চেতনায় শহীদ আসাদ

জোবায়ের আলী জুয়েল

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদের আজ ৫২তম শহীদ দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে আইয়ুব খানের পতনের দাবিতে মিছিল করার সময় তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামে। আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা হল (বর্তমান শহিদুল্লাহ হল) শাখার সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক।

ছাত্র জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ১৭ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং ২০ জানুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চানখারপুলের নিকটে তখনকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়। প্রায় ঘণ্টা খানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভালবারের গুলি ছুড়ে আসাদকে হত্যা করে।

তার মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র গণ-আন্দোলনের গোটা অবয়বকেই পাল্টে দেয় এবং তা তৎকালীন আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

তার মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। ২৪ তারিখে হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের এই দমননীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে নাই এবং শেষাবধি ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ঘটে।

আসাদ শুধু একজন ছাত্র সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ঐকান্তিক কৃষক সংগঠকও। অত্যন্ত সংগ্রামী মানসিকতার অধিকারী আসাদ “জনগণতন্ত্র”কে মনে করতেন মুক্তির মন্ত্র। আদর্শের প্রতি অটল বিশ্বাস, ধৈর্য, বিপদকে সহজভাবে গ্রহণ করার সাহস ছিল তার মধ্যে। শুধু ছাত্র ও সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। সার্বভৌম ও শ্রেণী শোষণ মুক্ত একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল তার।

২০ জানুয়ারি আসাদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। আসাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ ভিজেছিল। সারা দেশের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তারই ধারাবহিকতায় বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। লাখ লাখ শহীদের মাঝে সে কারণেই আসাদ অনন্য। তাই প্রয়োজন আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ, শপথ নিতে হবে শহীদ আসাদসহ সব শহীদের স্বপ্ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার। আসাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আসাদ গেটের সংস্কার ও শ্রী বৃদ্ধি তথা শহীদ আসাদের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ, জীবন সংগ্রামের তথ্য, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়ে উঠুক সর্বত্তই। আপামর জনসাধারণের এ দাবি সার্বজনীন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা]

jewelwriter53@gmail.com

আরও খবর

বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১ , ৬ মাঘ ১৪২৭, ৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

চেতনায় শহীদ আসাদ

জোবায়ের আলী জুয়েল

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদের আজ ৫২তম শহীদ দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে আইয়ুব খানের পতনের দাবিতে মিছিল করার সময় তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামে। আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা হল (বর্তমান শহিদুল্লাহ হল) শাখার সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক।

ছাত্র জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ১৭ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং ২০ জানুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চানখারপুলের নিকটে তখনকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়। প্রায় ঘণ্টা খানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভালবারের গুলি ছুড়ে আসাদকে হত্যা করে।

তার মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র গণ-আন্দোলনের গোটা অবয়বকেই পাল্টে দেয় এবং তা তৎকালীন আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

তার মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। ২৪ তারিখে হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের এই দমননীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে নাই এবং শেষাবধি ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ঘটে।

আসাদ শুধু একজন ছাত্র সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ঐকান্তিক কৃষক সংগঠকও। অত্যন্ত সংগ্রামী মানসিকতার অধিকারী আসাদ “জনগণতন্ত্র”কে মনে করতেন মুক্তির মন্ত্র। আদর্শের প্রতি অটল বিশ্বাস, ধৈর্য, বিপদকে সহজভাবে গ্রহণ করার সাহস ছিল তার মধ্যে। শুধু ছাত্র ও সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। সার্বভৌম ও শ্রেণী শোষণ মুক্ত একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল তার।

২০ জানুয়ারি আসাদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। আসাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ ভিজেছিল। সারা দেশের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তারই ধারাবহিকতায় বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। লাখ লাখ শহীদের মাঝে সে কারণেই আসাদ অনন্য। তাই প্রয়োজন আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ, শপথ নিতে হবে শহীদ আসাদসহ সব শহীদের স্বপ্ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার। আসাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আসাদ গেটের সংস্কার ও শ্রী বৃদ্ধি তথা শহীদ আসাদের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ, জীবন সংগ্রামের তথ্য, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়ে উঠুক সর্বত্তই। আপামর জনসাধারণের এ দাবি সার্বজনীন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা]

jewelwriter53@gmail.com