শিক্ষার ডিজিটাল যাত্রার দুই দশক

মোস্তাফা জব্বার

‘সব কিছুই আমরা ভুলে যাই’ এমন অপবাদ জাতিগতভাবে আমরা পেয়ে থাকি। দূরের ইতিহাস তো বটেই, খুব কাছের ইতিহাসই আমরা মনে রাখি না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কিছু কিছু জাতীয় নেতা-নেত্রীদের বিষয়ে সচেতন থাকলেও জাতীয় ঘটনাগুলোর অনেক কিছুই আমরা স্মৃতিতে ধরে রাখি না। আবার অনেক সময় জাতীয় নেতাদের কথাও আমরা মনে রাখি না। মনে করুন তো, মরহুম মাওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ প্রমুখের কথা। আমাদের চাইতে ভিন্ন রাজনীতি করলেও আজকাল কি কোন পর্যায়ে আমরা তাকে স্মরণ করি? অথচ আমাদের যৌবনকালে তারা ছিলেন সারা বাংলার জননেতা। রাজনীতিতে ভুল করেছেন বলেই হয়তো ইতিহাসই তাদের মনে রাখে না। আজকালের ছেলেমেয়েরা সম্ভবত তাদের নামই শুনেনি। আজকাল দেখি আমরা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কথাও মনে রাখি না। আমি অসংখ্য নাম উল্লেখ করতে পারব যাদের কথা কেউ স্মরণ করে না।

অনেক সময় আবার একজনের সৃজন অন্যজন স্মরণও করতে চাইনা। কখনও পরশ্রীকাতরতা বা ঈর্ষাও কাজ করে। রাজনীতির ক্ষেত্রে এটি মেনে নিতে বাধ্য হলেও অন্য কাজের ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়া উচিত নয়।

মাঝে মাঝে মনে হয়, গর্ব করার মতো ঘটনাও আমরা মনে রাখি না। ২০১৪ সালের একটি ঘটনার প্রতি আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। ওই বছরে আমরা বাংলা রেডিওর ৭৫ বছর আর বাংলা টিভির ৫০ বছর পালন করেছি। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এখনও বেশ দাপটের সঙ্গে টিকে আছে। কিন্তু কোন কোন প্রতিষ্ঠান টিকে থেকেও তাদের গৌরবের কথা স্মরণ করতে চায় না। আমি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কথা স্মরণ করতে পারি। এই প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৬৪ সালে উপমহাদেশের দ্বিতীয় ডিজিটাল কম্পিউটার এসেছিল ১৯৬৪ সালে। ভারতের কলকাতায় ১৯৫৩ সালে প্রথম এনালগ কম্পিউটার টাটায় যাত্রা শুরু করলেও চালু হয় ৫৫ সালের পর। অন্যদিকে ১৯৫৫ সালে ভারতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটে ডিজিটাল কম্পিউটার স্থাপিত হয়। ওরা সেইসব স্মরণে রেখেছে। অথচ আমাদের পরমাণু শক্তি কমিশন মনেই রাখেনি যে, কবে ছিল তাদের গৌরবের ৫০ বছর। আমি আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ছাড়াও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট সব কটি ট্রেডবডিকে জানিয়েও এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়াতে পারিনি। বেসিস-বিসিএস-আইএসপিএবি; কেউ কোন উদ্যোগ নেয়নি। আইসিটি মন্ত্রণালয় তো বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই করতে চায় নাই। সর্বশেষ স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান পরিষদের সভায় এই অর্জনকে স্মরণ করার সিদ্ধান্ত হলেও এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কেউ কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমি জানি না। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির কথাই মনে করি না কেন? ওরা তাদের জন্মের ২৫ বছর মনেই রাখেনি। শুনছি সামনের বছর ৩৪ বছরপূর্তি স্মরণ করবে। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। একেবারে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল; ইংরেজি পঞ্জিকার এসব মাসগুলো বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার বা বাঙালির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসগুলোর অনেকগুলো দিনের সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব যুক্ত আছে। বাকি মাসগুলোর কথা বাদ দিলেও ডিসেম্বরের কথা কোনভাবেই ভুলে থাকা যাবে না। এই মাসের বড় বড় তারিখগুলোর কথা খুব সংক্ষেপে স্মরণ করা যায়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামকরণ করেন। ৬ তারিখে বাংলাদেশ মুক্তির এক সুবর্ণ সময়ে প্রবেশ করে। ভারত-ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ডিসেম্বর মাসকে স্মরণ করা হলেও সেই দিনটিকে তেমনভাবে স্মরণ করতে দেখি না। এবার মুজিব শতবর্ষে আমরা এসব স্মরণ করেছি। একাত্তরের সেই দিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা। ২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। এখন দিনটি ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। মনে আছে ৬ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আমি লিখি ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা। ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটি সেই ঘোষণাকে অনুমোদন দেয়। সেই সময়েই আমি হংকংয়ের এসোসিও সম্মেলনে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা উপস্থাপন করি। ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। এরপর ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে আয়োজন করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনার। সেখানেও মূল প্রবন্ধ পাঠ করি আমি। ৬ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যে অনন্য ঘটনাগুলো ঘটে তারও আগে ৯৭ সালের ডিসেম্বরে আমার সভাপতিত্বে আয়োজিত হয়েছিল একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সেমিনার। উপস্থিত ছিলেন ভারতের ন্যাসকমের প্রয়াত দেওয়াং মেহতা। ৯৭ সালেই গঠিত হয়েছিল জেআরসি কমিটি। সেমিনারটি সেই কমিটির সুপারিশেই অনুষ্ঠিত হয়। সেই সেমিনারের পরই সরকার কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৯৮ মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল-জুন মাসে সেটি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের কোন ঘটনাকেই কেউ স্মরণ করেনি। যে দেশের সরকারের মূলমন্ত্র ডিজিটাল বাংলাদেশ, সেদেশে এর সঙ্গে যুক্ত দিনগুলোর কথা কি আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল না? এই জাতির কাছে অনেকেই এমন প্রত্যাশা করেন না। বরং আমাদের ইতিহাস চর্চায় সত্য গোপন করা বা বিকৃত করায় অনেক বড় বড় দৃষ্টান্ত রয়েছে।

আমি অবশ্য মনে করি এসব বিষয়ে আফসোস করে লাভ নেই। বরং সময় সুযোগ পেলে দিনগুলোর কথা একটু-আধটু স্মরণ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত আমি ডিসেম্বরের আরও দুটি যুগান্তকারী দিনের কথা এখানে স্মরণ করতে চাই। দিনটি ২৪ ডিসেম্বর ও ২৫ ডিসেম্বর। কেউ কখনও এই দিন দুটির কথা মনেই করতে পারবেন না।

প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করেই বলা দরকার। আমরা এখন যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি তখন বড় বড় যে কটি রূপান্তরের কথা বলি তার সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর। সরকার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরি করতে বলেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতে চান। এরই মাঝে অনেকগুলো ডিজিটাল ক্লাসরুম হয়েছে। আরও অনেক ক্লাসরুম তৈরি হচ্ছে। সরকার যে ডিজিটাল শিক্ষা চায় সেটি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। অন্যদিকে সরকার ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। আমি শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ২০১১-১৪ সালের ডিজিটাল ক্লাসরুম এবং বাধ্যতামূলক তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার সূচনা হয়েছিল ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯। বিষয়টি প্রায় কেউ জানে না। সেই দিন ঢাকার কাছে গাজীপুরের ছায়াবিথীতে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং তার পতœী সেলিনা মল্লিক আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল নামক একটি স্কুলের উদ্বোধন করেছিলেন। আমি স্মরণ করতে পারি যে, সেদিন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী একটি ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের কাছে সেদিন প্রজেক্টর বা বড় মনিটর ছিল না- তাই কাউকে ডিজিটাল শিক্ষার কোন কিছুই আমরা উপস্থাপন করতে পারিনি। তবে স্বপ্নটা যে দৃঢ় ছিল তার প্রমাণ হিসেবে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্কুলটিতে প্রচলন করেছিলাম। সেই স্কুলটির বৈশিষ্ট্য ছিল যে, শিশুশ্রেণী থেকে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর মানে হলো জীবনের প্রথম শিক্ষাদিবস থেকে প্রত্যেককে কম্পিউটার বিষয়টি পড়তে হবে। একই সঙ্গে শুরু হয় কম্পিউটার দিয়ে পড়াশোনা। দ্বিতীয়ত শিশুদের আমেরিকার জাম্পস্টার্ট কোম্পানির সফটওয়্যার দিয়ে ডিজিটাল শিক্ষ দেয়া হয়।

আমি নিজে স্মরণ করতে পারি যে, এর সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগে। ৮৭ সালে আমি যখন এ্যাপল কম্পিউটার বিক্রি করা শুরু করি তখন থেকেই এ্যাপলের শিক্ষামূলক সফটওয়্যার ও সলিউশনগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বাংলাদেশের প্রথম এ্যাপল ডিলারের নামও ছিল বিজনেস অ্যান্ড এডুকেশন সিস্টেমস লি.। এ্যাপলের নিজস্ব চ্যানেল ছাড়াও ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাপোর্ট দিতে গিয়ে আমি নতুন এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হই। এ্যাপল তখন একেবারেই আলাদা করে শিক্ষা খাতে কম্পিউটার প্রচলনের চেষ্টা করছিল। এমনকি অন্যদের চাইতে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য এ্যাপল পণ্যের দাম কম ছিল। সেই সময়ে আমেরিকায় ব্যাপকভাবে শিক্ষামূলক সফটওয়্যারের প্রচলন ঘটে। আমি ১৯৯৭ সালে ছেলে বিজয়ের জন্য এসব সফটওয়্যার আনি। নিজের ঘরে এসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে বুঝতে পারি যে, এটি এক অনন্য ব্যবস্থা। শিক্ষাকে ডিজিটাল করার সেই স্বপ্নটাকেই ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯ বাস্তবে রূপ দেয়া হয়।

খুব সঙ্গতকারণেই দিনটি হচ্ছে বাংলাদেশে ডিজিটাল শিক্ষার জন্মদিন। সহজ হিসেব করেই বলা যায যে, ২০১৪ সালে সেই দিনটির ১৫ বছর অতিক্রম করলাম আমরা। ২০ সালে ২০ বছর পার করলাম। এটি খুব সঙ্গত ছিল যে, আমরা সেই দিনটিকে স্মরণ করি। কেউ একজন কোন এক মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল সেই স্মৃতিময় সময়টিকে উজ্জ্বল করে উপস্থাপন করা। এটি খুব স্বাভাবিক ছিল যে ২০ বছরে সেই প্রচেষ্টার সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে একটু পর্যালোচনা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। একেবারে নীরবে নিভৃতে চলে গেল দিনটি।

স্মরণ করতে পারি ২০০০ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ১৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্কুলটি চালু হবার পর ২০০১ সালে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০০২ সালে আরও বাড়ে। ২০০৩ সাল নাগাদ দেশজুড়ে ৩০টি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান-সামন্তযুগীয় একটি সমাজে এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজটি নিঃসন্দেহে একটি চরম সাহসী কাজ ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সফটওয়্যার নিয়ে। আমরা আমেরিকা থেকে যেসব শিক্ষামূলক সফটওয়্যার আমদানি করি সেগুলো আমাদের জন্য উপযোগী মনে হয়নি। সবগুলো ইংরেজি সফটওয়্যার আমাদের পাঠক্রমকেও সহায়তা করছিল না। সেটির অভাব পূরণ করার জন্য আমি আমার আনন্দ মাল্টিমিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার বানানোর জন্য নির্দেশ দিই। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, রাজশাহী ক্যাম্পাস থেকে সফটওয়্যার বানানোও হয়। ফ্লাশ, ম্যাক্রোমিডিয়া ডিরেক্টর ইত্যাদির পাশাপাশি থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স ব্যবহার করি আমরা। কিন্তু সফটওয়্যারগুলো তেমন মানসম্মত হতে পারেনি। অবশেষে ২০১০ সালে আমি বিজয় শিশুশিক্ষা নামের একটি শিক্ষামূলক সফটওয়্যার বানাতে সক্ষম হই। বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জেসমিন জুইকে এর পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে। বলা যেতে পারে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠার এক দশক পর তার উপযোগী সফটওয়্যার বানাই আমরা। ২০১০ সালেল ২৫ ডিসেম্বর জেসমিনের শিশুকন্যা পরমার হাত ধরে বিজয় শিশু শিক্ষার উদ্বোধন হয়। এরপর ২০২০ সাল অবধি মোট ৮টি সফটওয়্যার বাজারে আসে। এখন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়াকে কাগজের বাইরে রেখে সম্পন্ন করা সম্ভব। এমন একটি অবস্থায় ২০ বছরের একটি মাইলফলককে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করাটি বাঞ্ছনীয় ছিল।

২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এখন মনে হচ্ছে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য আমাদের অনেক কাজ জরুরি ভিত্তিতে করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রথমত আমরা ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কম্পিউটার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে বসে থাকতে পারি না। আমাদের প্রথম শ্রেণী থেকে কম্পিউটার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। আপাতত আলাদা বিষয় হিসেবে শুরু করতে না পারলেও প্রথম শ্রেণীর বই থেকেই অধ্যায় হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। একই সঙ্গে সরকার সব ক্লাসরুমকে ডিজিটাল করার যে ঘোষণা দিয়েছে তার জন্য সকল পাঠ্যপুস্তককে ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যারে রূপান্তর করতে হবে।

আমার প্রত্যাশা আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুলের পথ ধরে বাংলাদেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটাল হবে।

ঢাকা। প্রথম লেখা: ২২ জানুয়ারি ২০১৫। আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের প্রণেতা]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২১ , ২১ পৌষ ১৪২৭, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

শিক্ষার ডিজিটাল যাত্রার দুই দশক

মোস্তাফা জব্বার

‘সব কিছুই আমরা ভুলে যাই’ এমন অপবাদ জাতিগতভাবে আমরা পেয়ে থাকি। দূরের ইতিহাস তো বটেই, খুব কাছের ইতিহাসই আমরা মনে রাখি না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কিছু কিছু জাতীয় নেতা-নেত্রীদের বিষয়ে সচেতন থাকলেও জাতীয় ঘটনাগুলোর অনেক কিছুই আমরা স্মৃতিতে ধরে রাখি না। আবার অনেক সময় জাতীয় নেতাদের কথাও আমরা মনে রাখি না। মনে করুন তো, মরহুম মাওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ প্রমুখের কথা। আমাদের চাইতে ভিন্ন রাজনীতি করলেও আজকাল কি কোন পর্যায়ে আমরা তাকে স্মরণ করি? অথচ আমাদের যৌবনকালে তারা ছিলেন সারা বাংলার জননেতা। রাজনীতিতে ভুল করেছেন বলেই হয়তো ইতিহাসই তাদের মনে রাখে না। আজকালের ছেলেমেয়েরা সম্ভবত তাদের নামই শুনেনি। আজকাল দেখি আমরা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কথাও মনে রাখি না। আমি অসংখ্য নাম উল্লেখ করতে পারব যাদের কথা কেউ স্মরণ করে না।

অনেক সময় আবার একজনের সৃজন অন্যজন স্মরণও করতে চাইনা। কখনও পরশ্রীকাতরতা বা ঈর্ষাও কাজ করে। রাজনীতির ক্ষেত্রে এটি মেনে নিতে বাধ্য হলেও অন্য কাজের ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়া উচিত নয়।

মাঝে মাঝে মনে হয়, গর্ব করার মতো ঘটনাও আমরা মনে রাখি না। ২০১৪ সালের একটি ঘটনার প্রতি আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। ওই বছরে আমরা বাংলা রেডিওর ৭৫ বছর আর বাংলা টিভির ৫০ বছর পালন করেছি। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এখনও বেশ দাপটের সঙ্গে টিকে আছে। কিন্তু কোন কোন প্রতিষ্ঠান টিকে থেকেও তাদের গৌরবের কথা স্মরণ করতে চায় না। আমি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কথা স্মরণ করতে পারি। এই প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৬৪ সালে উপমহাদেশের দ্বিতীয় ডিজিটাল কম্পিউটার এসেছিল ১৯৬৪ সালে। ভারতের কলকাতায় ১৯৫৩ সালে প্রথম এনালগ কম্পিউটার টাটায় যাত্রা শুরু করলেও চালু হয় ৫৫ সালের পর। অন্যদিকে ১৯৫৫ সালে ভারতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটে ডিজিটাল কম্পিউটার স্থাপিত হয়। ওরা সেইসব স্মরণে রেখেছে। অথচ আমাদের পরমাণু শক্তি কমিশন মনেই রাখেনি যে, কবে ছিল তাদের গৌরবের ৫০ বছর। আমি আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ছাড়াও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট সব কটি ট্রেডবডিকে জানিয়েও এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়াতে পারিনি। বেসিস-বিসিএস-আইএসপিএবি; কেউ কোন উদ্যোগ নেয়নি। আইসিটি মন্ত্রণালয় তো বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই করতে চায় নাই। সর্বশেষ স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান পরিষদের সভায় এই অর্জনকে স্মরণ করার সিদ্ধান্ত হলেও এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কেউ কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমি জানি না। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির কথাই মনে করি না কেন? ওরা তাদের জন্মের ২৫ বছর মনেই রাখেনি। শুনছি সামনের বছর ৩৪ বছরপূর্তি স্মরণ করবে। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। একেবারে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল; ইংরেজি পঞ্জিকার এসব মাসগুলো বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার বা বাঙালির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসগুলোর অনেকগুলো দিনের সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব যুক্ত আছে। বাকি মাসগুলোর কথা বাদ দিলেও ডিসেম্বরের কথা কোনভাবেই ভুলে থাকা যাবে না। এই মাসের বড় বড় তারিখগুলোর কথা খুব সংক্ষেপে স্মরণ করা যায়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামকরণ করেন। ৬ তারিখে বাংলাদেশ মুক্তির এক সুবর্ণ সময়ে প্রবেশ করে। ভারত-ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ডিসেম্বর মাসকে স্মরণ করা হলেও সেই দিনটিকে তেমনভাবে স্মরণ করতে দেখি না। এবার মুজিব শতবর্ষে আমরা এসব স্মরণ করেছি। একাত্তরের সেই দিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা। ২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। এখন দিনটি ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। মনে আছে ৬ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আমি লিখি ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা। ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটি সেই ঘোষণাকে অনুমোদন দেয়। সেই সময়েই আমি হংকংয়ের এসোসিও সম্মেলনে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা উপস্থাপন করি। ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। এরপর ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে আয়োজন করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনার। সেখানেও মূল প্রবন্ধ পাঠ করি আমি। ৬ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যে অনন্য ঘটনাগুলো ঘটে তারও আগে ৯৭ সালের ডিসেম্বরে আমার সভাপতিত্বে আয়োজিত হয়েছিল একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সেমিনার। উপস্থিত ছিলেন ভারতের ন্যাসকমের প্রয়াত দেওয়াং মেহতা। ৯৭ সালেই গঠিত হয়েছিল জেআরসি কমিটি। সেমিনারটি সেই কমিটির সুপারিশেই অনুষ্ঠিত হয়। সেই সেমিনারের পরই সরকার কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৯৮ মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল-জুন মাসে সেটি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের কোন ঘটনাকেই কেউ স্মরণ করেনি। যে দেশের সরকারের মূলমন্ত্র ডিজিটাল বাংলাদেশ, সেদেশে এর সঙ্গে যুক্ত দিনগুলোর কথা কি আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল না? এই জাতির কাছে অনেকেই এমন প্রত্যাশা করেন না। বরং আমাদের ইতিহাস চর্চায় সত্য গোপন করা বা বিকৃত করায় অনেক বড় বড় দৃষ্টান্ত রয়েছে।

আমি অবশ্য মনে করি এসব বিষয়ে আফসোস করে লাভ নেই। বরং সময় সুযোগ পেলে দিনগুলোর কথা একটু-আধটু স্মরণ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত আমি ডিসেম্বরের আরও দুটি যুগান্তকারী দিনের কথা এখানে স্মরণ করতে চাই। দিনটি ২৪ ডিসেম্বর ও ২৫ ডিসেম্বর। কেউ কখনও এই দিন দুটির কথা মনেই করতে পারবেন না।

প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করেই বলা দরকার। আমরা এখন যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি তখন বড় বড় যে কটি রূপান্তরের কথা বলি তার সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর। সরকার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরি করতে বলেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতে চান। এরই মাঝে অনেকগুলো ডিজিটাল ক্লাসরুম হয়েছে। আরও অনেক ক্লাসরুম তৈরি হচ্ছে। সরকার যে ডিজিটাল শিক্ষা চায় সেটি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। অন্যদিকে সরকার ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। আমি শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ২০১১-১৪ সালের ডিজিটাল ক্লাসরুম এবং বাধ্যতামূলক তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার সূচনা হয়েছিল ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯। বিষয়টি প্রায় কেউ জানে না। সেই দিন ঢাকার কাছে গাজীপুরের ছায়াবিথীতে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং তার পতœী সেলিনা মল্লিক আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল নামক একটি স্কুলের উদ্বোধন করেছিলেন। আমি স্মরণ করতে পারি যে, সেদিন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী একটি ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের কাছে সেদিন প্রজেক্টর বা বড় মনিটর ছিল না- তাই কাউকে ডিজিটাল শিক্ষার কোন কিছুই আমরা উপস্থাপন করতে পারিনি। তবে স্বপ্নটা যে দৃঢ় ছিল তার প্রমাণ হিসেবে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্কুলটিতে প্রচলন করেছিলাম। সেই স্কুলটির বৈশিষ্ট্য ছিল যে, শিশুশ্রেণী থেকে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর মানে হলো জীবনের প্রথম শিক্ষাদিবস থেকে প্রত্যেককে কম্পিউটার বিষয়টি পড়তে হবে। একই সঙ্গে শুরু হয় কম্পিউটার দিয়ে পড়াশোনা। দ্বিতীয়ত শিশুদের আমেরিকার জাম্পস্টার্ট কোম্পানির সফটওয়্যার দিয়ে ডিজিটাল শিক্ষ দেয়া হয়।

আমি নিজে স্মরণ করতে পারি যে, এর সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগে। ৮৭ সালে আমি যখন এ্যাপল কম্পিউটার বিক্রি করা শুরু করি তখন থেকেই এ্যাপলের শিক্ষামূলক সফটওয়্যার ও সলিউশনগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বাংলাদেশের প্রথম এ্যাপল ডিলারের নামও ছিল বিজনেস অ্যান্ড এডুকেশন সিস্টেমস লি.। এ্যাপলের নিজস্ব চ্যানেল ছাড়াও ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাপোর্ট দিতে গিয়ে আমি নতুন এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হই। এ্যাপল তখন একেবারেই আলাদা করে শিক্ষা খাতে কম্পিউটার প্রচলনের চেষ্টা করছিল। এমনকি অন্যদের চাইতে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য এ্যাপল পণ্যের দাম কম ছিল। সেই সময়ে আমেরিকায় ব্যাপকভাবে শিক্ষামূলক সফটওয়্যারের প্রচলন ঘটে। আমি ১৯৯৭ সালে ছেলে বিজয়ের জন্য এসব সফটওয়্যার আনি। নিজের ঘরে এসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে বুঝতে পারি যে, এটি এক অনন্য ব্যবস্থা। শিক্ষাকে ডিজিটাল করার সেই স্বপ্নটাকেই ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯ বাস্তবে রূপ দেয়া হয়।

খুব সঙ্গতকারণেই দিনটি হচ্ছে বাংলাদেশে ডিজিটাল শিক্ষার জন্মদিন। সহজ হিসেব করেই বলা যায যে, ২০১৪ সালে সেই দিনটির ১৫ বছর অতিক্রম করলাম আমরা। ২০ সালে ২০ বছর পার করলাম। এটি খুব সঙ্গত ছিল যে, আমরা সেই দিনটিকে স্মরণ করি। কেউ একজন কোন এক মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল সেই স্মৃতিময় সময়টিকে উজ্জ্বল করে উপস্থাপন করা। এটি খুব স্বাভাবিক ছিল যে ২০ বছরে সেই প্রচেষ্টার সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে একটু পর্যালোচনা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। একেবারে নীরবে নিভৃতে চলে গেল দিনটি।

স্মরণ করতে পারি ২০০০ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ১৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্কুলটি চালু হবার পর ২০০১ সালে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০০২ সালে আরও বাড়ে। ২০০৩ সাল নাগাদ দেশজুড়ে ৩০টি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান-সামন্তযুগীয় একটি সমাজে এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজটি নিঃসন্দেহে একটি চরম সাহসী কাজ ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সফটওয়্যার নিয়ে। আমরা আমেরিকা থেকে যেসব শিক্ষামূলক সফটওয়্যার আমদানি করি সেগুলো আমাদের জন্য উপযোগী মনে হয়নি। সবগুলো ইংরেজি সফটওয়্যার আমাদের পাঠক্রমকেও সহায়তা করছিল না। সেটির অভাব পূরণ করার জন্য আমি আমার আনন্দ মাল্টিমিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার বানানোর জন্য নির্দেশ দিই। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, রাজশাহী ক্যাম্পাস থেকে সফটওয়্যার বানানোও হয়। ফ্লাশ, ম্যাক্রোমিডিয়া ডিরেক্টর ইত্যাদির পাশাপাশি থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স ব্যবহার করি আমরা। কিন্তু সফটওয়্যারগুলো তেমন মানসম্মত হতে পারেনি। অবশেষে ২০১০ সালে আমি বিজয় শিশুশিক্ষা নামের একটি শিক্ষামূলক সফটওয়্যার বানাতে সক্ষম হই। বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জেসমিন জুইকে এর পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে। বলা যেতে পারে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠার এক দশক পর তার উপযোগী সফটওয়্যার বানাই আমরা। ২০১০ সালেল ২৫ ডিসেম্বর জেসমিনের শিশুকন্যা পরমার হাত ধরে বিজয় শিশু শিক্ষার উদ্বোধন হয়। এরপর ২০২০ সাল অবধি মোট ৮টি সফটওয়্যার বাজারে আসে। এখন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়াকে কাগজের বাইরে রেখে সম্পন্ন করা সম্ভব। এমন একটি অবস্থায় ২০ বছরের একটি মাইলফলককে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করাটি বাঞ্ছনীয় ছিল।

২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এখন মনে হচ্ছে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য আমাদের অনেক কাজ জরুরি ভিত্তিতে করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রথমত আমরা ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কম্পিউটার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে বসে থাকতে পারি না। আমাদের প্রথম শ্রেণী থেকে কম্পিউটার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। আপাতত আলাদা বিষয় হিসেবে শুরু করতে না পারলেও প্রথম শ্রেণীর বই থেকেই অধ্যায় হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। একই সঙ্গে সরকার সব ক্লাসরুমকে ডিজিটাল করার যে ঘোষণা দিয়েছে তার জন্য সকল পাঠ্যপুস্তককে ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যারে রূপান্তর করতে হবে।

আমার প্রত্যাশা আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুলের পথ ধরে বাংলাদেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটাল হবে।

ঢাকা। প্রথম লেখা: ২২ জানুয়ারি ২০১৫। আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের প্রণেতা]

mustafajabbar@gmail.com