দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম রেলপথ প্রকল্প

প্রথম পরিকল্পনা ব্রিটিশ আমলে বাস্তবায়িত হচ্ছে এখন

কক্সবাজারে ঝিনুক রেলস্টেশনের ভিত্তিপ্রস্তর আজ

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রথম ১৮৯০ সালে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। যা মায়ানমারের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সোয়াশ’ বছর পর এখন তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্প নেয়া হয়। এ পর্যন্ত ৪৯ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সালের জুনে রেলপথটির প্রথম অংশ চালু হবে প্রকল্প সূত্র জানায়।

১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কক্সবাজারের রামু থেকে মায়ানমারের সীমান্তের কাছে ঘুনদুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় কক্সাবাজারে ঝিনুক আদলে একটি আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। আজ বেলা ১১টায় কক্সবাজার সরকারি কলেজের উল্টো পাশে এই স্টেশনটি নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এ পর্যন্ত প্রথম অংশের ৪৯ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এই অংশে শেষ করার কথা রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘প্রথম অংশের ৪৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনের কাজ আজ থেকে শুরু হবে। রেলমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর পরেই এই স্টেশন নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রথম অংশের কাজ শেষ হবে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে দ্বিতীয় অংশের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।’ এ বিষয়ে এডিবি’র মাধ্যমে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ট্রান্স এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেলওয়ে রুটের অংশ হিসেবে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনদুম ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছেন ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি সরকারের ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পটি নির্মাণে মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১০ সালে ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটি দুটি অংশে ভাগ করে নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত প্রথম অংশে যৌথভাবে কাজ করছেন চায়নার সিআরইসি ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এছাড়া চকরিয়া থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের যৌথভাবে কাজ করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়নার সিসিইসিসি ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্টাক্সার লিমিটেড।

প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুনদুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু মায়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে রামু থেকে ঘুনদুম সীমান্ত পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে না। তাই প্রকল্পের দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার পর্যন্ত ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।

প্রকল্পে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যালিং সিস্টেম, ৩৯টি মেজর (বড়) ও ১৪৫টি মাইনর (ছোট) রেল সেতু এবং ৯৬টি লেভেলক্রসিং ও ২টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া রামু ও আশপাশের এলাকায় হাতির অভয়ারণ্য। ওই এলাকায় বুনোহাতি প্রায়শই দল বেঁধে চলাচল করে। অনেক সময় হাঁতি শুঁড় তুলেও পথ চলে। এক্ষেত্রে রেলপথ যাতে হাতির চলাচলে কোন সমস্যা সৃষ্টি না করে সেজন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। এজন্য রেলপথে বিশেষ ধরনের সেন্সর বসাতে হবে। এতে কখনও হাতি রেলপথে থাকলে ট্রেনচালক ওই এলাকা অতিক্রমের আগেই তা বুঝতে পারে। হাতির বিষয়টি মাথায় রেখে জমির প্রয়োজন কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চলবে। এজন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং বিশদ ডিজাইন তৈরি শেষ পর্যায়ে। এ পথে মাত্র ১ ঘণ্টায় যাত্রীরা চলাচল করতে পারবেন। অত্যাধুনিক এ রেলপথের সঙ্গে ইউরোপের আদলে ৫টি রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ হবে। প্রকল্পটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, কারিগরি তথা সার্বিকভাবে লাভজনক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল চলাচল শুরু হলে দেশের পর্যটন শিল্পে ও অর্থনৈতিক খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্ত ও ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচল চালু হবে।

সোয়াশ’ বছর আগে রেলপথটি নির্মাণে পরিকল্পনা হয়

১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেয়া হয় এই রেলপথ নির্মাণে। চট্টগ্রাম ও মায়ানমারের আকিয়াব বন্দরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর্যন্ত প্রায় সোয়াশ’ বছর আগে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি মায়ানমার। ১৮৯০ সালে মায়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-০৯ সালে মায়ানমার রেলওয়ে সমীক্ষাও চালায়। এরপর ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। তখন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাকি রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমার তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রেলপথ আর হয়নি। এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার একবার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে এ পথে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উদ্যোগ নেয়া হয় প্রকল্পটি নির্মাণে। তৎকালীন সরকারের অনুরোধে ১৯৭৬-৭৭ সালে আবার সমীক্ষা করে জেআরটিএস। পরে ১৯৯২ সালে এসকাপ কমিশন অধিবেশনে তিনটি ইউরো-এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এর একটি রুট বাংলাদেশ হয়ে মায়ানমার যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর এই রুট নিয়ে আর তেমন আলোচনা করা হয়নি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে আবারও এ রেলপথটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় রেলওয়ে সূত্র জানায়।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২১ , ৩০ পৌষ ১৪২৭, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম রেলপথ প্রকল্প

প্রথম পরিকল্পনা ব্রিটিশ আমলে বাস্তবায়িত হচ্ছে এখন

কক্সবাজারে ঝিনুক রেলস্টেশনের ভিত্তিপ্রস্তর আজ

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রথম ১৮৯০ সালে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। যা মায়ানমারের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সোয়াশ’ বছর পর এখন তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনদুম রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্প নেয়া হয়। এ পর্যন্ত ৪৯ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সালের জুনে রেলপথটির প্রথম অংশ চালু হবে প্রকল্প সূত্র জানায়।

১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কক্সবাজারের রামু থেকে মায়ানমারের সীমান্তের কাছে ঘুনদুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় কক্সাবাজারে ঝিনুক আদলে একটি আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। আজ বেলা ১১টায় কক্সবাজার সরকারি কলেজের উল্টো পাশে এই স্টেশনটি নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এ পর্যন্ত প্রথম অংশের ৪৯ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এই অংশে শেষ করার কথা রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘প্রথম অংশের ৪৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনের কাজ আজ থেকে শুরু হবে। রেলমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর পরেই এই স্টেশন নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রথম অংশের কাজ শেষ হবে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে দ্বিতীয় অংশের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।’ এ বিষয়ে এডিবি’র মাধ্যমে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ট্রান্স এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেলওয়ে রুটের অংশ হিসেবে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনদুম ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছেন ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি সরকারের ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পটি নির্মাণে মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১০ সালে ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটি দুটি অংশে ভাগ করে নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত প্রথম অংশে যৌথভাবে কাজ করছেন চায়নার সিআরইসি ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এছাড়া চকরিয়া থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের যৌথভাবে কাজ করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়নার সিসিইসিসি ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্টাক্সার লিমিটেড।

প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুনদুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু মায়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে রামু থেকে ঘুনদুম সীমান্ত পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে না। তাই প্রকল্পের দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার পর্যন্ত ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।

প্রকল্পে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যালিং সিস্টেম, ৩৯টি মেজর (বড়) ও ১৪৫টি মাইনর (ছোট) রেল সেতু এবং ৯৬টি লেভেলক্রসিং ও ২টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া রামু ও আশপাশের এলাকায় হাতির অভয়ারণ্য। ওই এলাকায় বুনোহাতি প্রায়শই দল বেঁধে চলাচল করে। অনেক সময় হাঁতি শুঁড় তুলেও পথ চলে। এক্ষেত্রে রেলপথ যাতে হাতির চলাচলে কোন সমস্যা সৃষ্টি না করে সেজন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। এজন্য রেলপথে বিশেষ ধরনের সেন্সর বসাতে হবে। এতে কখনও হাতি রেলপথে থাকলে ট্রেনচালক ওই এলাকা অতিক্রমের আগেই তা বুঝতে পারে। হাতির বিষয়টি মাথায় রেখে জমির প্রয়োজন কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চলবে। এজন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং বিশদ ডিজাইন তৈরি শেষ পর্যায়ে। এ পথে মাত্র ১ ঘণ্টায় যাত্রীরা চলাচল করতে পারবেন। অত্যাধুনিক এ রেলপথের সঙ্গে ইউরোপের আদলে ৫টি রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ হবে। প্রকল্পটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, কারিগরি তথা সার্বিকভাবে লাভজনক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল চলাচল শুরু হলে দেশের পর্যটন শিল্পে ও অর্থনৈতিক খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্ত ও ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচল চালু হবে।

সোয়াশ’ বছর আগে রেলপথটি নির্মাণে পরিকল্পনা হয়

১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেয়া হয় এই রেলপথ নির্মাণে। চট্টগ্রাম ও মায়ানমারের আকিয়াব বন্দরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর্যন্ত প্রায় সোয়াশ’ বছর আগে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি মায়ানমার। ১৮৯০ সালে মায়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-০৯ সালে মায়ানমার রেলওয়ে সমীক্ষাও চালায়। এরপর ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। তখন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাকি রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমার তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রেলপথ আর হয়নি। এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার একবার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে এ পথে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উদ্যোগ নেয়া হয় প্রকল্পটি নির্মাণে। তৎকালীন সরকারের অনুরোধে ১৯৭৬-৭৭ সালে আবার সমীক্ষা করে জেআরটিএস। পরে ১৯৯২ সালে এসকাপ কমিশন অধিবেশনে তিনটি ইউরো-এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এর একটি রুট বাংলাদেশ হয়ে মায়ানমার যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর এই রুট নিয়ে আর তেমন আলোচনা করা হয়নি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে আবারও এ রেলপথটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় রেলওয়ে সূত্র জানায়।