অমিত শাহ’র পশ্চিমবঙ্গ সফর : রাজনৈতিক প্রেক্ষিত

গৌতম রায়

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফর ঘিরে রাজ্য রাজনীতি সরগরম। অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এই রাজ্য সফর করলেন, না, বিজেপি নেতা হিসেবে করলেন, তার সফর এবং বিভিন্ন কথাবার্তা ঘিরে তা নিয়ে একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি একটি রাজ্য সফরকালে প্রশাসনিক কোন কার্যক্রম না রেখে শুধু-ই দলীয় কর্মসূচি পালন করে চলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজরিত শান্তিনিকেতনে গিয়েও এক মুহূর্তের জন্য নিজের বিজেপি নেতার পরিচয় ভুলে থাকতে না পারেন, তা হলে এ রকম মানুষকে ঘিরে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের মনে সংশয় তো তৈরি হবেই। যদিও গুজরাট গণহত্যার অন্যতম নায়ক অমিত শাহকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের কোনদিন-ই যে আলাদা করে, এতটুকু আগ্রহ ছিল না, তা আর নতুন করে বলবার কোন দরকার হয় না।

এক স্বনামধন্য চিকিৎসক তথা কথাসাহিত্যিক একবার ব্যক্তিগত স্তরে বলেছিলেন, বিজেপি ভোটে জেতে না। ভোটের পরে জেতে! সেই সাহিত্যিকের কৌতুকবাক্যটি বোধহয় এলোমেলো করে দিতে এই রাজ্যে কোমর বেঁধে নেমেছে। অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক বাসভবনে গিয়েছেন। বিবেকানন্দকে কার্যত আরএসএসের স্বয়ংসেবক হিসেবে দেখানোর উপক্রম গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির বেশ অনেকদিন ধরেই করছে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়কাল থেকেই মধ্যবিত্ত বাঙালি, তথা ভারতীয়র রামকৃষ্ণ মিশন ঘিরে ভাবাবেগকে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নির্বাচনী প্রচারকাজে সংযুক্ত করে দেয়ার চেষ্টাটা হিন্দুত্ববাদী শিবির করে চলেছে। নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার সময়ে অত্যন্ত সুকৌশলে আরএসএসের পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয়েছিল যে, মোদির উদ্দেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তৎকালীন সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী আত্মস্থানন্দ আশীর্বাদ এবং শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী পুষ্পার্ঘ্য পাঠিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো এটি জোরদারভাবে প্রচার করে।

শপথ নেয়ার আগে নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে চিঠি লিখে স্বামী আত্মস্থানন্দের কাছে আশীর্বাণী চাওয়া হয়। যে কোন মানুষ-ই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্ঘগুরু বা সহ সঙ্ঘগুরুর কাছে আশীর্বাদ চাইলে তাকে সংশ্লিষ্ট সন্ন্যাসীরা আশীর্বাণীসহ প্রত্যুত্তর দেন। এটাই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দস্তুর। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলের যে কোন ভক্তের আশীর্বাদ প্রার্থনার থেকে, নরেন্দ্র মোদির আশীর্বাদ প্রার্থনা এবং স্বামী আত্মস্থানন্দ কর্তৃক আশীর্বাদ প্রেরণ, কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না। কিন্তু আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি আত্মস্থানন্দজীর আশীর্বাদের ঘটনাটিকে নরেন্দ্র মোদির প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্বের ঘটনা হিশেবে গোটা মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরে নিজের একটা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই সামাজিক প্রযুক্তিটা রামকৃষ্ণ মিশন কে ঘিরে আরএসএস, বিজেপি নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে জোর কদমে করে চলেছে। অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাসে যাওয়া, সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রাণপ্রিয় নরেন, যিনি বহুত্ববাদের সাধনার ভেতরেই হিন্দুধর্মের মহত্বকে অনুভব করেছিলেন, মুচি, মেথর, চণ্ডালের ভেতর থেকেই আগামী ভারত জেগে উঠবে বলে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন, সেই বিবেকনন্দকে তার জন্মভিটেতে দাঁড়িয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে গেলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিবেকানন্দকে এভাবে অমিত শাহের সাম্প্রদায়িক উপস্থাপনা রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা পাশে দাঁড়িয়ে শুনলেন। বিবেকানন্দের মূল ভাবাদর্শ, শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী চেতনাকে এইভাবে অমিত শাহ কর্তৃক বিকৃত উপস্থাপনা, অসত্য ভাষ্যের ভেতর দিয়ে তুলে ধরা- এইসব সম্পর্কে রামকৃষ্ণ মিশন একটি প্রতিবাদী শব্দ উচ্চারণ করেনি।

রামকৃষ্ণ মিশনকে কেন্দ্র করে বিজেপির সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। চলতি বছরের শেষের দিকে এনআরসি ঘিরে গণবিক্ষোভ যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে রাত্রিবাস করলেন বেলুড় মঠের অতিথিশালাতে। পরের দিন বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণের ভেতরে বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে সভাকে প্রধানমন্ত্রী মোদি ব্যবহার করলেন এনআরসির পক্ষে প্রচারের উদ্দেশে। এভাবে বেলুড় মঠকে জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী, কেউ কখনও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবানুরাগীদের ভেতরে নিজেদের সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটানোর উদ্দেশে আরএসএসের যে কর্মকাণ্ড, সেই কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতাই পরিলক্ষিত হলো অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে বিবেকানন্দের পৈতৃক বাসভবনে গিয়ে স্বামীজীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নাম করে তাকে আরএসএস ভাবাদর্শের মানুষ হিসেবে তুলে ধরবার প্রয়াসের ভেতর দিয়ে।

গত ১০ বছর ধরে এই রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলবদলের যে সংস্কৃতি কায়েম করেছেন, বিজেপি এখন সেই সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরে মমতাকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে। গত লোকসভা নির্বাচনের সময়কালে অর্জুন সিং, সৌমিত্র খান প্রমুখের যে বিজেপিতে যোগদান বা ভোটের ফলের পর একাংশের তৃণমূল কর্মীদের বিজেপিতে যোগদানের যে হিরিক, আবার পুনর্মুষিকভব করে সেসব কর্মীদের তৃণমূলে ফিরে যাওয়া, এসব পর্যায়কে কার্যত ছাপিয়ে গেল অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে মেদিনীপুরের জনসভায়। তৃণমূলের ডাকাবুকো নেতা, নন্দীগ্রামপর্বের ভেতর দিয়ে মমতাকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে যিনি সব থেকে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই শুভেন্দু অধিকারী, অমিত শাহের সভাতে বিজেপিতে যোগ দিলেন। সেই সঙ্গে তৃণমূলের বেশ কিছু বিধায়ক, একজন সাংসদ, সিপিআইয়ের (এম) একজন বিধায়িকা, সিপিআইয়ের একজন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিলেন।

বস্তুত শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগ দেয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। তবে এই যোগদানের পর দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে বিশেষ হৃদ্যতার যে কথা শুভেন্দু প্রকাশ্যে বলেছেন, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সেই কথাগুলো ঘিরে। তৃণমূলের একটা বড় অংশের নেতৃত্ব অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালের সাড়ে ছয় বছর এনডিএতে থাকার যোগসূত্র যে আজ ও বহন করে যাচ্ছেন, শুভেন্দুর এই স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তাই আরএসএস- বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে লড়াই, যাকে সিপিআই (এম) ছদ্মলড়াই বলে অভিহিত করে থাকে, সেই অভিযোগের একটা বাস্তবভিত্তি তৃণমূলের বরিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের শুভেন্দু অধিকারীর স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

মমতা এককালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশে বিজেপিকে এই রাজ্যে মাটি পেতে সাহায্য করেছিলেন। বিজেপিকে এই রাজ্যে পা ফেলতে সুযোগ করে দেয়াটাই মমতার সব থেকে বড় রাজনৈতিক অপরাধ, এই কথাটা জ্যোতি বসু বারবার বলতেন। সে সঙ্গে নয়ের দশকে দমদম লোকসভা কেন্দ্রে গোষ্ঠী রাজনীতির তাগিদে সিপিআই (এম) প্রার্থী অধ্যাপক নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করা, যেটি মমতাকে বিজেপির পক্ষে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছিল, সেই প্রসঙ্গটিকেও কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করা চলে না। মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই, দমদম পুনরুদ্ধার হয়েছেÑ জ্যোতিবাবুর এই কথার ভেতর দিয়ে অনেক না বলা কথার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল।

নির্মল চ্যাটার্জীকে হারিয়ে তপন শিকদারকে জেতাতে সেই সময়ের এক ডাকাবুকো মন্ত্রীর ভূমিকা ঘিরে যে চাপান উতোর আছে, সেখান থেকে সিপিআই (এম) শিক্ষা নেয়নি। তাই সেই মন্ত্রীর ডান হাত বলে একদা হাত সুজিত বসু এখন মমতার মন্ত্রী। আর মমতা নিজে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আদলে নিজের দলের প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে খবরাখবর সংগ্রহ করে নিজেকে সফল স্ট্যালিনিস্টের মতো তুলে ধরলেও, তার বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা যে তার নিজের বাসাকেই আলগা করে দিচ্ছে, সেটা বুঝেও কেন কিছু করতে পারছেন না? আর এস এসের প্রতি তার দায়বদ্ধতা কি এতটাই প্রবল যে, আরএসএস নিজের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে দিয়ে এখন তার সংসার ভেঙে চৌচির করে দিচ্ছে দেখেও মমতার কিছু আস্ফালন করা ছাড়া কার্যত আর কিছুই রাজনৈতিকভাবে করবার নেই?

বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করে তাহলে আর এস এসের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’-ই যে হবে তাদের সব থেকে বড় অস্ত্র, তা মেদিনীপুরের সভায় অমিত শাহ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। রামকথার নায়ক, যাকে ঘিরে গোটা ভারতবাসীর মতোই বাংলার মানুষদের ও শ্রদ্ধা কোন অংশে কম নেই, সেই নরচন্দ্রমা ‘রাম’ কে বিজেপির পোস্টার বয় হিসেবে তুলে ধরবার সবটুকু প্রয়াস মেদিনীপুরের সভায় অমিত শাহের বক্তৃতা এবং সেøাগানের ভেতরে ছিল। এই সেøাগানের ভেতর দিয়েই অমিত শাহ তথা আরএসএস বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তৃণমূলের ঘর ভেঙে, নিজেদের ঘর গোছাবার যত চেষ্টাই তারা করুক না কেন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই যে তারা রাজনীতির একমাত্র উপায় বলে মনে করছে, সে বিষয়ে সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নেই।

বিপ্লবতীর্থ মিদিনীপুরে, মোহবনিতে শহিদ ক্ষুদিরামের জন্মগৃহে- সর্বত্র-ই সাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক বিভাজনের যে কর্মসূচি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির আছে, তার প্রয়োগের লক্ষ্যেই অমিত শাহ নিজেকে ব্যাপৃত রাখলেন। যে আরএসএস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে চিরদিন প্রতারণা করে এসেছে, সেই আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি, তথা তাদের পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে অমিত শাহের এতটুকু আটকায়নি।

ভারতের চিরপ্রবাহমান বহুত্ববাদী ভাবধারাকে তুলে ধরাই ছিল রবীন্দ্রনাথের সাধনা। সেই সাধনার গঙ্গাযাত্রা ঘটানোই আরএসএস-বিজেপির লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির অনেক আগেই বিশ্বভারতীর উপাচার্য, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, যার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী শিবিরের ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত, তিনি শান্তিনিকেতনের শতাব্দী প্রাচীন পৌষমেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এনআরসির পক্ষে প্রচারের জন্যে বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

সেই বিশ্বভারতীর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অমিত শাহ কার্যত হত্যা করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ কে তার বিশ্বমানবতার ধারণাকে কৌনিক রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচার চালিয়ে। অমিত শাহের বিরুদ্ধে যাতে কোন বিক্ষভ সংগঠিত হতে না পারে, তারজন্যে বিশ্বভারতীর বামপন্থি ছাত্রনেতাদের গৃহবন্দি করে রাখল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

মঙ্গলবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২১ , ২১ পৌষ ১৪২৭, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

অমিত শাহ’র পশ্চিমবঙ্গ সফর : রাজনৈতিক প্রেক্ষিত

গৌতম রায়

image

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফর ঘিরে রাজ্য রাজনীতি সরগরম। অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এই রাজ্য সফর করলেন, না, বিজেপি নেতা হিসেবে করলেন, তার সফর এবং বিভিন্ন কথাবার্তা ঘিরে তা নিয়ে একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি একটি রাজ্য সফরকালে প্রশাসনিক কোন কার্যক্রম না রেখে শুধু-ই দলীয় কর্মসূচি পালন করে চলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজরিত শান্তিনিকেতনে গিয়েও এক মুহূর্তের জন্য নিজের বিজেপি নেতার পরিচয় ভুলে থাকতে না পারেন, তা হলে এ রকম মানুষকে ঘিরে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের মনে সংশয় তো তৈরি হবেই। যদিও গুজরাট গণহত্যার অন্যতম নায়ক অমিত শাহকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের কোনদিন-ই যে আলাদা করে, এতটুকু আগ্রহ ছিল না, তা আর নতুন করে বলবার কোন দরকার হয় না।

এক স্বনামধন্য চিকিৎসক তথা কথাসাহিত্যিক একবার ব্যক্তিগত স্তরে বলেছিলেন, বিজেপি ভোটে জেতে না। ভোটের পরে জেতে! সেই সাহিত্যিকের কৌতুকবাক্যটি বোধহয় এলোমেলো করে দিতে এই রাজ্যে কোমর বেঁধে নেমেছে। অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক বাসভবনে গিয়েছেন। বিবেকানন্দকে কার্যত আরএসএসের স্বয়ংসেবক হিসেবে দেখানোর উপক্রম গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির বেশ অনেকদিন ধরেই করছে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়কাল থেকেই মধ্যবিত্ত বাঙালি, তথা ভারতীয়র রামকৃষ্ণ মিশন ঘিরে ভাবাবেগকে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নির্বাচনী প্রচারকাজে সংযুক্ত করে দেয়ার চেষ্টাটা হিন্দুত্ববাদী শিবির করে চলেছে। নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার সময়ে অত্যন্ত সুকৌশলে আরএসএসের পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয়েছিল যে, মোদির উদ্দেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তৎকালীন সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী আত্মস্থানন্দ আশীর্বাদ এবং শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী পুষ্পার্ঘ্য পাঠিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো এটি জোরদারভাবে প্রচার করে।

শপথ নেয়ার আগে নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে চিঠি লিখে স্বামী আত্মস্থানন্দের কাছে আশীর্বাণী চাওয়া হয়। যে কোন মানুষ-ই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্ঘগুরু বা সহ সঙ্ঘগুরুর কাছে আশীর্বাদ চাইলে তাকে সংশ্লিষ্ট সন্ন্যাসীরা আশীর্বাণীসহ প্রত্যুত্তর দেন। এটাই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দস্তুর। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলের যে কোন ভক্তের আশীর্বাদ প্রার্থনার থেকে, নরেন্দ্র মোদির আশীর্বাদ প্রার্থনা এবং স্বামী আত্মস্থানন্দ কর্তৃক আশীর্বাদ প্রেরণ, কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না। কিন্তু আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি আত্মস্থানন্দজীর আশীর্বাদের ঘটনাটিকে নরেন্দ্র মোদির প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্বের ঘটনা হিশেবে গোটা মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরে নিজের একটা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই সামাজিক প্রযুক্তিটা রামকৃষ্ণ মিশন কে ঘিরে আরএসএস, বিজেপি নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে জোর কদমে করে চলেছে। অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাসে যাওয়া, সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রাণপ্রিয় নরেন, যিনি বহুত্ববাদের সাধনার ভেতরেই হিন্দুধর্মের মহত্বকে অনুভব করেছিলেন, মুচি, মেথর, চণ্ডালের ভেতর থেকেই আগামী ভারত জেগে উঠবে বলে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন, সেই বিবেকনন্দকে তার জন্মভিটেতে দাঁড়িয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে গেলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিবেকানন্দকে এভাবে অমিত শাহের সাম্প্রদায়িক উপস্থাপনা রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা পাশে দাঁড়িয়ে শুনলেন। বিবেকানন্দের মূল ভাবাদর্শ, শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী চেতনাকে এইভাবে অমিত শাহ কর্তৃক বিকৃত উপস্থাপনা, অসত্য ভাষ্যের ভেতর দিয়ে তুলে ধরা- এইসব সম্পর্কে রামকৃষ্ণ মিশন একটি প্রতিবাদী শব্দ উচ্চারণ করেনি।

রামকৃষ্ণ মিশনকে কেন্দ্র করে বিজেপির সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। চলতি বছরের শেষের দিকে এনআরসি ঘিরে গণবিক্ষোভ যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে রাত্রিবাস করলেন বেলুড় মঠের অতিথিশালাতে। পরের দিন বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণের ভেতরে বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে সভাকে প্রধানমন্ত্রী মোদি ব্যবহার করলেন এনআরসির পক্ষে প্রচারের উদ্দেশে। এভাবে বেলুড় মঠকে জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী, কেউ কখনও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবানুরাগীদের ভেতরে নিজেদের সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটানোর উদ্দেশে আরএসএসের যে কর্মকাণ্ড, সেই কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতাই পরিলক্ষিত হলো অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে বিবেকানন্দের পৈতৃক বাসভবনে গিয়ে স্বামীজীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নাম করে তাকে আরএসএস ভাবাদর্শের মানুষ হিসেবে তুলে ধরবার প্রয়াসের ভেতর দিয়ে।

গত ১০ বছর ধরে এই রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলবদলের যে সংস্কৃতি কায়েম করেছেন, বিজেপি এখন সেই সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরে মমতাকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে। গত লোকসভা নির্বাচনের সময়কালে অর্জুন সিং, সৌমিত্র খান প্রমুখের যে বিজেপিতে যোগদান বা ভোটের ফলের পর একাংশের তৃণমূল কর্মীদের বিজেপিতে যোগদানের যে হিরিক, আবার পুনর্মুষিকভব করে সেসব কর্মীদের তৃণমূলে ফিরে যাওয়া, এসব পর্যায়কে কার্যত ছাপিয়ে গেল অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে মেদিনীপুরের জনসভায়। তৃণমূলের ডাকাবুকো নেতা, নন্দীগ্রামপর্বের ভেতর দিয়ে মমতাকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে যিনি সব থেকে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই শুভেন্দু অধিকারী, অমিত শাহের সভাতে বিজেপিতে যোগ দিলেন। সেই সঙ্গে তৃণমূলের বেশ কিছু বিধায়ক, একজন সাংসদ, সিপিআইয়ের (এম) একজন বিধায়িকা, সিপিআইয়ের একজন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিলেন।

বস্তুত শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগ দেয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। তবে এই যোগদানের পর দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে বিশেষ হৃদ্যতার যে কথা শুভেন্দু প্রকাশ্যে বলেছেন, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সেই কথাগুলো ঘিরে। তৃণমূলের একটা বড় অংশের নেতৃত্ব অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালের সাড়ে ছয় বছর এনডিএতে থাকার যোগসূত্র যে আজ ও বহন করে যাচ্ছেন, শুভেন্দুর এই স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তাই আরএসএস- বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে লড়াই, যাকে সিপিআই (এম) ছদ্মলড়াই বলে অভিহিত করে থাকে, সেই অভিযোগের একটা বাস্তবভিত্তি তৃণমূলের বরিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের শুভেন্দু অধিকারীর স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

মমতা এককালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশে বিজেপিকে এই রাজ্যে মাটি পেতে সাহায্য করেছিলেন। বিজেপিকে এই রাজ্যে পা ফেলতে সুযোগ করে দেয়াটাই মমতার সব থেকে বড় রাজনৈতিক অপরাধ, এই কথাটা জ্যোতি বসু বারবার বলতেন। সে সঙ্গে নয়ের দশকে দমদম লোকসভা কেন্দ্রে গোষ্ঠী রাজনীতির তাগিদে সিপিআই (এম) প্রার্থী অধ্যাপক নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করা, যেটি মমতাকে বিজেপির পক্ষে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছিল, সেই প্রসঙ্গটিকেও কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করা চলে না। মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই, দমদম পুনরুদ্ধার হয়েছেÑ জ্যোতিবাবুর এই কথার ভেতর দিয়ে অনেক না বলা কথার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল।

নির্মল চ্যাটার্জীকে হারিয়ে তপন শিকদারকে জেতাতে সেই সময়ের এক ডাকাবুকো মন্ত্রীর ভূমিকা ঘিরে যে চাপান উতোর আছে, সেখান থেকে সিপিআই (এম) শিক্ষা নেয়নি। তাই সেই মন্ত্রীর ডান হাত বলে একদা হাত সুজিত বসু এখন মমতার মন্ত্রী। আর মমতা নিজে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আদলে নিজের দলের প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে খবরাখবর সংগ্রহ করে নিজেকে সফল স্ট্যালিনিস্টের মতো তুলে ধরলেও, তার বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা যে তার নিজের বাসাকেই আলগা করে দিচ্ছে, সেটা বুঝেও কেন কিছু করতে পারছেন না? আর এস এসের প্রতি তার দায়বদ্ধতা কি এতটাই প্রবল যে, আরএসএস নিজের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে দিয়ে এখন তার সংসার ভেঙে চৌচির করে দিচ্ছে দেখেও মমতার কিছু আস্ফালন করা ছাড়া কার্যত আর কিছুই রাজনৈতিকভাবে করবার নেই?

বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করে তাহলে আর এস এসের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’-ই যে হবে তাদের সব থেকে বড় অস্ত্র, তা মেদিনীপুরের সভায় অমিত শাহ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। রামকথার নায়ক, যাকে ঘিরে গোটা ভারতবাসীর মতোই বাংলার মানুষদের ও শ্রদ্ধা কোন অংশে কম নেই, সেই নরচন্দ্রমা ‘রাম’ কে বিজেপির পোস্টার বয় হিসেবে তুলে ধরবার সবটুকু প্রয়াস মেদিনীপুরের সভায় অমিত শাহের বক্তৃতা এবং সেøাগানের ভেতরে ছিল। এই সেøাগানের ভেতর দিয়েই অমিত শাহ তথা আরএসএস বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তৃণমূলের ঘর ভেঙে, নিজেদের ঘর গোছাবার যত চেষ্টাই তারা করুক না কেন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই যে তারা রাজনীতির একমাত্র উপায় বলে মনে করছে, সে বিষয়ে সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নেই।

বিপ্লবতীর্থ মিদিনীপুরে, মোহবনিতে শহিদ ক্ষুদিরামের জন্মগৃহে- সর্বত্র-ই সাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক বিভাজনের যে কর্মসূচি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির আছে, তার প্রয়োগের লক্ষ্যেই অমিত শাহ নিজেকে ব্যাপৃত রাখলেন। যে আরএসএস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে চিরদিন প্রতারণা করে এসেছে, সেই আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি, তথা তাদের পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে অমিত শাহের এতটুকু আটকায়নি।

ভারতের চিরপ্রবাহমান বহুত্ববাদী ভাবধারাকে তুলে ধরাই ছিল রবীন্দ্রনাথের সাধনা। সেই সাধনার গঙ্গাযাত্রা ঘটানোই আরএসএস-বিজেপির লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির অনেক আগেই বিশ্বভারতীর উপাচার্য, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, যার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী শিবিরের ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত, তিনি শান্তিনিকেতনের শতাব্দী প্রাচীন পৌষমেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এনআরসির পক্ষে প্রচারের জন্যে বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

সেই বিশ্বভারতীর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অমিত শাহ কার্যত হত্যা করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ কে তার বিশ্বমানবতার ধারণাকে কৌনিক রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচার চালিয়ে। অমিত শাহের বিরুদ্ধে যাতে কোন বিক্ষভ সংগঠিত হতে না পারে, তারজন্যে বিশ্বভারতীর বামপন্থি ছাত্রনেতাদের গৃহবন্দি করে রাখল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]