‘বৈদেহী’ ও পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ

অমিতা চক্রবর্ত্তী

বৈদেহী মানে কী? যার দেহ নেই? নাকি যার দেহ থেকেও নিজের মালিকানায় নেই? না আরও অন্য কোনো মানে আছে? একটা মেয়ে যে কিনা মেয়েদের শরীর বা দেহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে জেনে বড় হয়েছে, এমনকি এই শরীরকে পবিত্র রাখা মানে জেনেছে সমাজ যে পুরুষকে ওই শরীর ভোগ করার জন্য আনুষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে অনুমোদন দেবে তার সাথেই একগামী হওয়া, সেই মেয়ে যখন সেই পুরুষের অক্ষমতার জন্য বহুগামী হয়ে টাকা রোজগার করে তখন সে নিজের কাছে নিজেই বৈদেহী। শুধু কি তাই! এই নারীকেও বেশ্যা বলে গালি শুনতে হয় সেই পুরুষের মুখেই। আহা কি সমাজ! আরেক ত্রাতা পুরুষ আব্দুল হক এই নারীকে রক্ষিতার মতো ব্যবহার করে তার বিনিময়ে অর্থ ও বৈষয়িক কিছু ব্যাবস্থাপনায় সাহায্য করে। অসহায় ও উপায়হীন সেই নারী এই সাহায্যের জন্য রীতিমতো কৃতজ্ঞবোধ করে। আরেক তরুণ তাকে ভোগ করার বিনিময়ে চোখ খুলে দেয় তার। সেই নারীকে বোঝায়, সে আব্দুল হকের রক্ষিতা বলেই তাকে সে সাহায্য করে। সেই নারী যৌনকর্ম ছাড়াও অন্য কাজ করে একই অর্থ রোজগার করতে পারে, এমনকি তার পঙ্গু স্বামীও ঘরে বসে টিউশনি করে টাকা রোজগার করতে পারে। বৈদেহী নারী যখন সত্যি যৌন দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উদ্যোগী হয়, তখন আব্দুল হক তাকে গণধর্ষণের জন্য যৌন-বিকৃত কতকগুলি পুরুষের হাতে মধ্যরাতে রাস্তায় ছুড়ে দেয়। আহ বৈদেহী! এই বৈদেহী শহর-গ্রাম-মফস্বলের সেই নারী যে কিনা পতিতালয়ে এনলিস্টেড নয়, ভাসমান প্রফেশনাল পতিতাও নয়। সে সকল নিম্নমধ্যবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত নারীর প্রতিচ্ছবি, যাকে সমাজের পঙ্গু অথবা কিছু সমর্থ অথবা প্রতিষ্ঠিত পুরুষ অবলীলায় যৌনদাসী করে ফেলে তার কোনো না কোনো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে।

এই নারী কীভাবে এইসব পুরুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অত্যাচার, নির্যাতন আর অপমানের বিচার চাইবে? এই সমাজের বিচারব্যবস্থায় তার জন্য তার পক্ষে কোনো আইন আছে কি? বরং সে স্বেচ্ছায় যৌনদাসী হয়েছে বলে সাব্যস্ত করবে সমাজ ও তার বিচারব্যাবস্থা। এই সমাজের নারী বা পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই কি এটা সত্য নয় যে, কোনো না কোনো ক্ষেত্রে সে দুর্বল, বা অসহায় অথবা অন্যের উপর কোন বিষয়ে নির্ভরশীল? এই দুর্বলতা, অসহায়তা অথবা নির্ভরশীলতার সুযোগে যৌন-বিকৃত পুরুষেরা বাধ্য করে নারীকে তার সাথে যৌনকর্ম করে বৈদেহী হয়ে যেতে। আর যারা বৈদেহী হয়ে যায়, তারা ওইসব পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে করে তাদের বয়কট করে করে এমন পরিস্থিতিতেই বৈদেহী হয়ে যায় যখন তার আর কিছুই করার থাকে না, কোনো উপায় থাকে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তবু সেইসব পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের ধ্বজাধারী নারীরা তাকে বেশ্যা বলেই গালি দেবে, এই সব পরিস্থিতি থেকে ওই নারীকে বের করে নিয়ে আসবে না। বরং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তাকে গণধর্ষণের মুখে ফেলে দেবে আব্দুল হকদের মতো।

নাসরীন জাহানের উপন্যাস ‘বৈদেহী’। এই উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়াতেই এতোগুলো কথা বলছিলাম।

নারীবাদ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য নিয়ে কতোই তো বিদগ্ধ লেখা প্রকাশিত হয়, তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোকে নারীর উপর ঘটে চলা নিরন্তর নীপিড়নের নতুন নতুন সংকট ও নতুন ভাবনার আলোক উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু এই সমাজের সকল শ্রেণিপেশার নারীই কেন অন্যের ইচ্ছেতে নিজেকে বৈদেহী করে ফেলতে বাধ্য হয়, কীভাবে নারীরা সমাজের আরোপিত মূল্যবোধের কাছে নিজেকে মতাদর্শিকভাবে সমর্পিত করবার পরেও সেই মূল্যবোধেরই বিপ্রতীপ আচরণ করতে বাধ্য হয়, তারই বয়ান নাসরীন জাহানের বৈদেহী। পুরুষের সুবিধাজনক মূল্যবোধে বড় হয় নারী, পুরুষই সেই মূল্যবোধকে হত্যা করে নিজের প্রয়োজনমতো, আবার সেই মূল্যবোধের বাইরে কেন গেল সেই নারী সে কারণে শাস্তিও তাকে দেয় পুরুষ। শুধু তাই নয়, সেই শাস্তির বিরুদ্ধে মুক্তির আওয়াজ তোলে সেই একই পুরুষ। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটা কবিতা মনে পড়ে যায়... শবমেহেরকে যে বানাইছে সেই মাইরাছে তারে, সেই দাড়াইছে প্রতিবাদের শ্রেষ্ঠ কাতারে... আহা! শবমেহের, তুমি বেঁচে থাকলে একদিন দেখতে, বুঝতে, সমাজের সকল নারী কোনো না কোনোভাবে শবমেহের, কোনো না কোনো পুরুষবাদী কায়দায় বৈদেহী।

‘বৈদেহী’ উপন্যাসের বয়ান ভদ্র সভ্য সুশীল সমাজের ধর্ষক মানসিকতার বয়ান। দৈনন্দিন যাপনের স্বাভাবিকতার আড়ালে নারীর যন্ত্রণাময় বৈদেহী হয়ে ওঠার বীভৎস অভিজ্ঞতাকে উপন্যাসের বিষয় করে সমাজে জানান দেবার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় নাসরীন জাহানকে।

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১ , ৭ মাঘ ১৪২৭, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

‘বৈদেহী’ ও পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ

অমিতা চক্রবর্ত্তী

image

বৈদেহী মানে কী? যার দেহ নেই? নাকি যার দেহ থেকেও নিজের মালিকানায় নেই? না আরও অন্য কোনো মানে আছে? একটা মেয়ে যে কিনা মেয়েদের শরীর বা দেহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে জেনে বড় হয়েছে, এমনকি এই শরীরকে পবিত্র রাখা মানে জেনেছে সমাজ যে পুরুষকে ওই শরীর ভোগ করার জন্য আনুষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে অনুমোদন দেবে তার সাথেই একগামী হওয়া, সেই মেয়ে যখন সেই পুরুষের অক্ষমতার জন্য বহুগামী হয়ে টাকা রোজগার করে তখন সে নিজের কাছে নিজেই বৈদেহী। শুধু কি তাই! এই নারীকেও বেশ্যা বলে গালি শুনতে হয় সেই পুরুষের মুখেই। আহা কি সমাজ! আরেক ত্রাতা পুরুষ আব্দুল হক এই নারীকে রক্ষিতার মতো ব্যবহার করে তার বিনিময়ে অর্থ ও বৈষয়িক কিছু ব্যাবস্থাপনায় সাহায্য করে। অসহায় ও উপায়হীন সেই নারী এই সাহায্যের জন্য রীতিমতো কৃতজ্ঞবোধ করে। আরেক তরুণ তাকে ভোগ করার বিনিময়ে চোখ খুলে দেয় তার। সেই নারীকে বোঝায়, সে আব্দুল হকের রক্ষিতা বলেই তাকে সে সাহায্য করে। সেই নারী যৌনকর্ম ছাড়াও অন্য কাজ করে একই অর্থ রোজগার করতে পারে, এমনকি তার পঙ্গু স্বামীও ঘরে বসে টিউশনি করে টাকা রোজগার করতে পারে। বৈদেহী নারী যখন সত্যি যৌন দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উদ্যোগী হয়, তখন আব্দুল হক তাকে গণধর্ষণের জন্য যৌন-বিকৃত কতকগুলি পুরুষের হাতে মধ্যরাতে রাস্তায় ছুড়ে দেয়। আহ বৈদেহী! এই বৈদেহী শহর-গ্রাম-মফস্বলের সেই নারী যে কিনা পতিতালয়ে এনলিস্টেড নয়, ভাসমান প্রফেশনাল পতিতাও নয়। সে সকল নিম্নমধ্যবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত নারীর প্রতিচ্ছবি, যাকে সমাজের পঙ্গু অথবা কিছু সমর্থ অথবা প্রতিষ্ঠিত পুরুষ অবলীলায় যৌনদাসী করে ফেলে তার কোনো না কোনো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে।

এই নারী কীভাবে এইসব পুরুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অত্যাচার, নির্যাতন আর অপমানের বিচার চাইবে? এই সমাজের বিচারব্যবস্থায় তার জন্য তার পক্ষে কোনো আইন আছে কি? বরং সে স্বেচ্ছায় যৌনদাসী হয়েছে বলে সাব্যস্ত করবে সমাজ ও তার বিচারব্যাবস্থা। এই সমাজের নারী বা পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই কি এটা সত্য নয় যে, কোনো না কোনো ক্ষেত্রে সে দুর্বল, বা অসহায় অথবা অন্যের উপর কোন বিষয়ে নির্ভরশীল? এই দুর্বলতা, অসহায়তা অথবা নির্ভরশীলতার সুযোগে যৌন-বিকৃত পুরুষেরা বাধ্য করে নারীকে তার সাথে যৌনকর্ম করে বৈদেহী হয়ে যেতে। আর যারা বৈদেহী হয়ে যায়, তারা ওইসব পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে করে তাদের বয়কট করে করে এমন পরিস্থিতিতেই বৈদেহী হয়ে যায় যখন তার আর কিছুই করার থাকে না, কোনো উপায় থাকে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তবু সেইসব পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের ধ্বজাধারী নারীরা তাকে বেশ্যা বলেই গালি দেবে, এই সব পরিস্থিতি থেকে ওই নারীকে বের করে নিয়ে আসবে না। বরং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তাকে গণধর্ষণের মুখে ফেলে দেবে আব্দুল হকদের মতো।

নাসরীন জাহানের উপন্যাস ‘বৈদেহী’। এই উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়াতেই এতোগুলো কথা বলছিলাম।

নারীবাদ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য নিয়ে কতোই তো বিদগ্ধ লেখা প্রকাশিত হয়, তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোকে নারীর উপর ঘটে চলা নিরন্তর নীপিড়নের নতুন নতুন সংকট ও নতুন ভাবনার আলোক উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু এই সমাজের সকল শ্রেণিপেশার নারীই কেন অন্যের ইচ্ছেতে নিজেকে বৈদেহী করে ফেলতে বাধ্য হয়, কীভাবে নারীরা সমাজের আরোপিত মূল্যবোধের কাছে নিজেকে মতাদর্শিকভাবে সমর্পিত করবার পরেও সেই মূল্যবোধেরই বিপ্রতীপ আচরণ করতে বাধ্য হয়, তারই বয়ান নাসরীন জাহানের বৈদেহী। পুরুষের সুবিধাজনক মূল্যবোধে বড় হয় নারী, পুরুষই সেই মূল্যবোধকে হত্যা করে নিজের প্রয়োজনমতো, আবার সেই মূল্যবোধের বাইরে কেন গেল সেই নারী সে কারণে শাস্তিও তাকে দেয় পুরুষ। শুধু তাই নয়, সেই শাস্তির বিরুদ্ধে মুক্তির আওয়াজ তোলে সেই একই পুরুষ। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটা কবিতা মনে পড়ে যায়... শবমেহেরকে যে বানাইছে সেই মাইরাছে তারে, সেই দাড়াইছে প্রতিবাদের শ্রেষ্ঠ কাতারে... আহা! শবমেহের, তুমি বেঁচে থাকলে একদিন দেখতে, বুঝতে, সমাজের সকল নারী কোনো না কোনোভাবে শবমেহের, কোনো না কোনো পুরুষবাদী কায়দায় বৈদেহী।

‘বৈদেহী’ উপন্যাসের বয়ান ভদ্র সভ্য সুশীল সমাজের ধর্ষক মানসিকতার বয়ান। দৈনন্দিন যাপনের স্বাভাবিকতার আড়ালে নারীর যন্ত্রণাময় বৈদেহী হয়ে ওঠার বীভৎস অভিজ্ঞতাকে উপন্যাসের বিষয় করে সমাজে জানান দেবার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় নাসরীন জাহানকে।