেও তিনি কখনোই ভুলতেন না। মোনাজাত ভাইয়ের মৃত্যুর বছর (১৯৯৫ সালে) পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল), ভাবির জন্মদিন উদ্যাপনটিও ছিল স্মরণীয় (মৃত্যু: ২৯ ডিসেম্বর)। হাবু ভাইয়ের (সে সময় দৈনিক সংবাদের রংপর প্রতিনিধি ও বর্তমানে দৈনিক যুগান্তরের রংপুর অফিস প্রধান মাহাবুব রহমান) সহায়তায় সেদিন রিকশাভ্যানে আনা হয় কয়েকটি ফুলের টব। সেগুলো উপহার হিসেবে ভাবিকে দিয়ে মোনাজাত ভাই ভাবির জন্মদিন উদ্যাপন করেন।

খবরের পেছনের খবরকে যে নামেই ডাকা হোক, এই ক্ষেত্রে মোনাজাতউদ্দিন আধুনিক ধারার পথিকৃৎ। নিজের জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন। যমুনা নদীর কালাসোনার চরে ট্যাংকলরির তেল চুরির ওপর মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন করতে গিয়ে তাকে কর্মরত অবস্থায়ই প্রাণ দিতে হয়েছে। কর্মরত অবস্থায় তিনি যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন, আমার মতে তাকে শহীদ সংবাদিকের মর্যাদা দেয়া উচিত। আমি বর্তমান মিডিয়াবান্ধব সরকারের কাছে চারণসাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে শহিদের মর্যাদা দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। সম্মাননীয় সাংবাদিক নেতারাও যেন একই দাবিতে সোচ্চার হন সেই আহ্বানও জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, আমি সর্বপ্রথম এই দাবি জানিয়েছিলাম ২০১৮ সালে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন রংপুর প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী। রংপুর প্রেস ক্লাব ভবনে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে গণ্যমান্য অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাজকর্র্র্র্র্মী আকবর হোসেন, যিনি মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের অনেক স্মৃতিরই সাক্ষী; বলেন ‘মোনাজাতউদ্দিনের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি’। সে অনুষ্ঠানের সংবাদ স্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক যুগের আলো’তে প্রকাশিত হয়েছে।

দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী পালন তো দূরের কথা, তার মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদটিও ঢাকার কোন পত্রিকায় ছাপা হয় না! গত বছরও হয়নি! ২৯ ডিসেম্বর চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিবসে তাকে শহীদ সাংবাদিকের মর্যাদা দেয়ার দাবি পুনরায় ব্যক্ত করছি। প্রত্যাশা রাখছি, সংবাদপত্রগুলো তথা জাতি তার মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করবে।

[লেখক : ছড়াকার, সংস্কৃতি ও উন্নয়নকর্মী]

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ , ১৪ পৌষ ১৪২৭, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হোক

আশাফা সেলিম

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। এই নামটি শোনামাত্র এমন একজন সাংবাদিকের কর্মময় জীবনের প্রতিচ্ছবি স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, যিনি কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় তিনি নিজেকে গভীরভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। এতটাই মিশিয়ে ফেলেছিলেন যে শুধু মৃত্যুই তাকে তার পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে।

যে খবর বা সংবাদ জনমনে আগ্রহের সৃষ্টি করে, পাঠকের কৌতূহলী মন সে সম্পর্র্কে আরও বিস্তারিত জানতে চায়। উৎসুক হয়ে ওঠে জানতে নেপথ্য কাহিনী বা সেসব তথ্য যার কারণে ঘটনাটির সূত্রপাত। আর এসব তথ্য বা সংবাদই নেপথ্য সংবাদ, শেকড় সংবাদ বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। মোনাজাত ভাই এই ‘নেপথ্য সংবাদ’ আর ‘শেকড় সংবাদ’ শব্দ দুটিকে পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও অনিবার্য করে তুলেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন যার নাম ‘সংবাদ নেপথ্য’।

প্রায় ৬ বছর (১৯৯০-৯৫) মোনাজাত ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালী সময়। তার সান্নিধ্যে থাকার সুবাদে দেখেছি, সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যাপারে তিনি কতো ভিন্ন মাত্রার তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন! ছিলেন আপাদমস্তক এক সৃজনশীল মানুষ! সংবাদপত্র ছাড়াও, শিল্প-সাহিত্যের নানান শাখায় তার উজ্জ্বল বিচরণই তার সৃজনশীলতার সাক্ষ্য বহন করে। তার হাতের লেখা বা হস্তলিপি যেমন সুন্দর ছিল, তেমনি তিনি ছিলেন ছড়া এবং নাটক রচনায়ও পারদর্শী। বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত তার লেখা নাটক প্রশংসিত হয়েছে। সাইনবোর্ড, বইয়ের প্রচ্ছদ ইত্যাদি ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উত্তরাধুনিক। রংপুরের নাট্য সংগঠন ‘শিখা সংসদ’, ‘সারথি নাট্য সম্প্রদায়’, বইয়ের দোকান ‘ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি’র সাইনবোর্ডেও ডিজাইনসহ তার সৃষ্টি অনেক ডিজাইনই এখনও তার সৃজনশীলতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

কোন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা প্রকাশের পূর্বেই, তথ্যটি পেলে মোনাজাত ভাই ব্যস্ত হয়ে উঠতেন ঘটনার নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে। কী কারণে ঘটনাটি ঘটলো, পেছনের কারণ/ফ্যাক্টরগুলো কী ছিল তা খুঁজে বের করতেন। খবরের শেকড় অনুসন্ধানটি ছিল তার রক্তে মেশা নেশার মতো। অনুসন্ধানকৃত তথ্য সংবলিত ফলোআপ রিপোর্টটি যখন ছাপা হয়, তখন তাকে অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলা হয়। হয়তো ছাপা হলো ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সরা ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘটে নেমেছেন’। নিউজটির ভেতরে হয়তো সাধারণ কারণগুলো রয়েছে। আছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রোগীদের দুর্ভোগের কথাও। কিন্তু এই সংবাদের পেছনের সুরঙ্গ দিয়ে ঢুকলে হয়তো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে রহস্যের জাল। বেরিয়ে আসবে সংবাদ সৃষ্টির পেছনের অনেক অজানা তথ্য, যা থেকে মানুষ খুঁজে পাবে ঘটনার পেছনের ঘটনা। রাষ্ট্র খুঁজে পাবে সমস্যা সমাধানের পথ। মোনাজাতউদ্দিনের আগ্রহটা বেশি থাকতো অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেইসব অজানা তথ্যকে আলোয় নিয়ে আসার প্রতি। আর এই আগ্রহের পথ ধরেই তাকে চলে যেতে হয়েছে পরপারে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে, কর্মরত অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সরেজমিন প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নাম মোনাজাতউদ্দিন। তার পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি টেবিল মেড রিপোর্ট, লোকমুখে বা সহকর্মীদের মুখ থেকে শুনে রিপোর্ট অর্থাৎ ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ জাতীয় রিপোর্ট করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। বিব্রত হয়েছিলেন। তিনি তার একটি বইয়ে ‘দাড়িতে মৌচাক’ আর্টিকেলে এ বিষয়ে লিখেছেন। লেখাটির সারাংশ: পরিচিত কারো কাছে শুনেছেন কোন এক গ্রামে একজনের দাড়িতে মৌচাক বসেছে। অর্থাৎ মৌমাছিরা বাসা বেঁধেছে। তাই দেখতে উৎসুক জনতা দলে দলে ছুটে যাচ্ছে সেখানে। তথ্যটি পেয়ে, মোনাজাত ভাই ঘটনাস্থলে না গিয়ে, তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করেই ‘এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট’ হিসেবে ‘দাড়িতে মৌচাক’ শিরোনামে তার পত্রিকায় পাঠান। রিপোর্টটি গুরুত্ব সহকারে বক্স করে ছাপা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এ রিপোর্ট না পাঠানোয়, অন্য পত্রিকার সাংবাদিকদের নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভীষণ বকাঝকা খেতে ও জবাবদিহি করতে হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তথ্যটি ছিল বানোয়াট। তথ্যদাতা রসিকতার মাধ্যমে তাকে বিব্রত করতেই বানানো তথ্যটি দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি যে কোন রিপোর্টের ক্ষেত্রে সরেজমিন-এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। অর্থাৎ ঘটনাস্থল বা স্পটে না গিয়ে তিনি কোন তথ্যের উপরই পুরোপুরি নির্ভর করতেন না বা সে বিষয়ে সাধারণত রিপোর্ট করতেন না। এই ঘটনাটিসহ তিনি সাংবাদিকতা জীবনে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেছেন তার প্রথম বই ‘পথ থেকে পথে’র আর্টিকেলগুলোতে। এছাড়াও তার রচিত সর্বমোট ১০টি বইয়ের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা জগতের আরও নানা অনুষঙ্গ।

ঢাকার বাইরের কোন এক অবহেলিত জেলা রংপুরে (যাকে সেসময় ‘মফস্বল’ বলা হতো) অবস্থান করেই তিনি তার স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্মনিষ্ঠা, ধ্যান ও সাধনাক্রমে সে মাথা এতোটাই উঁচু হয়েছিল যে, ‘মফস্বল সাংবাদিকতা’র সীমানা (গ্লানি?) পেরিয়ে, তা দেশের গণ্ডিও ছাড়িয়েছিল। কর্মএলাকা উত্তরাঞ্চল হলেও, সংবাদশিকারী হয়ে তিনি সমগ্র উত্তরাঞ্চল ছাড়াও সারা দেশের মাঠেঘাটে প্রান্তরে জনপদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর তার পুরস্কার ও স্বীকৃতিস্বরূপ আখ্যায়িত হয়েছেন অনবদ্য এক সম্মানজনক অভিধায়- ‘চারণ সাংবাদিক’। এই উপাধি বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই অর্জন করেছেন। তিনি জীবদ্দশায় বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিপস পুরস্কার, জহুর হোসেন স্মৃতি স্বর্ণপদক, পদ্মার ঢেউ, অশোকা ফেলোশিপ ইত্যাদি। মরণোত্তর ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন দেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল স্বীকৃতি ‘একুশে পদক’।

মোনাজাত ভাই তার প্রায় তিন দশকের কর্মচঞ্চল সাংবাদিকতা জীবনে অনবদ্য নিরলস নিষ্ঠা ও নিরন্তর চেষ্টায় এদেশের সংবাদপত্র জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। এতটাই উজ্জ্বল যে, তার সে আলোয় আজ ও আগামীকালের সংবাদকর্মীদের আলোকিত না হয়ে উপায় নেই।

সাংবাদিকতা পেশাটিতে তিনি এমনভাবে মিশে গিয়েছিলেন যে, সয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু সেই বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিত্তবৈভবের নেশা তাকে এতটুকু ছোঁয়নি। প্রায় তিন দশক সাংবাদিকতা করেও তার নিজ শহর রংপুরে নিজে একটি বাড়ি করে যেতে পারেননি। কিন্তু ভাবির (নাসিমা মোনাজাত ইতি) কাছ থেকেই শুনেছি, তা নিয়ে মোনাজাত ভাইয়ের ভেতরে ভেতরে কিছুটা আফসোস বা অনুশোচনা থাকলেও তিনি কখনোই সংসার বিরাগী বা উদাসীন ছিলেন না মোটেই। বরং ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী এবং তিনটি মেধাবী সন্তানের গর্বিত পিতা। তার দুটি মেয়ে এমবিবিএস ডাক্তার এবং একটি ছেলে (বুয়েটের মেধাবী ছাত্র, প্রয়াত)। ভাবি এবং সংসার ও সন্তানদের প্রতি মোনাজাত ভাইয়ের গভীর ভালোবাসা, মনোযোগ ও দায়িত্বশীলতায় কোন কমতি বা ঘটতি ছিল না। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গিয়ে ভাবি বলেন, তিনি রংপুরের বাইরে থাকলেও ‘১৪ ডিসেম্বর’ (তাদের বিবাহবার্ষিকী) তারিখটিকে ঠিকই মনে রাখতেন; এবং পালন করতেন অন্যভাবে। শুধু তাই নয়; তিনি দেশের যে প্রান্তেই থাকতেন সেখান থেকেই দিনে ৪/৫ বার ল্যান্ড ফোনে বাড়ির সবার খোঁজ নিতেন। দিনের বেলায় এত ঘন ঘন ফোন পেয়ে ভাবি হয়তো কখনও বিরক্ত হয়েই বলতেন ‘এত বারবার তোমার ফোন ধরতে ধরতে চুলোয় আমার তরকারি পুড়ে যাচ্ছে’।

মোনাজাত ভাই রংপুরের বাইরে থাকলে, হয়তো মুকুল ভাইকে (মোনাজাত ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ জুনিয়র ফ্রেন্ড, রংপুরের প্রয়াত সাংবাদিক-রাজনীতিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মোস্তাফিজ) বলতেন, ‘মুকুল, ১৪ ডিসেম্বর তুমি আমার বাসায় গিয়ে কলিং বেল টিপবে; তোমার ভাবি বের হলে, ‘শুভ বিবাহবার্ষিকী’ বলে ফুল দিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। মুকুল ভাইও সেই মোতাবেক ১৪ তারিখে মোনাজাত ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ভাবিকে চমকে দিতেন। ভাবির জন্মদিন উদ্যাপন করতেও তিনি কখনোই ভুলতেন না। মোনাজাত ভাইয়ের মৃত্যুর বছর (১৯৯৫ সালে) পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল), ভাবির জন্মদিন উদ্যাপনটিও ছিল স্মরণীয় (মৃত্যু: ২৯ ডিসেম্বর)। হাবু ভাইয়ের (সে সময় দৈনিক সংবাদের রংপর প্রতিনিধি ও বর্তমানে দৈনিক যুগান্তরের রংপুর অফিস প্রধান মাহাবুব রহমান) সহায়তায় সেদিন রিকশাভ্যানে আনা হয় কয়েকটি ফুলের টব। সেগুলো উপহার হিসেবে ভাবিকে দিয়ে মোনাজাত ভাই ভাবির জন্মদিন উদ্যাপন করেন।

খবরের পেছনের খবরকে যে নামেই ডাকা হোক, এই ক্ষেত্রে মোনাজাতউদ্দিন আধুনিক ধারার পথিকৃৎ। নিজের জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন। যমুনা নদীর কালাসোনার চরে ট্যাংকলরির তেল চুরির ওপর মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন করতে গিয়ে তাকে কর্মরত অবস্থায়ই প্রাণ দিতে হয়েছে। কর্মরত অবস্থায় তিনি যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন, আমার মতে তাকে শহীদ সংবাদিকের মর্যাদা দেয়া উচিত। আমি বর্তমান মিডিয়াবান্ধব সরকারের কাছে চারণসাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে শহিদের মর্যাদা দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। সম্মাননীয় সাংবাদিক নেতারাও যেন একই দাবিতে সোচ্চার হন সেই আহ্বানও জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, আমি সর্বপ্রথম এই দাবি জানিয়েছিলাম ২০১৮ সালে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন রংপুর প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী। রংপুর প্রেস ক্লাব ভবনে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে গণ্যমান্য অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাজকর্র্র্র্র্মী আকবর হোসেন, যিনি মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের অনেক স্মৃতিরই সাক্ষী; বলেন ‘মোনাজাতউদ্দিনের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি’। সে অনুষ্ঠানের সংবাদ স্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক যুগের আলো’তে প্রকাশিত হয়েছে।

দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী পালন তো দূরের কথা, তার মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদটিও ঢাকার কোন পত্রিকায় ছাপা হয় না! গত বছরও হয়নি! ২৯ ডিসেম্বর চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিবসে তাকে শহীদ সাংবাদিকের মর্যাদা দেয়ার দাবি পুনরায় ব্যক্ত করছি। প্রত্যাশা রাখছি, সংবাদপত্রগুলো তথা জাতি তার মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করবে।

[লেখক : ছড়াকার, সংস্কৃতি ও উন্নয়নকর্মী]