টিকে থাকার লড়াইয়ে রাসেল-জসিমরা

খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে ছোটদের শীতের পোশাক বিক্রি করেন রাসেল আহমেদ। বয়স ২৩ বছর। তিনি অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। করোনায় আয় কমায় জীবন চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আগে ৮ হাজার টাকার মধ্যে ৫ হাজার টাকা খরচ করতাম। বাকি ৩ হাজার টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠাতাম। করোনায় মালিক বেতন কমিয়েছে। এখন আর মায়ের কাছে টাকা পাঠাতে পারি না।’

গুলিস্তানের ফুটপাতের ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রি করেন জমিস উদ্দিন। করোনায় আয় কমায় পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়েছেন। নিজে থাকেন একটি মেসে। তিনিও পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন না। মানবেতর জীবনযাপন করছে তার পরিবার। তিনি বলেন, ‘টাকার অভাবে এপ্রিলে স্ত্রী-পোলাপানকে গ্রামে পাঠিয়েছি। এখনও আনতে পারিনি। কবে পারব তাও বলতে পারছি না। আমি এখন মেসে থাকি। মেস ভাড়া দিয়ে হাতে বাড়তি কোন টাকা থাকে না যে তাদের কাছে পাঠাব।’

এমন হাজারো রাসেল ও জসিম করোনায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে আগের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার কেউ কেউ শত কষ্টের মধ্যে টিকে আছে। তবে সামনে আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে তা জানা নেই। তাদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। তাও হাতে গোনা কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছাড়া পাননি।

লোকাল বাসে নারীদের প্রসাধনী বিক্রেতা আতাউর রহমান বলেন, ‘চার মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বের হই। রাত ১১টায় বাসায় ফিরি যেন বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা না হয়। ভাড়া দিতে না পেরে ফোনও রিসিভ করা বন্ধ করে দিয়েছি। এভাবে আর কত পালিয়ে বেড়াতে হবে, আমি জানি না। কয়েক মাস আগে তো ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফের ধীরে ধীরে শুরু করেছি।’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন সংবাদকে বলেন, ‘করোনা আবির্ভাবের পর থেকে আমরা কোনমতে টিকে আছি। অনেকে এই পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য না হওয়ার কারণে। আমরা যারা ব্যবসায় রয়েছি তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। অন্য ব্যবসায়ীরা যেভাবে সরকারের সুযোগ-সুবিধা পায় আমরা তা পাই না। যেমন সরকার যখন তৈরি পোশাক খাতকে কোন সুবিধা দেয় তখন তারা সরসরি ব্যাংক যোগাযোগ করেই পেয়ে যায়। কিন্তু আমরা তা পাই না। করোনার মধ্যে সরকার আমাদের ২ হাজার কোটি টাকার একটা প্রণোদনা দিয়েছে। এই প্রণোদনা থেকে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ৫০ হাজার টাকা ঋণ পাবেন। কিন্তু ঋণ নিতে গিয়ে তারা নানা ঝামেলায় পড়ছেন। ব্যাংকাররা বলছে, এটা নাই, ওটা নাই, এই কাগজ লাগবে, ওই কাগজ লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ঝামেলার কারণে অনেকে ঋণ না পেয়ে ফিরে আসছেন। এটা খুব বৈষম্য। আমরা ছোট ব্যবসায়ী বলে যদি সরকারি সুবিধা না পাই তাহলে তো সমস্যা। সবার সমান সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।’

করোনার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট হিসাব নাই তবে আমাদের ব্যবসা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪.৩ শতাংশ। গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, দারিদ্র্য দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেখা গেছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা। করোনার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।

বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন (বিইএ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ঘোষিত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির কারণে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছিলেন। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের চাকরিজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। করোনায় প্রায় ৫৫.৫ মিলিয়ন বাংলাদেশির আর্থসামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১৯ থেকে বেড়ে ৩০ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আগে থেকেই আরও সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচেই বসবাস করত। ফলে সে সময় (জুলাই) মোট দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ওপর ছিল।

করোনায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের কর্মীরাও ভালো নেই। সম্প্রতি টিআইবি’র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, করোনাকালে কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক স্থায়ীভাবে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছাঁটাইয়ের শিকার এসব কর্মীও মানবেতর জীবনযাপন করছে।

শনিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২১ , ২৫ পৌষ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

টিকে থাকার লড়াইয়ে রাসেল-জসিমরা

রেজাউল করিম

image

করোনায় ব্যবসা মন্দা। ফুটপাত ব্যবসায়ীরা হতাশ -সংবাদ

খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে ছোটদের শীতের পোশাক বিক্রি করেন রাসেল আহমেদ। বয়স ২৩ বছর। তিনি অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। করোনায় আয় কমায় জীবন চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আগে ৮ হাজার টাকার মধ্যে ৫ হাজার টাকা খরচ করতাম। বাকি ৩ হাজার টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠাতাম। করোনায় মালিক বেতন কমিয়েছে। এখন আর মায়ের কাছে টাকা পাঠাতে পারি না।’

গুলিস্তানের ফুটপাতের ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রি করেন জমিস উদ্দিন। করোনায় আয় কমায় পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়েছেন। নিজে থাকেন একটি মেসে। তিনিও পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন না। মানবেতর জীবনযাপন করছে তার পরিবার। তিনি বলেন, ‘টাকার অভাবে এপ্রিলে স্ত্রী-পোলাপানকে গ্রামে পাঠিয়েছি। এখনও আনতে পারিনি। কবে পারব তাও বলতে পারছি না। আমি এখন মেসে থাকি। মেস ভাড়া দিয়ে হাতে বাড়তি কোন টাকা থাকে না যে তাদের কাছে পাঠাব।’

এমন হাজারো রাসেল ও জসিম করোনায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে আগের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার কেউ কেউ শত কষ্টের মধ্যে টিকে আছে। তবে সামনে আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে তা জানা নেই। তাদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। তাও হাতে গোনা কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছাড়া পাননি।

লোকাল বাসে নারীদের প্রসাধনী বিক্রেতা আতাউর রহমান বলেন, ‘চার মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বের হই। রাত ১১টায় বাসায় ফিরি যেন বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা না হয়। ভাড়া দিতে না পেরে ফোনও রিসিভ করা বন্ধ করে দিয়েছি। এভাবে আর কত পালিয়ে বেড়াতে হবে, আমি জানি না। কয়েক মাস আগে তো ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফের ধীরে ধীরে শুরু করেছি।’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন সংবাদকে বলেন, ‘করোনা আবির্ভাবের পর থেকে আমরা কোনমতে টিকে আছি। অনেকে এই পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য না হওয়ার কারণে। আমরা যারা ব্যবসায় রয়েছি তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। অন্য ব্যবসায়ীরা যেভাবে সরকারের সুযোগ-সুবিধা পায় আমরা তা পাই না। যেমন সরকার যখন তৈরি পোশাক খাতকে কোন সুবিধা দেয় তখন তারা সরসরি ব্যাংক যোগাযোগ করেই পেয়ে যায়। কিন্তু আমরা তা পাই না। করোনার মধ্যে সরকার আমাদের ২ হাজার কোটি টাকার একটা প্রণোদনা দিয়েছে। এই প্রণোদনা থেকে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ৫০ হাজার টাকা ঋণ পাবেন। কিন্তু ঋণ নিতে গিয়ে তারা নানা ঝামেলায় পড়ছেন। ব্যাংকাররা বলছে, এটা নাই, ওটা নাই, এই কাগজ লাগবে, ওই কাগজ লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ঝামেলার কারণে অনেকে ঋণ না পেয়ে ফিরে আসছেন। এটা খুব বৈষম্য। আমরা ছোট ব্যবসায়ী বলে যদি সরকারি সুবিধা না পাই তাহলে তো সমস্যা। সবার সমান সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।’

করোনার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট হিসাব নাই তবে আমাদের ব্যবসা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪.৩ শতাংশ। গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, দারিদ্র্য দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেখা গেছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা। করোনার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।

বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন (বিইএ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ঘোষিত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির কারণে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছিলেন। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের চাকরিজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। করোনায় প্রায় ৫৫.৫ মিলিয়ন বাংলাদেশির আর্থসামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১৯ থেকে বেড়ে ৩০ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আগে থেকেই আরও সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচেই বসবাস করত। ফলে সে সময় (জুলাই) মোট দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ওপর ছিল।

করোনায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের কর্মীরাও ভালো নেই। সম্প্রতি টিআইবি’র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, করোনাকালে কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক স্থায়ীভাবে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছাঁটাইয়ের শিকার এসব কর্মীও মানবেতর জীবনযাপন করছে।