পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ভোট এবং বামপন্থিরা

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন যেমন ভারতের জাতীয় স্তরে সাম্প্রদায়িকতাকে আগামী দিনে রোখা যাবে, কি যাবে না-এই প্রশ্নে ভীষণ-ই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দক্ষিণ এশিয়াতে শান্তি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘুর স্বাধিকার বজায় থাকবে, কি থাকবে না, এই প্রশ্নেও অশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। আগামী দিনে যদি পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে চলে যায়, সেক্ষেত্রে ভারতে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ লাগামছাড়া যেমন হবে, তেমনি বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা অনেকখানি শক্তিশালী হবে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সরকারকে সংকটে ফেলবার যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলেছে, সেই অপচেষ্টা খানিকটা হলেও সাফল্যের মুখ দেখবে।

দুঃখের বিষয় এই যে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন ভোটটির এই গুরুত্ব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একটি ও অ বিজেপি দল সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপি রোখবার প্রশ্নে আলোচনাতে আনবার তেমন কোন দরকারই নেই, এই কারণে যে; তৃণমূল দলটি যদি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে তাহলে, প্রকাশ্যে, ঢাক পিটিয়েই হোক, আর একের পর এক নেতাদের বিজেপিতে যোগদানের নিরিখেই হোক, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভেতর মিশে যাবে। আরএসএসের ঘনিষ্ঠ লোকজন যে বিজেপিকে শক্তিশালী করবার জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী করেছিল, এটা আরএসএস, বিজেপির সাহায্যে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতার থেকে বেশি আর কেউ জানতেন না।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট নিয়ে ক্ষমতাসীন তৃণমূল এবং ক্ষমতাকাক্সক্ষী বিজেপির ভিতর যে তৎপরতা, বাম মহলে তার সিকি ভাগও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বামেদের সঙ্গে যাদের নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ার এখনো পর্যন্ত প্রবল সম্ভাবনা আছে, সেই কংগ্রেস দলের অবস্থাও তথৈবচ। অথচ এই বামেরাই কিন্তু ক্ষমতায় থাকার সময়ে নির্বাচনী সংগ্রাম ঘিরে অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের তুলনায় অনেক বেশি মেথোডিকাল ছিল। গত ১০ বছর ক্ষমতায় না থাকার সময়কালে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট ভুক্ত বামেরা যে অনেকখানি অগোছালো, এলেমেলো হয়ে গিয়েছেন, এটা তাদের ভোটের মুখের কার্যকলাপ থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

গত ১০ বছরে একটা জবরদস্তবিরোধী হিসেবে বামেরা নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি, এই না পারাটা বিজেপির কোমরে জোর এনে দেয়ার পক্ষে অনেকখানি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত বামফ্রন্টের ভেতরে থাকা বামদলগুলোর মধ্যে মো. সেলিম ছাড়া এমন কোন নেতা গত ১০ বছরে নিজেদের তুলে ধরতে পারেননি, যার সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে। সূর্যকান্ত মিশ্র, অত্যন্ত ভদ্রলোক। সৎ হিসেবেও তার পরিচয় সুবিদিত। কিন্তু ডাকাবুকো নেতা হিসেবে গত ১০ বছরে তিনি একটা বিকল্প নেতৃত্বের ধারা তৈরি করতে পারেননি। বামমহলের এই নেতৃত্বের সংকটটি ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কাছে একটা বড় বিষয় হিসেবে নিশ্চিতভাবে আসন্ন বিধানসভা ভোটে উঠে আসবে।

বামেরা বলে থাকেন, নেতা নয়, নীতি। কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন ভোটের পাটিগণিতের অঙ্ক কষতে হয়, তখন ‘মুখ’ কে, এই প্রশ্নটা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই মোকাবিলা করতে হয়। নেতৃত্বের এই ‘মুখে’র প্রশ্নটির রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করা মানে প্রকৃত সত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখা। এই ‘মুখে’র প্রশ্নে বামপন্থিরা এবং বিজেপি, উভয়েই তৃণমূলের থেকে পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে থাকাটা পূরণ করতে বিজেপি হঠাৎ করে কোনো সেলিব্রেটিকে সামনে এনে চমক দিলেও দিতে পারে। কিন্তু বামপন্থিদের রাজনৈতিক চরিত্রের ভেতরে তেমন হঠাৎ চমক দেয়ার যেমন কোনো প্রথা নেই, তেমনই এ উড়িয়ে এনে জুড়ে বসিয়ে কাউকে ‘নেতা’ বা ‘মুখ’ করে দেয়াটা বামপন্থিদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। একটা ধারাবাহিক পদ্ধতির ভেতর থেকে বামপন্থিদর মধ্যে ‘নেতৃত্বে’ কর্মীরা উত্তোলিত হন। সেখান থেকেই ‘মুখ’ হিসেবে তারা উঠে আসেন।

তবে সাম্প্রতিক অতীতে গণ-আন্দোলনের ভেতর থেকে উঠে আসা কর্মীদের তুলে ধরবার বদলে, একটু বলিয়ে কইয়ে, ভালো ইংরেজি বলতে পারেন, শহরের তথাকথিত স্মার্টনেস আছে, এমন নতুন প্রজন্মের কর্মীদের ‘নেতা’ হিসেবে তুলে ধরবার একটা প্রবণতা বামপন্থিদর ভেতর উত্তোরোত্তর বাড়ছেই। যে কর্মী সামাজিক গণমাধ্যমে যত বেশি তার ভক্তকুলের দ্বারা বিজ্ঞাপিত হচ্ছেন, ‘নেতা’ হিসেবে উঠে আসার ক্ষেত্রে তার টিআরপি তত বাড়ছে। যে কর্মী বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমে যত বেশি মুখ দেখাতে সমর্থ হচ্ছেন, সেই ব্যক্তির নেতা হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা তত বাড়ছে। একবার ও বিচার করা হচ্ছে না, সেসব কর্মীদের বিতর্কের মান কেমন। কেবল বিচার্য হয়ে উঠছে, বিপক্ষ কে চটুল কথায় সে কতখানি পর্যুদস্ত করতে পারছে, সেই দিকটাই। সংখ্যাতত্ত্ব আওড়ে সেই বক্তা কত বেশি নিজেকে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্র ‘ব্রজ মাস্টারে’র এ যুগীয় সংকলন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারছে, তার উপরে নির্ভর করছে, সেই কর্মীর নেতা হিসেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়টি।

পশ্চিমবঙ্গের এই ভোটের মুখে নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করা কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কার্যত মমতা-বিজেপির আড়কাঠি হিসেবে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। গত লোকসভা ভোটে এই রাজ্য থেকে বিজেপি ১৮টি আসন পাওয়ার পর থেকেই এরা এই তত্ত্বের অবতারণা করেছে যে, মমতাই একমাত্র পারবেন বিজেপিকে রুখতে। তাই মমতার সঙ্গে বামফ্রন্ট ভুক্ত বামেদের একটা ভোট কেন্দ্রিক বোঝাপড়া জরুরি। এদের কাছে মমতার দুর্নীতি, দল ভাঙানো- এগুলো কিছুই বিবেচ্য নয়। এমন কি এরা মমতাকে ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’র ধারক-বাহক হিসেবে মানতেও রাজি নন। বিশেষ করে কয়েক মাস আগে বিহার বিধানসভার ভোটে সিপিআই (এমএল) বেশ কতকগুলো আসন পাওয়ার পর এই তথাকথিত ‘লিবারাল’ দের মমতা, বিজেপির হয়ে আড়কাঠির ভূমিকাটা ভয়ঙ্কর রকম তীব্র হয়ে উঠেছে। দিন যত এগোচ্ছে, সামাজিক গণমাধ্যমে এই মতের সমর্থকরা সূর্যকান্ত মিশ্রদের বিজেপির দালাল হিসেবে প্রকাশ্যে লিখে একদিকে গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের ভেতরে একটা বিভ্রান্তি আনছেন। অপরদিকে বিজেপি আর তৃণমূল, যাকে এখন পশ্চিমবঙ্গে ‘বিজেমূল’ বলে অভিহিত করা হয়, সেই শক্তির কোমরে জোর আনবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন।

বামপন্থিদের কাছে একটি রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দখল করাই কি একমাত্র লক্ষ্য? সামাজিক পরিবর্তন আনার কোনো দায় কি বামপন্থিদের নেই? এই প্রশ্নেই এ কথা আসে যে, তৃণমূল কংগ্রেস, গত ১০ বছরে যে মাৎস্যন্যায় পশ্চিমবঙ্গের বুকে চালিয়েছে, তার মোকাবিলায় বামপন্থিদের সামাজিক ভূমিকা কি ছিল? যারা বামফ্রন্টের ভেতরে আছেন, তাদেরই বা ভূমিকা কি ছিল? আর যারা বামফ্রন্টের ভেতরে থাকা বামেদের আদৌ বাম বলেই মনে করেন না, নিজেদেরই সব থেকে বড়ো বামপন্থি বলে ভাবতে ভালোবাসেন, তাদেরই বা ভূমিকা কি ছিল? আজ যেসব লিবারাল নামক ‘বিপ্লবী’ রা বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে মমতাকে সমর্থনের কথা বলছেন, এঁরাই তো বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মমতার অন্যতম সহায়ক ছিলেন। এরাই তো সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্বে মমতার সব থেকে প্রিয়পাত্র ছিলেন। তখন কি এরা চোখ বুজে ছিলেন মমতার সঙ্গে আরএসএস- বিজেপির নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ঘিরে? বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং যখন মমতার তথাকথিত অনশন মঞ্চে এসেছিলেন কলকাতার ধর্মতলায়, তখন এই লিবারেলদের উপস্থিতির ছবি তো গুগুল ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। লিবারেল দের তখন এক এবং একমাত্র কর্মসূচি ছিল, যে কোন উপায়ে বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো। সেই লিবারালেরাই গত ১০ বছরে মমতার বিজেপির পালে হাওয়া দেয়ার জন্যে মুসলমানদের টাকাতেই তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ কিছু ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা দেয়া নিয়ে একটি শব্দ ও কি উচ্চারণ করেছেন? মমতা তার দ্বিতীয় দফার শাসনকালের একদম শেষপর্বে হিন্দু সমাজের ভেতরেও বিভাজন তৈরিতে ‘পুরোহিত ভাতা’র প্রবর্তন করেছেন। ভিপি সিংয়ের আমলে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করবার ভেতর দিয়ে শ্মশানে যারা পৌরহিত্য করেন বা শ্রাদ্ধে যারা অগ্রদানী পুরোহিত হিসেবে থাকেন, তারা ‘অন্যান্য অনগ্রসর জাতি’র (ওবিসি) মর্যাদা পেয়েছেন। অথচ মমতার পুরোহিত ভাতার সুযোগ এই আর্থ-সামাজিকভাবে কোণঠাসা শ্মশানের ব্রাহ্মণ বা অগ্রদানী ব্রাহ্মণেরা পাননি। এই যে হিন্দু সমাজের ভেতরেও বিভাজন তৈরি করে মমতা কার্যত প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন, এ সম্পর্কে একটি শব্দ ও কিন্তু এই লিবারালরা আজ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।

পশ্চিমবঙ্গে সংবাদমাধ্যম এমনভাবে রাজনৈতিক খবরগুলো পরিবেশন করছে, যেখান থেকে সবার মনে হবে, তৃণমূল আর বিজেপি ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব এখানে নেই। বামপন্থিরা অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ভেতরে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখার ফলে, সংবাদ জগতের কাছে তাদের আন্দোলনগুলো দুচার-লাইনের বেশি খবর হয়েও উঠছে না। বামপন্থিরা সংবাদমাধ্যমের তাদের প্রতি এই অবহেলার পাল্টা হিসেবে সামাজিক গণমাধ্যমের কথা বলছেন। কিন্তু সেই সামাজিক গণমাধ্যমেও বেশিরভাগ বামপন্থি কর্মী সমর্থকদের ভেতরে উপদলীয় পছন্দের বিষয়টিই সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

বিষয়টি এই রকম হচ্ছে যে, কোন একটি সমাবেশ বা আন্দোলনে যদি ক, খ, গ, ঘ উপস্থিত থাকেন, আর আমি যদি ‘ঘ’ এর অনুগত কর্মী বা সমর্থক হই, সেক্ষেত্রে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ কে কার্যত ব্ল্যাক আউট করে, কেবল ‘ঘ’ এর ছবি, ‘ঘ’ সংক্রান্ত খবরাখবরই গুরুত্ব পাচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক বক্তব্য ও গুরুত্ব পাচ্ছে না। দল তো নয়ই। একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ‘ঘ’ দাদাকে ঘিরে ব্যক্তি স্তুতি। এটা কি কেউ কোনদিন আগে কল্পনা করেছিলেন যে, কমিউনিস্ট পার্টির জেলা স্তরের নেতার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সমর্থক পরিচয় দিয়ে কেউ সামাজিক গণমাধ্যমে অভিনন্দন জানাবে? মুজফফর আহমদ, জ্যোতি বসু, সরোজ মুখার্জী, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ কিংবা বিনয় চৌধুরীর বিয়ের তারিখ কি, সেটা তার আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরে কখনও এসেছে? আজ যারা দলের শীর্ষস্থানে আছেন, ডা. সূর্যকান্ত মিশ্র, মহ. সেলিম, রবীন দেবদের বিয়ের তারিখ কি তাদের অতি ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধারাও জানেন?

বামপন্থিদের এককালে যেমন রেজিমেন্টেশন ছিল, আদর্শগত ভিন্নতা নিয়ে ঠিক তেমন বজ্রকঠিন রেজিমেন্টেশনের ভেতর দিয়েই আরএসএস দিনের পর দিন নিজেদের সংহত করেছে। ক্ষমতা দখলের স্বার্থে সেই রেজিমেন্টেশনের চরিত্র তারা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভেতরে সব সময়েই সময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সরবরাহ করে থাকে। সেই রেজিমেন্টেশনের ধারাটির বিকল্প সংস্কৃতি তৈরির কথা বামপন্থিরা, বিশেষ করে সিপিআই (এম), তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসলেও, বাস্তবে, তেমন বিকল্প একটি সামাজিক প্রযুক্তি তারা আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। আজ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্বারোপ করলেও দেশজ সংস্কৃতির সার্বিক ধারাবাহিকতার চর্চার ভেতর তারা তাদের কর্মী সমর্থকদের পুরোপুরি আনতে পারেননি।

আজও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থিদের কাছে কিউবা, ভিয়েতনাম বা সেই দেশের নেতারা যত আপন, তত আপন হয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ বা সেই দেশের শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফির মতো মানুষেরা। অথচ সাম্প্রদায়িকতা রুখতে বাঙালির এই সার্বিক সেতুবন্ধন ছিল সব থেকে জরুরি। আজ যদি মায়াকভস্কির পাশে এখানে কাজী আবদুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’ ঘিরে আলোচনা একদম ভূমিস্তরের মানুষের ভেতরে পৌঁছে দেয়া যেত, বাংলা আজ ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকদের অগাধ মৃগয়া ভূমি হতো না।

এই নিবন্ধ রচনার দিন, ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ । এদের কর্মকাণ্ডকে অন্নদাশঙ্কর রায় অভিহিত করেছিলেন, বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ হিসেবে। সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ মুজফফর আহমদ। সেই ইতিহাসকে স্মরণ ধারাবাহিকতার করার ভেতর দিয়ে তো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার একটা প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারত। কিন্তু সেই চেষ্টা কোথায়? নির্বাচনী সংগ্রামের পরিবেশকে তৈরি করবার জন্যে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এককালের কমিউনিস্টরা তৈরি করতেন, তার ফসলই ছিল ৩৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন বামফ্রন্ট সরকার। সেই উদ্যোগ আজ কোথায়? উদ্যমই বা আজ কোথায়? এখন কি প্রতিভার দাম সেই আগের মতো দেয়া হয়? প্রতিভা তো এখন নেতাদের সঙ্গে কে কতো বেশি ঘনিষ্ঠ তার নিরিখে নির্ধারিত হয়। সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ শিল্পীদের বেশিরভাগই এতদিন শোভাবর্ধন করতেন তৃণমূল কংগ্রেসের। এখন তারা শোভাবর্ধনের জন্য পা বাড়িয়েছেন বিজেপির দিকে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১ , ৯ মাঘ ১৪২৭, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ভোট এবং বামপন্থিরা

গৌতম রায়

image

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন যেমন ভারতের জাতীয় স্তরে সাম্প্রদায়িকতাকে আগামী দিনে রোখা যাবে, কি যাবে না-এই প্রশ্নে ভীষণ-ই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দক্ষিণ এশিয়াতে শান্তি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘুর স্বাধিকার বজায় থাকবে, কি থাকবে না, এই প্রশ্নেও অশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। আগামী দিনে যদি পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে চলে যায়, সেক্ষেত্রে ভারতে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ লাগামছাড়া যেমন হবে, তেমনি বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা অনেকখানি শক্তিশালী হবে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সরকারকে সংকটে ফেলবার যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলেছে, সেই অপচেষ্টা খানিকটা হলেও সাফল্যের মুখ দেখবে।

দুঃখের বিষয় এই যে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন ভোটটির এই গুরুত্ব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একটি ও অ বিজেপি দল সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপি রোখবার প্রশ্নে আলোচনাতে আনবার তেমন কোন দরকারই নেই, এই কারণে যে; তৃণমূল দলটি যদি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে তাহলে, প্রকাশ্যে, ঢাক পিটিয়েই হোক, আর একের পর এক নেতাদের বিজেপিতে যোগদানের নিরিখেই হোক, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভেতর মিশে যাবে। আরএসএসের ঘনিষ্ঠ লোকজন যে বিজেপিকে শক্তিশালী করবার জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী করেছিল, এটা আরএসএস, বিজেপির সাহায্যে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতার থেকে বেশি আর কেউ জানতেন না।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট নিয়ে ক্ষমতাসীন তৃণমূল এবং ক্ষমতাকাক্সক্ষী বিজেপির ভিতর যে তৎপরতা, বাম মহলে তার সিকি ভাগও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বামেদের সঙ্গে যাদের নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ার এখনো পর্যন্ত প্রবল সম্ভাবনা আছে, সেই কংগ্রেস দলের অবস্থাও তথৈবচ। অথচ এই বামেরাই কিন্তু ক্ষমতায় থাকার সময়ে নির্বাচনী সংগ্রাম ঘিরে অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের তুলনায় অনেক বেশি মেথোডিকাল ছিল। গত ১০ বছর ক্ষমতায় না থাকার সময়কালে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট ভুক্ত বামেরা যে অনেকখানি অগোছালো, এলেমেলো হয়ে গিয়েছেন, এটা তাদের ভোটের মুখের কার্যকলাপ থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

গত ১০ বছরে একটা জবরদস্তবিরোধী হিসেবে বামেরা নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি, এই না পারাটা বিজেপির কোমরে জোর এনে দেয়ার পক্ষে অনেকখানি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত বামফ্রন্টের ভেতরে থাকা বামদলগুলোর মধ্যে মো. সেলিম ছাড়া এমন কোন নেতা গত ১০ বছরে নিজেদের তুলে ধরতে পারেননি, যার সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে। সূর্যকান্ত মিশ্র, অত্যন্ত ভদ্রলোক। সৎ হিসেবেও তার পরিচয় সুবিদিত। কিন্তু ডাকাবুকো নেতা হিসেবে গত ১০ বছরে তিনি একটা বিকল্প নেতৃত্বের ধারা তৈরি করতে পারেননি। বামমহলের এই নেতৃত্বের সংকটটি ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কাছে একটা বড় বিষয় হিসেবে নিশ্চিতভাবে আসন্ন বিধানসভা ভোটে উঠে আসবে।

বামেরা বলে থাকেন, নেতা নয়, নীতি। কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন ভোটের পাটিগণিতের অঙ্ক কষতে হয়, তখন ‘মুখ’ কে, এই প্রশ্নটা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই মোকাবিলা করতে হয়। নেতৃত্বের এই ‘মুখে’র প্রশ্নটির রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করা মানে প্রকৃত সত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখা। এই ‘মুখে’র প্রশ্নে বামপন্থিরা এবং বিজেপি, উভয়েই তৃণমূলের থেকে পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে থাকাটা পূরণ করতে বিজেপি হঠাৎ করে কোনো সেলিব্রেটিকে সামনে এনে চমক দিলেও দিতে পারে। কিন্তু বামপন্থিদের রাজনৈতিক চরিত্রের ভেতরে তেমন হঠাৎ চমক দেয়ার যেমন কোনো প্রথা নেই, তেমনই এ উড়িয়ে এনে জুড়ে বসিয়ে কাউকে ‘নেতা’ বা ‘মুখ’ করে দেয়াটা বামপন্থিদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। একটা ধারাবাহিক পদ্ধতির ভেতর থেকে বামপন্থিদর মধ্যে ‘নেতৃত্বে’ কর্মীরা উত্তোলিত হন। সেখান থেকেই ‘মুখ’ হিসেবে তারা উঠে আসেন।

তবে সাম্প্রতিক অতীতে গণ-আন্দোলনের ভেতর থেকে উঠে আসা কর্মীদের তুলে ধরবার বদলে, একটু বলিয়ে কইয়ে, ভালো ইংরেজি বলতে পারেন, শহরের তথাকথিত স্মার্টনেস আছে, এমন নতুন প্রজন্মের কর্মীদের ‘নেতা’ হিসেবে তুলে ধরবার একটা প্রবণতা বামপন্থিদর ভেতর উত্তোরোত্তর বাড়ছেই। যে কর্মী সামাজিক গণমাধ্যমে যত বেশি তার ভক্তকুলের দ্বারা বিজ্ঞাপিত হচ্ছেন, ‘নেতা’ হিসেবে উঠে আসার ক্ষেত্রে তার টিআরপি তত বাড়ছে। যে কর্মী বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমে যত বেশি মুখ দেখাতে সমর্থ হচ্ছেন, সেই ব্যক্তির নেতা হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা তত বাড়ছে। একবার ও বিচার করা হচ্ছে না, সেসব কর্মীদের বিতর্কের মান কেমন। কেবল বিচার্য হয়ে উঠছে, বিপক্ষ কে চটুল কথায় সে কতখানি পর্যুদস্ত করতে পারছে, সেই দিকটাই। সংখ্যাতত্ত্ব আওড়ে সেই বক্তা কত বেশি নিজেকে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্র ‘ব্রজ মাস্টারে’র এ যুগীয় সংকলন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারছে, তার উপরে নির্ভর করছে, সেই কর্মীর নেতা হিসেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়টি।

পশ্চিমবঙ্গের এই ভোটের মুখে নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করা কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কার্যত মমতা-বিজেপির আড়কাঠি হিসেবে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। গত লোকসভা ভোটে এই রাজ্য থেকে বিজেপি ১৮টি আসন পাওয়ার পর থেকেই এরা এই তত্ত্বের অবতারণা করেছে যে, মমতাই একমাত্র পারবেন বিজেপিকে রুখতে। তাই মমতার সঙ্গে বামফ্রন্ট ভুক্ত বামেদের একটা ভোট কেন্দ্রিক বোঝাপড়া জরুরি। এদের কাছে মমতার দুর্নীতি, দল ভাঙানো- এগুলো কিছুই বিবেচ্য নয়। এমন কি এরা মমতাকে ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’র ধারক-বাহক হিসেবে মানতেও রাজি নন। বিশেষ করে কয়েক মাস আগে বিহার বিধানসভার ভোটে সিপিআই (এমএল) বেশ কতকগুলো আসন পাওয়ার পর এই তথাকথিত ‘লিবারাল’ দের মমতা, বিজেপির হয়ে আড়কাঠির ভূমিকাটা ভয়ঙ্কর রকম তীব্র হয়ে উঠেছে। দিন যত এগোচ্ছে, সামাজিক গণমাধ্যমে এই মতের সমর্থকরা সূর্যকান্ত মিশ্রদের বিজেপির দালাল হিসেবে প্রকাশ্যে লিখে একদিকে গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের ভেতরে একটা বিভ্রান্তি আনছেন। অপরদিকে বিজেপি আর তৃণমূল, যাকে এখন পশ্চিমবঙ্গে ‘বিজেমূল’ বলে অভিহিত করা হয়, সেই শক্তির কোমরে জোর আনবার যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন।

বামপন্থিদের কাছে একটি রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দখল করাই কি একমাত্র লক্ষ্য? সামাজিক পরিবর্তন আনার কোনো দায় কি বামপন্থিদের নেই? এই প্রশ্নেই এ কথা আসে যে, তৃণমূল কংগ্রেস, গত ১০ বছরে যে মাৎস্যন্যায় পশ্চিমবঙ্গের বুকে চালিয়েছে, তার মোকাবিলায় বামপন্থিদের সামাজিক ভূমিকা কি ছিল? যারা বামফ্রন্টের ভেতরে আছেন, তাদেরই বা ভূমিকা কি ছিল? আর যারা বামফ্রন্টের ভেতরে থাকা বামেদের আদৌ বাম বলেই মনে করেন না, নিজেদেরই সব থেকে বড়ো বামপন্থি বলে ভাবতে ভালোবাসেন, তাদেরই বা ভূমিকা কি ছিল? আজ যেসব লিবারাল নামক ‘বিপ্লবী’ রা বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে মমতাকে সমর্থনের কথা বলছেন, এঁরাই তো বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মমতার অন্যতম সহায়ক ছিলেন। এরাই তো সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্বে মমতার সব থেকে প্রিয়পাত্র ছিলেন। তখন কি এরা চোখ বুজে ছিলেন মমতার সঙ্গে আরএসএস- বিজেপির নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ঘিরে? বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং যখন মমতার তথাকথিত অনশন মঞ্চে এসেছিলেন কলকাতার ধর্মতলায়, তখন এই লিবারেলদের উপস্থিতির ছবি তো গুগুল ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। লিবারেল দের তখন এক এবং একমাত্র কর্মসূচি ছিল, যে কোন উপায়ে বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো। সেই লিবারালেরাই গত ১০ বছরে মমতার বিজেপির পালে হাওয়া দেয়ার জন্যে মুসলমানদের টাকাতেই তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ কিছু ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা দেয়া নিয়ে একটি শব্দ ও কি উচ্চারণ করেছেন? মমতা তার দ্বিতীয় দফার শাসনকালের একদম শেষপর্বে হিন্দু সমাজের ভেতরেও বিভাজন তৈরিতে ‘পুরোহিত ভাতা’র প্রবর্তন করেছেন। ভিপি সিংয়ের আমলে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করবার ভেতর দিয়ে শ্মশানে যারা পৌরহিত্য করেন বা শ্রাদ্ধে যারা অগ্রদানী পুরোহিত হিসেবে থাকেন, তারা ‘অন্যান্য অনগ্রসর জাতি’র (ওবিসি) মর্যাদা পেয়েছেন। অথচ মমতার পুরোহিত ভাতার সুযোগ এই আর্থ-সামাজিকভাবে কোণঠাসা শ্মশানের ব্রাহ্মণ বা অগ্রদানী ব্রাহ্মণেরা পাননি। এই যে হিন্দু সমাজের ভেতরেও বিভাজন তৈরি করে মমতা কার্যত প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন, এ সম্পর্কে একটি শব্দ ও কিন্তু এই লিবারালরা আজ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।

পশ্চিমবঙ্গে সংবাদমাধ্যম এমনভাবে রাজনৈতিক খবরগুলো পরিবেশন করছে, যেখান থেকে সবার মনে হবে, তৃণমূল আর বিজেপি ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব এখানে নেই। বামপন্থিরা অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ভেতরে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখার ফলে, সংবাদ জগতের কাছে তাদের আন্দোলনগুলো দুচার-লাইনের বেশি খবর হয়েও উঠছে না। বামপন্থিরা সংবাদমাধ্যমের তাদের প্রতি এই অবহেলার পাল্টা হিসেবে সামাজিক গণমাধ্যমের কথা বলছেন। কিন্তু সেই সামাজিক গণমাধ্যমেও বেশিরভাগ বামপন্থি কর্মী সমর্থকদের ভেতরে উপদলীয় পছন্দের বিষয়টিই সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

বিষয়টি এই রকম হচ্ছে যে, কোন একটি সমাবেশ বা আন্দোলনে যদি ক, খ, গ, ঘ উপস্থিত থাকেন, আর আমি যদি ‘ঘ’ এর অনুগত কর্মী বা সমর্থক হই, সেক্ষেত্রে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ কে কার্যত ব্ল্যাক আউট করে, কেবল ‘ঘ’ এর ছবি, ‘ঘ’ সংক্রান্ত খবরাখবরই গুরুত্ব পাচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক বক্তব্য ও গুরুত্ব পাচ্ছে না। দল তো নয়ই। একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ‘ঘ’ দাদাকে ঘিরে ব্যক্তি স্তুতি। এটা কি কেউ কোনদিন আগে কল্পনা করেছিলেন যে, কমিউনিস্ট পার্টির জেলা স্তরের নেতার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সমর্থক পরিচয় দিয়ে কেউ সামাজিক গণমাধ্যমে অভিনন্দন জানাবে? মুজফফর আহমদ, জ্যোতি বসু, সরোজ মুখার্জী, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ কিংবা বিনয় চৌধুরীর বিয়ের তারিখ কি, সেটা তার আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরে কখনও এসেছে? আজ যারা দলের শীর্ষস্থানে আছেন, ডা. সূর্যকান্ত মিশ্র, মহ. সেলিম, রবীন দেবদের বিয়ের তারিখ কি তাদের অতি ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধারাও জানেন?

বামপন্থিদের এককালে যেমন রেজিমেন্টেশন ছিল, আদর্শগত ভিন্নতা নিয়ে ঠিক তেমন বজ্রকঠিন রেজিমেন্টেশনের ভেতর দিয়েই আরএসএস দিনের পর দিন নিজেদের সংহত করেছে। ক্ষমতা দখলের স্বার্থে সেই রেজিমেন্টেশনের চরিত্র তারা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভেতরে সব সময়েই সময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সরবরাহ করে থাকে। সেই রেজিমেন্টেশনের ধারাটির বিকল্প সংস্কৃতি তৈরির কথা বামপন্থিরা, বিশেষ করে সিপিআই (এম), তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসলেও, বাস্তবে, তেমন বিকল্প একটি সামাজিক প্রযুক্তি তারা আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। আজ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্বারোপ করলেও দেশজ সংস্কৃতির সার্বিক ধারাবাহিকতার চর্চার ভেতর তারা তাদের কর্মী সমর্থকদের পুরোপুরি আনতে পারেননি।

আজও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থিদের কাছে কিউবা, ভিয়েতনাম বা সেই দেশের নেতারা যত আপন, তত আপন হয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ বা সেই দেশের শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফির মতো মানুষেরা। অথচ সাম্প্রদায়িকতা রুখতে বাঙালির এই সার্বিক সেতুবন্ধন ছিল সব থেকে জরুরি। আজ যদি মায়াকভস্কির পাশে এখানে কাজী আবদুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’ ঘিরে আলোচনা একদম ভূমিস্তরের মানুষের ভেতরে পৌঁছে দেয়া যেত, বাংলা আজ ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকদের অগাধ মৃগয়া ভূমি হতো না।

এই নিবন্ধ রচনার দিন, ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ । এদের কর্মকাণ্ডকে অন্নদাশঙ্কর রায় অভিহিত করেছিলেন, বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ হিসেবে। সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ মুজফফর আহমদ। সেই ইতিহাসকে স্মরণ ধারাবাহিকতার করার ভেতর দিয়ে তো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার একটা প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারত। কিন্তু সেই চেষ্টা কোথায়? নির্বাচনী সংগ্রামের পরিবেশকে তৈরি করবার জন্যে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এককালের কমিউনিস্টরা তৈরি করতেন, তার ফসলই ছিল ৩৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন বামফ্রন্ট সরকার। সেই উদ্যোগ আজ কোথায়? উদ্যমই বা আজ কোথায়? এখন কি প্রতিভার দাম সেই আগের মতো দেয়া হয়? প্রতিভা তো এখন নেতাদের সঙ্গে কে কতো বেশি ঘনিষ্ঠ তার নিরিখে নির্ধারিত হয়। সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ শিল্পীদের বেশিরভাগই এতদিন শোভাবর্ধন করতেন তৃণমূল কংগ্রেসের। এখন তারা শোভাবর্ধনের জন্য পা বাড়িয়েছেন বিজেপির দিকে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]