কুয়াশা অতল

রাহমান ওয়াহিদ

তরকারির ঝুড়ি থেকে বেগুনি রঙের দুটো বেগুন হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নেড়েচেড়ে দেখছিল মিনহাজ। সপ্তাহখানেক আগে কেনা কেজিখানেক বেগুন। টাটকা তরতাজা বেগুনগুলোতে এখন আর তাজা ভাবটা নেই। হালকা হলদে আভা পড়তে শুরু করেছে। ফ্রিজে রাখা হয় নি। রাখলে হয়তো এমনটা হতো না। কেন রাখে নি-সে প্রশ্ন করাই যায় মেনকা খানমকে। কিন্তু ইচ্ছে করে না। পোড়া বেগুনের সাথে টমেটো আর আদার কুচি মেশানো ভর্তার দারুণ এক ফ্লেভার নাকে আসে মিনহাজের। সত্যি সত্যি না। হাওয়াই ফ্লেভার। শীত এলেই এমনটা হয়। এই ঘ্রাণটা মা’র হাত থেকে আসা। বিয়ের পরে মেনেকাও ভর্তাটা বানানো শিখেছিল মা’র কাছ থেকে। শীতে জবুথবু হয়ে অফিস থেকে ফেরার পর মেনেকা যখন সারপ্রাইজ দেবার মতো করে প্লেটে বেগুনের ভর্তাটা তুলে দিত, তখন দারুণ এক মুগ্ধতায় ওর একটা হাত টেনে নিয়ে আলতো করে চুমু দিত মিনহাজ। ভীষণ এনজয় করতো সে আনন্দটা। এ চুমুর একটা নামও দিয়েছিল মেনেকা। ব্রিনজাল কিস। আহা, কি দারুণ নাম! এ নিয়ে কত হাসাহাসিই না হতো সে সময়। পাল্টা চুমু দিতে দিতে মেনেকা বলতো,

‘কী, কেমন লাগলো? তোমার ওই ব্রিনজাল ম্যাশ্ড-এর চেয়ে ভালো না?’

‘হুঁ, ভালো না মানে? দারুণ!’ বলেই আরেকটি চুমু দেয়ার চেষ্টা করতো মিনহাজ। পারতো না। তার আগেই হাসতে হাসতে রান্নাঘরে ঢুকে যেত মেনেকা। তারপর ঠিক কত মাস বা বছর আগে শেষ ব্রিনজাল কিসটা পড়েছিল গালে, তা এখন আর তেমন মনে পড়ে না মিনহাজের। তবে ভর্তাটা বন্ধ হয়নি কখনও। বেগুনের থলিটা রান্নাঘরে রাখলে সেদিনই না হোক, পরের যে কোনো দিন বা রাতের খাবারের সাথে প্রিয় ভর্তাটা প্লেটে আসতো। এখনও আসে। তাতে যতেœরও কোনো ঘাটতি এখন অব্দি দেখেনি মিনহাজ। শুধু ভর্তাটা পাতে দিয়ে আদরের অপেক্ষাটা এখন আর নেই মেনেকার।

দিলকুশার সরকারি অফিস থেকে হাতিরঝিলের দোতলায় সাড়ে আটশো স্কয়ার ফিটের ভাড়া বাসায় ফিরতে আজ একটু রাতই হয়েছে মিনহাজের। ন’টার কাছাকাছি। রেভিনিউ অফিসারের চাকরি মানে ঘানির বলদের মতো নিজেকে চাকরি দেবীর পায়ে বিনা বাক্যে সমর্পিত করা। রাত নেই। দিন নেই। অসুখ বিসুখ বউবাচ্চা- কিচ্ছু নেই। মানতে পারলে মানো, না পারলে সোজা ঢাকার বাইরে। আর ঢাকার বাইরে মানে নয় বছরের ছোট্ট অর্ঘ্যর ভালো স্কুলে পড়ার স্বপ্নটা ভ্যানিশ। সেটা ঠেকাতেই রোজ রোজ এ রকম গলদঘর্ম হওয়া। এটাও হাসিমুখে মেনে নেয়া যেত, যদি মেনেকাটা একটু স্বস্তির আশ্রয় হতে পারতো। অথচ বছর তিনেক আগেও মেনেকা খাবারের প্লেট সামনে রেখে অনেক রাত পর্যন্ত মিনহাজের অপেক্ষায় বসে থাকতো। সেই টিপিক্যাল বাঙালি বধূদের মতো। সাজানো খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আবারও গরম করে এনে টেবিল সাজাতো। মিনহাজ কতবার যে বলেছে- এভাবে খাবার সামনে রেখে বসে না থাকতে, কিন্তু মেনেকা মাথা নেড়ে বলতো,

‘থাক না এই ছোট্ট অভ্যেসটা। তাতে অন্তত মনে হবে কেউ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’

কথাটা মন্দ না। একসময় এই অপেক্ষাটা মিনহাজের ভালো লাগতেই শুরু করেছিল। কিন্তু আজ? বেডরুমে ছেলেটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেনেকা ড্রইং রুমের বড় সোফাটায় চাদর মুড়ি দিয়ে কাত হয়ে শোয়া। আজকাল এভাবে রোজই শোয়। কেন বেডরুমে নয়, সে প্রশ্নটা আর করা হয় নি মেনেকাকে। ছেলের উপর কোনো কারণে রাগ করে, বা একই বেড-এর একঘেঁয়েমি দূর করার জন্যও হতে পারে। তবে আটটাতেই এভাবে শুয়ে সান্ধ্য ঘুমের অভ্যেসটা ওর অনেক দিনের। গেটে তালা দেয়া থাকে। যখন ইচ্ছে খুলে বাসায় ঢোকার ব্যবস্থা আছে। টেবিলে খাবার সাজানো থাকে। ওয়াশ রুমে ধোয়া তোয়ালে সাবানও রেডি করা থাকে। শুধু মিনহাজের জন্য ব্যাকুল ফোনকলটা থাকে না।

বেগুনগুলোকে পলিথিনবন্দি করে ফ্রিজে রাখে মিনহাজ। আজো টেবিলে খাবার সাজানো। শুধু ওভেনে একটু গরম করে নেয়া। খিদেও চিন চিন করছে পেটে। কিন্তু কী যে হয়- খেতে ইচ্ছে করে না মিনহাজের। ছোটখাটো কোনো অভিমান? কোনো অপ্রাপ্তির কষ্ট? না, এসব কিছু না। এগুলো অনেক আগেই ঘুচে গেছে। তাহলে কি ওই বেগুনগুলোর অবহেলায় পড়ে থাকার দুঃখবোধ? না সেটিও না। সংসারের কোনো কিছু নিয়েই কোনো অবহেলা নেই মেনেকার। এলার্জির জন্য ডাক্তারের বারণও একটা কারণ হতে পারে। সেটি মেনেকা বলতে পারতো তাকে। বলেনি কেন, সেটাও বড় কোনো কারণ নয়। অনেক দরকারি কথাও মেনেকা খুব প্রয়োজন না হলে আজকাল বলে না। একটা বিষণœতা কাজ করে কি ওর মনের ভেতর? দেখে তো তেমনটা মনে হয় না মিনহাজের। গ্রাজুয়েট বুদ্ধিমতী মেয়ে মেনেকাকে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে

হলেও একটা ছোট্ট কাঁটা যে খচ্খচ্ করছে ওর মনের গহীনে কোথাও- সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না গেজেটেড অফিসার মিনহাজের। এগারো বছরের সংসার জীবনের আটটি বছরই কেটেছে আনন্দ-বেদনার কাব্যধারায়। একটু অবসর জুটলেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়া, বাইরে খেয়ে বাসায় ফেরা, টুকটাক কেনাকাটা, ছোট্ট অর্ঘ্যর এটাসেটা আবদার মেটানো, পার্কে ঘোরাঘুরি- এসব তো ছিলোই, ছোটখাটো মান-অভিমানও হয়েছে এসবের মধ্যে। আবার তা মিটেও গেছে অল্প সময়েই। পছন্দ-অপছন্দের অনেকটাই অমিল থাকলেও মোটামুটি এক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সংসারটি ওদের চলছিল বেশ। কিন্তু বছর তিনেক আগে হঠাৎ এক বাদুড়ঝাঁপটায় সংসার-সেতারের কোন্ তারটি যে ছিঁড়ে গেল- সেটি তাদের অজানা না থাকলেও তা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি কখনও তেমন। বরং ছন্দপতনের এই ব্যাপারটি কেউ কাউকে বুঝতে না দেবার চেষ্টাই তারা করে চলেছে নিরন্তর। বেডে শরীরী সাড়া দেবার ব্যাপারটিতেও নড়চড় তেমন কিছু হয় নি। শুধু মিনহাজের বুকে মাথা রেখে ঘুমোনোর যে অভ্যেসটি ছিল মেনেকার- সেটার ডিউরেশনটা কমেছে। কোনো কোনো দিন মুখটা রাখেও না। কারণও বলেছে মেনেকা।

‘কিছু মনে করো না, জানোই তো শীতে পুরোনো শ্বাসকষ্টটা একটু বেড়ে যায়। বেশিক্ষণ তাই ওইভাবে মুখ রাখতে পারি না।’

শুধু কথার শেষে ‘সোনা’ শব্দটি আগে যুক্ত হতো, সেদিন আর তা হয় নি। সেক্স করতেও কখনও আপত্তি না করলেও মিনহাজ ঠিকই বুঝতো- মেনেকার শরীরটা তেমন সাড়া দিচ্ছে না। বলতো,

‘থাক না আজ মিনু। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মীট করার দরকার কী? দিন তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না।’

কিন্তু নাছোড় মেনেকা হার মানতে চায় নি। কন্টিনিউ করতেই বলেছে সব সময়। বললে কী হবে? ওর সুখানুভূতির যে নিজস্ব আনন্দধ্বনিটা মিনহাজকে চাঙা রাখতো, সেটা আর আসে না মেনেকার মুখ থেকে। দাঁতে দাঁত চেপে রেখে যে স্বামীকে হ্যাপি রাখতে চাইছে সে, বুঝতে কষ্ট হয় না মিনহাজের। শরীর মনের কোনো কষ্টকে গোপন কওে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা কি? হয়তোবা সেটাই। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলবার সুযোগও দেয় না সে।

চা খাওয়ার অভ্যেস নেই তেমন। রাতে তো নয়ই। কোনো অভ্যেসই নেই মিনহাজের। এখন এই হালকা শীতের রাতে এক কাপ চা খেলে কি ভালো লাগবে? ভালো না লাগুক, মনের ভেতরে জমে থাকা জ্যাম খানিকটা কাটলেও কাটতে পারে। রান্নার ব্যস্ততায় কিছুটা শেয়ার করতে চা বানানোটা শিখেছে মিনহাজ মেনেকার কাছ থেকেই। পানি চড়িয়ে দেয় সে গ্যাসচুলায়। এক কাপের জায়গায় দু’কাপ চায়ের পানি পড়লো। দু’কাপ কেন? মেনেকা রাতে চা খায়। সেজন্যেই কি? কিন্তু ওতো এখন ঘুমিয়ে। তাহলে কি অনেক আগের অভ্যেস থেকেই? হতেও পারে। অফিস থেকে কখনও বিকেলে ফিরতে পারলে অভ্যেসমতো দু’কাপ চা বানাতো মিনহাজ। বারান্দায় বসে দুজনে চা খেতে খেতে গল্প হতো। সপ্তাহখানেক আগেও বিকেলে এমন গল্প হয়েছে। কিন্তু জমে নি সেটা। আজকাল এ রকমই হয়। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর মেনেকাই মুখ খুলেছিল প্রথম।

‘মনটা খারাপ দেখছি তোমার। কারণটা জানা যাবে?

মেনেকার মুখের দিকে একবার ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে পরক্ষণেই ঘরে ফেরা পাখিগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়েছিল মিনহাজ।

‘নাহিদা হঠাৎ করে তোমাকে ব্লক মেরেছে, সেজন্যেই কি?

চমকে ওঠার মতো করে তাকায় মিনহাজ মেনেকার দিকে। কথাটা মিথ্যে নয়। আর মেনেকার তা জানাও অসম্ভব কিছু নয়। কারণ, দুজনের ফেসবুক আইডিই দুজনের কাছে ওপেন্ড। কেউ কারো আইডি গোপন করবে না, কারো পোস্ট নিয়ে লাইক মন্তব্য চলবে না- এমন শর্তেই ফেসবুক চালু রেখেছে দু’জনই। মিনহাজ কিছু বলছে না দেখে মেনেকাই আবার বলে,

‘কারণটা যদি এটাই হয়, তাহলেও বলবো মন খারাপের কিছু নেই। মেয়েটা দু’দু’টো বছর একজনের সংসার করে সুখী হতে পারলো না। ডিভোর্স দিয়ে মনের মতো মানুষ খুঁজেছে। এতদিন পর যাকে পেয়েছে তাকে আবার তোমার পছন্দ না। কেন? তোমার তো বরং উচিৎ ছিল ওকে সাপোর্ট করা। তা না করে...’

‘তাই বলে অমন সুন্দর একটা মেয়ে কঙ্কাল মার্কা এক বাঁদরের গলায় মালা দেবে? তা-ও তেতাল্লিশ বছর বয়সের এক অর্ধ বুড়োকে? এটা তুমি মানতে বল?’

‘অবশ্যই বলবো। মেয়েটার বয়সও তো কম না। বত্রিশ। সমস্যা কী? ছেলেটার প্রথম বিয়ে আর মেয়ের দ্বিতীয়। তাতে কী? দুই ফ্যামিলিই রাজি। তো তোমার আপত্তিটা কেন? তুমি কি চাইছো মেয়েটি আইবুড়ো হয়ে থেকে তোমাকে সারাজীবন ফেসবুকে সঙ্গ দিক?’

‘না, তা চাইবো কেন? ওই ব্যাটার না আছে চেহারা, না আছে শরীর, না আছে টাকাপয়সা। কী দেখে পছন্দ করলো ওকে? আমার নিজের কেউ হলে কি সাপোর্ট করতে করতাম?’

‘চেহারা স্বাস্থ্য ধনী- সবই তো পেয়েছিলো। টিকলো কই। এখন ও ছেলেটার সুন্দর মনটাকে বিয়ে করতে চাইছে। আমি তো বলবো ঠিকই করছে। কিন্তু তোমার আপত্তির কারণ তো এটা না মিনহাজ। আমি তো চিনি তোমাকে হাড়ে হাড়ে।’

শেষ কথাটায় একটু ধাক্কা খায় মিনহাজ। মেনেকা কী মীন করছে সেটা না বোঝার কথা নয় তার। কিন্তু কিছু বলতে গেলে অযথা কথা বাড়তো। তিক্ততা বাড়তো। দু’তিন দিন কথা বন্ধ থাকতো। কী দরকার? মিনহাজ চায় নি সেটা। চুপ থেকেছে। মেনেকাও আর অপেক্ষা করে নি। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়েছিল সে। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মিনহাজের তিন বছর আগের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। ভার্সিটি লাইফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঈশিতা যদি দিনাজপুর থেকে টিচার্স ট্রেনিং-এ এসে সেদিন ওদের বাসায় না উঠতো, তাহলে আজকের এমন গুমোট অবস্থাটা তৈরি হতো না। টেনেটুনে কোনোভাবে কেটেই যেত বাকি জীবনটা। তখনও অনূঢ়া ঈশিতা ঢাকায় থাকার মতো নিরাপদ জায়গা না পেয়ে বন্ধুত্বের দাবিতে মিনহাজের বাসায় কয়েকদিন থাকার কথাটা বললে মিনহাজ আপত্তি করে নি। মেনেকাও সানন্দে রাজি হয়েছিল। দারুণ মিশুক মেয়ে ঈশিতা কয়েক দিনেই আপন করে নিয়েছিল মেনেকাকে। ওদের আট বছরের ভালোবাসাবাসির সম্পর্কে যাতে কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সে ব্যাপারে উভয় দিক থেকেই সতর্কতা ছিল যথেষ্ট। তারপরও শেষ রক্ষাটা হলো কি? হলো না। পুরো বদলে গেল মেনেকা। কথা কমে গেল। হাসি যেটুকু ছিল, তা-ও উড়ে গেল। কী করেছিল মিনহাজ? তেমন কিছু কি? ঈশিতা যখন রান্নায় ব্যস্ত তখন ওরা আলো আঁধারির বারান্দায় স্মৃতিচারণায় ব্যস্ত থেকেছে। ছয় ছয়টি বছরের ভার্সিটি লাইফের আনন্দঘন স্মৃতি। কম কিছু তো নয়। হাজারো কথার ফুলঝুরিতে, হাসি গল্পে মেতে উঠে সেইসব দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া। যেতেই পারে। এর বেশি তো কিছু না। ভে-রি নরম্যাল।

‘না, তুমি এতটা ডুবে না গেলেও পারতে। অন্তত মনে করা উচিত ছিল- কিচেনে তোমার পার্টনারটা গলদঘর্ম হচ্ছে। একটু ঢুঁ মেরে দেখেও গেলে না। আর ঈশিতারও বোঝা উচিৎ ছিল- তার বন্ধুটি এখন আর একা নেই।’

চাপা অভিমান লুকিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল মেনেকা। কিন্তু ট্রেনিং থেকে ফেরা ক্লান্ত ঈশিতাকে একটু সময় দেয়া কি বেশি কিছু? অনেকদিনের বন্ধুত্ব। স্মৃতিগুলো উথলে উঠে একটু বেহিসেবী হতেই পারে। কিন্তু কোনো যুক্তি মানেনি মেনেকা। উল্টো বলেছিল,

‘আমাকে বুঝিয়ো না মিনহাজ। আগেও দেখেছি- সুন্দরী দেখলে সব ভুলে যাও তুমি। মনেই রাখো না তোমার বউ বলে কেউ আছে। ইনফ্যাক্ট, তোমার আসলে বিয়ে করাটাই ঠিক হয় নি।’

খুব শক্ত শক্ত কথা। লেগেছিল খুব মিনহাজের। মনের কোনো না কোনো কিছুর অভাববোধ বিয়ের আগে পরে যে কারোরই থাকতেই পারে কিন্তু সেগুলো মিন করে একেবারে মুখের উপর সোজাসাপ্টা বলে দেয়াটা কি শোভন? সুন্দর রুচিমনের মেনেকার অন্তত এটা মানায় না। কথাগুলো অন্যভাবেও বলতে পারতো সে। বিরক্তিতে তাই জবাব দিতেও ইচ্ছে করেনি মিনহাজের। সেদিন থেকেই উত্তুরে হিমেল হাওয়া শ্বাস ফেলতে শুরু করে তাদের সম্পর্কের সূক্ষ্ম তারগুলোতে।

দু’কাপ র’চা রেডি। কাপ দু’টি দুই হাতে নিয়ে ড্রইংরুমে ঢোকে মিনহাজ। পায়ের শব্দ টের পেয়ে মেনেকা শোয়া থেকে উঠে বসে। দম নিয়ে নিয়ে ওকে থামানোর চেষ্টায় শশব্যস্ত হয়ে বলতে থাকে-

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, কাছে এসো না। শ্বাসকষ্টের সাথে জ্বরও এসে গেছে। সম্ভবত পজিটিভ। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে বেডরুমে থাকো। আমি আইসোলেশনে থাকতে চাই। আর এগিয়ো না, প্লিজ।’

কাপদু’টো টেবিলে রেখে জোর করে মেনেকার কাছে গিয়ে বসে মিনহাজ। গলা খানিকটা উঁচিয়ে বলে,

‘কিসের আইসোলেশন? ওটা তো অনেক আগেই তৈরি হয়ে গেছে। নতুন করে আবার কিসের আইসোলেশন? মানি না আমি ওইসব।’

‘তুমি না মানলে না মানো। কিন্তু ছেলেটাকে তো বাঁচাতে হবে। প্লিজ মিনহাজ, কথা শোন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ওর কাছে যাও তুমি। না গেলে ও এসে পড়বে । সর্বনাশ হয়ে যাবে ওর। প্লিজ যাও। যাও তুমি।’

মিনহাজ তবুও সামনে এগিয়ে যায়। মেনেকার প্রতিরোধের হাত সরিয়ে দিয়ে চোয়াল দুটো শক্ত করে ওর মাথার কাছে বসে। বলে,

‘কেন যাবো। তোমাকে অসুস্থ রেখে কেন সরে যাবো আমি? এ্যাম আই কাওয়ার্ড? কিসের সন্তান? কিসের কোভিড নাইন্টিন ফাইন্টিন? কিচ্ছু মানি না আমি। হলে হোক সবারই পজিটিভ। বাঁচলে একসাথে বাঁচবো। মরলেও একসাথে।’

‘কিন্তু তা বোধহয় আর হবে না মিনহাজ। মনটা তো কবেই গেছে। এখন শরীরটাও... খুব কষ্ট হচ্ছে দম নিতে মিনহাজ। অর্ঘ্যকে...’

হাঁফাতে হাঁফাতে কথা শেষ করতে পারে না মেনেকা। নিঃশব্দে ঢলে পড়ে সোফায়। পাশের ঘর থেকে চোখ ডলতে ডলতে আসে অর্ঘ্য। মাকে জড়িয়ে ধরে ডাকতে থাকে। একটা এ্যাম্বুলেন্স ডাকা দরকার এখুনি। কিন্তু হাত পা মন কিছুই কাজ করছে না মিনহাজের। সবকিছুই অবশ হয়ে আসছে। মেনেকার দিকে তাকায়। বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে ওর। মায়ের সাড়া না পেয়ে কান্না শুরু করেছে অর্ঘ্য।

‘বাবা, আম্মু কথা বলছে না কেন? কী হয়েছে আম্মুর?’

‘তেমন কিচ্ছু না বাবা। একটু জ্বর। এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। তুমি আমার ফোনটা নিয়ে এস তো বেডরুম থেকে।’

কিন্তু অতটা সময় দেবে কি মেনেকা? অসুখটা সিরিয়াস জেনেও কিচ্ছু বলে নি সে! কিন্তু কেন? মনটা নেই কেন? তেমন কিছুই তো হয় নি। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। সংসারে এর চেয়েও অনেক বড় বড় ভুলও তো হয়। ঠিকও হয়ে যায় একসময়। কিন্তু মেনেকা কী করলো এটা? চুপচাপ থেকে থেকে এত বড় শাস্তিটা কেন দিল সে মিনহাজকে? কেন? কেন? অস্ফুট স্বরে বের হয়ে আসা প্রশ্নগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। থামে না কিছুতেই...

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কুয়াশা অতল

রাহমান ওয়াহিদ

image

তরকারির ঝুড়ি থেকে বেগুনি রঙের দুটো বেগুন হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নেড়েচেড়ে দেখছিল মিনহাজ। সপ্তাহখানেক আগে কেনা কেজিখানেক বেগুন। টাটকা তরতাজা বেগুনগুলোতে এখন আর তাজা ভাবটা নেই। হালকা হলদে আভা পড়তে শুরু করেছে। ফ্রিজে রাখা হয় নি। রাখলে হয়তো এমনটা হতো না। কেন রাখে নি-সে প্রশ্ন করাই যায় মেনকা খানমকে। কিন্তু ইচ্ছে করে না। পোড়া বেগুনের সাথে টমেটো আর আদার কুচি মেশানো ভর্তার দারুণ এক ফ্লেভার নাকে আসে মিনহাজের। সত্যি সত্যি না। হাওয়াই ফ্লেভার। শীত এলেই এমনটা হয়। এই ঘ্রাণটা মা’র হাত থেকে আসা। বিয়ের পরে মেনেকাও ভর্তাটা বানানো শিখেছিল মা’র কাছ থেকে। শীতে জবুথবু হয়ে অফিস থেকে ফেরার পর মেনেকা যখন সারপ্রাইজ দেবার মতো করে প্লেটে বেগুনের ভর্তাটা তুলে দিত, তখন দারুণ এক মুগ্ধতায় ওর একটা হাত টেনে নিয়ে আলতো করে চুমু দিত মিনহাজ। ভীষণ এনজয় করতো সে আনন্দটা। এ চুমুর একটা নামও দিয়েছিল মেনেকা। ব্রিনজাল কিস। আহা, কি দারুণ নাম! এ নিয়ে কত হাসাহাসিই না হতো সে সময়। পাল্টা চুমু দিতে দিতে মেনেকা বলতো,

‘কী, কেমন লাগলো? তোমার ওই ব্রিনজাল ম্যাশ্ড-এর চেয়ে ভালো না?’

‘হুঁ, ভালো না মানে? দারুণ!’ বলেই আরেকটি চুমু দেয়ার চেষ্টা করতো মিনহাজ। পারতো না। তার আগেই হাসতে হাসতে রান্নাঘরে ঢুকে যেত মেনেকা। তারপর ঠিক কত মাস বা বছর আগে শেষ ব্রিনজাল কিসটা পড়েছিল গালে, তা এখন আর তেমন মনে পড়ে না মিনহাজের। তবে ভর্তাটা বন্ধ হয়নি কখনও। বেগুনের থলিটা রান্নাঘরে রাখলে সেদিনই না হোক, পরের যে কোনো দিন বা রাতের খাবারের সাথে প্রিয় ভর্তাটা প্লেটে আসতো। এখনও আসে। তাতে যতেœরও কোনো ঘাটতি এখন অব্দি দেখেনি মিনহাজ। শুধু ভর্তাটা পাতে দিয়ে আদরের অপেক্ষাটা এখন আর নেই মেনেকার।

দিলকুশার সরকারি অফিস থেকে হাতিরঝিলের দোতলায় সাড়ে আটশো স্কয়ার ফিটের ভাড়া বাসায় ফিরতে আজ একটু রাতই হয়েছে মিনহাজের। ন’টার কাছাকাছি। রেভিনিউ অফিসারের চাকরি মানে ঘানির বলদের মতো নিজেকে চাকরি দেবীর পায়ে বিনা বাক্যে সমর্পিত করা। রাত নেই। দিন নেই। অসুখ বিসুখ বউবাচ্চা- কিচ্ছু নেই। মানতে পারলে মানো, না পারলে সোজা ঢাকার বাইরে। আর ঢাকার বাইরে মানে নয় বছরের ছোট্ট অর্ঘ্যর ভালো স্কুলে পড়ার স্বপ্নটা ভ্যানিশ। সেটা ঠেকাতেই রোজ রোজ এ রকম গলদঘর্ম হওয়া। এটাও হাসিমুখে মেনে নেয়া যেত, যদি মেনেকাটা একটু স্বস্তির আশ্রয় হতে পারতো। অথচ বছর তিনেক আগেও মেনেকা খাবারের প্লেট সামনে রেখে অনেক রাত পর্যন্ত মিনহাজের অপেক্ষায় বসে থাকতো। সেই টিপিক্যাল বাঙালি বধূদের মতো। সাজানো খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আবারও গরম করে এনে টেবিল সাজাতো। মিনহাজ কতবার যে বলেছে- এভাবে খাবার সামনে রেখে বসে না থাকতে, কিন্তু মেনেকা মাথা নেড়ে বলতো,

‘থাক না এই ছোট্ট অভ্যেসটা। তাতে অন্তত মনে হবে কেউ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’

কথাটা মন্দ না। একসময় এই অপেক্ষাটা মিনহাজের ভালো লাগতেই শুরু করেছিল। কিন্তু আজ? বেডরুমে ছেলেটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেনেকা ড্রইং রুমের বড় সোফাটায় চাদর মুড়ি দিয়ে কাত হয়ে শোয়া। আজকাল এভাবে রোজই শোয়। কেন বেডরুমে নয়, সে প্রশ্নটা আর করা হয় নি মেনেকাকে। ছেলের উপর কোনো কারণে রাগ করে, বা একই বেড-এর একঘেঁয়েমি দূর করার জন্যও হতে পারে। তবে আটটাতেই এভাবে শুয়ে সান্ধ্য ঘুমের অভ্যেসটা ওর অনেক দিনের। গেটে তালা দেয়া থাকে। যখন ইচ্ছে খুলে বাসায় ঢোকার ব্যবস্থা আছে। টেবিলে খাবার সাজানো থাকে। ওয়াশ রুমে ধোয়া তোয়ালে সাবানও রেডি করা থাকে। শুধু মিনহাজের জন্য ব্যাকুল ফোনকলটা থাকে না।

বেগুনগুলোকে পলিথিনবন্দি করে ফ্রিজে রাখে মিনহাজ। আজো টেবিলে খাবার সাজানো। শুধু ওভেনে একটু গরম করে নেয়া। খিদেও চিন চিন করছে পেটে। কিন্তু কী যে হয়- খেতে ইচ্ছে করে না মিনহাজের। ছোটখাটো কোনো অভিমান? কোনো অপ্রাপ্তির কষ্ট? না, এসব কিছু না। এগুলো অনেক আগেই ঘুচে গেছে। তাহলে কি ওই বেগুনগুলোর অবহেলায় পড়ে থাকার দুঃখবোধ? না সেটিও না। সংসারের কোনো কিছু নিয়েই কোনো অবহেলা নেই মেনেকার। এলার্জির জন্য ডাক্তারের বারণও একটা কারণ হতে পারে। সেটি মেনেকা বলতে পারতো তাকে। বলেনি কেন, সেটাও বড় কোনো কারণ নয়। অনেক দরকারি কথাও মেনেকা খুব প্রয়োজন না হলে আজকাল বলে না। একটা বিষণœতা কাজ করে কি ওর মনের ভেতর? দেখে তো তেমনটা মনে হয় না মিনহাজের। গ্রাজুয়েট বুদ্ধিমতী মেয়ে মেনেকাকে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে

হলেও একটা ছোট্ট কাঁটা যে খচ্খচ্ করছে ওর মনের গহীনে কোথাও- সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না গেজেটেড অফিসার মিনহাজের। এগারো বছরের সংসার জীবনের আটটি বছরই কেটেছে আনন্দ-বেদনার কাব্যধারায়। একটু অবসর জুটলেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়া, বাইরে খেয়ে বাসায় ফেরা, টুকটাক কেনাকাটা, ছোট্ট অর্ঘ্যর এটাসেটা আবদার মেটানো, পার্কে ঘোরাঘুরি- এসব তো ছিলোই, ছোটখাটো মান-অভিমানও হয়েছে এসবের মধ্যে। আবার তা মিটেও গেছে অল্প সময়েই। পছন্দ-অপছন্দের অনেকটাই অমিল থাকলেও মোটামুটি এক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সংসারটি ওদের চলছিল বেশ। কিন্তু বছর তিনেক আগে হঠাৎ এক বাদুড়ঝাঁপটায় সংসার-সেতারের কোন্ তারটি যে ছিঁড়ে গেল- সেটি তাদের অজানা না থাকলেও তা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি কখনও তেমন। বরং ছন্দপতনের এই ব্যাপারটি কেউ কাউকে বুঝতে না দেবার চেষ্টাই তারা করে চলেছে নিরন্তর। বেডে শরীরী সাড়া দেবার ব্যাপারটিতেও নড়চড় তেমন কিছু হয় নি। শুধু মিনহাজের বুকে মাথা রেখে ঘুমোনোর যে অভ্যেসটি ছিল মেনেকার- সেটার ডিউরেশনটা কমেছে। কোনো কোনো দিন মুখটা রাখেও না। কারণও বলেছে মেনেকা।

‘কিছু মনে করো না, জানোই তো শীতে পুরোনো শ্বাসকষ্টটা একটু বেড়ে যায়। বেশিক্ষণ তাই ওইভাবে মুখ রাখতে পারি না।’

শুধু কথার শেষে ‘সোনা’ শব্দটি আগে যুক্ত হতো, সেদিন আর তা হয় নি। সেক্স করতেও কখনও আপত্তি না করলেও মিনহাজ ঠিকই বুঝতো- মেনেকার শরীরটা তেমন সাড়া দিচ্ছে না। বলতো,

‘থাক না আজ মিনু। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মীট করার দরকার কী? দিন তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না।’

কিন্তু নাছোড় মেনেকা হার মানতে চায় নি। কন্টিনিউ করতেই বলেছে সব সময়। বললে কী হবে? ওর সুখানুভূতির যে নিজস্ব আনন্দধ্বনিটা মিনহাজকে চাঙা রাখতো, সেটা আর আসে না মেনেকার মুখ থেকে। দাঁতে দাঁত চেপে রেখে যে স্বামীকে হ্যাপি রাখতে চাইছে সে, বুঝতে কষ্ট হয় না মিনহাজের। শরীর মনের কোনো কষ্টকে গোপন কওে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা কি? হয়তোবা সেটাই। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলবার সুযোগও দেয় না সে।

চা খাওয়ার অভ্যেস নেই তেমন। রাতে তো নয়ই। কোনো অভ্যেসই নেই মিনহাজের। এখন এই হালকা শীতের রাতে এক কাপ চা খেলে কি ভালো লাগবে? ভালো না লাগুক, মনের ভেতরে জমে থাকা জ্যাম খানিকটা কাটলেও কাটতে পারে। রান্নার ব্যস্ততায় কিছুটা শেয়ার করতে চা বানানোটা শিখেছে মিনহাজ মেনেকার কাছ থেকেই। পানি চড়িয়ে দেয় সে গ্যাসচুলায়। এক কাপের জায়গায় দু’কাপ চায়ের পানি পড়লো। দু’কাপ কেন? মেনেকা রাতে চা খায়। সেজন্যেই কি? কিন্তু ওতো এখন ঘুমিয়ে। তাহলে কি অনেক আগের অভ্যেস থেকেই? হতেও পারে। অফিস থেকে কখনও বিকেলে ফিরতে পারলে অভ্যেসমতো দু’কাপ চা বানাতো মিনহাজ। বারান্দায় বসে দুজনে চা খেতে খেতে গল্প হতো। সপ্তাহখানেক আগেও বিকেলে এমন গল্প হয়েছে। কিন্তু জমে নি সেটা। আজকাল এ রকমই হয়। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর মেনেকাই মুখ খুলেছিল প্রথম।

‘মনটা খারাপ দেখছি তোমার। কারণটা জানা যাবে?

মেনেকার মুখের দিকে একবার ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে পরক্ষণেই ঘরে ফেরা পাখিগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়েছিল মিনহাজ।

‘নাহিদা হঠাৎ করে তোমাকে ব্লক মেরেছে, সেজন্যেই কি?

চমকে ওঠার মতো করে তাকায় মিনহাজ মেনেকার দিকে। কথাটা মিথ্যে নয়। আর মেনেকার তা জানাও অসম্ভব কিছু নয়। কারণ, দুজনের ফেসবুক আইডিই দুজনের কাছে ওপেন্ড। কেউ কারো আইডি গোপন করবে না, কারো পোস্ট নিয়ে লাইক মন্তব্য চলবে না- এমন শর্তেই ফেসবুক চালু রেখেছে দু’জনই। মিনহাজ কিছু বলছে না দেখে মেনেকাই আবার বলে,

‘কারণটা যদি এটাই হয়, তাহলেও বলবো মন খারাপের কিছু নেই। মেয়েটা দু’দু’টো বছর একজনের সংসার করে সুখী হতে পারলো না। ডিভোর্স দিয়ে মনের মতো মানুষ খুঁজেছে। এতদিন পর যাকে পেয়েছে তাকে আবার তোমার পছন্দ না। কেন? তোমার তো বরং উচিৎ ছিল ওকে সাপোর্ট করা। তা না করে...’

‘তাই বলে অমন সুন্দর একটা মেয়ে কঙ্কাল মার্কা এক বাঁদরের গলায় মালা দেবে? তা-ও তেতাল্লিশ বছর বয়সের এক অর্ধ বুড়োকে? এটা তুমি মানতে বল?’

‘অবশ্যই বলবো। মেয়েটার বয়সও তো কম না। বত্রিশ। সমস্যা কী? ছেলেটার প্রথম বিয়ে আর মেয়ের দ্বিতীয়। তাতে কী? দুই ফ্যামিলিই রাজি। তো তোমার আপত্তিটা কেন? তুমি কি চাইছো মেয়েটি আইবুড়ো হয়ে থেকে তোমাকে সারাজীবন ফেসবুকে সঙ্গ দিক?’

‘না, তা চাইবো কেন? ওই ব্যাটার না আছে চেহারা, না আছে শরীর, না আছে টাকাপয়সা। কী দেখে পছন্দ করলো ওকে? আমার নিজের কেউ হলে কি সাপোর্ট করতে করতাম?’

‘চেহারা স্বাস্থ্য ধনী- সবই তো পেয়েছিলো। টিকলো কই। এখন ও ছেলেটার সুন্দর মনটাকে বিয়ে করতে চাইছে। আমি তো বলবো ঠিকই করছে। কিন্তু তোমার আপত্তির কারণ তো এটা না মিনহাজ। আমি তো চিনি তোমাকে হাড়ে হাড়ে।’

শেষ কথাটায় একটু ধাক্কা খায় মিনহাজ। মেনেকা কী মীন করছে সেটা না বোঝার কথা নয় তার। কিন্তু কিছু বলতে গেলে অযথা কথা বাড়তো। তিক্ততা বাড়তো। দু’তিন দিন কথা বন্ধ থাকতো। কী দরকার? মিনহাজ চায় নি সেটা। চুপ থেকেছে। মেনেকাও আর অপেক্ষা করে নি। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়েছিল সে। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মিনহাজের তিন বছর আগের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। ভার্সিটি লাইফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঈশিতা যদি দিনাজপুর থেকে টিচার্স ট্রেনিং-এ এসে সেদিন ওদের বাসায় না উঠতো, তাহলে আজকের এমন গুমোট অবস্থাটা তৈরি হতো না। টেনেটুনে কোনোভাবে কেটেই যেত বাকি জীবনটা। তখনও অনূঢ়া ঈশিতা ঢাকায় থাকার মতো নিরাপদ জায়গা না পেয়ে বন্ধুত্বের দাবিতে মিনহাজের বাসায় কয়েকদিন থাকার কথাটা বললে মিনহাজ আপত্তি করে নি। মেনেকাও সানন্দে রাজি হয়েছিল। দারুণ মিশুক মেয়ে ঈশিতা কয়েক দিনেই আপন করে নিয়েছিল মেনেকাকে। ওদের আট বছরের ভালোবাসাবাসির সম্পর্কে যাতে কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সে ব্যাপারে উভয় দিক থেকেই সতর্কতা ছিল যথেষ্ট। তারপরও শেষ রক্ষাটা হলো কি? হলো না। পুরো বদলে গেল মেনেকা। কথা কমে গেল। হাসি যেটুকু ছিল, তা-ও উড়ে গেল। কী করেছিল মিনহাজ? তেমন কিছু কি? ঈশিতা যখন রান্নায় ব্যস্ত তখন ওরা আলো আঁধারির বারান্দায় স্মৃতিচারণায় ব্যস্ত থেকেছে। ছয় ছয়টি বছরের ভার্সিটি লাইফের আনন্দঘন স্মৃতি। কম কিছু তো নয়। হাজারো কথার ফুলঝুরিতে, হাসি গল্পে মেতে উঠে সেইসব দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া। যেতেই পারে। এর বেশি তো কিছু না। ভে-রি নরম্যাল।

‘না, তুমি এতটা ডুবে না গেলেও পারতে। অন্তত মনে করা উচিত ছিল- কিচেনে তোমার পার্টনারটা গলদঘর্ম হচ্ছে। একটু ঢুঁ মেরে দেখেও গেলে না। আর ঈশিতারও বোঝা উচিৎ ছিল- তার বন্ধুটি এখন আর একা নেই।’

চাপা অভিমান লুকিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল মেনেকা। কিন্তু ট্রেনিং থেকে ফেরা ক্লান্ত ঈশিতাকে একটু সময় দেয়া কি বেশি কিছু? অনেকদিনের বন্ধুত্ব। স্মৃতিগুলো উথলে উঠে একটু বেহিসেবী হতেই পারে। কিন্তু কোনো যুক্তি মানেনি মেনেকা। উল্টো বলেছিল,

‘আমাকে বুঝিয়ো না মিনহাজ। আগেও দেখেছি- সুন্দরী দেখলে সব ভুলে যাও তুমি। মনেই রাখো না তোমার বউ বলে কেউ আছে। ইনফ্যাক্ট, তোমার আসলে বিয়ে করাটাই ঠিক হয় নি।’

খুব শক্ত শক্ত কথা। লেগেছিল খুব মিনহাজের। মনের কোনো না কোনো কিছুর অভাববোধ বিয়ের আগে পরে যে কারোরই থাকতেই পারে কিন্তু সেগুলো মিন করে একেবারে মুখের উপর সোজাসাপ্টা বলে দেয়াটা কি শোভন? সুন্দর রুচিমনের মেনেকার অন্তত এটা মানায় না। কথাগুলো অন্যভাবেও বলতে পারতো সে। বিরক্তিতে তাই জবাব দিতেও ইচ্ছে করেনি মিনহাজের। সেদিন থেকেই উত্তুরে হিমেল হাওয়া শ্বাস ফেলতে শুরু করে তাদের সম্পর্কের সূক্ষ্ম তারগুলোতে।

দু’কাপ র’চা রেডি। কাপ দু’টি দুই হাতে নিয়ে ড্রইংরুমে ঢোকে মিনহাজ। পায়ের শব্দ টের পেয়ে মেনেকা শোয়া থেকে উঠে বসে। দম নিয়ে নিয়ে ওকে থামানোর চেষ্টায় শশব্যস্ত হয়ে বলতে থাকে-

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, কাছে এসো না। শ্বাসকষ্টের সাথে জ্বরও এসে গেছে। সম্ভবত পজিটিভ। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে বেডরুমে থাকো। আমি আইসোলেশনে থাকতে চাই। আর এগিয়ো না, প্লিজ।’

কাপদু’টো টেবিলে রেখে জোর করে মেনেকার কাছে গিয়ে বসে মিনহাজ। গলা খানিকটা উঁচিয়ে বলে,

‘কিসের আইসোলেশন? ওটা তো অনেক আগেই তৈরি হয়ে গেছে। নতুন করে আবার কিসের আইসোলেশন? মানি না আমি ওইসব।’

‘তুমি না মানলে না মানো। কিন্তু ছেলেটাকে তো বাঁচাতে হবে। প্লিজ মিনহাজ, কথা শোন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ওর কাছে যাও তুমি। না গেলে ও এসে পড়বে । সর্বনাশ হয়ে যাবে ওর। প্লিজ যাও। যাও তুমি।’

মিনহাজ তবুও সামনে এগিয়ে যায়। মেনেকার প্রতিরোধের হাত সরিয়ে দিয়ে চোয়াল দুটো শক্ত করে ওর মাথার কাছে বসে। বলে,

‘কেন যাবো। তোমাকে অসুস্থ রেখে কেন সরে যাবো আমি? এ্যাম আই কাওয়ার্ড? কিসের সন্তান? কিসের কোভিড নাইন্টিন ফাইন্টিন? কিচ্ছু মানি না আমি। হলে হোক সবারই পজিটিভ। বাঁচলে একসাথে বাঁচবো। মরলেও একসাথে।’

‘কিন্তু তা বোধহয় আর হবে না মিনহাজ। মনটা তো কবেই গেছে। এখন শরীরটাও... খুব কষ্ট হচ্ছে দম নিতে মিনহাজ। অর্ঘ্যকে...’

হাঁফাতে হাঁফাতে কথা শেষ করতে পারে না মেনেকা। নিঃশব্দে ঢলে পড়ে সোফায়। পাশের ঘর থেকে চোখ ডলতে ডলতে আসে অর্ঘ্য। মাকে জড়িয়ে ধরে ডাকতে থাকে। একটা এ্যাম্বুলেন্স ডাকা দরকার এখুনি। কিন্তু হাত পা মন কিছুই কাজ করছে না মিনহাজের। সবকিছুই অবশ হয়ে আসছে। মেনেকার দিকে তাকায়। বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে ওর। মায়ের সাড়া না পেয়ে কান্না শুরু করেছে অর্ঘ্য।

‘বাবা, আম্মু কথা বলছে না কেন? কী হয়েছে আম্মুর?’

‘তেমন কিচ্ছু না বাবা। একটু জ্বর। এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। তুমি আমার ফোনটা নিয়ে এস তো বেডরুম থেকে।’

কিন্তু অতটা সময় দেবে কি মেনেকা? অসুখটা সিরিয়াস জেনেও কিচ্ছু বলে নি সে! কিন্তু কেন? মনটা নেই কেন? তেমন কিছুই তো হয় নি। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। সংসারে এর চেয়েও অনেক বড় বড় ভুলও তো হয়। ঠিকও হয়ে যায় একসময়। কিন্তু মেনেকা কী করলো এটা? চুপচাপ থেকে থেকে এত বড় শাস্তিটা কেন দিল সে মিনহাজকে? কেন? কেন? অস্ফুট স্বরে বের হয়ে আসা প্রশ্নগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। থামে না কিছুতেই...