দেড় বছরে পদ্মা সেতুসহ চার মেগা প্রকল্প শেষ হবে

যথাসময়ে কাজ শেষ করা বড় চ্যালেঞ্জ কঠোর নজরদারির পরামর্শ

করোনাভাইরাসের লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে পুরোদমে চলছে সড়ক উন্নয়নের মেগা প্রকল্পের কাজ। আগামী দেড় বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি বঙ্গবন্ধু টানেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে যথা সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সরকারের কঠোর নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল সচিবালয় সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা সেতুসহ চারটি বড় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ শেষে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে চালু করা হবে। সেগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলি টানেলের কাজ এগিয়ে চলছে, গতি পেয়েছে। সবগুলো আগামী ২০২২ সালে উদ্বোধন করতে পারব। ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই আমরা এই প্রকল্পগুলো চালু করব। চার প্রকল্পের মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বেরের মধ্যে মেট্রোরেল চালু যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তা যথাসময়ে অর্জন করা সম্ভব হবে না। এছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকও একটা ফান্ড আমাদের দিচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, শৃঙ্খলা না থাকলে উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে।

তবে যথা সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সংবাদকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বে একটা ধাক্কা খেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টসহ সব বড় বড় প্রকল্পে। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প করোনা মোকাবিলায় যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করার কারণে বাস্তবায়নের গতি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। তাই যথা সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই করোনা পরবর্তীতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সরকারের কঠোর নজরদারির পরামর্শ দেন তিনি।

নতুন বছরে নতুন উদ্যোমে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে নেয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে অবরুদ্ধ পরিস্থিতে চলে যায় পুরো দেশ। এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলোও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছিল অনিশ্চয়তা। সব অনিশ্চতা দূর করে গত ১০ ডিসেম্বর ৪১তম ইস্পাতের কাঠামো (স্প্যান) বসানোর মাধ্যমে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় স্বপ্নে পদ্মা সেতু। করোনার কারণের শ্রমিক সংকট কাঁটিয়ে রাত-দিন কাজ চলছে মেট্রোরেল, কর্ণফুলি বঙ্গবন্ধু টানেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১০ ডিসেম্বর সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিয়ারে (খুঁটি) সর্বশেষ ৪১তম ইস্পাতের কাঠামো বসানোর মাধ্যমে পুরোপুরি দৃশমান হয়েছে। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। এরমধ্যে মূল সেতু ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও নদী শাসন ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য এখনও দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা আরও ৬ মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

মেট্রোরেল-৬

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুন। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে উত্তরা-মতিঝিল অংশ খুলে দেয়ার কথাছিল। কিন্তু কমলাপুর পর্যন্ত পুরো অংশ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করা হবে। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল)। এরমধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের শেষ করতে ২৪ ঘণ্টা কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় কাজ এগিয়ে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দিনের বেলায় প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বঙ্গবন্ধু টানেল

‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ মডেলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারাকে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদশে তৈরি হচ্ছে সাড়ে তিন কিলোমিটারের সুড়ঙ্গপথটি। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। চীনা অর্থায়নে চলমান বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। এরই মধ্যে নদীর তলদেশ দিয়ে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি টিউবের মধ্যে একটি খনন ও রিং স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় টিউবের খনন কাজ। নদীর তলদেশের নিচে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল, দুই মুখে সড়ক আর ওভারপাস বা সেতুসড়ক নির্মিত হচ্ছে। ২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পে সময়মতো অর্থ ছাড় না করায় কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

রাজধানীর যানজট নিরসনে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়ল সড়ক) নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) আওতায়। তিনধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পুরো প্রকল্পটি। প্রথম ধাপে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার, তৃতীয় ধাপে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) এটি নির্মাণে বিনিয়োগ করছে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। আর জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করছে সরকার।

রুট জটিলতায় ও অর্থায়ন সমস্যার কারণে-এর নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল সাড়ে প্রায় পাঁচ বছর। অবশেষে ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সেতু বিভাগ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর সড়ক থেকে শুরু হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেল লাইনের উপর দিয়ে নির্মাণ করা হবে। এরপর সওজ’র অতীশ দীপঙ্কর সড়কের উপর দিয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত যাবে। পরের অংশটি গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। ২০০৯ সালে অনুমোদন হয় প্রকল্পের ডিপিপি। পরে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ৮ হাজার ৯৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন ধাপে নির্মাণ হচ্ছে প্রকল্পটি। এরমধ্যে চায়না এক্সিম ব্যাংক ও আইসিবি চায়না যৌথভাবে ৭ হাজার ৩১৮ কোটি কাটা ঋণ সহায়তা দিবে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারে ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে। তিন ধাপে প্রকল্পের নির্মাণ ২০২২ সালে ডিসেম্বরে শেষ হবে সেতু বিভাগ সূত্রে জানায়।

সোমবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২১ , ২০ পৌষ ১৪২৭, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

দেড় বছরে পদ্মা সেতুসহ চার মেগা প্রকল্প শেষ হবে

যথাসময়ে কাজ শেষ করা বড় চ্যালেঞ্জ কঠোর নজরদারির পরামর্শ

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

করোনাভাইরাসের লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে পুরোদমে চলছে সড়ক উন্নয়নের মেগা প্রকল্পের কাজ। আগামী দেড় বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি বঙ্গবন্ধু টানেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে যথা সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সরকারের কঠোর নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল সচিবালয় সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা সেতুসহ চারটি বড় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ শেষে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে চালু করা হবে। সেগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলি টানেলের কাজ এগিয়ে চলছে, গতি পেয়েছে। সবগুলো আগামী ২০২২ সালে উদ্বোধন করতে পারব। ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই আমরা এই প্রকল্পগুলো চালু করব। চার প্রকল্পের মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বেরের মধ্যে মেট্রোরেল চালু যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তা যথাসময়ে অর্জন করা সম্ভব হবে না। এছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকও একটা ফান্ড আমাদের দিচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, শৃঙ্খলা না থাকলে উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে।

তবে যথা সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সংবাদকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বে একটা ধাক্কা খেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টসহ সব বড় বড় প্রকল্পে। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প করোনা মোকাবিলায় যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করার কারণে বাস্তবায়নের গতি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। তাই যথা সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই করোনা পরবর্তীতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সরকারের কঠোর নজরদারির পরামর্শ দেন তিনি।

নতুন বছরে নতুন উদ্যোমে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে নেয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে অবরুদ্ধ পরিস্থিতে চলে যায় পুরো দেশ। এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলোও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছিল অনিশ্চয়তা। সব অনিশ্চতা দূর করে গত ১০ ডিসেম্বর ৪১তম ইস্পাতের কাঠামো (স্প্যান) বসানোর মাধ্যমে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় স্বপ্নে পদ্মা সেতু। করোনার কারণের শ্রমিক সংকট কাঁটিয়ে রাত-দিন কাজ চলছে মেট্রোরেল, কর্ণফুলি বঙ্গবন্ধু টানেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১০ ডিসেম্বর সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিয়ারে (খুঁটি) সর্বশেষ ৪১তম ইস্পাতের কাঠামো বসানোর মাধ্যমে পুরোপুরি দৃশমান হয়েছে। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। এরমধ্যে মূল সেতু ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও নদী শাসন ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য এখনও দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা আরও ৬ মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

মেট্রোরেল-৬

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুন। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে উত্তরা-মতিঝিল অংশ খুলে দেয়ার কথাছিল। কিন্তু কমলাপুর পর্যন্ত পুরো অংশ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করা হবে। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল)। এরমধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের শেষ করতে ২৪ ঘণ্টা কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় কাজ এগিয়ে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দিনের বেলায় প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বঙ্গবন্ধু টানেল

‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ মডেলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারাকে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদশে তৈরি হচ্ছে সাড়ে তিন কিলোমিটারের সুড়ঙ্গপথটি। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। চীনা অর্থায়নে চলমান বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। এরই মধ্যে নদীর তলদেশ দিয়ে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি টিউবের মধ্যে একটি খনন ও রিং স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় টিউবের খনন কাজ। নদীর তলদেশের নিচে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল, দুই মুখে সড়ক আর ওভারপাস বা সেতুসড়ক নির্মিত হচ্ছে। ২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পে সময়মতো অর্থ ছাড় না করায় কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

রাজধানীর যানজট নিরসনে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়ল সড়ক) নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) আওতায়। তিনধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পুরো প্রকল্পটি। প্রথম ধাপে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার, তৃতীয় ধাপে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) এটি নির্মাণে বিনিয়োগ করছে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। আর জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করছে সরকার।

রুট জটিলতায় ও অর্থায়ন সমস্যার কারণে-এর নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল সাড়ে প্রায় পাঁচ বছর। অবশেষে ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সেতু বিভাগ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর সড়ক থেকে শুরু হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেল লাইনের উপর দিয়ে নির্মাণ করা হবে। এরপর সওজ’র অতীশ দীপঙ্কর সড়কের উপর দিয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত যাবে। পরের অংশটি গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। ২০০৯ সালে অনুমোদন হয় প্রকল্পের ডিপিপি। পরে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ৮ হাজার ৯৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন ধাপে নির্মাণ হচ্ছে প্রকল্পটি। এরমধ্যে চায়না এক্সিম ব্যাংক ও আইসিবি চায়না যৌথভাবে ৭ হাজার ৩১৮ কোটি কাটা ঋণ সহায়তা দিবে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারে ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে। তিন ধাপে প্রকল্পের নির্মাণ ২০২২ সালে ডিসেম্বরে শেষ হবে সেতু বিভাগ সূত্রে জানায়।