গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে

মো. আরাফাত রহমান

রাজধানী ঢাকাসহ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে এবং শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশের অনুষঙ্গ হিসেবে গড়ে ওঠা শহরে বসবাসরত নাগরিকদের চাহিদা ও অধিকতর আর্থিক সুবিধা বিবেচনায় প্রান্তিক জনপদের দরিদ্র পরিবারের প্রধানত: নারী গৃহকর্মী যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিশোরী বা শিশু গ্রাম থেকে এসে এ সব শহরের বাসা, মেস বা ডরমিটরিতে গৃহকর্মে নিয়োজিত হওয়ার প্রবণতা চলমান রয়েছে।

দারিদ্র্যপীড়িত বিশেষ বিশেষ এলাকা থেকে শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োজিত হওয়ার লক্ষ্যে শহরে আসার প্রবণতা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, সাধারণত নগরবাসী মানুষের গৃহের সার্বিক নিরাপত্তা এবং গৃহকর্তা ও গৃহের সদস্যদের প্রতি ইপ্সিত আনুগত্যের বিবেচনায় নারী গৃহকর্মীদের অধিকতর সুবিধাজনক বিবেচনা করার ফলে সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী হিসেবে নারী গৃহকর্মী বিশেষত কিশোরী বা শিশু গৃহকর্মী নিয়োগের প্রতি অগ্রাধিকার প্রদানের প্রবণতাও লক্ষণীয়।

আনুগত্য প্রাপ্তির এ মানসিকতার মাঝে বিকৃতিও লক্ষ্য করা যায় যা গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে। নির্যাতনের ফলে মৃত্যু বা হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতো কোন কোন ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সংবেদনশীল মানব সমাজকে চরমভাবে বেদনাবিদ্ধ করে। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় সরকার গৃহকর্মীদের জন্য পর্যায়ক্রমে আইনি কাঠামো তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মে নিযুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও কল্যাণার্থে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর্মক্ষম প্রতিটি নাগরিকের জন্য কর্মের অধিকার হচ্ছে তার অধিকার, কর্তব্য এবং মর্যাদার বিষয় এবং শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধের মূলনীতি হলো-‘শ্রমিকের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসম্পাদন এবং সম্পাদিত কাজ অনুযায়ী শ্রমের মূল্য পরিশোধ’। অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয়লাভে সমঅধিকারী। অনুচ্ছেদ ৩৪ এ সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে ধর্ম, গোত্র, গাত্রবর্ণ, জেন্ডার, ভাষা, রাজনৈতিক বা ভিন্নমত, জাতীয় অথবা সামাজিক উৎস, সম্পদ, জন্ম বা অন্যান্য স্ট্যাটাস-নিরক্ষেপভাবে সমান।

অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির পরিবার, গৃহ ও পত্র যোগাযোগ-এ সব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতামূলক হস্তক্ষেপ বা বিঘœ সৃষ্টি করা এবং তার সম্মান ও মর্যাদায় আঘাত করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪ ও ২৫-এ সব শ্রমিকের সমান কাজের জন্য সমান মজুরি নীতির ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত মজুরির বিনিময়ে স্বাধীনভাবে কর্ম নির্বাচন, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, সাময়িক ছুটিসহ বিশ্রাম ও বিনোদন, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাস, পরিবারসহ মানবিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। দেশের চলমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে পরিবার বা গৃহের আবশ্যকীয় কার্যাদি সম্পন্ন করে গৃহকর্তার অপেক্ষাকৃত উন্নততর পেশাগত দায়িত্ব নির্বিঘেœ সম্পাদনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে গৃহকর্মীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

এজন্যই সরকার গৃহকর্মে নিযুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় ও কল্যাণার্থে একটি নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত গৃহকর্ম সম্পর্কিত কনভেনশন-১৮৯ অনুসমর্থনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আলোচ্য প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মীদের সুরক্ষাও কল্যাণের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ নীতি গৃহকর্মে নিয়োজিত কর্মীদের কাজের শর্ত ও নিরাপত্তা, শোভন কর্মপরিবেশ, পরিবারসহ মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী মজুরি ও কল্যাণ, নিয়োগকারী ও গৃহকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং কোন অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তা নিরসন প্রভৃতি বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করে। একই সঙ্গে এ নীতি সংবিধানে ঘোষিত সমঅধিকার এবং সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মূলনীতি হিসেবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক।

[লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়]

arafat.bcpr@seu.edu.bd

রবিবার, ১০ জানুয়ারী ২০২১ , ২৬ পৌষ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে

মো. আরাফাত রহমান

রাজধানী ঢাকাসহ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে এবং শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশের অনুষঙ্গ হিসেবে গড়ে ওঠা শহরে বসবাসরত নাগরিকদের চাহিদা ও অধিকতর আর্থিক সুবিধা বিবেচনায় প্রান্তিক জনপদের দরিদ্র পরিবারের প্রধানত: নারী গৃহকর্মী যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিশোরী বা শিশু গ্রাম থেকে এসে এ সব শহরের বাসা, মেস বা ডরমিটরিতে গৃহকর্মে নিয়োজিত হওয়ার প্রবণতা চলমান রয়েছে।

দারিদ্র্যপীড়িত বিশেষ বিশেষ এলাকা থেকে শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োজিত হওয়ার লক্ষ্যে শহরে আসার প্রবণতা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, সাধারণত নগরবাসী মানুষের গৃহের সার্বিক নিরাপত্তা এবং গৃহকর্তা ও গৃহের সদস্যদের প্রতি ইপ্সিত আনুগত্যের বিবেচনায় নারী গৃহকর্মীদের অধিকতর সুবিধাজনক বিবেচনা করার ফলে সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী হিসেবে নারী গৃহকর্মী বিশেষত কিশোরী বা শিশু গৃহকর্মী নিয়োগের প্রতি অগ্রাধিকার প্রদানের প্রবণতাও লক্ষণীয়।

আনুগত্য প্রাপ্তির এ মানসিকতার মাঝে বিকৃতিও লক্ষ্য করা যায় যা গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে। নির্যাতনের ফলে মৃত্যু বা হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতো কোন কোন ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সংবেদনশীল মানব সমাজকে চরমভাবে বেদনাবিদ্ধ করে। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় সরকার গৃহকর্মীদের জন্য পর্যায়ক্রমে আইনি কাঠামো তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মে নিযুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও কল্যাণার্থে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর্মক্ষম প্রতিটি নাগরিকের জন্য কর্মের অধিকার হচ্ছে তার অধিকার, কর্তব্য এবং মর্যাদার বিষয় এবং শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধের মূলনীতি হলো-‘শ্রমিকের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসম্পাদন এবং সম্পাদিত কাজ অনুযায়ী শ্রমের মূল্য পরিশোধ’। অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয়লাভে সমঅধিকারী। অনুচ্ছেদ ৩৪ এ সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে ধর্ম, গোত্র, গাত্রবর্ণ, জেন্ডার, ভাষা, রাজনৈতিক বা ভিন্নমত, জাতীয় অথবা সামাজিক উৎস, সম্পদ, জন্ম বা অন্যান্য স্ট্যাটাস-নিরক্ষেপভাবে সমান।

অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির পরিবার, গৃহ ও পত্র যোগাযোগ-এ সব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতামূলক হস্তক্ষেপ বা বিঘœ সৃষ্টি করা এবং তার সম্মান ও মর্যাদায় আঘাত করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪ ও ২৫-এ সব শ্রমিকের সমান কাজের জন্য সমান মজুরি নীতির ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত মজুরির বিনিময়ে স্বাধীনভাবে কর্ম নির্বাচন, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, সাময়িক ছুটিসহ বিশ্রাম ও বিনোদন, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাস, পরিবারসহ মানবিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। দেশের চলমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে পরিবার বা গৃহের আবশ্যকীয় কার্যাদি সম্পন্ন করে গৃহকর্তার অপেক্ষাকৃত উন্নততর পেশাগত দায়িত্ব নির্বিঘেœ সম্পাদনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে গৃহকর্মীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

এজন্যই সরকার গৃহকর্মে নিযুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় ও কল্যাণার্থে একটি নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত গৃহকর্ম সম্পর্কিত কনভেনশন-১৮৯ অনুসমর্থনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আলোচ্য প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মীদের সুরক্ষাও কল্যাণের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ নীতি গৃহকর্মে নিয়োজিত কর্মীদের কাজের শর্ত ও নিরাপত্তা, শোভন কর্মপরিবেশ, পরিবারসহ মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী মজুরি ও কল্যাণ, নিয়োগকারী ও গৃহকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং কোন অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তা নিরসন প্রভৃতি বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করে। একই সঙ্গে এ নীতি সংবিধানে ঘোষিত সমঅধিকার এবং সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মূলনীতি হিসেবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক।

[লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়]

arafat.bcpr@seu.edu.bd