প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন উদ্যোগ নিয়েছে অন্য উৎস থেকেও টিকা সংগ্রহের জন্য। ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র পাশাপাশি এবার বিকল্প উৎস থেকে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) সংগ্রহে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়াল (পরীক্ষা) পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। চীনের একটি প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে করোনার টিকার চূড়ান্ত ট্রায়াল অর্থাৎ মানবদেহে পরীক্ষা চালানোর অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে। এছাড়াও রাশিয়া ও চীনে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. এসএম আলমগীর গতকাল সংবাদকে বলেছেন, ‘টিকা সংগ্রহের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। তবে আমার মনে হয়, এতো টিকার আমাদের প্রয়োজন হবে না। আমাদের যা প্রয়োজন সেই পরিমাণ টিকা আমরা কিনে বসে আছি। আমরা সেরাম থেকে কিনেছি তিন কোটি ডোজ টিকা। গ্যাভি সুবিধায় কিনেছি ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা।’
এই ৯ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকায় চার কোটি ৯০ লাখ মানুষকে দেয়া হলে বাকি জনসংখ্যার অর্থাৎ প্রায় ৯ কোটি মানুষের টিকা কোথায় থেকে যোগান দেয়া হবে-জানতে চাইলে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। যদি প্রয়োজন হয় সেটা পরে কেনা যাবে। একবছর পর টিকা অ্যাভেইলেবল হবে, তখন সাশ্রয়ী মূল্যে ভালোমানের টিকা বাজারে আসবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘এতোদিন টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বস্তরেই কিছুটা ঢিলেমি ভাব ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, করোনা সংক্রমণ পর্যায়ক্রমে সহনীয় মাত্রায় নি¤œমুখী হবে। সেরাম এবং কোভাক্স সুবিধার আওতায় যে টিকা কেনা হয়েছে তা দিয়েই করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। কিন্তু ভারত থেকে সেরামের টিকা যথাসময়ে প্রাপ্তি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় এখন অন্য উৎস থেকেও টিকা কেনায় অধিকতর জোর দেয়া হচ্ছে।’ সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এর মধ্যে মোট ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ মানুষকে (জনপ্রতি ২টি) দুই বছরে করোনার টিকা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম বছর ২০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় আসবে।
সরকার এখন পর্যন্ত দুটি সংস্থা থেকে ৯ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে। এ হিসেবে বাকি নয় কোটি ৩২ লাখ মানুষের জন্য ১৮ কোটি ৬৪ লাখ ডোজ টিকা সংগ্রহ করতে হবে।
‘কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি’র সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেছেন, ‘যদি টিকা (ভ্যাকসিন) সফল হয় তাহলে বছরখানেক পর হয়তো আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারবো। তখন এটি সাধারণ ভাইরাসে পরিণত হবে, ওই সময়ে আরও উন্নত টিকাও বাজারে এসে যাবে।’
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আওতায় অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের সহযোগিতায় গঠিত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’র (কোভ্যাক্স) আওতায় আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮০টি দেশ গ্যাভি’তে যুক্ত হয়েছে। কোভ্যাক্স সুবিধার অধীনে প্রতিটা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ তিন কোটি ডোজ টিকা কিনেছে এবং কোভ্যাক্স সুবিধায় আরও চার কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা কেনার চুক্তি করেছে। চার কোটি ৯০ লাখ মানুষের জন্য নয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাচ্ছে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা পেতে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং দেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কোম্পানির সঙ্গে গত ৫ নভেম্বর চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির আওতায় প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে বাংলাদেশকে। আর কোভাক্স সুবিধার আওতায় কেনা টিকা আসবে জুন-জুলাই থেকে।
টিকা সংগ্রহের তোড়জোড়
এতোদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলে আসছিলেন, জানুয়ারির শেষের দিকে অথবা ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ‘অক্সফোর্ডে’র টিকার প্রথম চালান দেশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ‘ভারত সরকার ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে’-এমন খবর প্রকাশ এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে গত ৩ জানুয়ারি সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালার কিছু মতামতকে ঘিরে যথাসময়ে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সেই বিষয়গুলো তো হাতে আছেই। যেমন- চাইনিজ ভ্যাকসিন, রাশিয়ান ভ্যাকসিন, এগুলো আমাদের হাতে আছে। এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এখনও তাদের ট্রায়াল শেষ হয়নি। তাদের ট্রায়াল শেষ হলে আমরা এগ্রিমেন্টে যাব।’
করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু হলে তার ১৫ দিনের মধ্যেই ভারত রপ্তানি শুরু করবে বলে ৪ জানুয়ারি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা একটি গণমাধ্যমকে জানান, প্রতিবেশী দেশগুলোকে টিকা দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি তাদের সরকার দিয়ে আসছিল, তা এখনও অটুট রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে টিকা দেয়া শুরু হলেই ১৫ দিনের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে রপ্তানির অনুমতি দেয়া হবে। এর মধ্যে কিছু টিকা আমরা উপহার হিসেবে দেব। বাকি টিকা রপ্তানি করা হবে আমাদের সরকার যে দামে টিকা কিনবে, মোটামুটি সেই দামেই।’
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) গত ৫ জানুয়ারি করোনা থেকে সুরক্ষায় পাঁচ হাজার ৬৫৯ কোটি সাত লাখ টাকা ব্যয়ে ভ্যাকসিন কেনা সংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ভ্যাকসিন কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। বাকি টাকা টিকা পরিবহন, সংরক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হবে।
‘চলমান কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডামিক প্রিপার্ডনেস’ শীর্ষক প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা করা হয়েছে।
পুনরায় ট্রায়ালের প্রস্তাব চীনা প্রতিষ্ঠানের
টিকার পরীক্ষা, গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের জন্য সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যের কাছে একটি প্রস্তাব দেয় চীনের আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। এটি দেশটির চংকিং জিফেই বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি গত ২ সেপ্টেম্বর প্রথম ট্রায়ালের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। সম্প্রতি আবারও আবেদন করেছে। তাদের আবেদনের প্রায় চারমাস পর তাতে নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে বিএসএমএমইউ।
গত সোমবার চীনের ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিখিত এ প্রস্তাব দেয়া হয় বলে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য প্রফেসর ডা. কনককান্তি বড়–য়া সংবাদকে বলেছেন, তারা চীনের ওই প্রতিষ্ঠানের টিকা তৈরির ট্রায়ালে প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। তবে এখনও তা প্রিলিমিনারি পর্যায়ে আছে। আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে, তা পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বিএসএমএমইউ’র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংবাদকে জানিয়েছেন, চীনের ওই প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের কথা বলেছিল। কিন্তু ভ্যাকসিনের কাজ করার পদ্ধতি বা এর স্বচ্ছতা কতটুকু তা প্রকাশ না করায় তা বাতিল হয়ে গেছে। আবার তারা ট্রায়ালের প্রস্তাব দিয়েছেন; এতে কাগজপত্রসহ অন্যান্য সবকিছু ঠিক থাকলেও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন লাগবে।
বিএসএমএমইউ’র অপর একজন ঊর্ধ্বতন চিকিৎসক জানান, চীনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সব ধরনের তথ্যউপাত্ত দেয়ার পর তা ভার্সিটির রিভিউ (আইআরবি) বোর্ডে যাবে। সেখান থেকে রিচার্স কাউন্সিলে যাবে। রিচার্স কাউন্সিল যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদনের পর তা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
এর আগে চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশে তাদের টিকার পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ট্রায়ালের অর্থায়ন-জটিলতায় তাতে সেই উদ্যোগ থমকে যায়।
বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২১ , ২৩ পৌষ ১৪২৭, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২
প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন উদ্যোগ নিয়েছে অন্য উৎস থেকেও টিকা সংগ্রহের জন্য। ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র পাশাপাশি এবার বিকল্প উৎস থেকে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) সংগ্রহে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়াল (পরীক্ষা) পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। চীনের একটি প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে করোনার টিকার চূড়ান্ত ট্রায়াল অর্থাৎ মানবদেহে পরীক্ষা চালানোর অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে। এছাড়াও রাশিয়া ও চীনে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. এসএম আলমগীর গতকাল সংবাদকে বলেছেন, ‘টিকা সংগ্রহের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। তবে আমার মনে হয়, এতো টিকার আমাদের প্রয়োজন হবে না। আমাদের যা প্রয়োজন সেই পরিমাণ টিকা আমরা কিনে বসে আছি। আমরা সেরাম থেকে কিনেছি তিন কোটি ডোজ টিকা। গ্যাভি সুবিধায় কিনেছি ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা।’
এই ৯ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকায় চার কোটি ৯০ লাখ মানুষকে দেয়া হলে বাকি জনসংখ্যার অর্থাৎ প্রায় ৯ কোটি মানুষের টিকা কোথায় থেকে যোগান দেয়া হবে-জানতে চাইলে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। যদি প্রয়োজন হয় সেটা পরে কেনা যাবে। একবছর পর টিকা অ্যাভেইলেবল হবে, তখন সাশ্রয়ী মূল্যে ভালোমানের টিকা বাজারে আসবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘এতোদিন টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বস্তরেই কিছুটা ঢিলেমি ভাব ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, করোনা সংক্রমণ পর্যায়ক্রমে সহনীয় মাত্রায় নি¤œমুখী হবে। সেরাম এবং কোভাক্স সুবিধার আওতায় যে টিকা কেনা হয়েছে তা দিয়েই করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। কিন্তু ভারত থেকে সেরামের টিকা যথাসময়ে প্রাপ্তি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় এখন অন্য উৎস থেকেও টিকা কেনায় অধিকতর জোর দেয়া হচ্ছে।’ সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এর মধ্যে মোট ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ মানুষকে (জনপ্রতি ২টি) দুই বছরে করোনার টিকা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম বছর ২০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় আসবে।
সরকার এখন পর্যন্ত দুটি সংস্থা থেকে ৯ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে। এ হিসেবে বাকি নয় কোটি ৩২ লাখ মানুষের জন্য ১৮ কোটি ৬৪ লাখ ডোজ টিকা সংগ্রহ করতে হবে।
‘কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি’র সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেছেন, ‘যদি টিকা (ভ্যাকসিন) সফল হয় তাহলে বছরখানেক পর হয়তো আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারবো। তখন এটি সাধারণ ভাইরাসে পরিণত হবে, ওই সময়ে আরও উন্নত টিকাও বাজারে এসে যাবে।’
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আওতায় অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের সহযোগিতায় গঠিত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’র (কোভ্যাক্স) আওতায় আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮০টি দেশ গ্যাভি’তে যুক্ত হয়েছে। কোভ্যাক্স সুবিধার অধীনে প্রতিটা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ তিন কোটি ডোজ টিকা কিনেছে এবং কোভ্যাক্স সুবিধায় আরও চার কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা কেনার চুক্তি করেছে। চার কোটি ৯০ লাখ মানুষের জন্য নয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাচ্ছে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা পেতে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং দেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কোম্পানির সঙ্গে গত ৫ নভেম্বর চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির আওতায় প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে বাংলাদেশকে। আর কোভাক্স সুবিধার আওতায় কেনা টিকা আসবে জুন-জুলাই থেকে।
টিকা সংগ্রহের তোড়জোড়
এতোদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলে আসছিলেন, জানুয়ারির শেষের দিকে অথবা ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ‘অক্সফোর্ডে’র টিকার প্রথম চালান দেশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ‘ভারত সরকার ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে’-এমন খবর প্রকাশ এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে গত ৩ জানুয়ারি সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালার কিছু মতামতকে ঘিরে যথাসময়ে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সেই বিষয়গুলো তো হাতে আছেই। যেমন- চাইনিজ ভ্যাকসিন, রাশিয়ান ভ্যাকসিন, এগুলো আমাদের হাতে আছে। এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এখনও তাদের ট্রায়াল শেষ হয়নি। তাদের ট্রায়াল শেষ হলে আমরা এগ্রিমেন্টে যাব।’
করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু হলে তার ১৫ দিনের মধ্যেই ভারত রপ্তানি শুরু করবে বলে ৪ জানুয়ারি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা একটি গণমাধ্যমকে জানান, প্রতিবেশী দেশগুলোকে টিকা দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি তাদের সরকার দিয়ে আসছিল, তা এখনও অটুট রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে টিকা দেয়া শুরু হলেই ১৫ দিনের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে রপ্তানির অনুমতি দেয়া হবে। এর মধ্যে কিছু টিকা আমরা উপহার হিসেবে দেব। বাকি টিকা রপ্তানি করা হবে আমাদের সরকার যে দামে টিকা কিনবে, মোটামুটি সেই দামেই।’
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) গত ৫ জানুয়ারি করোনা থেকে সুরক্ষায় পাঁচ হাজার ৬৫৯ কোটি সাত লাখ টাকা ব্যয়ে ভ্যাকসিন কেনা সংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ভ্যাকসিন কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। বাকি টাকা টিকা পরিবহন, সংরক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হবে।
‘চলমান কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডামিক প্রিপার্ডনেস’ শীর্ষক প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা করা হয়েছে।
পুনরায় ট্রায়ালের প্রস্তাব চীনা প্রতিষ্ঠানের
টিকার পরীক্ষা, গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের জন্য সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যের কাছে একটি প্রস্তাব দেয় চীনের আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। এটি দেশটির চংকিং জিফেই বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি গত ২ সেপ্টেম্বর প্রথম ট্রায়ালের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। সম্প্রতি আবারও আবেদন করেছে। তাদের আবেদনের প্রায় চারমাস পর তাতে নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে বিএসএমএমইউ।
গত সোমবার চীনের ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিখিত এ প্রস্তাব দেয়া হয় বলে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য প্রফেসর ডা. কনককান্তি বড়–য়া সংবাদকে বলেছেন, তারা চীনের ওই প্রতিষ্ঠানের টিকা তৈরির ট্রায়ালে প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। তবে এখনও তা প্রিলিমিনারি পর্যায়ে আছে। আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে, তা পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বিএসএমএমইউ’র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংবাদকে জানিয়েছেন, চীনের ওই প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের কথা বলেছিল। কিন্তু ভ্যাকসিনের কাজ করার পদ্ধতি বা এর স্বচ্ছতা কতটুকু তা প্রকাশ না করায় তা বাতিল হয়ে গেছে। আবার তারা ট্রায়ালের প্রস্তাব দিয়েছেন; এতে কাগজপত্রসহ অন্যান্য সবকিছু ঠিক থাকলেও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন লাগবে।
বিএসএমএমইউ’র অপর একজন ঊর্ধ্বতন চিকিৎসক জানান, চীনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সব ধরনের তথ্যউপাত্ত দেয়ার পর তা ভার্সিটির রিভিউ (আইআরবি) বোর্ডে যাবে। সেখান থেকে রিচার্স কাউন্সিলে যাবে। রিচার্স কাউন্সিল যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদনের পর তা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
এর আগে চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশে তাদের টিকার পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ট্রায়ালের অর্থায়ন-জটিলতায় তাতে সেই উদ্যোগ থমকে যায়।